ব্লকচেইন: আগামী দিনের বিকল্প ও কার্যকর প্রশাসন

ব্লকচেইনভিত্তিক প্রশাসনে রাষ্ট্রীয় গোপন ফাইল বলে কিছু থাকবে না। প্রয়োজনও নেই।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 18 Nov 2022, 11:37 AM
Updated : 18 Nov 2022, 11:37 AM

এক) ভাষা বনাম ক্রিপ্টোগ্র্যাফি

‘কলম’ বলতে বাংলাভাষীরা ‘লেখার একটি বিশেষ যন্ত্র’ বোঝে। ‘কোদাল’ বলতে তারা বোঝে ‘মাটি খোঁড়ার বিশেষ একটা যন্ত্র’। এই শব্দ দুটি যে আলাদা দুটি ‘যন্ত্র’ বোঝাবে, এই সিদ্ধান্ত বাংলাভাষীরা নিশ্চয়ই একসঙ্গে বসে নেয়নি। কোনোভাবে আগের প্রজন্মের বাংলাভাষীদের নেয়া এই সিদ্ধান্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীর সামনে এসেছে এবং সিদ্ধান্তটা তারা মেনে নিয়েছে, হয়ত না মানার বিশেষ কোনো কারণ ছিল না বলেই।

‘কলম’ শব্দের অর্থ যে ‘একটি লিখনযন্ত্র’ সেটা নিশ্চয়ই প্রত্যেক বাংলাভাষীর ইতোপূর্বে শ্রুত শত শত বাক্যের ভাষিক স্মৃতিতে ধারণ করা আছে। ধরা যাক একটি (কালো) বাক্সে এই তথ্যগুলো রাখা আছে। সেই বাক্সের নাম দেয়া যাক ‘ব্লক’। শব্দটির অর্থ ব্যুৎপত্তিগতভাবে কাঠের গুঁড়ি, কিন্তু একটা ইট বা কাঠ-প্লাস্টিক-ধাতু খণ্ডকেও ‘ব্লক’ বলা যেতে পারে। মুদ্রণে এক সময় ব্লকের খুব ব্যবহার হতো।

কাঠ বা ধাতুর যে ‘ব্লক’ দিয়ে আমরা ছাপচিত্র বানাই, কাপড়ে নকশা করি, তাতে নানারকম নকশা খোদাই করা থাকে, ব্লকে কালি লাগিয়ে কাপড় বা কাগজের ওপর চাপ দিলে সেই নকশা ছাপা হয়ে দৃশ্যমান হয়। একটি ব্লকে কী পরিমাণ নকশা ধরে রাখা যাবে, কত সুক্ষ্ম করা যাবে একেকটি ব্লকের নকশা, তার নিশ্চয়ই একটা সীমা আছে। কোনো ব্লকের ধারণ ক্ষমতা অসীম নয়, আবার খুব একটা কমও নয়।

ধরা যাক, এক বাংলাভাষী বলল, ‘এই কলম দিয়ে লেখা যায় না।’ কিংবা ‘এই কলমে কালি নেই।’ বাক্য দুটি উক্ত হওয়া মাত্র কিছু বিশেষ ধ্বনিক্রম শ্রোতার কানের ভেতর দিয়ে তার মস্তিষ্কের ভাষিক স্মৃতির ব্লকে ঢুকে স্বীকৃতির আবেদন করে। করতেই হবে, সব আওয়াজই শ্রোতার মস্তিষ্কের কাছে স্বীকৃতির আবেদন করে, যদিও সব আওয়াজই (ধরা যাক, গাড়ির ভেঁপু, কুকুরের ঘেউঘেউ) ভাষার ‘শব্দ’ নয়। অবিলম্বে শ্রোতার স্মৃতির ব্লকের ভেতরে যাচাইয়ের কাজটা শুরু হয়ে যায়। ‘কলম’ একটি লেখার যন্ত্র এবং তা দিয়ে সাধারণত লিখতে পারার কথা, তবে যন্ত্র খারাপ হতেই পারে এবং সেক্ষেত্রে কলম দিয়ে লেখা সম্ভব নাও হতে পারে। লেখার জন্য কলম যন্ত্রটাতে কালি ভরতে হয় এবং কালি ভরা না হলে বা কালি শুকিয়ে গেলে কলমে কালি থাকে না... এই সব বিচিত্র তথ্য শ্রোতার স্মৃতির (ধরা যাক) ‘কলম’ শীর্ষক ব্লকে ‘লিপিবদ্ধ’ থাকে। শ্রোতার স্মৃতির ব্লকে আগে থেকে লিপিবদ্ধ এই সব তথ্যের ভিত্তিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাইয়ের পর মস্তিষ্ক এক সময় রায় দেয়, ‘বাক্য দুটি গ্রহণযোগ্য বটে’। এর মানে হচ্ছে, বাক্যদুটি যাচাইকৃত বা ইংরেজিতে বললে ‘ভ্যালিডেটেড’ হয়েছে।

কিছুক্ষণ পর, ধরা যাক, আরেক বাংলাভাষী বলল ‘এই কোদালে কালি নেই’ কিংবা ‘এই কলম দিয়ে মাটি খোঁড়া যায় না!’ এই বাক্যদুটিও স্বীকৃতি পাবার আবেদন করবে, অন্য যেকোনো আওয়াজ বা শব্দের মতো। শ্রোতার মনে, ধরা যাক, ‘কলম’ স্মৃতিব্লক ছাড়া আরও একটি স্মৃতি-ব্লক রয়েছে: ‘কোদাল’ ব্লক। এই দুই ব্লকে লিপিবদ্ধ তথ্যের সঙ্গে যাচাই করতে গিয়ে মস্তিষ্ক দেখল যে কোদাল এমন কোনো যন্ত্র নয় যাতে কালি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, কিংবা কলমও মাটি খোঁড়ার কোনো যন্ত্র হতে পারে না। যাচাইয়ের পর শ্রোতার মস্তিষ্ক রায় দিল, ‘বাক্য দুটি গ্রহণযোগ্য নয়’। এর মানে, বাক্যদুটি স্বীকৃতি পেল না বা ভ্যালিডেটেড হলো না কিংবা অস্বীকৃত বা প্রত্যাখ্যাত হলো, সে আপনি যেভাবেই ব্যাপারটা বর্ণনা করুন না কেন। মস্তিষ্কের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে আপনি হয় মাথা নাড়লেন কিংবা মুখে শ্রোতাকে বললেন, ‘কী সব আবোল-তাবোল বকছেন, পাগল না পেট খারাপ?’

