Published : 28 Feb 2022, 10:02 PM
আমরা বাঙালিরা ভারী আবেগপ্রবণ আর আমাদের এই চিত্তচাঞ্চল্য, ব্যাকুলতা ব্যঞ্জনা পায় আমাদের মুখের বুলিতে, আমাদের লেখনীতে, আমাদের যাপিত জীবনের ভাষাতে। আর যেই ভাষা আমাদের সমস্ত আবেগ আর আকুলতার প্রকাশবাহন, তাকে ঘিরে আমরা ব্যাকুল হবো, উদ্বেলিত হবো – তাই-ই তো স্বাভাবিক। আর দিনপঞ্জীর নিয়ম মেনে ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষাকে ঘিরে আমাদের উছ্বাস বাড়ে বহুগুণ, আমাদের গর্বের পারদ হয়ে ওঠে ঊর্ধ্বমুখী। 'আমাদের হৃদয়ে, মননে বাংলা ভাষা' এমন শব্দাবলীর বিন্যাসে আমাদের আত্মতুষ্টি দৃশ্যায়মান হয় সর্বত্র। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পূর্তির লগ্নে দাঁড়িয়ে নিজের মনকে প্রশ্ন করছিলাম সত্যিই কী আমরা হৃদয়ে আর মননে বাংলা ভাষাকে ধারণ করি? যেই 'মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়' এর প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ থেকে বাঙালির স্বাধীনতার অগ্নিঝরা সংগ্রামের সুত্রপাত, আজ আসলেই কী আমরা অন্তর দিয়ে জানি আর মানি যে 'মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো'? বিশ্বায়নের এই যুগে, ক্রমশ দ্রুত 'আধুনিক' হয়ে ওঠবার প্রয়াসে ব্যগ্র বাঙালির কাছে যুগান্তরে, প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে ফেরা 'মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা' এই লাইনখানি সত্যিই কী আর কোন আন্তরিক অর্থবহন করে? না কী এসবই কথার কথা যা বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি এলে মনে পড়ে, মনে পড়তে হয়? 'আধুনিক', শহুরে, শিক্ষিত বাঙালির কাছে ভাষা নিয়ে এই আকুলতা কী শুধুই আজ দেখানেপনার আদিখ্যেতা?
ভাষা বহমান আর এই বহমানতাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকে সমকালীন করে তোলে নিরন্তর। এই সতত পরিবর্তনশীল ভাষা কিন্তু একই সঙ্গে বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী। আর সে কারণেই নানান ভাষা, নানান সাংস্কৃতিক উপাত্ত আর উপাচার থেকে সে খুব স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই উপাদান গ্রহণ করে নিজেকে সপ্রাণ সতেজ রাখে। একটা কথা মনে রাখা খুব জরুরী যে কালক্রমে ঘটে যাওয়া ভাষার এই পরিবর্তন কোন চাপিয়ে দেওয়া পরিবর্তন নয়, এ বড় সহজাত। এই পরিবর্তনে ভাষা সমৃদ্ধ হয়, বিকৃত নয়। আর এখানেই যে বিষয়টি উল্লেখ করা খুব জরুরী culture trumps language but language shapes culture – ভাষার জন্ম হয় সংস্কৃতির কোলে, ভাষাকে ব্যুৎপত্তি জোগায় সংস্কৃতি আবার সংস্কৃতির উপাচারকে ব্যঞ্জনা দেয়, ব্যক্ত করে ভাষা; সংস্কৃতি পরিস্ফুটিত হয়, প্রকাশমান হয় ভাষার উপযোগে। সে কারণেই ভাষা যদি সংস্কৃতির স্বাভাবিক আর সাংসিদ্ধিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্যূত