Published : 06 Jun 2022, 10:26 PM
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর আগুন ও বিস্ফোরণে অগণিত মানুষের পোড়া ও ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ দেখে পুরো দেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এই দেশে গরিব মানুষের প্রাণ যে কত তুচ্ছ, কত সস্তা, কত অনিরাপদ, তা আবারও প্রমাণ হলো। আগুনে ঝলসানো অসংখ্য আহত-নিহত মানুষকে ঘিরে পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে আহাজারি চলছে, চলছে স্বজনদের শোকের মাতম! কিন্তু তাতে কি আসে যায়? গরিবের জীবনের অপচয় কি তাতে বন্ধ হবে? পদে পদে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় গড়া আমাদের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কি তাতে টনক নড়বে? এই দুর্ঘটনার, অসংখ্য মানুষের আত্মদানের ঘটনার প্রতিবিধান হবে? বন্ধ হবে এ ধরনের অবহেলাজনিত মৃত্যুর?
এতবড় একটা কন্টেইনার ডিপোতে কী ধরনের রাসায়নিক আছে সে তথ্য কেউ জানায়নি। কেউ জানতেও পারেনি। তাইতো সাধারণ আগুন মনে করে যখন অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যরা অসীম সাহসে এগিয়ে গেছে, রাসায়নিকের বিস্ফোরণ ও আগুনে তারা নিজেরাই ঝলসে গেছে। এখন পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপক দলের ৯ জন সদস্য আত্মদান করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মালিকপক্ষের কাউকেই সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের তরফে উদ্ধারকারীদের সহায়তা করার মতো কেউই ছিলেন না। এতে করে উদ্ধারকাজ চালানোর সময়ও একের পর এক কন্টেইনারের রাসায়নিক বিস্ফোরিত হয়েছে, মানুষ পুড়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শত শত আহত-নিহত ব্যক্তিকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে। চিকিৎসকসহ সেবাকর্মীরা আহারনিদ্রা বাদ দিয়ে হতাহতদের সারিয়ে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। সাধারণ মানুষদের অনেকেই দুর্গতদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। অনেকে রক্ত দিতে ছুটে এসেছেন। কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই অনেকেই মানবতার টানে সহায়তা দেওয়ার জন্যে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাতে কি নিহতজনদের ফিরিয়ে আনা যাবে? আগুনে যাদের শরীর ঝলসে গেছে, তারা কী তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন? প্রশ্ন হলো, কেন, কার পাপে এমন বিপুল সংখ্যক মানুষকে এমন নির্মম ট্রাজেডির শিকার হতে হলো? এই ঘটনার জন্য কে বা কারা দায়ী? তাদের কি বিচার হবে?
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক ফ্যাক্টরি কীভাবে হলো, তার তদন্ত কে করবে? কেন রাসায়নিকের ব্যাপারে কোনো তথ্য অগ্নিনির্বাপক দলের কাছে ছিল না? ওইসব রাসায়নিক কী ওখানে বৈধভাবে ছিল? এই কন্টেইনার ডিপোতে কীধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই বা বহাল ছিল? না থাকলে, কেন ছিল না?
সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোর হতাহতের বেশিরভাগই দরিদ্র শ্রমিক, হতাহতের তালিকায় আছেন উদ্ধারকারী ফায়ারসার্ভিস কর্মী, পুলিশ সদস্য। কেউ সামান্য দুমুঠো ভাতের জন্যে জীবনকে বন্ধক দিয়ে কাজে ছিলেন, কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিংবা মানবিকতার টানে মানুষকে বাঁচাতে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। যে শ্রমিক মালিকপক্ষের লোভের আগুনে নিজের জীবনকে ছাই বানালো, যে শ্রমিক আগুনে পুড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, দগ্ধ হয়ে পুরো জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল, তাদের দায়িত্ব কে নেবে? কেন তাদের এমন নির্মম পরিণতির মুখে পড়তে হলো?