কোদাল ও কলমের মতো অগণিত শব্দের অগণিত স্মৃতি ব্লক রয়েছে বাংলাভাষীদের মস্তিষ্কে। ত্রিশ কোটি বাংলাভাষীর মস্তিষ্কের ভাষিক স্মৃতির ব্লকগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গড়ে তুলেছে একেকটি ‘ব্লকচেইন’ বা ‘ব্লকনেট’। বাংলায় ‘ফলক-শিকল’, ‘ফলক-জাল’, ‘শিকল-পট্ট’, ‘পট্টজাল’ ইত্যাদি প্রতিশব্দ ব্যবহার করা যায়।

প্রতিটি শব্দের, শব্দ ও বাক্য গঠনের (অর্থাৎ ব্যাকরণের), এই সব গঠিত শব্দ ও বাক্য উচ্চারণের, কোন কোন বিশেষ প্রতিবেশে এই সব শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা যায় বা যায় না, শব্দ ও বাক্যগুলোর অভিধা-লক্ষণা-ব্যঞ্জনাসহ বিচিত্র সব তথ্য ধরা আছে এই সব ব্লক, ব্লকচেইন কিংবা পুরো ব্লকনেটে। কোনো বাংলাভাষীই এই ব্লকচেইনের পুরোটা ধারণ করে না, কিন্তু সব বাংলাভাষীর মস্তিষ্ক মিলেই যে এই ব্লকচেইনটি ধারণ করা আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এক-একজন বাংলাভাষীর মস্তিষ্ক এই চেন বা জালের কিছুটা ধারণ করে, পুরোটা নয়। এর প্রথম প্রমাণ, কোনো বাক্যে যেখানে ‘কলম’ ব্যবহার হওয়ার কথা, সেখানে ‘কোদাল’ ব্যবহার করলে যেকোনো বাংলাভাষী প্রতিবাদ করতে পারে। সবাই খেয়াল যদি নাও করে, আলস্যবশত প্রতিবাদ নাও করে, কেউ না কেউ, একাধিক বাংলাভাষী প্রতিবাদ করবে– এমনটা ধরে নেওয়াই যায়। এর দ্বিতীয় প্রমাণ, এমন অনেক শব্দ আছে, যেগুলো আমি জানি না, কিন্তু আপনি জানেন। আবার এমন অনেক শব্দও রয়েছে, যেগুলো আপনি আর আমি দুজনের কেউই জানি না, কিন্তু আমাদের দুজনের চেয়ে বেশি খবর রাখে, এমন কেউ হয়ত জানে।

ব্যাপারটা এমন যে কারও পক্ষেই ‘কলম’ শব্দের ভিন্নতর ব্যবহার সম্ভব নয়। পৃথিবীর কারও পক্ষে, কোনো বাঙালি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চাইলেও ‘কলম’ শব্দের অর্থ বদলে দিতে পারবে না। যদি কোনো মারাত্মক সংক্রামক রোগে পৃথিবীর সব বাংলাভাষীর মৃত্যুও হয়, সেক্ষেত্রেও ‘কলম’ শব্দের অর্থ বদলে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ লিখিত ভাষাতেও এই শব্দের ব্যবহারের প্রকৃতি লিপিবদ্ধ আছে। কলম নিয়ে যা কিছু লেখা হয়েছে, তার সব যদি চিরতরে মুছে যায় এবং সব বাংলাভাষীর মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে হয়ত ‘কলম’ ব্লক বা ফলকটি মানব অস্তিত্ব থেকে মুছে যাবে। পত্রপত্রিকা-মিডিয়ায় মাঝে মাঝে একটি ভাষার একজন মাত্র ব্যবহারকারীর খবর পাই আমরা। সেই লোকের মৃত্যু হলে এবং ভাষাটির লিপি এবং সাহিত্য না থাকলে ওই বিশেষ ভাষার সব ব্লক চিরতরে হারিয়ে গিয়ে ভাষাটি মরে যায়।

আমরা মুখে যখন বলি, ‘কলম’ বা ‘কোদাল’, সেগুলো অর্থহীন কিছু ধ্বনির বিশেষ একেকটি ক্রম: ক-ল-ম, কিংবা ক-ও-দ-আ-ল। আমাদের মস্তিষ্ক হয়ত এই একেকটি ধ্বনিকে বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ কিংবা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় আবেশে রূপান্তরিত করে। আবার এমনও হতে পারে, একেকটি বিদ্যুৎপ্রবাহ এবং রাসায়নিক পদার্থের মিলিত রূপ প্রতিফলিত করে একেকটি ধ্বনিকে। কাজটা যেভাবেই হোক, প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি শব্দ মস্তিষ্কে যেভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে সেটি অত্যন্ত জটিল, হয়ত আঙ্গুলের ছাপের চেয়ে বহুগুণ জটিল। জটিল, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর, কারণ মস্তিষ্ক প্রতিটি ধ্বনি ও শব্দকে আলাদা করতে সক্ষম, অন্যথায় মানুষে মানুষে ভাষিক যোগাযোগ সম্ভবই হতো না।

