Published : 23 Feb 2022, 09:21 PM
'দারিদ্র্য' বনাম 'দরিদ্রতা' বনাম 'দারিদ্র্যতা'। এর তিন শব্দের মধ্যে কোনটি 'শুদ্ধ'? 'পরবর্তীতে' কিংবা 'ফলশ্রুতি' এই দুই শব্দ কেন শুদ্ধ নয়? 'সাড়া ফেলা'- এই সংযোগমূলক ক্রিয়াটির পরিবর্তে কেন 'সাড়া জাগানো' বলতেই হবে? একাধিক বুজর্গ মনে করেন, 'পরবর্তীতে', উপরোক্ত কিংবা 'ফলশ্রুতি' শুদ্ধ শব্দ নয়। বর্তমান আলোচনায় আমরা এই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করবো। যদিও এ রকম শব্দ আরও অনেক আছে বাংলা ভাষায়, আপাতত, এই পাঁচটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করলেই আমার দিক থেকে অন্তত অনেকটুকু দরকারি কথা বলা হয়ে যাবে।
প্রদীপ জ্বালানোর পূর্বে কমপক্ষে দুটি সলতে পাকিয়ে নিই। প্রথমত, পৃথিবীতে যত সত্তা বা এনটিটি আছে, সেগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে: ১. বাস্তব বা অন্টোলজিক্যাল, ২. জ্ঞানগত বা এপিস্টেমোলজিক্যাল এবং ৩. প্রয়োজনগত বা টেলেওলজিক্যাল। 'কলম', 'টেবিল', 'নদী', 'পাহাড়' এগুলো বাস্তব সত্তা। শূন্য বা ইথার জ্ঞানগত সত্তা, কারণ নিছক জ্ঞানচর্চার জন্যে এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে। পরলোক-আত্মা ইত্যাদি প্রয়োজনগত সত্তা। জ্ঞানগত ও প্রয়োজনগত সত্তাগুলো সবসময় ছিল না, বিশেষ প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজনে মানুষ কালক্রমে এই ধারণাগুলো সৃষ্টি করেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই জ্ঞানগত এবং প্রয়োজনগত সত্তাগুলো পরিত্যক্ত হয়। এর প্রমাণ, আজ আমরা জানি, 'ইথার' বলে কিছু নেই, যদিও এই সত্তাটির কথা শৈশবে বিজ্ঞান বইয়ে আমরা পড়েছি।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষ এবং বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা শব্দবিশেষকে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ মনে করলেও ভাষাবিজ্ঞান মতে শব্দ বা বাক্যের শুদ্ধ/অশুদ্ধ বলে কিছু নেই। ভাষাবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে একটি শব্দ কিংবা বাক্য প্রতিযোগী একটি শব্দ কিংবা বাক্যের তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য কিংবা তূলনামূলকভাবে কম গ্রহণযোগ্য হতে পারে। একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়- এমন শব্দ ও বাক্য মানুষ সাধারণত মাতৃভাষায় উচ্চারণ করে না। সব ভাষাতেই তথাকথিত 'অশুদ্ধ' শব্দ আছে। বাংলা 'সততা' শব্দের কথাই ধরা যাক। 'সৎ' বিশেষণের সঙ্গে {তা} প্রত্যয় যোগ করলে আমরা পাবো 'সত্তা'। দুই 'ত' এর মধ্যে স্বরের আগম হয়ে 'সততা' (উচ্চারণ 'সতোতা') কেন হবে? শব্দটি নিঃসন্দেহে অশুদ্ধ, কিন্তু কার সাধ্য আছে এই অশুদ্ধ শব্দটিকে বাদ দিয়ে 'ভালো মানুষ' অর্থে শুদ্ধ 'সত্তা' শব্দকে চালু করার? এ ধরনের কিছু শব্দ 'আর্ষ' অর্থাৎ ঋষিদের প্রয়োগ কিংবা 'নিপাতনে সিদ্ধ' বলে গোঁজামিল দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হতো সংস্কৃত ব্যাকরণে, তার দেখাদেখি বাংলায়।
কীসের ভিত্তিতে সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা কোনো শব্দকে 'শুদ্ধ' কিংবা 'অশুদ্ধ' বিবেচনা করতেন? খ্রিস্টপূর্ব কালের বৈয়াকরণ পাণিনি 'কল্পনা' করেছিলেন, শব্দের চেয়ে ক্ষুদ্রতর কিছু উপাদান, যেমন, ধাতু, বিভক্তি, প্রত্যয় ইত্যাদি যোগ করে শব্দ গঠিত হয়। পাণিনির এই কল্পনায় দুটি সমস্যা আছে। প্রথমত এই উপাদানগুলো বাস্তব বা অন্টোলজিক্যাল কোনো উপাদান নয়। এগুলো নিছকই জ্ঞানগত বা প্রয়োজনগত উপাদান, যার মানে হচ্ছে, উপাদানগুলো অপরিহার্য নয়। দ্বিতীয়ত, এগুলো দিয়ে বেশির ভাগ শব্দের গঠন ব্যাখ্যা করা গেলেও, অনেক শব্দকেই, আমরা যেমনটা উজানে দেখেছি, এই উপাদানগুলোর যোগফল হিসেবে দেখানো যায় না। 