হয় কিংবা বৃহত্তর ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনচর্চা বা মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে বিচিত্রতার অনুসন্ধানে নিজের রূপ-পরিচয় হারায়, তখন সেই পরিবর্তন সহজ বা স্বাভাবিক থাকেনা। একে কোন ভাবেই ভাষার বহতা বলা যাবেনা বরং ধীরে ধীরে এর মাধ্যমে গভীর বিযুক্তি বা বিষঙ্গ ঘটে ভাষার সঙ্গে ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে, এমনকি বিযুক্তি ঘটে বৈষম্য সৃষ্টি হয় একই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যেও।
বাঙালি আর বাঙালির বাংলা ভাষা– দুইই মিশ্র প্রকৃতির। সে কারণেই বাংলাভাষার শব্দ ভান্ডারে তৎসম, তদ্ভব, দেশি শব্দের সঙ্গে ফারসি, আরবি, তুর্কি, হিন্দি, উর্দু থেকে শুরু করে ওলন্দাজ, ইংরেজিসহ নানান ভাষার শব্দ সহজাতভাবেই জুড়ে গেছে। ধীরে ধীরে এগুলি বাঙালির নিজস্ব শব্দ হয়ে উঠেছে। আজ যদি বলি 'নিঃশ্বাসে বুকভরে অম্লজান গ্রহণ করে কেদারায় বসে দূরালাপনীতে প্রিয় সুহৃদের সাথে আলাপচারিতায় রত হলাম' , সকলেই বেশ নড়েচড়ে বসবেন, খানিকটা ভ্রুকুটিও দেখতে হবে, সে হলফ করে বলতে পারি। 'অম্লজান' না বলে 'অক্সিজেন' বললে, 'কেদারা' না বলে 'চেয়ার' বললে, 'দূরালাপনী' না বলে 'টেলিফোন' বললেই স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ 'অক্সিজেন', 'চেয়ার, 'টেলিফোন' শব্দগুলি ছাড়াও ছাপোষা বাঙালির নিত্যকার জীবনের সাথে জুড়ে থাকা তারিখ, লেবু, বালতি, সরকার, সবজি, আলপিন, শিরোনাম, অফিস, পাউরুটিসহ নানান শব্দই কিন্তু অন্য ভাষা থেকে এসে বাংলাতে আত্তীকৃত হয়ে গেছে ভাষার বহতায়। এমনকি আশৈশব বয়ামভরা যে আচারের লোভের কাছে আত্মসমর্পিত হয়নি এমন বাঙালির খোঁজ মেলা দুষ্কর, সেই 'আচার'ও আদতে বাংলা শব্দ নয়। অথবা 'সব খেলার সেরা বাঙালির সেই ফুটবল' বলে মান্না দে'র সাথে গলা মিলিয়ে যে আমরা গেয়েই গেলাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই 'ফুটবল' শব্দও বাংলার নিজস্ব শব্দ নয়। 'মাছিমারা কেরানি' প্রবাদে কাল থেকে কালান্তরে জর্জরিত হওয়া বাঙালি খোঁজ নিলে জানতে পারবে 'কেরানি' শব্দটিও পর্তুগীজ থেকে এসে বাংলাকে এতোটাই নিজের করে নিয়েছে যে 'কেরানি' শব্দ শুনলেই খুব সাদামাটা ছাপোষা সকল ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলা এক আদ্যোপান্ত বাঙালি চেহারাই মনে আসে। তাই বলছিলাম, নানান ভাষার শব্দের বাংলা ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠবার এই প্রক্রিয়া সহজাত, এর মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া নেই কোন। জনপদে চিরচলমান, নিয়ত পরিবর্ধনশীল সংস্কৃতির নিত্যনতুন উপাচার, উপাদান আর অভ্যাসকে ব্যঞ্জনা দিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই আত্তীকরণের এই প্রক্রিয়া ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির চিরকালীন সংস্কৃতির কোলেই এ সকল শব্দ লালিত হয়েছে, চর্চিত হয়েছে। আর এই নিত্যনতুন সংযুক্তিতে বরং বাঙালির সংস্কৃতি পরিস্ফুটিত হয়েছে, প্রসারিত হয়েছে।