ধ্বনি ও শব্দের বিপরীতে এই যে সম্ভাব্য একেকটি বৈদ্যুতিন বা রাসায়নিক বিক্রিয়া, তাকে আমরা চাইলে, একান্ত টেলেওলজিক্যাল কারণে অর্থাৎ আলোচনার সুবিধার জন্যে সংখ্যা, বর্ণ এবং চিহ্ন যেমন ‘হ্যাশ’, ‘স্ল্যাশ’ বা ‘স্টার’ দিয়ে লিখে দেখাতে পারি। ধরা যাক, একটি বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে ‘ক’, একটি বিশেষ ইলেক্ট্রন প্রবাহের স্মারক-সংখ্যা ২। ধরা যাক, কোনো স্মৃতিব্লকে ‘কলম’ শব্দটি #ক-২# হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকে। ‘কোদাল’ শব্দটি লিপিবদ্ধ হয়, ধরা যাক, #খ-১# হিসেবে। লিপিবদ্ধ করার এই পদ্ধতিকে বলা যেতে পারে ‘হ্যাশিং’। দুই বাংলাভাষীর স্মৃতিব্লকে প্রতিটি শব্দের হ্যাশিং-এর মধ্যে মিল আছে, কিন্তু দুই হ্যাশিং এক নয়, কারণ প্রতিটি বাংলাভাষী অনন্য। একটি মানুষের সঙ্গে টায়ে টায়ে মিলে এমন আরেকটি মানুষ নেই, থাকে না।

হ্যাশিং-এর ফলে ‘কলম’ কিংবা ‘কোদাল’-এর জন্য সৃষ্টি হয় অনন্য একেকটি মহা জটিল ‘ক্রিপ্টোগ্র্যাফি’। প্রতিটি হ্যাশ, ধরা যাক একেকটি শব্দ, আর ক্রিপ্টোগ্র্যাফি হচ্ছে একেকটি বাক্য কিংবা পুরো একটি বাক্যগুচ্ছ বা অনুচ্ছেদ। প্রতিটি ক্রিপ্টোগ্র্যাফিও অনন্য, একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। বক্তা যখন ‘কলম’ শব্দটি ব্যবহার করে, তার মস্তিষ্কে মূলত বিশেষ ফলক বা গুপ্তপট্টে কলমের ক্রিপ্টোগ্রাফিই সচল হয়ে ওঠে। শ্রোতার মস্তিষ্ক যখন ‘কলম’ শব্দের উপযুক্ততা যাচাই করে, তার মস্তিষ্কেও অনুরূপ ক্রিপ্টোগ্রাফি সচল হয়। আবারও বলছি, ‘অনুরূপ’ কিন্তু পুরোপুরি এক নয়, কারণ প্রতিটি বাংলাভাষীর মস্তিষ্ক আলাদা। দুই জন বাংলাভাষীর স্মৃতিব্লকে প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ-অভিধা-ব্যঞ্জনা-লক্ষণা-ব্যবহারের মধ্যে মিল আছে, কিন্তু কখনই সেগুলো এক নয়। যাইহোক, হাজার হাজার বাংলাভাষীর স্মৃতিব্লকে ক্রমাগত যাচাই হয়ে ‘কলম’ শব্দ বাংলা ভাষায় চালু রয়েছে।

প্রতিটি শব্দকে হ্যাশিং করে ক্রিপ্টোগ্র্যাফিতে লিপিবদ্ধ করা এবং ক্ষণে ক্ষণে, কথা শোনামাত্র এই ক্রিপ্টোযাচাই করার কাজটার নাম ‘মাইনিং’। কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন ও জটিল এবং এতে প্রচুর শক্তিক্ষয়ও হয় বটে। অনেক সময় দেখবেন, অনেকক্ষণ কথা বললে বা শুনলে আপনি ক্লান্তবোধ করতে থাকেন।

মাইনিং-এর কাজটা সম্মিলিতভাবে করছে লক্ষ লক্ষ বাঙালি শরীরের লক্ষ লক্ষ মস্তিষ্ক নামক যন্ত্র। মস্তিষ্কগুলো এই কাজ কি বিনা পারিশ্রমিকে করছে? ফেলো কড়ি মাখো তেল। সাত মন তেল পুড়লেই শুধু রাধা নাচে। মাইনিং করার জন্যে মস্তিষ্ককে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, ধরা যাক ‘ডোপামাইন’ নামক রস দিয়ে। এছাড়া নিউরনগুলোতে নিরবিচ্ছিন্ন রক্তসরবরাহের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে খাদ্যও জোগানো হচ্ছে।

দুই) ব্লকচেইনের ফনিমনসা, ফলক-শিকল কিংবা পট্টজাল

হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে লেনদেনের একটিমাত্র উপায়ই ছিল– এক হাতে মাল নেবেন, অন্য হাতে দাম দেবেন। এর নাম ‘নগদ লেনদেন’। এতে তৃতীয় কোনো পক্ষের প্রয়োজন নেই। একটাই সমস্যা এই লেনদেনে, ক্রেতা ও বিক্রেতা কিংবা দাতা ও গ্রহীতা উভয়কে সরেজমিনে উপস্থিত থাকতে হয়।

পুনর্জাগরণের যুগে ইউরোপে গড়ে উঠেছিল ব্যাংক ব্যবস্থা। ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রেখে ব্যাংকড্রাফট নেয়া যেত এবং ক্রেতা বা দাতা ডাকযোগে সেই ড্রাফট পাঠাতে পারত বিক্রেতা বা গ্রহীতার কাছে। এর পর শ দুয়েক বছর আগে চালু হয়েছিল ডাকঘর থেকে মানি অর্ডারে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা। গত শতকের শেষ দুই দশকে চালু হয়েছিল ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ই-ট্রান্সফার ইত্যাদি। ইদানিং নগদ বা বিকাশ। এই সব ধরনের লেনদেনে একটি মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে: ব্যাংক বা ডাকঘর, বিকাশ ইত্যাদি, লেনদেনের জন্যে যাদেরকে আবার নির্দিষ্ট ফিও দিতে হয়। নগদ বা বিকাশেও আমরা টাকা পাঠাতে পারি। কিন্তু তাতেও মধ্যবর্তী বিকাশ বা নগদ কোম্পানির সহায়তা আমাদের নিতে হয় এবং ব্যাংকের মতো তাদেরও ফি দিতে হয়।

