Published : 28 May 2022, 07:09 PM
বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও নারী আন্দোলনের অন্যতম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বেগম নূরজাহান মুরশিদের ৯৭-তম জন্মদিন গেল ২২ মে। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তারানগরে। বেড়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে। ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হচ্ছে, তখন তার বয়স ২৩।
চল্লিশ দশকের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাঙা-গড়া, পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি, মহান ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ, ছয়দফা, মুক্তিযুদ্ধসহ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এক অম্লান সাক্ষী এই কালজয়ী নারী। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। পাকিস্তান-উত্তর সময়ে যে নারীরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেদের মেধা ও মননের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষর রেখেছিলেন নূরজাহান মুরশিদ নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম। নূরজাহান মুরশিদ স্মারক গ্রন্থের ভূমিকায় ১৯৫৪ সালকে যদিও তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল দেশভাগের আগ থেকেই। ১৯৫৪ সালে নূরজাহান মুরশিদ যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নারায়ণগঞ্জ আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু তৎকালীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে তার যোগাযোগ আরও আগে থেকেই। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরেই আত্মপ্রকাশ করেছিল গণতান্ত্রিক যুব লীগ, যেখানে কমিউনিস্ট, ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল তরুণকর্মীরা অংশ নিয়েছিলেন। গত শতাব্দীর মধ্যচল্লিশ থেকেই মুসলিম লীগে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দুটো ধারার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নূরজাহান মুরশিদ তখন কলকাতায় থাকতেন। সেখানেই তিনি সংযোগ গড়ে তুলেছিলেন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশটির সঙ্গে, যার নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে পূর্ব বাংলার আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আইন পরিষদ সচিব (পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি) হিসেবে কাজ করেছেন নূরজাহান মুরশিদ। আইন পরিষদের একজন নারী সদস্য হিসেবে বিভিন্ন আইন প্রণয়নে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি জয়লাভ করেছিলেন। বাংলার মুক্তিসংগ্রামে তার অবদান ইতিহাসবিদিত। তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতীয় বিধানসভার উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর ফলে তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাকে নিরুদ্দেশ অবস্থাতেই ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই প্রথম স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। যুদ্ধোত্তর সেই বিপর্যস্ত সময়ে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ছিলেন একজন নির্বাচিত সাংসদ। আমৃত্যু তিনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি। সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থায় নর-নারীর জীবনের পুনর্বিন্যাস ছিল তার স্বপ্ন আর এ সত্যই উঠে এসেছিল তাঁর সম্পাদিত মাসিক এদেশ-একাল পত্রিকাটিতে।
এমন বর্ণাঢ্য যার জীবন, এত বৃহৎ যার কর্মপরিসর তাকে ও তার সময়কে বুঝতে হলে তাই সে সময়ের, বিশেষত আমাদের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বে উঠে আসা মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিকে বুঝতে হবে। নূরজাহান মুরশিদ যে কেবল সেই দ্রুত বিকাশমান শ্রেণির একজন প্রতিনিধিই ছিলেন তা নয়; তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংগ্রামে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং নিজের সাধ্যমতো এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে রুচি-স্নিগ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
দুই
নূরজাহান মুরশিদ নিজের জীবনচর্চায় নারী স্বাধীনতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন প্রতিটি পর্যায়ে। তার সান্নিধ্যে পরবর্তী দুই প্রজন্ম নারী হিসেবে নিজের স্বাধীন জীবনযাপন ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। তার সম্পাদিত মাসিক এদেশ-একাল পত্রিকায় নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার গুরুত্ব এবং সামাজিক প্রভাব সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখনি রয়েছে। সংস্কৃতিচর্চায় সেকালের পথিকৃৎ হয়ে এ কালের নারী সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য পথ তৈরি করে গেছেন তিনি। কেবল সংস্কৃতিই নয়, তার সঙ্গে রাজনীতির যে গভীর সংযোগ রয়েছে- এ কথাও তার জীবনের প্রতিটি কর্মের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বেদনার বিষয় হলো এই মহান রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে এ যুগে আমরা কজন নারী জানি? কজনই বা তার কাজের সাথে পরিচিত? তাঁর জীবনচর্চা, মনন ও বোধের অনুসন্ধান আজকের দিনে আমরা কজনই বা করছি?