এমন একটি জনবহুল স্থানে কন্টেইনার ডিপোর অনুমতি কে দিয়েছিল? আর সেখানে বিপজ্জনক দাহ্যবস্তুই বা কার অনুমতিতে জমা রাখা হয়েছিল? সেখানে নিরাপত্তাঝুঁকি কতটুকু বিবেচনা করা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের জবাব সরকারকেই দিতে হবে। কেননা শেষ বিচারে রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।
দেশে কিছু দিন বিরতি দিয়ে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে৷ সেসব আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে মানুষ এবং সম্পদ৷ যখন মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন বেশ হৈ-চৈ হচ্ছে৷ দেশজুড়ে আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে, সবাই নড়েচড়ে বসছেন, কর্তৃপক্ষ পরিত্রাণের উপায় খুঁজছেন, তদন্ত কমিটি হচ্ছে, তদন্ত কমিটি রির্পোট জমা দিচ্ছে, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারপর আবার সব চুপচাপ৷ আবার যখন কোনো জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে, তখন আগুন লাগার কারণের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়৷ সেই নিমতলী থেকে মানুষ পুড়ছে, তারপর চকবাজার, বনানীর এফআর টাওয়ার৷ সর্বশেষ সীতাকুণ্ড।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর নিমতলী ও চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় হয়। দুই জায়গাতেই আগুনের সূত্রপাত হয় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে৷ আর আগুন দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করেছিল রাসায়নিকের কারণে৷ নিমতলীর এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মারা যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়৷ তদন্ত কমিটি সেখান থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোসহ ১৭টি সুপারিশ করেছিল৷ তারপর বহু বছর পার হয়ে গেছে, সুপারিশ কাগজেই রয়ে গেছে৷ তারপর চকবাজার ট্রাজেডি এবং বনানী ট্র্যাজেডি৷ এবারও তদন্ত কমিটি হয়েছে৷ সেই সুপারিশ এবং তা বাস্তবায়নের কথা ঘুরেফিরেই আসছে৷ কারণ, সুপারিশ যদি বাস্তবায়িত না হয় তাহলে সেই সুপারিশে মানুষের লাভ কোথায়? মানুষ শুধু তদন্ত কমিটি দেখতে চায় না৷ মানুষ চায়, তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা তা দেখতে৷
মুখে মুখে বড় কথা বলা হলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যে আমরা কত দুর্বল সীতাকুণ্ডের ঘটনায় তা আবারও প্রমাণ হলো। আগুনের কাছে গিয়ে বা আগুনের ভেতরে গিয়ে আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার স্যুট (অেগ্নি-নিরোধক বিশেষ পোশাক) দরকার, সীতাকুণ্ডে কোনো অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যের গায়ে তা দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট কারো ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস (IMDG Code) কোড সম্বন্ধে ধারণা আছে বলে মনে হয়নি। তবে সীতাকুণ্ডের ঘটনায় সবার আগে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে কন্টেইনার ডিপো ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে। কনটেইনারগুলো আইএমডিজি কোড মেনে রাখা হয়নি, বিপজ্জনক মালামালগুলোও সেখানে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। অথচ এগুলো নিরাপত্তাবিধি মেনে আলাদা করে রাখার কথা। এই কন্টেইনার ডিপো ব্যবস্থাপনায় যারা জড়িত তাদেরকে মানুষ হত্যার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। তা না হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও ঘটবে।
কোনো ঘটনা থেকে কেবল শিক্ষা নিয়ে বসে থাকলেই পরবর্তী ঘটনা আটকানো যায় না৷ কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার যথাযথ কারণ বের করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই যে কোনো সভ্য সমাজের রীতি৷ কিন্তু আমরা তা করি না৷ আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন আইন মেনে চলার অভ্যাস নেই, সাধারণ মানুষকে আইন মানানোর বাধ্যকতা সৃষ্টির জন্য যে সব কর্তৃপক্ষ আছেন, তারাও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন৷ অনেক ক্ষেত্রে টাকা খেয়ে সব অনিয়মকে জায়েজ করে দেন৷ ফলে একের পর এক ট্রাজিক দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে৷
আসলে আইন বা নিয়ম না-মানার কারণেই আমাদের দেশে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে৷ সীতাকুণ্ডের ঘটনাও অনিয়মেরই ফল। আমাদের অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও ভাবতে হবে৷ এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন৷ অগ্নিনির্বাপণে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পানির পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা৷ কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পানি সরবরাহের সীমাবদ্ধতা লক্ষ গেছে। তাই অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন হতে পারে একটি কার্যকর উদ্যোগ৷
অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় দ্রুত পানি সরবরাহের প্রয়োজনে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে ফায়ার হাইড্রেন্ট (অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত বিশেষ পাম্পযুক্ত পানিকল) স্থাপন করা খুবই জরুরি৷ কারণ, ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস, যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে৷ যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়৷ এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, লম্বা পাইপের সাহায্যে ইচ্ছেমতো যে-কোনো দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়৷
উন্নত দেশগুলোতে আগুন নেভানোর কাজে ফায়ারফাইটিং ড্রোন ব্যবহার করা হয়। ড্রোনের সুবিধা হলো এটি নিচে দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ এসব ড্রোন ৩শ' থেকে ৪শ' মিটার উচ্চতায় যেতে পারে এবং এগুলো মিনিটে ১০০ লিটার গতিতে পানি ছিটাতে পারে৷
উন্নত দেশগুলোতে ফায়ারফাইটিং রোবটও ব্যবহার করা হয়। ছোট ট্যাঙ্কের মতো এই ফায়ারফাইটিং রোবটগুলো আগুনের খুব কাছে পৌঁছে যেতে পারে৷ এগুলো ৮৫ মিটার বা একটি ফুটবল মাঠের দূরত্বে পানি ছেটাতে পারে৷
কোনো কোনো দেশ আগুন নেভানোর কাজে এলইউএফ ৬০ নামে একটি চলনশীল ওয়্যারলেস রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে৷ এটি ১ হাজার ফুট পর্যন্ত সামনের আগুন নিভিয়ে পথ পরিষ্কার করে দেয়৷ এছাড়া মিনিটে ১ হাজার ৮শ' লিটার পানি ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছুড়তে পারে৷ বিদ্যুৎ চলে গেলে এতে ম্যানুয়েল কন্ট্রোলও আছে৷ বিশেষ করে ওয়্যারহাউস বা আন্ডারগ্রাউন্ডে আগুন নেভানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সহজেই এর মাধ্যমে করা যায়৷। অগ্নিনির্বাপণের এসব আধুনিক উপকরণ নিয়ে ভাবতে হবে।
জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে চালানো দেশটাকে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে নিয়মে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সবার আগে সরকার সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ। এই দেশে আর কতো মানুষ মরলে সংশ্লিষ্টদের হুঁশ হবে? দেশটা নিয়মের পথে ফিরে আসবে?