অর্থ লেনদেনের এই দুই ব্যবস্থারই সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে, বিশেষ করে মধ্যস্থ-নির্ভর লেনদেনে জালিয়াতি, সঠিক লোকের কাছে টাকা না যাওয়া ইত্যাদি তো আছেই। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা ব্যাংক সেই সময় ভাঙায় যখন মুদ্রাপরিবর্তনের হার সবচেয়ে কম অর্থাৎ ব্যাংককে কম টাকা দিতে হবে বিদেশ থেকে আসা টাকার প্রাপককে। ব্যাংক টাকাটা নিজের তহবিলে রেখে দেয় বেশ কিছু দিন বিভিন্ন অজুহাতে, অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে তো এ ব্যাপারটা ঘটেই থাকে। এতে করে টাকাটা ব্যাংকে খাটে এবং সুদটা ব্যাংকের খাতেই জমা হয়। আপনার টাকা আপনার একাউন্টে জমা করার আগে হাজার রকম কাগজপত্র চায় ব্যাংক এবং তাতেও দিন-সপ্তাহ-মাস চলে যেতে পারে। তারপর, আমার ক্ষেত্রে একবার যেমন ঘটেছে, বাংলাদেশের ঢাকার ব্যাংকে পাঠানো টাকা চলে গেছে সেনেগালের ডাকারের ব্যাংকে এবং আরেকবার ঘটেছে এর উল্টোটা। সরকার আপনার ব্যাংকের একাউন্টে আসা টাকা বাজেয়াপ্তও করতে পারে, বিশেষ করে সরকার যদি আপনার কাছে টাকা পায় এবং সে টাকা দিতে আপনি গড়িমসি করে থাকেন।

এই দুই ব্যবস্থার অসুবিধাগুলো বাদ দিয়ে শুধু সুবিধাগুলো নিয়ে এমন কোনো প্রযুক্তি কি উদ্ভাবন করা যায়, যাতে ক্রেতা ও বিক্রেতা কিংবা দাতা ও গ্রহীতা সশরীরে উপস্থিত না থেকেও লেনদেন সম্পন্ন হওয়া সম্ভব? এমন একটি ব্যবস্থা আমাদের চোখের সামনেই আছে বটে। কারও কাছে চিঠি বা পার্সেল পাঠাতে আমাদেরকে কুরিয়ার সার্ভিস বা ডাকব্যবস্থার সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু ইমেইল বা ছবি পাঠাতে কারও কাছে আমাদের যেতে হয় না। কিন্তু প্রথমত, ইমেইলেরও একটা ঠিকানা আছে, গুগোল, ইয়াহু, রকেটমেইল বা অনুরূপ কোনো সংস্থা, যারা চাইলে আপানার একাউন্ট ব্লক করে দিতে পারে। এর মানে হচ্ছে, ইমেইল পাঠাতেও আপনাকে সেই মধ্যবর্তী সংস্থার কাছেই যেতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত ইমেইল একাউন্ট হ্যাক হতে পারে, হয়ে থাকে। তৃতীয়ত, একই ইমেইল বা ছবি বার বার কাউকে বা অনেককে পাঠানো যায় কপি-পেস্ট করে এবং পাঠানো ছবি বা ইমেইলের অনুলিপি প্রেরক কম্পিউটারে থেকে যায়। ছবির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক আছে, কিন্তু কাউকে ৫,০০০ টাকা পাঠানোর পরও সেই একই ৫০০০ টাকা যদি আপনার তহবিলে থেকে যায়, তবে টাকাটা পাঠানো হয়েছে বলা যায় না।

কেউ কারও কাছে টাকা পাঠালে প্রথমত, প্রেরক ও গ্রাহক উভয়কেই প্রথমে জানতে হবে যে লেনদেন ঠিকঠাকমতো সম্পন্ন হয়েছে। প্রেরকের তহবিল থেকে ওই পরিমাণ টাকা হ্রাস পেতে হবে এবং গ্রাহকের তহবিলে একই পরিমাণ টাকা বৃদ্ধি পেতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রেরিত টাকা কেউ জালিয়াতি করে যেন না নিয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে নিশ্চিত (এবং নিশ্চিন্ত) হতে হবে। এই কাজটা মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান ব্যাংক বা পোস্টঅফিস করতে পারে, তাদের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা সত্তেও, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, লেনদেন থেকে এই সব প্রতিষ্ঠানকে চিরতরে বাদ দেওয়া।

ধরা যাক, রাম তার বন্ধু রহিমকে কোনো কারণে ১০০ টাকা দিল। এই অর্থপ্রদানের একটা হিসাব তো রাখতে হবে, কারণ ‘হিসাবের গরুকে নাকি বাঘে খায় না’। রামের একাউন্ট্যান্ট নিজেদের লেজারবুক বা খতিয়ানে রহিম খাতের ডেবিটের দিকে ১০০ টাকা এবং নগদ বা ক্যাশ হিসাবের ক্রেডিটের দিকে ১০০ টাকা লিখে রাখল। এভাবে লেখার পেছনের কারণটা একটু বলি, যারা জানেন না, তাদের জন্যে অবশ্যই।

পঞ্চদশ শতকের গণিতবিদ, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অন্তরঙ্গ বন্ধু লুকা প্যাসিওলি (মতান্তরে প্যাসিওলো) (১৪৪৭-১৫১৭) সাহেবের আবিষ্কৃত ‘সোনালী নিয়ম’ নামে হিসাবরক্ষণের একটি নিয়ম হিসাবশাস্ত্রে অনুসরণ করা হয়ে আসছে গত শ পাঁচেক বছর ধরে। এই নিয়ম অনুসারে হিসাব তিন প্রকার: ব্যক্তিবাচক, সম্পত্তিবাচক এবং আয়ব্যয়বাচক। ‘রহিম’ ব্যক্তিবাচক হিসাব। এ ধরনের হিসাবে কেউ যদি কিছু গ্রহণ করে, তবে সে ডেবিট হবে এবং যদি কেউ কিছু প্রদান করে, তবে সে ক্রেডিট হবে। রহিম গ্রহণ করছে বলে সে ‘ডেবিট’। নগদ বা অর্থ হচ্ছে সম্পত্তিবাচক হিসাব। এই ধরনের হিসাবে যা কিছু আসে, তা ডেবিট আর যা কিছু যায় তা ক্রেডিট। টাকাটা চলে যাচ্ছে বলে সেটা ক্রেডিট।