পারিবারিক পরিসরে নূরজাহান মুরশিদকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তিনি আমার মায়ের একমাত্র মামা প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক ড. খান সরওয়ার মুরশিদের জীবনসঙ্গী। সেই সূত্রে সম্পর্কে তিনি আমার নানি হন। যেহেতু আমার শৈশবে অধ্যাপক মুরশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, তাই আমি তাকে 'ইউনিভার্সিটির নানা' বলতাম এবং নূরজাহান মুরশিদকে বলতাম 'ইউনিভার্সিটির নানু'। বোধ হবার পরে প্রথম তাদের সংসারে যাই ঢাকার মিন্টু রোডস্থ মন্ত্রী পাড়ার বাসভবনে। তখন মন্ত্রী পদটি যথেষ্ট সম্মানের। আর একজন শিশুর জন্য তো রূপকথার গল্পের প্রতাপশালী এক চরিত্র। আমার 'ইউনিভার্সিটির নানু' একজন নারী এবং তিনি মন্ত্রী- এ কথা মনে হলেই তাকে একটু ছুঁয়ে দেখতাম। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম তার দিকে। আমার বিস্ময় তিনি ভুলিয়ে দিতেন আদর দিয়ে। ছোটবেলা দেখেছি সে বাড়িতে বহু মানুষের আনাগোনা ছিল। সারাদেশের মানুষ আসতেন নানা কাজে বা দেখা করতে। সুনিপুণভাবে সব সামলাতেন নানু। ধৈর্য এবং দক্ষতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তিনি ঘরটিও সামলে রাখতেন পরম মমতায়। নিপুণ পরিপাটি এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন নূরজাহান মুরশিদ। পোশাকে, চলনে এবং বাচনে তার আধুনিকতা ও পরিমিতি ছিল অসাধারণ। কথা বলার সময় নানুর সাবলীল কিন্তু বলিষ্ঠ শব্দচয়ন আজও আমার কানে বাজে।
পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে যাই তাদের সংসারে। নানা অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বিশাল বাড়িতে নানা-নানুর আদরে বেশ কয়েকটা দিন কাটাই, আমার বয়স তখন পাঁচ। তারপরে নানা রাষ্ট্রদূত হয়ে চলে যান পোল্যান্ডে। কাজের ফাঁকে দেশে বেড়াতে আসলে আমাদের দেখা হতো। তখন আমাদের বাসায় আসতেন বা আমরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যেতাম দেখা করতে।
দেশে ফিরে আসার পরে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের বাড়িটি হয়ে উঠেছিল আমাদের আরেক নানুবাড়ি। গাছগাছালি পরিবেষ্টিত এ বাড়িটির প্রতিটি গাছের ফলে ছিল আমার বিশেষ অধিকার। গ্রীষ্মে নানাবাড়ির আম-কাঁঠাল ঠিক পৌঁছে যেত বাড়িতে। আর এ সবকিছুই একা হাতে তদারকি করতেন নূরজাহান মুরশিদ। রাষ্ট্রীয় নানা ব্যস্ততা, সংগঠন পরিচালনা, পত্রিকা প্রকাশ- সবকিছু করেও ঠিকই তিনি মনে রাখতেন আমাদের সকলের কথা।
অসংখ্য মানুষের মতো আমার জীবনেও নূরজাহান মুরশিদ অন্যতম এক প্রেরণার নাম। জীবনের নানা উত্থান-পতনে আজও কাজের ঘরে পড়ার টেবিলের সামনে চশমা চোখে নূরজাহান মুরশিদের ব্যক্তিত্বময় সৌম্য চেহারাটাই আমার চোখে ভেসে ওঠে। তার কর্মমুখর জীবন, নান্দনিক আর সাহসী বোধের মতো এ ছবিটিও আমার চোখে অম্লান-অমলিন।