'হংস' শব্দটি {হন} ধাতু থেকে সাধিত বলে দাবি করা হয়। বেচারা হাঁস আবার কাকে হনন করে? 'মাংস' শব্দে আছে {মন} ধাতু। 'মাংস' শব্দের সঙ্গে 'মন' এর কী সম্পর্ক? 'সিংহ' শব্দটি নাকি {হিনস} ধাতু থেকে সাধিত। শব্দটি কেন 'হিংস' নয়? 'স' আর 'হ' বর্ণবিপর্যয় হয়ে {হিনসঅ} নাকি হয়ে যায় 'সিনহঅ'। বর্ণবিপর্যয়ের পিছনে কারণটা কী, সিংহের কামড়, নাকি থাবার আঘাত? অন্ততপক্ষে এই শব্দগুলো আদৌ কোনো ধাতু থেকে সাধিত নয় এবং পাণিনিও স্বীকার করেছেন, সব সংস্কৃত শব্দকে ধাতু-প্রত্যয়/বিভক্তিতে বিশ্লেষণ করা যায় না।
ধরা যাক, {দরিদ্র} প্রাতিপদিকের সঙ্গে {য়} প্রত্যয় যোগ করে গঠিত হলো 'দারিদ্র্য'। আবার একই {দরিদ্র} প্রাতিপদিকের সঙ্গে {তা} প্রত্যয় যুক্ত করে গঠন করা যায় 'দরিদ্রতা'। কেউ বলতে পারেন, 'দারিদ্র্য' যেহেতু আছে, 'দরিদ্রতা' শব্দ গঠনের কী দরকার? দরকার নিশ্চয়ই আছে, নইলে শব্দ গঠিত হবে কেন? একটি শব্দ থাকা সত্তেও সমার্থক আরেকটি শব্দ তৈরি হতেই পারে, বাংলা কিংবা যে কোনো ভাষায়। 'বন্ধুত্ব' থাকা সত্ত্বেও কি 'বন্ধুতা' শব্দ তৈরি হয়নি বাংলা ভাষায়, সুমনের গানে: 'চাইছি তোমার বন্ধুতা'? 'সেনা' এবং 'সৈন্য'- এই দুই সমার্থক শব্দ বাংলায় আছে, প্রথমটির শেষে {য়} প্রত্যয় যুক্ত করে দ্বিতীয়টির সৃষ্টি।
'সবই মানতে পারি, কিন্তু 'দারিদ্র্যতা' শব্দটিতো কোনো মতেই মানা যায় না!'- বলতে পারেন আমাদের বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ। {দরিদ্র} প্রাতিপদিকের সঙ্গে {য়} প্রত্যয় যুক্ত করে একবার 'দারিদ্র্য' বিশেষ্য গঠন করার পর, পুনরায় সেই সাধিত বিশেষ্যটির সঙ্গে {তা} প্রত্যয় যুক্ত করে কেন সমার্থক আরেকটি বিশেষ্য গঠন করতে হবে? এর উত্তরে আমরা খান সাতেক যুক্তি দেবো। প্রথমত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শব্দ কেউ গঠন করে না, শব্দ নিজে থেকেই গঠিত হয়ে যায়। এর ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক কারণ নিশ্চয়ই আছে। 'য়' অন্ত একাধিক প্রাতিপদিক, যেমন, 'বশ্য', 'মান্য', 'বাধ্য' ইত্যাদির সঙ্গে {তা} প্রত্যয় যুক্ত হয়ে থাকে বাংলায়। এটা ঠিক, যে 'বশ্য', 'মান্য' ইত্যাদি বিশেষ্য নয়, কিন্তু যে বাংলাভাষী 'দরিদ্রতা' শব্দটি গঠন করেন, তিনি হয়তো অবচেতনে 'দারিদ্র্য' কে শব্দ নয়, পদহীন প্রাতিপদিক বিবেচনা করে তার সঙ্গে {তা} প্রত্যয় যুক্ত করেন, 'বশ্যতা', 'বাধ্যতা' ইত্যাদি শব্দের অনুকরণে।
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন বাংলায় {সখ্য} এর সঙ্গে {তা} প্রত্যয় যুক্ত করে 'সখ্যতা' গঠিত হয়েছিল। শব্দটি 'ভুল' কিংবা 'অশুদ্ধ'ই হওয়া উচিত, প্রথাগত বৈয়াকরণদের বিবেচনায়। কেন যে মানুষ তথাকথিত ভুল তথা অশুদ্ধ শব্দ গঠন করে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে, কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে এই যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন শব্দ গঠন করেছেন, আমরাও করছি। তৃতীয়ত, 'দারিদ্র্যতা' শব্দকে আপনি ভুল বলতে পারেন, কিন্তু এ ধরনের শব্দ যে গঠিত হয়ে থাকে, সেটা অস্বীকার করবেন কী করে? বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানকে 'জারজ' বলে আপনি ঘৃণা করলেই সেই সন্তান মরেতো যায় না! চতুর্থত, স্বল্পসংখ্যক উন্নাসিক লোকের বিরক্তি উৎপাদন করা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষতি যাতে হচ্ছে না, কোন যুক্তিতে এবং কীভাবে মানুষের এমন একটি ঐতিহাসিক এবং স্বাভাবিক প্রবণতা বন্ধ করা যাবে? পঞ্চমত, 'ভুল! অশুদ্ধ!' বলে তারস্বরে চিৎকার করলেই কি ভাষায় তথাকথিত অশুদ্ধ শব্দ গঠিত হওয়া বন্ধ হবে, হয়েছে কখনও অতীতে, বাংলা কিংবা অন্য কোনো ভাষায়?