রহিমও ব্যবসায়ী এবং তারও একটা হিসাবের খাতা আছে বৈকি। সেই খাতা বা খতিয়ানে ‘রাম’ একটা হিসাব এবং ক্যাশ একটা হিসাব। রাম যেহেতু টাকাটা দিয়েছে, সেহেতু ‘রাম’ হিসাবের ডানদিকে অর্থাৎ ক্রেডিটের দিকে ১০০ টাকা লেখা হবে। আবার টাকাটা যেহেতু এসেছে, সেহেতু নগদ (নগদানও বলা হয়) হিসাবে ১০০ টাকা ক্রেডিট হবে। যেকোনো লেনদেনের অর্থ দুই বার এবং দুই দিকে লিপিবদ্ধ করতেই হবে, একবার কোনো হিসাবের ডেবিটের দিকে এবং আরেক বার একই পরিমাণ অর্থ অন্য একটি হিসাবের ক্রেডিটের দিকে। হিসাবরক্ষণের এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ডাবল এন্ট্রি সিস্টেম’।

একই লেনদেন রাম এবং রহিমের হিসাবে এমনভাবে লিপিবদ্ধ হতে হবে যেন দুই লিখন পরস্পরের প্রতিফলন হয়– রামের কোম্পানির নগদ হিসাবে যে ১০০ টাকা ক্রেডিট লেখা হয়েছিল, রহিমের কোম্পানির নগদ হিসাবে সেটা লেখা হয়েছে ডেবিট। রামের খতিয়ান বইয়ে ‘রহিম’ হিসাবে যে ১০০ টাকা ডেবিট হয়েছিল, রহিমের খতিয়ান বইতে সেই একই ১০০ টাকা ‘রাম’ হিসাবে ক্রেডিট হয়েছে।

হিসাব লেখার ব্যাপারটা কমবেশি বোঝা গেল। কিন্তু ধরা যাক, রাম এবং রহিম টাকাটা পাঠানোর জন্যে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী দালাল প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে চায় না। ‘আমার টাকা আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব!’ ‘আমার হিসাব আমার চয়েস!’ রাম কীভাবে রহিমকে টাকাটা পাঠাবে, আর কীভাবেই বা নিজেদের লেনদেনের এই হিসাব একে অপরকে দেখিয়ে বা তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে দেখিয়ে ‘নিশ্চিতকরণ’ বা ভ্যালিডেট করে রাখবে? টাকা পাঠানো, হিসাব রাখা... এই সব কাজ একবারে, একসাথে করে সময় ও পরিশ্রম বাঁচানোর একটা উপায় বের করা গেলে কি ভালো হতো না?

রালফ ম্যার্কেল (জন্ম ১৯৫২) নামে এক মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্যে একাধিক স্তরবিশিষ্ট এবং প্রতিস্তরে দ্বিশাখা বিশিষ্ট একটি বৃক্ষচিত্র-নকশার কল্পনা করেছিলেন তার ছাত্রাবস্থায়। ১৯৭৯ সালে এই বৃক্ষচিত্র বা তথ্য লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতির প্যাটেন্ট নিয়েছিলেন তিনি। ম্যার্কেলের নাম অনুসারে একে ‘ম্যার্কেল বৃক্ষচিত্র’ বলা হয়, যার অন্য নাম ‘হ্যাশ-ট্রি’ বা ‘হ্যাশ বৃক্ষচিত্র’। ধরা যাক, এই (ফণিমনসা জাতের, ‘ফণিমনসা’ বৃক্ষ নয় জানি, তবু বর্ণনার স্বার্থে মেনে নিন!) বৃক্ষে প্রথম পাতাটি মাটি ফুঁড়ে বের হলো। পাতাটির নাম দেওয়া হলো ০-১। বৃক্ষটি থেকে নতুন দুটি পাতা বের হলো, যাদের নাম দেওয়া হলো যথাক্রমে ০-০-০-১ এবং ১-০-১-১। এই দুই পাতার প্রথমটি থেকে দুটি পাতা বের হলো, ০-০ এবং ০-১ এবং দ্বিতীয়টি থেকেও দুটি পাতা বের হলো, ১-০ এবং ১-১।

প্রথম স্তরের পাতাটি যদি বাবা বা মা হয় তবে দ্বিতীয় স্তরের দুই পাতা তাদের ছেলে বা মেয়ে। তৃতীয় স্তরের চার পাতা প্রথম স্তরের নাতি-নাতনি এবং দ্বিতীয় স্তরের পুত্র-কন্যা। দ্বিতীয় স্তরের (ধরা যাক) পাতা ১-০ আসলেই তার বাপ বা মায়ের সন্তান কিনা তা যাচাই করার একটা উপায় হচ্ছে, নম্বরগুলো মিলিয়ে দেখা। ০-০ অবশ্যই ০-০-০-১ এর ছেলে, কারণ তাদের মধ্যে ক্রম বা সিকোয়েন্সে মিল আছে। আবার ১-১ এর বাবা যে ১-০-১-১ সেটাও তাদের নম্বর মিলিয়ে বের করা যায়। দ্বিতীয় স্তরের পাতাগুলো যে প্রথম পাতা ০-১ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, সেটা যাচাই করাও কঠিন নয়। আমি অতিসরলীকরণ করে বলছি বটে, কিন্তু ব্যাপারটা এর চেয়ে অনেক জটিল, নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থেই নিশ্চয়ই একে জটিল করা হয়েছে।

প্রতিটি পাতা ধরা যাক, একেকটি ‘ব্লক’। এই ব্লকের বাংলা প্রতিশব্দ আছে কমপক্ষে দুট, ‘ফলক’ এবং ‘পট্ট’। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজারা তাম্রপট্টে দানসংক্রান্ত তথ্যাদি লিখে ভূমিদান করতেন। একাধিক ব্লক মিলে যে ‘ব্লকচেইন’ হয় তার বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে: ‘ফলক-শিকল’ বা ‘পট্টজাল’। প্রতিটি ব্লক, ফলক বা পট্টগুলো হচ্ছে সেই ব্লকচেইন, ফলক-শিকল বা পট্টজালের একেকটি আঙটা। ইংরেজি শব্দ ‘ব্লকচেইন’ বলতেও বাধা নেই, কিন্তু এর বাংলা নামও দেওয়া হলো, যাতে ভাষার যদি মর্জি হয়, বাংলা নামগুলোও যাতে চালু হতে পারে। সন্তানের মতো শব্দেরও জন্মের অব্যবহিত পরে নামকরণ করা বিধেয়।