অন্যদিকে ঊনিশ শতকে ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বাঁকবদলের ইতিহাস ঘাঁটলে এর সমান্তরাল এক বিপরীতমুখী চিত্র পাওয়া যায়। সেই সময়কার ভাষা দ্বন্দ্বের কবলে পড়ে 'হিন্দু বাংলা' বনাম 'মুসলমান বাংলা'সহ দোভাষী পুঁথির যে বাংলার উদাহরণ মেলে, সেখানে কোন স্বাভাবিক আত্তীকরণের গল্প নেই। এই ইতিহাস বিষঙ্গের, এই ইতিহাস বিযুক্তির। এই যে ভাষাগত বা সাহিত্যগত অনিবার্যতা ও প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই অন্য ভাষার শব্দের সংখ্যাগত বাহুল্য, এ কিন্তু এক প্রকার জবরদস্তি। অন্য ভাষার উপাদান বা শব্দভান্ডারের স্বাভাবিক আত্তীকরণকে যদি 'স্বাধীনপ্রক্রিয়া' বলে ধরা যায়, তবে এই ভাষা রূপ বদলকারী এই জবরদস্তিকে 'ভাষা-আগ্রাসন' বা 'ভাষা সাম্রাজ্যবাদ' বলে অভিহিত করা যায় খুব সচেতনভাবেই।
বাংলা ভাষাকে নানান সময়ে এমন 'ভাষা-আগ্রাসন' বা 'ভাষা সাম্রাজ্যবাদ' এর শিকার হতে হয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ দেয় ১৯৪৭ সালের সমসাময়িক সময়ে অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত আগে ও পরে কলকাতা ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত বহুসংখ্যক পত্রিকাতে বেশ কিছু লেখক মধ্যপ্রাচ্যের ভাবধারায় প্রণোদিত হয়ে তাঁদের লেখাতে, বিশেষত কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের সীমাহীন ও যথেচ্ছ ব্যবহার করে বাংলা ভাষার চিরচেনা রূপকে এক অর্থে জলাঞ্জলি দিয়েই তাকে অচেনা করে তুলেছিলেন। হুমায়ূন আজাদ তাঁর 'ভাষা আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি' এ ধরণের বেশ কিছু উদাহরণ উদ্ধৃত করেছেন।
'সায়ফুল্লার কুওৎ আবার নামছে কলবে দুর্নিবার
খালেদী বাজুর তলোয়ার নাচে মুমিনের হাতে খর-দুধার'… (ফররুখ আহমদ)
অথবা
'জরির জোবা, শেরোয়ানী আর আমামার সঙ্জায়
আতরের পানি, মেশকের রেণু খোসবু বিলায়ে যায়'… (সৈয়দ আহসান আলী)
হুমায়ূন আজাদ এসব কবিতাকে 'নজরুলের ইসলামি কবিতার দরিদ্র পাকিস্তানি পরিণতি' বলে তির্যকভাবে বর্ণনা করেছেন। এমন আরও নানান উদাহরণ মেলে সনজীদা খাতুনের 'রবীন্দ্রনাথ: বাঙালী মুসলমান সমাজ: বাংলাদেশ' প্রবন্ধে।
'কলিজার খুনে ওয়াতানের ধুলি করিয়া লাল
আজাদীর তরে শহীদ হলে যে বীর দুলাল,
তাহারা মোদের সালাম নাও, তাহারা মোদের আশিস্ দাও
ভাঙা কেল্লার উর্ধে যাহারা উড়ালে ঝান্ডা আল-হেলাল।'
