Published : 24 Jun 2022, 10:41 PM
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল একটি ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতির জনক সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সমগ্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্হা উন্নয়নের জন্য দেশের বড় বড় নদীর উপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকা উল্টা দিকে ঘুরতে শুরু করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সনে জাতির জনকের সুযোগ্যা কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দেশ আবার বঙ্গবন্ধুর দেখানো উন্নয়নের পথে ফিরে আসে।
১৯৯৮-১৯৯৯ সনে শেখ হাসিনার সরকার এর সময়ে পদ্মা সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি সমীক্ষা শেষ করা হয়। কিন্তু পরর্বতী কালে জামাত-বিএনপি জোট সরকার নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপন করে ২০০৩-২০০৫ সনে পদ্মা সেতুর ফিজিবিলিটি সমীক্ষা শেষ করে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরকার গঠনের পর থেকেই পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী হয়। ২০০৯-২০১১ সনে পদ্মা সেতুর ডিজাইন নকশা চূড়ান্ত করা হয় এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে।
এর পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। দেশিয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে আশঙ্কা দেখা দেয়। নানান টালবাহানা ও সময় ক্ষেপন করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিশ্বব্যাংক এর দেখানো পথে এডিবি, জাইকা এবং আইডিবিও তাদের প্রতিশ্রুত ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সময় ক্ষেপনের ফলে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ অবস্হায় দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ সরকার যখন বিব্রতকর অবস্হার সম্মুখীন ঠিক তখনই শেখ হাসিনা তার সাহসী, বিচক্ষণ, বলিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেন ও ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু নির্মান করা হবে ইনশাআল্লাহ এবং তা হবে পুরোপুরি নিজস্ব অর্থায়নে। আবার ও দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা হৈ হৈ করতে শুরু করে এবং নানাভাবে সরকারকে নিরৎসাহিত করতে থাকে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মান করা থেকে । ষড়যন্ত্রকারীরা প্রপাগান্ডা চালাতে থাকে যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান করার চেষ্টা করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর যে চাপ তৈরী হবে তা সামলানোর ক্ষমতা সরকার এর নেই এবং নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মান করার জন্য আন্তর্জাতিক কোন ঠিকাদার পাওয়া যাবে না। কিন্তু জাতির জনক এর মতই নির্ভীক ও দৃঢ়চেতা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্রকারীদের প্রপাগান্ডায় বিচলিত না হয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, বাংলাদেশের জনগন ও শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের প্রতি আকুন্ঠ সর্মথন ব্যক্ত করেন ।
২০১৪ সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে যে স্বপ্নযাত্রার শুরু করেন মাননীর প্রধানমন্ত্রী ২৫ জুন সেই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে তার পরিসমাপ্তি ঘটাবেন । তবে এই স্বপ্নযাত্রার পথ খুব মসৃণ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে ছিল বাধা ও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ । পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে অর্থের জোগান, নদী ব্যবস্থাপনা, নদীর তলদেশে পাইল নির্মাণ ও গুজব মোকাবেলা অন্যতম। অর্থের জোগানের যে চ্যালেঞ্জ তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী, বিচক্ষন, বলিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বগুণের মাধ্যমে মোকাবেলা করা সহজ হয় ।
নদী ব্যবস্থাপনার কাজটি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। পদ্মা বিশ্বের অন্যতম প্রমত্তা নদী। এই নদীর প্রবল স্রোত, বিপুল পরিমাণ পলিমাটির উপস্থিতি কাজের শুরু থেকেই সমস্যা হিসেবে ছিল। ২০১৪ সালে কাজ শুরুর পরের বছরেই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের বেচিং প্ল্যান্টসহ একাংশ নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সালের দিকে স্রোতের কারণে মাওয়ায় নদীর তলদেশে গভীর খাদ তৈরি হয়। এছাড়া মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বিভিন্ন সময় ভাঙনও দেখা দেয়। ফলে নদীশাসনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। দুই পাড়ে নদী ব্যবস্থাপনার কাজ করা হয়েছে ১৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার । জাজিরা প্রান্তে বেশি নদী ব্যবস্থাপনার দরকার হওয়ার মূল কারণ হলো পদ্মা নদী ভারত থেকে ঢুকছে উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে । নিচে নামতে থাকার সময় পদ্মা সেতুর কাছে এসে জাজিরা প্রান্তে প্রথম তীব্র আঘাত হানে । এ কারণে এখানে বেশি সুরক্ষা প্রয়োজন। এখান থেকে নদী ক্ষয় করতে করতে পানি আসে মাওয়া প্রান্তে অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। ততোক্ষণে স্রোতের তীব্রতা কমে আসে। নদী শাসনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো নদী ভাঙন রোধ করে মূল সেতু রক্ষা করা। নদী ভাঙন রোধ করা না গেলে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে নতুন নদী সৃষ্টি করবে। এতে দেখা যাবে সেতু থাকবে এক জায়গায়, নদী থাকবে আরেক জায়গায়। তাই নদী শাসন করে এক স্থানেই নদীর অবস্থান ধরে রাখতে হবে। এই কাজটিও বহুমাত্রিক। প্রথমে নদীর তলদেশ (২৫ মিটার) ড্রেজিং করে পাঁচটি স্তরে বড় আকারের (৮০০ কেজি) বালির বস্তা ফেলা হয়। এরপর তিন স্তরে আরো (১২৫ কেজি) বালির বস্তা ফেলা হয় । তার ওপর এক মিটার উচ্চতায় পানির নি্চের স্তরে ১৬৫ কেজি ওজনের কংক্রিটের ব্লক ফেলা হয় । এরপর জিও ব্যাগ ফেলে ঢালাই করে তার ওপর সিসি ব্লক বিছিয়ে নদী শাসনের কাজ শেষ করা হয় । এই কাজে ১ কোটি ৩৩ লাখ কংক্রিটের ব্লক ও ২ কোটির বেশি বালুভর্তি জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে ।
নদী খননের ফলে ২১২ কোটি ঘনফুট বালু স্থানান্তর করতে হয়েছে সেটি ও ছিল চ্যালেঞ্জের কাজ। অর্থাৎ পুরো নদী ব্যবস্থাপনার কাজটিই ছিল চ্যালেঞ্জের । বিশ্ব রেকর্ড সম্পন্ন নদী ব্যবস্থাপনার কাজের সময় যে সকল চ্যালেঞ্জ এসেছে অভিজ্ঞ ঠিকাদার চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন এবং প্যানেল অব এক্সপার্টদের দূরদৃষ্টি ও কার্যকরী সিদ্ধান্তে ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় সে সকল চ্যালেঞ্জ সফলতার সাথে মোকাবেলা করা হয়েছে।
নদীর তলদেশে পাইল নির্মাণ করা ছিল পদ্মা সেতুর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণে বেশ কয়েকবার নকশার পরিবর্তন করতে হয়েছে এবং সেতু নির্মাণের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে ও নির্মাণ কাজের সময় বেড়ে গেছে। নদীর তলদেশে ১২২ মিটার গভীর পাইল স্থাপন করা হয়েছে যা কিনা একটা বিশ্ব রেকর্ড। পৃথিবীর কোন সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে এত গভীরতায় পাইল বসানো হয় নি । এত গভীর পাইল বসানোর জন্য বিশ্ববিখ্যাত জার্মানির হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে, যা কিনা পদ্মা সেতুর জন্যই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল। পদ্মা নদীর মাওয়া পয়েন্টে প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয়। আমাজন নদীর পরেই কোনো নদী দিয়ে এত বেশি পানি প্রবাহিত হয়। ডিজাইনের সময় নদীর তলদেশ কেমন ছিল, আগামী একশ বছর পর সেটা কেমন থাকবে- পাইল ডিজাইনের সময় এগুলো বিবেচনায় রাখতে হয়েছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, আগামী ১০০ বছরে নদীর তলদেশের ৬৫ মিটার পর্যন্ত মাটি সরে যেতে পারে। সবকিছু সূক্ষ্ণভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে পদ্মা সেতুর জন্য পাইলের গভীরতা ১২২ মিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি পাইলের ব্যাসার্ধ ৩ মিটার আর ৭০ মিলিমিটার পুরু স্টিল দিয়ে সিলিন্ডার আকৃতির পাইলগুলো তৈরি করা হয় । ১০০ বছরে মাটির নিচে জং ধরে কিছু ক্ষয় হলেও পাইলের স্টিলের যথেষ্ট পূরুত্ব অবশিষ্ট থাকবে। পদ্মা সেতু একটু বাঁকানো এই কারণে পাইলিং এর কাজটি অরেকটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল। পদ্মা নদীর তলদেশের মাটির গঠনের ভিন্নতার কারণে সেতুর ১৪টি পিলার নিয়ে ১ বছরের বেশি সময় ধরে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ১৪টি পিলারের ডিজাইন বার বার পরিবর্তনের কারণে নির্মাণ কাজ অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। এক-একটি পিলারের পাইলের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬টি থেকে ৮টি করতে হয়েছে। পিলারের ডিজাইন করার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে কোনো জাহাজ সেতুর পিলারে ধাক্কা লাগলেও সেই ধাক্কা সামলানোর সামর্থ্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। পাইলিংয়ের উপরিভাগে স্ক্রিন গ্রাউটিং করে (অতিমিহি সিমেন্টের স্তর) পাইলের ওজন বহনক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণকালে গুজব মোকাবেলা করা ছিল ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে 'মানুষের কাটা মাথা লাগবে' বলে সারাদেশে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল । এই গুজবকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে 'ছেলে ধরা' সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। পদ্মা সেতু নিয়ে যেকোনো গুজব ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কঠোর নজরদারি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আইন শৃংখলা বাহিনীর অসামন্য তৎপরতায় গুজব মোকাবেলা করা সম্ভব হয়। ২৫ জুন কোটি বাঙালির স্বপ্নের এ সেতু উদ্বোধনের আগে-পরে বেশ সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এ নিয়ে কোনও নাশকতা বা ষড়যন্ত্রের সুযোগ কেউ না পায়।