ষষ্ঠত, 'দারিদ্র্যতা' শব্দকে যারা ভুল বলছে, তারা বিশ্বাস করে, {য়} এবং {তা}- এই দুটি প্রত্যয় আছে এবং তারা এও বিশ্বাস করে যে {য়} প্রত্যয়ান্ত বিশেষ্যের সঙ্গে {তা} যোগ করে বিশেষ্য গঠন করা উচিত নয়। এই বিশ্বাসতো সর্বৈব ভুলও হতে পারে। প্রত্যয় নামক সত্তা যে পাণিনির কল্পনা মাত্র এবং {য়} বা {তা} যে বাস্তবের কোনো (অন্টোলজিক্যাল) বস্তু নয়, সে ব্যাপারটা আমাদের পণ্ডিতদের মাথাতেই আসে না। সপ্তমত, বিশেষ্য থেকে বিশেষ্য শব্দ গঠিত হওয়াটা যদি অভূতপূর্ব কোনো ব্যাপার না হয়ে থাকে বাংলা ভাষায়, তবে 'দারিদ্র্য' এবং 'দারিদ্র্যতা' উভয় শব্দকে গ্রহণযোগ্য মনে করাতে সমস্যা কী?
'পরবর্তী' একটি বিশেষণ এবং এর সঙ্গে {তে} প্রত্যয় যুক্ত করে গঠিত হয় ক্রিয়াবিশেষণ 'পরবর্তীতে'। পণ্ডিতদের মতে এই শব্দটি নাকি অশুদ্ধ। 'পরে' কিংবা 'পরবর্তী কালে' বলা যেতে পারে, কিন্তু 'পরবর্তীতে' কদাপি নয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, 'পরবর্তী' শব্দকে কেন নিছক বিশেষণ হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে 'পরবর্তী কালে' জাতীয় শব্দবন্ধে? বাংলা ভাষায় বিশেষণের সঙ্গে কি {তে} প্রত্যয় যুক্ত হয় না? 'আমার ভালোতে লোকের কী যায় আসে?' বাক্যে 'ভালো' বিশেষণের সঙ্গে কি {তে} প্রত্যয় যুক্ত হয়নি? 'পরবর্তীতে' শব্দ খুব ব্যবহার হয় বাংলায় এবং এই শব্দটি গঠিত হয়েছে, কারণ প্রথমত, 'পরে' এবং 'পরবর্তী কালে' কথা দুটির সঙ্গে এর অর্থের পার্থক্য আছে, এবং দ্বিতীয়ত, সম্ভবত, দ্বিভাষী বাঙালির মনে ইরেজি 'সাবসিকোয়েন্টলি' ক্রিয়াবিশেষণের একটি বাংলা প্রতিশব্দের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
এককালে 'ফলশ্রুতি' শব্দের অর্থ ছিল '(ধর্মকথা) শোনার ফল'। কিন্তু এই অর্থই কি স্থির থাকবে অনন্তকাল? এককালে 'উদার' শব্দের অর্থ ছিল 'এমন একটি প্রাণী যার বড় উদর বা পেট আছে', অর্থাৎ 'ঘোড়া'। এখন 'উদার' শব্দের অর্থ 'যার বড় হৃদয় আছে'। আমরা কি 'অশ্ব' অর্থে 'উদার' শব্দটিকে আর ব্যবহার করতে পারবো? একই ভাবে 'ফলশ্রুতি' শব্দের অর্থ আগে যাই থাক, হাল আমলের অর্থ: 'কাজের পরিণাম'। কোন যুক্তিতে আমরা শত শত বৎসর আগের অর্থ ধরে 'কনসিকোয়েন্স' অর্থে 'ফলশ্রুতি' শব্দটিকে ব্যবহারে বাধা দেবো? 'বহতা নদী, রমতা সাধু।' হিন্দি প্রবাদ। ভাষাও স্বতঃপরিবর্তনশীল, শব্দের রূপ ও অর্থ প্রতি মুহূর্তে বদলাচ্ছে, যদিও সিনেমায় প্রতি সেকেন্ডে পরিবর্তিত ২৪ ফ্রেমের মতো আমরা সেই পরিবর্তন খেয়াল করছি না।
মরণশীল মানুষ একান্তই নিজের প্রয়োজনে ব্যাকরণের জালে ভাষাকে বাঁধবার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু 'কাল' ও 'বৈচিত্র্য' নামক দুই নেংটি ইঁদুর সেই জাল কেটে ভাষাসিংহকে বার বার মুক্ত করে দেয়। এভাবেই চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। তথাকথিত ভুল বানান যারা লেখে, ভুল উচ্চারণ যারা করে তাদের কারণেই ভাষার পরিবর্তন হয়। পরিবর্তনই ভাষার প্রাণভোমরা। সর্বযুগে সবাইকে শুদ্ধ লিখতে, বলতে বাধ্য করতে চেষ্টা করে থাকেন পণ্ডিতেরা। খ্রিস্টপূর্ব যুগেও পণ্ডিতেরা বলেছেন, নতুন প্রজন্ম ভাষাকে নষ্ট করে ফেলছে। ভাষার বাপের ভাগ্য যে সর্বদেশে, সর্বকালে পণ্ডিতেরা সংখ্যালঘু ছিলেন। কারণ আপামর জনসাধারণকে যদি এক প্রকার শুদ্ধ উচ্চারণ করতে বাধ্য করানো সম্ভব হয়েই যায়, তবে ভাষা আর বদলাবে না, চিরকালের মতো স্থির হয়ে যাবে। 'যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে!' ভুল বলিয়ে, ভুল লিখিয়ে মূর্খ লোকজনের সংখ্যা সর্বদেশে সর্বকালে বেশি থাকে বলেই পরিবর্তিত হতে হতে ভাষা বেঁচে থাকে। মূর্খদের সংখ্যাবাহুল্যের কারণে ভুল বানান, ভুল উচ্চারণ কালক্রমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলেই শ পাঁচেক বছর আগের ইংরেজি আর আজকের ইংরেজির বানান, শব্দ ও বাক্যগঠনে এত পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করতে পারি। সব ভাষার ক্ষেত্রেই এই কথা সত্য প্রমাণিত হবে।
তার মানে কি ভুল বলা, ভুল লেখাকে উৎসাহিত করতে হবে? অবশ্যই না। তবে একটি শব্দ বা বাক্যরীতি অশুদ্ধ হবার কারণটা আগে নির্ধারণ করতে হবে। দেখতে হবে, কারণটা যৌক্তিক, নাকি ব্যক্তিবিশেষের মনগড়া কুসংস্কার কিংবা অজ্ঞতাপ্রসূত। উচ্চারণ, ব্যুৎপত্তি, ঐতিহ্য, অভ্যাস- বানানের এই চার নিয়ামকের মধ্যে কোন কোনটিকে প্রাধ্যান্য দিতে হবে, সেটা পণ্ডিতেরা বিচার করে দেখবেন। প্রতিটি নিয়ম যুক্তিসম্মত হতে হবে এবং কোনো নিয়মকেই জোর করে চাপিয়ে দেবার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। দেখতে হবে, কোন কোন শব্দের বানানে বিকল্প আছে এবং সেই বিকল্প প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত বহাল রাখতে হবে।
'সাড়া ফেলা'- একটি সংযোগমূলক ক্রিয়া। 'সাড়া' বিশেষ্য হচ্ছে ক্রিয়াটির 'মেরু' এবং 'ফেলা' ক্রিয়া হচ্ছে এর 'বাহক'। যে অল্প কয়েকটি ক্রিয়া বহু মেরুর সঙ্গে বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাংলা ভাষায়, 'ফেলা' তার মধ্যে একটি ('দেখে ফেলা', 'করে ফেলা', 'শুনে ফেলা' … এমন শত শত যৌগিক ক্রিয়া আছে বাংলায়)। এই বিশেষ বাহকটি 'হঠাৎ করে কিছু করা' বোঝায়। 'জাগানো' ক্রিয়াও বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হতে বাধা নেই, তবে কিনা বাহক হিসেবে খুব একটা ব্যবহৃত হয় না এই ক্রিয়াটি, অন্ততপক্ষে 'ফেলা'র তুলনায় এর ব্যবহার কমতো বটেই। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে 'সাড়া ফেলা' না বলে কেন 'সাড়া জাগানো' বলতেই হবে, কিংবা কেন দ্বিতীয়টির তুলনায় প্রথমটি কম গ্রহণযোগ্য হবে। একজন ব্যক্তির বিবেচনায়, বিশেষ একটি ক্রিয়ার বিশেষ ব্যঞ্জনা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা থাকতেই পারে, কিন্তু একক ব্যক্তির বিবেচনা ভাষা কিংবা ব্যাকরণের নিয়মের নির্ধারক হতে পারে না।
'উপরোক্ত', 'নিম্নোক্ত', 'পূর্বোক্ত'- এই তিনটি শব্দের মধ্যে কেবল প্রথমটিকে ভুল সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এর পরিবর্তে 'উপর্যুক্ত' লেখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর কারণ কী জানতে ইচ্ছে হতেই পারে। সংস্কৃত প্রাতিপদিক 'উপরঃ' (ধরা যাক, উচ্চারণ 'উপরঅ') এর সঙ্গে 'উক্ত' শব্দ যোগ করলে সন্ধির নিয়মে অ(হ)+উ = র্যু হয় বটে। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষা লিখছি, বলছি, সংস্কৃত নয়। 'উপর-নীচ' বলার সময় আমরা কি 'উপরঅ-নীচঅ' উচ্চারণ করি বাংলায় উড়িয়াদের মতো? যদি অন্তে অ-হীন 'উপর' এর সঙ্গে 'উক্ত' যোগ হয় তবে আমরা পাবো (র+উ= রু) 'উপরুক্ত'। এই বানান বা উচ্চারণের প্রস্তাব আমাদের প-িতেরা করেননি, কারণ তেনাদের মাথায় ঢুকে আছে সংস্কৃত ব্যাকরণের ভূত।