এমনতর কবিতার উদাহরণ যেমন উল্লেখ আছে এই প্রবন্ধে ঠিক তেমনি গদ্যভাষাতেও জবরদস্তির অদ্ভুত উদাহরণ পাই 'লেবাসের অন্দরে তার তামাম তনু পোসিনায় তরবতর' লাইনখানিতে যা কীনা নির্জনে প্রেমিক পুরুষের মুখোমুখি হয়ে প্রেমিকার অবস্থা বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে 'বাঙলা ভাষা' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদের আলোচনা সত্যিকার অর্থে প্রাসঙ্গিক হবে।
"এ পাকিস্তানিকরণ আন্দোলন শুধু বাংলা শব্দভান্ডারকেই আক্রমণ করেনি, তা হানা দিতে চেষ্টা করে বাংলা বাকভঙ্গি পর্যস্ত। এ উৎকট প্রক্রিয়া কী রকম ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় 'দাতা কর্ণে'র বদলে 'দাদা হাতেম', 'বিদ্যাদিগগজে'র বদলে 'এলেমের জাহাজ', 'সতী সাবিত্রী'র বদলে 'সতী রহিমা', 'জুতো শেলাই থেকে চত্তীপাঠে'র বদলে 'জুতো শেলাই থেকে টুপি শেলাই তক', 'জন্মান্তরের' বদলে 'কেয়ামতের দিন পর্যন্ত' ব্যবহারের প্রস্তাবে।"
ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্তির এই সময়ে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদের এই বিশ্লেষণ শুধুমাত্র যে দেশভাগ বা পাকিস্তান সৃষ্টির সময়কালীন 'ভাষা-আগ্রাসন' প্রসঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সবিশেষ উপযুক্ত মনে হয় তাই নয়, বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও বড় সমকালীন বলে বোধ হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে যখন কিছু শব্দের কারণে, বা জন্মগত নাম বা ধর্মপরিচয়ের কারণে কালজয়ী লেখকের লেখা বাদ পড়ে কিংবা পুরোনো রচনার শব্দ পালটিয়ে দেওয়া হয় অথবা যাপিত জীবনে বহুকাল ধরে চলে আসা বহুল ব্যবহৃত চিরচেনা শব্দগুলিকে যখন জোর করে পাল্টে দেবার গভীর উদ্দেশ্যমূলক চেষ্টা চলে তখন বিস্ময়, শঙ্কা, আশাহীনতা, ক্ষোভ, ক্রোধ, উদ্বেগ আর নিদারুণ মর্মপীড়া গ্রাস করে সচেতন বাঙালিকে। আর ঠিক এখানটাতেই গত সত্তর বছরের অর্জন নিয়ে দ্বিধা জাগে, প্রশ্ন ওঠে।
একদিকে যেমন ধর্মের লেবাসে বাংলা ভাষাকে ঢেকে দেবার সূক্ষ্ম অথচ গভীর এক প্রয়াস চলছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক হবার দৌড়ে নেমে শহুরে শিক্ষিত বাঙালি তার নিত্যকার ভাষা ব্যবহারে অনাবশ্যক, অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ করে আরেক রকম জবরদস্তি চালাচ্ছেন। যেমনটি আগে বলছিলাম, কালের নিয়মে, জীবনের প্রয়োজনে সংস্কৃতি বদলায়, বদলায় আচার, ব্যবহার, জীবনবোধ। সংস্কৃতি কোন স্থবির বিষয় নয়, এটি চিরচলমান প্রক্রিয়া। আর সংস্কৃতি বদলায় বলে ভাষাতেও তার পরিবর্তন আসে, আর তা আসে খুব স্বাভাবিক সহজাত নিয়মেই। সেই হিসেবে শহুরে বাঙালি বদলেছে, তার চিন্তা-চেতনা-আশা-পরিকল্পনা সবেতেই বদল এসেছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার ভাষাও বদলাবে, তাতে সন্দেহ নেই, আশ্চর্য হবারও নেই কিছু। কিন্তু বিস্ময় লাগে তখনই, যখন দেখা যায় বিকৃত উচ্চারণ আর বাচনভঙ্গীতে বাংলা বলাটা 'coolness' বা 