১০০ টাকা লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রামের খতিয়ান এন্ট্রি লেখার পর সেটা একটা সাংকেতিক ভাষা বা ক্রিপ্টোগ্র্যাফিতে অনুবাদ করা হলো। অনুবাদটা দিয়ে সৃষ্টি হলো একটা ‘মূলপাতা’ বা মূল ব্লক। ব্লকটা পাঠানো হলো রহিমকে এবং রহিম পড়েটড়ে দেখল, সব ঠিকই আছে। রহিম ব্লকটা ভ্যালিডেট বা নিশ্চিত করল। আগ্রহী আরও দুই-একজন কিংবা অনেকে ব্লকটা দেখতে পারে। তৃতীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা জানবে যে দুই জন ব্যক্তির মধ্যে একটা ১০০ টাকার লেনদেন হয়েছে, কিন্তু তারা কখনই জানবে না, লেনদেনটা কোন দুই জন ব্যক্তির মধ্যে হয়েছে, কিংবা ‘রাম’ বা ‘রহিম’ কে বা কারা। রহিম এবং রাম শুধু জানবে যে ওই দুই ব্যক্তি আসলে তারা দুই জন। তবে তৃতীয় ব্যক্তি যদি ‘অধিকারী’ হয় অর্থাৎ যদি তাকে সব যাচাই করার অধিকার দেয়া হয় সর্বসম্মতিক্রমে, তবে তিনিও ব্লকে প্রবেশাধিকার পেতে পারেন বৈকি।

এক সময় রাজাবাদশরা তাদের চিঠিতে সিলমোহর বা মোহর মেরে দিতেন। রাজবাদশাদের পানির পিপাতেও অনেক সময় মোহর লাগানো থাকত, যাতে কেউ পানিতে বিষপ্রয়োগ করতে না পারে! মাত্র এক দশক আগেও দাপ্তরিক চিঠিতে সিলগালা করে দেওয়া হতো। একইভাবে সার্বজনীন নিশ্চিতকরণ শেষ হবার পর ব্লকে ডিজিটাল সিলমোহর মেরে দেওয়া হবে। এই সিলমোহরের নাম ‘টাইমস্ট্যাম্প’। সাংকেতিক সিলমোহরও নতুন কিছু নয়, পঞ্চদশ শতকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯), ষোড়শ শতকে (১৫৬৪-১৬৪২) গ্যালিলিও, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭) সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের বক্তব্য লিখে সিলমোহর দিয়ে দিয়েছেন।

কোনো ব্লকে সাংকেতিক সিলমোহর দেবার পর সেই ব্লকে আর পরিবর্তন করা যায় না। এছাড়া প্রতিটি ব্লক যেহেতু তার পিতা/মাতা ব্লক, পিতামহ/পিতামহী ব্লকের দ্বারাও নিশ্চিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে, সে কারণেও কোনো পুরনো ব্লকে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। নতুন ব্লকেও পিতা বা পিতমহ ব্লকের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু লেখা অসম্ভব। এর ফলে ব্লকচেইন হ্যাক বা জালিয়াতি করা যায় না।

লেনদেনের ক্রিপ্টোগ্র্যাফি তৈরি, টাইমস্ট্যাম্প দেওয়া ইত্যদি কাজ হয়ে থাকে ব্লকচেইন প্রোগ্রামে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্লকচেইন প্রযুক্তির উদগাতার নাম সাতোশি নাকামোতো। তিনি এর স্রষ্টা নন, বলা বাহুল্য। নাকামোতো ১৯০৮ সালে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা একটি প্রবন্ধ লিখে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। নামে জাপানি বলে মনে হলেও সাতোশি নাকামোতোর প্রকৃত পরিচয় অধ্যাবধি উদঘাটিত হয়নি।

‘ইউ-টরেন্ট’ নামে একটি প্রোগ্রাম আছে যা দিয়ে পৃথিবীর একাধিক কম্পিউটার থেকে আপনি একটি বই বা চলচ্চিত্রের ফাইল নামাতে পারেন বা ডাউনলোড করতে পারেন। ব্লকচেইন প্রোগ্রামটা এই ইউ-টরেন্টের সঙ্গে তুলনীয়। এই প্রোগ্রাম চলে পৃথিবীর হাজার হাজার কম্পিউটারে যাদের মালিকেরা এই প্রোগ্রাম চালাতে চায়। ইউ-টরেন্টে অবশ্য আপনাকে কিছুই করতে হয় না। কিন্তু ব্লকচেইন প্রোগ্রাম যারা চালায়, তাদের দায়িত্ব একাধিক– লেনদেনের যাবতীয় অপরিহার্য তথ্য, কোনো চুক্তি হয়ে থাকলে সেই চুক্তিপত্র, প্রেরক ও গ্রাহকের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট লেনদেন নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি ক্রিপ্টোগ্র্যাফিতে লিপিবদ্ধ করা। ক্রিপ্টো মানে ‘গুঢ়’, ‘গুপ্ত’ বা ‘গোপন’ আর ‘গ্র্যাফি’ মানে ‘লিপি’। ‘ক্রিপ্টোগ্র্যাফি’ অর্থ ‘গুপ্তলিপি’। গুপ্তলিপিতে সব কিছু লেখার নাম ‘মাইনিং’ বা ‘খনন’।

মাইনিং-এর কাজে মুন্সিয়ানা লাগে, খরচও লাগে। প্রধান খরচ অবশ্য বিদ্যুৎ খরচ। সঠিকভাবে যুক্তপট্ট, শিকল-ফলক বা ব্লকচেইনে ক্রিপ্টোগ্র্যাফিতে লেনদেনের বিবরণ ও নিশ্চিতকরণ লিপিবদ্ধ করে সঠিকভাবে সিলমোহর দেবার কাজটা কে কত দ্রুত করতে পারবে তা নিয়ে একাধিক ‘মাইনার’ বা ‘খনক’-এর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। যদি আপনার আগে কাজটা কেউ করে ফেলতে পারে, তবে আপনার পুরো পরিশ্রম, সময় এবং বিদ্যুৎ খরচ সব জলে যাবে।