'উপরোক্ত' শব্দ কোন প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে সেই কথাটি বলি। যদি কারও শব্দকোষে একই রূপগত বৈসাদৃশ্য, অর্থগত সাদৃশ্য এবং পদ/শ্রেণীগত বৈসাদৃশ্য আছে এমন কমপক্ষে দুটি শব্দজোড় থাকে, তবে সেই শব্দজোড়ের ভিত্তিতে তার মস্তিষ্কের রূপতাত্ত্বিক উপাঙ্গ বা মডিউলে একটি রূপকৌশল বা শব্দগঠন কৌশল সৃষ্টি হবে, যা দিয়ে প্রয়োজনে নতুন শব্দ গঠন করা যাবে, পুরনো শব্দ স্মরণ করা যাবে এবং নতুন শব্দ বোঝা যাবে। নিম্নে <—> নিম্নোক্ত; পূর্বে <—> পূর্বোক্ত। এই শব্দজোড়টি বাঙালির শব্দকোষে আছে, কারণ 'পূর্বোক্ত' এবং 'নিম্নোক্ত' এই দুটি শব্দই গ্রহণযোগ্য। এই দুই শব্দকোষের ভিত্তিতে বাঙালির রূপতাত্ত্বিক উপাঙ্গে যে রূপকৌশলটি সৃষ্টি হতে পারে, সেটির চেহারা হবে এ রকম: /Xএ/<—> /Xওক্ত/। এখানে চলক বা ভ্যারিয়েবল X হচ্ছে 'নিমন্' কিংবা 'পূরব্' যার সঙ্গে 'ওক্ত' ধ্রুবক বা কনস্ট্যান্ট যুক্ত হচ্ছে। উপরের রূপকৌশলে 'নিম্নে' শব্দ 'পার্স' বা প্রক্ষেপ করলে পাওয়া যাবে 'নিম্নোক্ত'। এই একই রূপকৌশলে 'উপরে' শব্দ পার্স করলে আমরা পাবো 'উপরোক্ত'। একেবারে সোজা অঙ্কের হিসাব, পাণিনি কিংবা সংস্কৃত ব্যাকরণের রাজ্যের ফালতু প্যাঁচালে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের।
'উপরোক্ত' নিয়মের মূলে আছে মানব মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি 'অ্যানালজি' যাকে বাংলায় আমি বলি: 'অনুসার'। শব্দগঠনের এমন নিয়মের দাবি সস্যুর করেছেন ১৯১৫ সালে, তবে মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহ ও অ্যালান ফোর্ড এই দাবিকে অধিকতর পূর্ণতা দিয়েছেন। এরও আগে খ্রিস্টপরবর্তী ১০০-৪০০ শতকে গ্রেকো-রোমান যুগের ব্যাকরণে অনেকটা এ জাতীয় উপায়েই শব্দগঠনের নিদান দেয়া হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে পাণিনির ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচয়ের পর ইওরোপ এবং তার দেখাদেখি ইওরোপের লেজুড় আমরা রূপতত্ত্বের এই ধারাটিকে বিস্মৃত হয়েছি।
বাঙালির জাতীয়তাবোধ বড় অদ্ভুত। 'মাস্ক' বলতে যার আপত্তি, 'ইরাদা' বলতে পেরে সে খুশি। এই লোকেরাই আবার আজকালকার ছেলেমেয়েদের দোষ দেয় এই বলে যে বাংলা বলা বা লেখার সময় তারা হিন্দি বা ইংরেজির অনুকরণ করে, অকারণে হিন্দি, ইংরেজি ও আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে প্রমিত ভাষার মানের বারোটা বাজায়, যে মান নাকি আবার অবিনশ্বরও। এদের কী করে বোঝাই যে এ জাতীয় দুষ্কর্ম গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে করেছেন, আক্ষরিক অর্থে। 'যেথায় তোমার রূপ হতেছে' কথাটা দিয়ে শুরু হয়েছে এক রবীন্দ্র সংগীতে। 'বালকদলে করতেছে চিৎকার' বা অনুরূপ কোনো পঙতি পড়েছি বলে মনে পড়ছে ওঁর এক কবিতায়। 'হতেছে' কিংবা 'করতেছে' কি প্রমিত বাংলার ক্রিয়ারূপ? এখানেই শেষ নয়। ৭ই মার্চ, ১লা বৈশাখ, ১৬ই ডিসেম্বরের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ৭ মার্চ, ১ বৈশাখ, ১৬ ডিসেম্বর, বাংলা ব্যাকরণের নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, হিন্দি-ইংরেজির অনুকরণে, জাপানযাত্রীর পত্র এবং অন্যান্য রচনায়। বাঙালি নতুন প্রজন্ম গুরুকার্য শিরোধার্য করে 'এক বৈশাখ', 'সাত মার্চ লিখছে, বলছে। তাদের অভিভাবকেরা ৭ মার্চ নামে এক ভবন খাড়া করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে।