'smartness' এর নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অকারণ আর যথেচ্ছ ইংরেজি শব্দের প্রয়োগে বাংলা না বললে যেন নিজের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান ঠিক প্রমাণ করা যায়না। এই প্রয়োগ যে শব্দগত বা ভাষাগত ভাবেও সবসময় সঠিক হয় তাও কিন্তু নয়। একদিন টেলিভিশনে এক জনপ্রিয় উপস্থাপক এক লোকপ্রিয় গীতিকারকে প্রশ্ন করছিলেন 'আপনি তো অনেক sad songs লেখেন , so আমার question হলো আপনি কেন এমন sadist lyricist?' এমন শুনে ঘাবড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কী? আবার যত্রতত্র 'hello viewers' বলা সঞ্চালক রেডিওতেও যখন এই শব্দমালা প্রয়োগ করেন তখন তো খানিক নড়েচড়ে বসতেই হয়। কিন্তু ধরা যাক আজকের শহুরে বাঙালি যখন বলেন 'তোমাকে কাল খুব মিস করেছি' তখন অবাক লাগেনা, ধাক্কাও লাগেনা কারণ 'মিস করা'র এই অনুভূতি বাঙালির ভাবনার জগতে নিজের জায়গা করে নিয়েছে কালক্রমে। কিন্তু চমকে উঠতেই হয় এমন বাক্য গঠন যখন শুনি 'আপনার হাবি তো আপনাকে out of the world লাভ করে! OMG আপনি সো লাকি!!!' অথবা 'I can't sit হাঁটুগেড়ে এরকম সবার মিডিলে গিয়ে'। এই যে ভাষার ব্যবচ্ছেদ এতে কিন্তু কোন ভাষাই ঠিক মতো করে শেখা হচ্ছেনা। আর দিনশেষে এমন জবরদস্তির কবলে পড়ে এক হযবরল উচ্চারণ আর বাচনভঙ্গি গ্রাস করছে আমাদের। আবার অন্যদিকে হিন্দিভাষী জনপদের চলচ্চিত্র, গান, সংস্কৃতি আমাদের এমন ভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে যে চিরন্তন বাঙালির সংস্কৃতি, তার শব্দকোষ বদলে যাচ্ছে অদ্ভুতভাবে। 'হালদি', 'মেহেন্দি' থেকে শুরু করে চিরচেনা 'পরোটা'কে 'পারাঠা' না বললে আর মান থাকছেনা। শহুরে বাঙালি এখন আর জিলাপি খায় না 'জালেবি' খায়। হিন্দি 'কিউ কি'র প্রভাবে কিংবা অনুকরণে যত্রতত্র 'কারণ' না বলে 'কেন কী' নামক নতুন অদ্ভুত এক শব্দবন্ধ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে আজকের আধুনিক বাঙালি।
আজকাল আবার খুব চল হয়েছে 'আমি কিন্তু একদম judgemental নই' কিংবা 'আমি কাউকে একেবারেই judge করিনা' এমন বাক্যবন্ধের। কিন্তু এ বাক্য বলার পর সমস্তটাই হয়তো হবে ভারী 'judgemental' কথোপকথন। আর এতে অবাক হবারও কিছু নাই কারণ আমরা শব্দটা শিখেছি কিন্তু তার অর্থটা অন্তরে ধারণ করতে পারিনি। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আমাদের শেখায় নিজেদের ব্যক্তিগত ঠিক ভুলের নিক্তির নিরিখেই অন্যদের বিচার করতে, নিজের দৃষ্টি দিয়ে অন্যকে পরখ করতে। আমরা সেটাই জানি। অপরকে judge করা আর অপরের বিষয়ে 'judgemental' হয়ে ওঠা আমাদের জাতিগত অভ্যাস। ঠিক যেমনটি ঘটে 'privacy' শব্দের বেলায়। আমরা 'privacy' পেতে চাই কিন্তু তা দিতে জানিনা। তাই বলি আমরা হয়তো কিছু শব্দ শিখেছি, তা বলতে শিখেছি কিন্তু তা ধারণ করতে শিখিনি কারণ এসব আমাদের যাপিত জীবনের অংশই নয়। তাই এদের যত্রতত্র ব্যবহারকে খুব বেমানান লাগে, বেখাপ্পা লাগে।