মাইনিং একটি ‘কাবিখা’ বা ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ প্রোগ্রাম। কোনো মাইনার যদি তার কাজের প্রমাণ (‘প্রুফ অব ওয়র্ক’ বা ‘পি ও ডব্লিউ’) প্রদর্শন করতে পারে, তবে তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। লেনদেনের খরচ ব্যাংকের তুলনায় সামান্য, কিন্তু কিছু খরচ তো আছেই। সেই খরচটাও মাইনাররাই পাবে। মাইনারদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় ক্রিপ্টো কারেন্সি বা গুপ্তমুদ্রায়। অনেক রকম গুপ্তমুদ্রা রয়েছে: ‘বিটকয়েন’, ‘ইথেরিয়াম’, ‘কার্দানো’ ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে পৃথিবীর প্রথম গুপ্তমুদ্রা ‘বিটকয়েন’-এর প্রতিষ্ঠাতা অজ্ঞাতনামা সাতোশি নাকামোতো।

ব্লকচেইন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে রাম এবং রহিম দুজনের প্রত্যেকের আলাদা ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ ডিজিটাল ঠিকানা লাগবে। যারা রাম-রহিমের লেনদেন যাচাই করতে চান, তাদেরও নিজ নিজ ঠিকানা থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ব্লকচেইন পদ্ধতিতে যেই যুক্ত হবেন, তার একটি ডিজিটাল ঠিকানা থাকতেই হবে। এই ঠিকানা যদি হারায়, অন্য কারও হাতে পড়ে, তবে যার ঠিকানা হারাবে, তার বিপদ হতে পারে, নিজের মানিব্যাগ বা অতি ব্যক্তিগত কাগজপত্র হারানোর মতো।

তিন) ব্লকচেইন বা যুক্তপট্ট প্রশাসন

অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, যেকোনো লেনদেনে তৃতীয় পক্ষের অস্তিত্ব থাকলে কোনো না কোনো সমস্যা হবার কথা। শিক্ষা দিয়েই শুরু করা যাক। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যখন শিল্পকলা শিখতে শুরু করেছিলেন, তারা গুরুর কাছে গিয়েছেন, গুরুর কর্মশালায় শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করতে করতে কাজ শেখা শুরু করেছেন। পাঁচ-সাত বছরে কাজ শেখা হয়ে যাবার পর নিজেরা কর্মশালা দিয়েছেন। সেখানে নিজে কাজ করেছেন এবং অন্য শিক্ষানবীশদের কাজ শেখাতে শুরু করেছেন।

ভারতবর্ষের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিক্ষাও গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চলত। সনদের কোনো বালাই ছিল না, গুরু-শিষ্যের মাঝে মধ্যবর্তী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু শিক্ষার যা উদ্দেশ্য, দক্ষতা অর্জন, সেটা ঠিকই পূরণ হতো। প্রাচীন গ্রীসেও, প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের সময়ের শিক্ষাও অনেকটা গুরুমুখী ছিল।

আমাদের যুগে শিক্ষার্থীরা চারুকলা স্কুল/কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে, সঙ্গীত বিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগে ভর্তি হয়, চার বছরে স্নাতক হয় এবং কাজ যে তারা পুনর্জাগরণের যুগের শিল্পীদের চেয়ে ভালো শেখে– এ দাবি করা মুশকিল। একই কথা বলা যায় সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও। গুরু-শিষ্য পরম্পরার যুগে যে সব বড় বড় সঙ্গীতকার আমরা পেয়েছি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত শিক্ষা তেমন সঙ্গীতকার সৃষ্টি করতে অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে বললে ভুল বলা হবে না। মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই এই সমস্যার মূল কারণ হওয়া অসম্ভব নয়।

শিক্ষা যদি যুক্তপট্ট বা ব্লকচেইনে চলে যায়, ধরা যাক, একটা বিষয়ে কী কী জানতে হবে, সেটা লেখা থাকবে ব্লকে। আপনি কীভাবে সেই বিষয়গুলো শিখবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কোনো ভালো শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, অনলাইনে ক্লাস করতে পারেন, শুধু বই পড়েও আপনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারেন। সিলেবাস থাকবে ব্লকে। বিশেষ বিষয়ে যা যা অপরিহার্যভাবে জানতে হয়, তা জানার প্রমাণ দিলেই আপনি পাশ করবেন। পরীক্ষায় পাশ করা নিয়ে কথা, কোথায় পড়লেন– লিভারপুলে, নাকি হাতিরপুলে, কীভাবে পড়লেন– স্কুলে ভর্তি হয়ে নাকি নিজে নিজে... এগুলো আর যোগ্যতার নিয়ামক হবে না। পরীক্ষায় আপনি পাশ করেছেন কিনা, সেটাও লেখা থাকবে ব্লকচেইনে। আপনার ডিজিটাল ঠিকানা চেক করলে যে কেউ জানতে পারবে, আপনি কী জানেন আর কী জানেন না। শিক্ষা ব্লকচেইনে গেলে বিদ্যালয়ের অপরিহার্যতা কমে যাবে, কিন্তু শিক্ষকের বিশেষ করে চৌকশ শিক্ষকের অপরিহার্যতা বাড়বে। এখনকার শিক্ষাজগৎ খারাপ শিক্ষকে পরিপূর্ণ, কিন্তু তখন খারাপ মুদ্রার মতো খারাপ শিক্ষকও বাজার থেকে উধাও হয়ে যেতে বাধ্য হবে।