কিছুটা অপ্রসাঙ্গিক হলেও বলি, ধর্মীয়, ইসলামী ঐতিহ্যের কারণে 'আলহামদুলিল্লাহ' বলা যেমন বাংলা ভাষার অংশ হয়ে গেছে, তেমনি প্রথমত, অতীতের উপনিবেশায়ন এবং বর্তমানের বিশ্বায়নের কারণে 'নো মাস্ক, নো সার্ভিস' বলাও একসময় অভ্যাস হয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে 'হরফুন মৌলা'র মতো আরবি-ফার্সি শব্দবন্ধ বাংলা শব্দকোষের অংশ হয়ে গেছে, কোনো এক কালে ফার্সি ভারতবর্ষের দাপ্তরিক ভাষা ছিল বলে। 'মুখোশ' শব্দের যে ব্যঞ্জনা বাংলায় আছে, সেটা কি 'মাস্ক' শব্দের সঙ্গে যায়? মুখোশ দিয়ে আমরা ঘর সাজাই। পহেলা বৈশাখে মুখোশ নিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা করি। 'ভণ্ডের মুখোশ খুলে দিন!' এর পরিবর্তে 'ভণ্ডের মাস্ক খুলে দিন!' বলে দেখুনতো! 'মুখোশ না পরলে সেবা নেই!' কিংবা অনুরূপ বাক্যাংশ দিয়ে যদি 'নো মাস্ক, নো সার্ভিস' বোঝানোর খায়েশ হতো, তবে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই কৃতঋণ অনুবাদ করার দরকার ছিল। ফরাসি দেশে বস্তু বাস্তবে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার নাম দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নাম দিতে হয়। তড়িঘড়ি করে 'বোচাইয়া', 'কালাইয়া' নাম দিয়ে পরে খেয়াল হবার পর নতুন করে 'পদ্মলোচন' নাম রাখলে সেই নামে কেউ আর ডাকবে না।
'কারণ' এবং 'কারণে' দুটোই শুদ্ধ। পক্ষান্তরে 'ধরণ' অশুদ্ধ, কিন্তু 'ধারণ' শুদ্ধ। কেন? এমন নিয়মতো ভাষাব্যবহারকারীকে দ্বিধাগ্রস্ত করার কথা। বাংলা একাডেমির অভিধানে 'খ্রিষ্ট' এবং 'খ্রিস্ট' পরস্পরের বিকল্প, অর্থাৎ দুটোই শুদ্ধ, কিন্তু 'খ্রীষ্ট' হবে না, কারণ এটা নাকি বিদেশি শব্দ। বাংলা ভাষায় এই শব্দের বয়স চারশো বছরের কম নয়, কিন্তু এখনও এটি বিদেশি শব্দ রয়ে গেছে। কবে আর এটি দেশি হবে? ভাষাবিজ্ঞানের মতে, কোনো ভাষায় বিদেশি কোনো শব্দ থাকতে পারে না, কারণ ভিন্ন ভাষার শব্দ অধমর্ণ ভাষার ফনোলজির নিয়ম না মেনে সেই ভাষার শব্দকোষে ঢুকতেই পারে না।
'সর্বজনীন' নাকি 'সার্বজনীন'? আমরা সবসময় লিখে এসেছি 'সার্বজনীন দুর্গপূজা'। বড় হয়ে শুনলাম, বানানটা নাকি অশুদ্ধ। শুদ্ধ নাকি 'সর্বজনীন'। পরে জানলাম দুটিই নাকি শুদ্ধ, কারণ পাণিনির ব্যাকরণে দুটি শব্দই আছে। সর্বজন + {খ} প্রত্যয় = সর্বজনীন। সর্বজন+ {খঞ} প্রত্যয় = সার্বজনীন। এই {খ} আর {খঞ} নাকি আবার {ইন} প্রত্যয়ের রকমফের। দুই শব্দের নাকি ভিন্ন অর্থও আছে। 'সর্বজনের জন্যে প্রযোজ্য' বনাম 'সর্বজনের দ্বারা সৃষ্ট' বা এ জাতীয় কিছু। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমত, পাণিনি কী বলেছিলেন বা বলেননি, সংস্কৃতে এসব শব্দের কী অর্থ ছিল বা না ছিল, বাংলা ব্যাকরণে আমি কেন তা গ্রাহ্য করবো? তিনিতো আর বাংলা ব্যাকরণ লিখেননি!