এই সবই তো ভাষা আগ্রাসনের উদাহরণ, জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার, বদলে দেবার প্রয়াস। তাই ৪৭ বা তার অব্যবহিত পরে সে যুগের তথাকথিত 'কবি'র লেখা 'ভাঙিল জিন্দান, টুটিল জিঞ্জির/ আগে চল্ আজাদ রাহাগীর' এর সাথে ২০২২ এর ভাষাদিবসে এ যুগের তেমনি এক তথাকথিত 'কবি'র লেখা 'দেশে কিংবা ফরেনে/বাংলা কালচার থাকে আমার প্রাণে'র মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখিনা। এই অদ্ভুতুড়ে ভাষা ব্যবচ্ছেদ আর যাই হোক ভাষাচর্চা নয় আর তা বাংলা ভাষার জন্য কল্যাণকর নয় মোটেই। কখনও রাজনীতি, কখনও ধর্ম, কখনও বা বিশ্বায়নকে অজুহাত করে কিংবা কখনও আর্থসামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি বানিয়ে বাংলা ভাষার বানান, তার বর্ণমালাকে বিকল বা বিনাশ করবার প্রয়াস হয়েছে বারবার। সেই প্রয়াস কখনও সুচিন্তিত, পরিকল্পিত, কখনও আবার নিতান্তই অনাদরে, অবহেলায় আর বেশ খানিকটা হীনমন্যতায়। যে ভাষার পরিচয় দিতে আমরা 'মাতৃ' শব্দটা জুড়ে দেই, একবারও কী ভাবি সেই ভাষার ওপর অমন অত্যাচার চালানো যায় কি? তাকে অতটা পীড়ন করা শোভা পায় কি?
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই নানান উদযাপনে বাংলা বর্ণমালাকে 'দুঃখিনী বর্ণমালা' হিসেবে উপস্থাপন করে আবেগের বন্যা বয়ে যায় কিন্তু এতে সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষার দুঃখ দূর হয় কি? প্রতিদিনকার জীবনে বাংলা বর্ণমালার চর্চা বজায় রাখার প্রয়াসে বাংলা হরফে, সঠিক বাংলা বানানে লেখার অভ্যাস চালু করলে বরং 'দুঃখিনী বর্ণমালা'র দুঃখ ঘুচলেও ঘুচতে পারে আর তা আমাদেরকেই মহিমান্বিত করবে। 'বাংলায় কাঁচা' শব্দবন্ধে গৌরব বোধ না করে বরং প্রতিনিয়ত বাংলা বলায়, লেখায় কিংবা উচ্চারণের অযুত ভুলগুলিকে শুদ্ধতার চর্চায় সামিল করে বাংলা ভাষার এই যথেচ্ছ ব্যবচ্ছেদকে প্রতিহত করবার একান্ত প্রয়োজন আছে বলেই বোধ হয়। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলাকে ঘিরে আমাদের এই বাৎসরিক মাসব্যাপী সাময়িক আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং সারা বছর জুড়ে বাংলাকে ঘিরে আমাদের যে অবহেলা আর হীনমন্যতাকে সরিয়ে রেখে, বাংলা ভাষাকে সত্যিকার অর্থে এই জনপদের উপযোগিতার ভাষা করে তুলতে হবে। বাংলা ভাষা তার হৃদপিঞ্জরে বাঙালির হাজার বছরের জাতিগত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাস ধারণ করে আছে। একে আঘাত করা বা এর ওপর যথেচ্ছ জবরদস্তি করা মানেই জাতির মর্মমূলে আঘাত করা, তার অস্ত্বিত্ব ধ্বংস করবার প্রয়াসের নামান্তর। '… যদি বঙ্গদেশের উন্নতি চাও, যদি বঙ্গভাষার প্রাধান্য দেখিতে চাও, যদি মঙ্গলময়ের ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চাও, তবে ভাষাব্যবচ্ছেদ হইতে বিরত থাকো' – সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী "মাতৃভাষা ও জাতীয় উন্নতি" গ্রন্থে উদ্ধৃত খানবাহাদুর আহছানউল্লার এই উক্তিটি আজকের দিনেও ভারী প্রাসঙ্গিক বলে আমার বিশ্বাস।