বিসিএসের কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতে পারে ব্লকচেইন। যাবতীয় পদোন্নতি (পদাবনতি এবং পদচ্যুতিই বা কেন নয়?) ব্লকচেইনভিত্তিক হতে পারে। জাপানে পদোন্নতির আবেদন করতে হয় না, অফিসে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে অফিসই সিদ্ধান্ত নেয়, কখন কার পদোন্নতি হওয়া উচিত। আমলা নির্বাচনী পরীক্ষায় ব্যবহৃত হতে পারে ব্লকচেইন। মুখোমুখি সাক্ষাতকার ছাড়া বাকি সব কিছু হতে পারে অনলাইনে এবং সব তথ্য ব্লকে লিপিবদ্ধ থাকতে পারে।

আপনি পাসপোর্ট করবেন। এর ফর্ম পূরণ, ছবি তোলানো, পুলিশ ভেরিফিকেশন ইত্যাদি কাজ করার জন্যে রয়েছে পুরো একটি পাসপোর্ট এবং ইমিগ্রেশন বিভাগ এবং এর হাজার হাজার কর্মচারী। এছাড়া আছে পাসপোর্ট অফিসের চারপাশে ঘুর ঘুর করা শত শত দালাল, শত চেষ্টা করেও যাদের খপ্পর থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছি না। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে ঢুঁঢুঁ। বাংলাদেশের নাগরিক নয়, এমন লোকজন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ চলে গেছে, এমন ঘটনা বিরল নয়, যখন কিনা বৈধ নাগরিকেরা নিজেদের নাগরিক হিসেবে ভেরিফাইড হবার জন্য ঘুস দিতে দিতে জেরবার। ব্লকচেইনে পাসপোর্ট করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে, কারণ প্রয়োজনীয় সব তথ্য আপনার ডিজিটাল ঠিকানা থেকেই জানা যাবে।

এ বছর কে, কত আয় করেছেন, লেখা থাকবে ব্লকচেইনে। সুতরাং আয়করের ফর্ম ফিলআপ করার কোনো ব্যাপার থাকবে না। আপনার ডিজিটাল ঠিকানাই বলে দেবে নির্দিষ্ট বছর আপনার কত আয়কর হওয়া উচিত। ট্রেড লাইসেন্স চান, জন্মসনদ চান, কোনো ফরম ফিলআপের প্রয়োজন আর হবে না। ফি দেবেন আর হাতে এসে যাবে লাইসেন্স। যতবার গান বাজবে শিল্পী স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার সম্মানী পেয়ে যাবেন। প্রতিটি বই বিক্রি হবার সঙ্গে সঙ্গে লেখক জানবে, কত লেখক সম্মানী জমা হলো তার গুপ্তমুদ্রা-থলিকা বা ক্রিপ্টোওয়ালেটে। ইতোমধ্যে ব্লকচেইনে ডিজিটাল শিল্পের ব্যবসা শুরু হয়েছে। ডিজিটাল চিত্রক্রয়ের রশিদের নাম ‘এন এফ টি’ (নন ফাঞ্জিবল টোকেন)। প্রতিটি ডিজিটালচিত্র অনন্য। ক্রীত ডিজিটাল চিত্রের চাহিদা যদি বাড়ে, তবে এর দামও বাড়বে। ডিজিটালচিত্র ক্রিপ্টোমুদ্রাতে ক্রয় ও বিক্রয়যোগ্য।

ব্লকচেইনে বেআইনি মজুদদারি করে পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে যাবে। পণ্য বিক্রি হওয়ামাত্র ভ্যাট জমা হয়ে যাবে সরকারের হিসাবে। ভ্যাটের বিবরণ সরকারের কাছে দাখিল করার প্রয়োজন হবে না। মাসশেষে লোকজনের বেতনও চলে আসবে তার ক্রিপ্টোওয়ালেটে। চাকরির আবেদন করা, চাকরি পাওয়া, পেনশনে যাওয়া, পদোন্নতি... সব কিছু স্বয়ংক্রিয় এবং সহজতর হবে।

ব্লকচেইনের কারণে রাজনীতি স্বচ্ছতর হবে। ভোট জালিয়াতি কিংবা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রশ্নই আসবে না। কোন প্রার্থী, কতটার সময় কত ভোট পেয়েছে জানা জাবে ব্লকচেইনে। গোনার প্রয়োজন নেই আর গুনতে গিয়ে দুই নম্বরী করারও সুযোগ থাকবে না। কোন প্রার্থী, কোন দল কী করেছে, কখন তারা কোন কথা দিয়ে রাখেনি, কোন প্রার্থী পাস, কোন প্রার্থী ধপাস, কোন দল, কোন প্রার্থীর যোগ্যতা কেমন– সব মুহূর্তে জানা যাবে ডিজিটাল ঠিকানায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে ব্লকচেইন, বিশেষ করে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে চুক্তির ক্ষেত্রে। ধরা যাক, চীন, ভুটান, নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ মিলে স্বাক্ষরিতব্য বহুপাক্ষিক জলবিতরণ চুক্তিতে ব্যবহৃত হতে পারে ব্লকচেইন প্রযুক্তি।

ব্লকচেইনভিত্তিক প্রশাসনে রাষ্ট্রীয় গোপন ফাইল বলে কিছু থাকবে না। প্রয়োজনও নেই। রাষ্ট্র সবার, সুতরাং গোপনীয়তার কী দরকার? গোপনে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধু বা আলেন্দের মতো নেতাকে মেরে ফেলা কঠিন হয়ে পড়বে। গুম-খুন, ক্রসফায়ার অকল্পনীয় হবে, কারণ ব্লকচেইন থেকে আগেভাগেই জানা যাবে কে, কারা, কখন, কী করছে। গোয়েন্দা সংস্থার অপরিহার্যতা কমে যাবে। প্রশাসন ব্লকচেইনভিত্তিক হলে, কোনো আমীর হামজা স্বাধীনতা পুরস্কার পাবে না। বিচার বিভাগেও সফলভাবে ব্যবহৃত হতে পারে ব্লকচেইন। ‘জাস্টিস ডিলেড জাস্টিস ডিনাইড’। এর ফলে দীর্ঘসূত্রিতা কমে গিয়ে বিচার ত্বরান্বিত হবে এবং অবশেষে সুবিচার সম্ভবপর হয়ে উঠবে।