দ্বিতীয়ত, {খ}, {খঞ} ইত্যাদি কাল্পনিক প্রত্যয় সংস্কৃতেই ছিল না, বাংলায় কোথা থেকে থাকবে? আমি যখন চাইলে প্রত্যয়ের অস্তিত্বেই অবিশ্বাস করতে পারি, তখনইবা কী করণীয়? 'আভ্যন্তরিন' বানান যদি অশুদ্ধ নাই হবে, কেন আজকাল 'অভ্যন্তরীণ' বানান লিখতে বাধ্য করা হয়? অভ্যন্তর + {খঞ} = আভ্যন্তরীণ হতেই পারে। শুদ্ধ বানান নির্ধারণের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত যেহেতু আনাড়ি লোকজনের অজ্ঞতাপ্রসূত এবং গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া, সেহেতু কেন সেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবো না? আমাদের আপত্তির প্রধান কারণ হচ্ছে, বিকল্প বানান সব সময়ই ছিল। এমন কিছু শব্দকে অশুদ্ধ বলা হচ্ছে, যেগুলো আসলে ভীষণ রকমের শুদ্ধ এবং তাও পাণিনির আমল থেকে।
'উপরোক্ত, দারিদ্র্যতা, আভ্যন্তরীণ, ফলশ্রুতি, সাড়া ফেলেছে এবং পরবর্তীতে'- এই বানানগুলো হরহামেশা লেখা হয়, কিন্তু সমাজে একটি পক্ষ এই বানানগুলোকে 'অশুদ্ধ' বলে বাতিল করে। যে কারণে এই বানানগুলোকে অশুদ্ধ বলা হয়, আলোচনার উজানে সেই প্রতিটি কারণকে খারিজ করা হয়েছে। সুতরাং 'উপরোক্ত' একটি বানানও অশুদ্ধ হবার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। এই দেখুন না, আমি কখনও লিখি 'হওয়ার' এবং কখনও 'হবার' এবং দুটোই শুদ্ধ, পরস্পরের বিকল্প। আমি, অধ্যাপক মনসুর মুসা এবং রাখাল রাহা গত কুড়ি বছর যাবৎ বলে আসছি, তথাকথিত শুদ্ধ বানান: 'উপর্যুক্ত, দারিদ্র্য, অভ্যন্তরীণ, ফল, সাড়া জাগিয়েছে এবং পরবর্তী কালে'র পাশে ঐ বানানগুলো থাকলে ক্ষতি কী? বাংলা ভাষায় লক্ষ লক্ষ শব্দ, কিন্তু মাত্র শ তিনেক শব্দে নাকি এ রকম বিকল্প আছে। 'উপরোক্ত' যেহেতু প্রচলিত, সেহেতু 'উপর্যুক্ত' কে শুদ্ধ ও 'উপরোক্ত' কে অশুদ্ধ ঘোষণা দিলে ভাষাব্যবহারকারী দ্বিধায় পড়বেই পড়বে এবং আখছার দ্বিধায় পড়ছে। এই দ্বিধার 'ফলশ্রুতিতে' বহুবিধ ক্ষতি আছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিসিএস সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে জীবনের গতিধারা চিরতরে পাল্টে যাওয়া।
বিকল্প বানান আর ভুল বানানের মধ্যে তফাৎ আছে। আমি যখন বলি যে কোনো বানানকে 'ভুল' বলা যাবে না, 'কম গ্রহণযোগ্য' বলতে হবে, সেটা আমি সাধারণত বলি বিকল্প বানানের ক্ষেত্রে। 'শিশির' শব্দকে কে 'সিসির', 'ষিষির' এবং 'ছিছির' লিখলে অপেশাদার আমজনতার দৃষ্টিতে যথাক্রমে 'ভুল', 'মহাভুল' এবং 'সাংঘাতিক ভুল' হবে। ভাষাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই তিন বানানকে যথাক্রমে 'অগ্রহণযোগ্য', 'অধিকতর অগ্রহণযোগ্য', 'একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়' বলতে হবে। 'ভুল' আর 'অগ্রহণযোগ্য' কথার অর্থ কাছাকাছি হতে পারে, কিন্তু ব্যঞ্জনা এদের এক নয়। একটা উদাহরণ দিই। 'বিবাহবিহীন শারীরিক সম্পর্ক' কিংবা 'পরকীয়া প্রেম' সকল সমাজেই হয়। কারও বিবৃতিতে এই আচরণ 'জ্বেনা' বা 'পাপ', আবার কারও বিবৃতিতে এই আচরণ 'বিশেষ সমাজে অগ্রহণযোগ্য'। একজন ধর্মযাজক এমন সম্পর্ককে 'পাপ' বলতেই পারেন, কিন্তু একজন মুক্তমনা যুক্তিবাদী মানুষ এই শব্দগুলো ব্যবহার করতেই পারেন না। একইভাবে, একজন পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানীও কোনো শব্দকে 'ভুল' বলতে পারেন না- কেন বলতে পারেন না, সেটা এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে।
বানানের শুদ্ধাশুদ্ধ যারা নির্ধারণ করেন, ফনোলজি, মর্ফোলজি এবং ভাষামনস্তত্ত্বের পরিষ্কার জ্ঞান থাকা উচিত তাদের। 'ভুল' শব্দটিকে অনেকেই 'ভূল' লেখে। 'ভুল লিখিতে ভুল করিও না!' বানান করতে বলা হতো ইন্টারভিউতে, আজ থেকে কয়েক দশক আগে। 'ভুল' শব্দের আমার উচ্চারণে অন্তত দীর্ঘ ঊ আছে, হয়তো অনেকের উচ্চারণেই আছে, যার মানে হচ্ছে, ভুলের কারণটা হয়তো ফনোলজিক্যাল বা ধ্বনিতাত্ত্বিক। তথাকথিত বিদেশি শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তবুও রাস্তাঘাটে, ব্যানারে-পোস্টারে-ফেস্টুনে আমরা 'মিলাদ শরীফ', 'কোরান শরীফ' বানান কেন দেখি? এই ভাষিক আচরণের পিছনেও ফনোলজি আছে কিনা ভাবতে হবে। এমনও হতে পারে যে দীর্ঘ ঈ বা দীর্ঘ ঊ উচ্চারণ হারিয়ে যায়নি, প্রবলভাবে উপস্থিত সাধারণ মানুষের উচ্চারণে কিংবা এই দীর্ঘ উচ্চারণ হয়তো আবার ফিরে আসছে।