এ পর্যায়ে কেউ কিন্তু ভেবে বসবেন না যে আমি অন্য ভাষা শিক্ষার বিরোধিতা করছি। একেবারেই তা নয়। নিত্য নতুন ভাষা শেখার মাধ্যমে শুধু যে সংযোগের নানান বৈশ্বিক দুয়ার উন্মুক্ত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয় তা-ই নয়; এর সাথে দেখবার, জানবার আর বুঝবার যে মানসচক্ষু তাও খুলে যাবার বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই প্রেক্ষিতে দুটি বিষয় মনে রাখা অতীব জরুরী । প্রথমত, একটি ভাষাকে সম্যকভাবে শিখতে গেলে, বুঝতে গেলে, সেই ভাষার সূক্ষ্ম দ্যোতনাসমূহকে অনুধাবন করতে হবে। আর সেই কাজটা ঠিক ভাবে করবার জন্য যেই সংস্কৃতির কোলে সেই ভাষার জন্ম, তার অনুসন্ধান করতে হবে চিন্তায় আর মননে। ভাষাকে তার মূল সংস্কৃতির প্রেক্ষিত দিয়ে বুঝতে হবে, সেই সংস্কৃতির ভেতরকার দর্শনকে উপলব্ধিতে আনবার প্রয়াস থাকতে হবে। আর তা না করলে সেই ভাষাজ্ঞান শুধুমাত্র অভিধানে বর্ণিত শব্দভান্ডার হয়েই থেকে যাবে। সেই ভাষাচর্চাতে মনের ভাব আর মুখের বুলির মেলবন্ধন ঘটবেনা। আর দ্বিতীয়ত নিজের ভাষাকে ঠিকভাবে আয়ত্ত্ব না করলে, নিজের সংস্কৃতির প্রেক্ষিত আর ভাব-দর্শনকে না চিনলে অন্য ভাষা শিক্ষাও অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিটি সংস্কৃতি আর সেই সংস্কৃতিজাত ভাষা যেমন আলাদা ঠিক তেমনি একটি সংস্কৃতির নিজস্বতাতেও সমরূপতা নয় বরং বহুরূপতা থাকে। আর সকল সাংস্কৃতিক উপাদান সমূহের মতো ভাষার সব উপাচারও সমসত্ত্ব নয় বরং এতে বিবিধতা আছে, আছে একের মধ্যে বহুত্ব। আর ভাষা শেখায়, বলায়, এর চর্চায় এই বোধকে কাজে লাগাতে হবে নয়তো তা অদৃশ্য অক্ষের চারপাশে উদেশ্যহীন এক পরিক্রমণে পরিণত হবে।
এ কথা সত্যি যে বিশ্বায়নের এই যুগে বাঙালিকে অন্য ভাষা বিশেষত ইংরেজি শিখতেই হবে নয়তো নানান সম্ভাবনার দুয়ার তার জন্য বন্ধই থেকে যাবে। সে কারণেই ইংরেজি ভাষা শিক্ষা আজ আর বাঙালির কাছে বিলাসিতা নয় বরং বাস্তবতা, বাহুল্য নয় বরং প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু এর মানে এই নয় যে তাকে তার মাতৃভাষা বাংলাকে বিসর্জন দিয়ে ইংরেজিকে গ্রহণ করতে হবে। 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে. যাবে না ফিরে' এই কথার মাঝে আমি ভাষা শিক্ষার মূল সূত্র খুঁজে পাই। মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে কিংবা তাকে বিসর্জন দিয়ে আর যাই হোক ইংরেজি ভাষায় দিগগজ হওয়া যাবেনা আর সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে ওঠাও হবেনা।
আজ থেকে প্রায় ১৪০ বছর আগেও রবীন্দ্রনাথ জানতেন আর মানতেন যে বাঙালিকে ইংরেজি শিখতেই হবে। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজিতে শিক্ষা কখনই সমগ্র দেশে সমান ভাবে সম্ভব হবেনা, এ শিক্ষা সমস্ত বাঙালির শিক্ষা হয়ে উঠতে পারবেনা কোনকালেই, তাই বরং তিনি ইংরেজি শিক্ষালব্ধ জ্ঞানকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে নিজে যেমন আগ্রহী ছিলেন তেমনি অন্যদেরকেও আহ্বান জানিয়েছিলেন। শিক্ষায় ইংরেজি ও বাংলায় আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেই ১৮৮৩ সালে রবি ঠাকুর বলেছিলেন 'ইংরেজিতে যাহা শিখিয়াছ, তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলাসাহিত্য উন্নতিলাভ করুক ও অবশেষে বঙ্গ-বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক। ইংরাজিতে শিক্ষা কখনই দেশের সর্বত্র ছড়াইতে পারিবে না'। দুনিয়াময় তাবড় তাবড় ভাষাবিদেরা বারবার এই কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন যে মাতৃভাষার ভিত শক্ত না হলে তার ওপর অন্য ভাষা শিক্ষার কাঠামো গড়েই তোলা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থে সেই কথাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পুনর্ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে 'ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। …… বাঙালির পক্ষে ইংরেজি-শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই'। আবার এই গ্রন্থেরই আরেক জায়গায় বলেছেন '…আমার ইংরেজি-শিক্ষার সেই আদিম দৈন্য সত্বেও পরিমিত উপকরণ নিয়ে আমার চিত্তবৃত্তি কেবল গৃহিণীপনার জোরে ইংরেজি-জানা ভদ্রসমাজে আমার মান বাঁচিয়ে আসছে। নিশ্চিত জানি, তার কারণ – শিশুকাল থেকে আমার মনের পরিণতি ঘটেছে কোনো ভেজাল-না-দেওয়া মাতৃভাষায়।'
তাই বলি, মাতৃভাষাকে ব্যবচ্ছেদ করে নয়, বিসর্জন করে নয়, তাকে নিয়ে একমাসের গৌরব আর বাকি এগারো মাসের হীনমন্যতাকে ঝেড়ে ফেলে বাঙালিকে শেকড় আঁকড়ে ধরে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখতে হবে, নিজের মাটিতে নোঙর ফেলে চিন্তার আধুনিকতায় মুক্ত হতে হবে। সত্যিকার অর্থে বিশ্বনাগরিক হতে গেলে নিজের আত্মপরিচয় ভুলে নয় বরং নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে জেনে, বুঝে, তাকে মনে আর মননে ধারণ করতে হবে। ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগের আদিখ্যেতায় উৎসবের উদযাপন হয়, বাজার অর্থনীতির মুনাফা হয়, তার চাইতে অনেক গভীর করে রচিত হয় আত্মঘাতী এক বৃত্ত। মাতৃভাষাকে ঘিরে বাঙালির আবেগের এই আতিশয্যে হয়তো একরকমের জাতিগত আত্মতুষ্টি আছে কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি করে আছে সামষ্টিক আত্মপ্রবঞ্চনা, তা কী কখনও ভেবে দেখেছি আমরা?