শুদ্ধ-অশুদ্ধের তকমা লাগিয়ে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে না। বানানবিদকে খুঁজে দেখতে হবে, বিশেষ বানান ভুল ঠিক কোন কারণে হচ্ছে। সেই কারণ যদি যুক্তিযুক্ত হয়, তবে বানান পুনর্নির্ধারণের কথাও ভাবতে হবে বৈকি। বানান ঐতিহাসিকভাবে বদলায়, কিন্তু যুক্তিযুক্তভাবে পরিকল্পনা করেও বানান বদলানোতে দোষের কিছু দেখি না। নতুন বানান নির্ধারণের পর নতুন ও পুরনো বানান উভয়কে বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে দিতে হবে কয়েক দশক। পরে, সময়মতো মানুষের প্রবণতা বিচার করে একটি বানান বাদ দেওয়া যেতে পারে অভিধানে বা অন্যত্র।
বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের যারা প্রকৃত ইজারাদার, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বানান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্ত যারা 'ইতিপূর্বে' নিয়েছেন, এখনও নিয়ে থাকেন, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে তাদের উচ্চশিক্ষা নেই, একজনেরও নেই। ডিগ্রি যদি থাকে এবং ভুল সিদ্ধান্ত যদি তারা নিয়ে থাকেন, তবেতো তাদের অপরাধ আরও কয়েক ডিগ্রি বেশি হবে। ডিগ্রিহীনতার প্রভাব যদি তাদের সিদ্ধান্তে না পড়তো, এ নিয়ে আমি আপত্তি করতাম না। সব পেশার ক্ষেত্রে ডিগ্রি থাকতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা হয়তো নেই। ডিগ্রি থাক বা না থাক, ভাষা নিয়ে কিংবা যে কোনো বিষয়ে যে কেউ কথা বলতেই পারেন, কিন্তু ভুল বললে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করলে, আচরণে আনাড়িপনা পরিলক্ষিত হলে, যোগ্যতার প্রশ্ন উঠবে বৈকি। তখন অনধিকারীর ডিগ্রিহীনতা নিয়ে কথা উঠবেই উঠবে, ঠিক যেমন ব্রিজ ভেঙে যাবার পরই দেখা হবে, ইঞ্জিনিয়র বেচারা পাশ করা কিনা। কোয়াক ডাক্তার থাকতেই পারে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল কোনো সমাজে, সবারতো আর ডাক্তারি পড়ার সুযোগ হয় না, কিন্তু কোয়াক যখন রোগী মেরে ফেলে কিংবা উল্টাপাল্টা প্রেসক্রিপশন দেয়, তখন পেশাদারদের পক্ষ থেকে আপত্তি-প্রতিবাদতো আসতেই হবে।
বানানের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ববর্তী বৈয়াকরণ, এমনকি রবীন্দ্রনাথ, রাজশেখর বসুর মতো বড়সড় প্রাতস্মরণীয়েরা বড়সড় সব ভুল করেছেন এবং তাদের অনেকে, যেমন সুনীতিকুমার বা সুকুমার সেন সে কথা অপকটে স্বীকারও করেছেন। কিন্তু এদের শিষ্যেরা একবার গুরুমশায়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নেবার পর 'পরবর্তীতে' তার ভুলস্বীকারকে আর আমলে নেননি। অথচ দেখুন, বিকল্প আছে সব জায়গায়, বাংলা একাডেমির অভিধানে, স্কুলপাঠ্য বইয়ে, কোথায় নয়? পৃথিবী, জীবন বিকল্পময়। বিকল্প একটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে বানানের বিকল্পহীন শুদ্ধতার ভুল ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা ভাষাব্যবহারে অনর্থক দ্বিধার সৃষ্টি করছে- এটা আমার এবং আমার মতো আরও অনেকের দাবি।
১৯৯৬ সালের জুন মাস থেকে আমি ব্যাকরণের জগতে আছি। বানান বিষয়ে দুই বাংলার প্রায় প্রতিটি অনাচারের আমি প্রতিবাদ করেছি, যুক্তি দিয়ে। তথাকথিত বানানবিদদের কেউ কেউ আমার লেখালেখি সংগ্রহ করেন বটে, কিন্তু পড়েন যে সেই প্রমাণ আমি কখনও পাইনি, না তাদের কথায়, না তাদের লেখায়। এই অধমের লেখাটেখা পড়তেই হবে, এমন কোনো মাথার দিব্বি দিচ্ছি না, আরও হাজার বই আছে। জগতের হোক কিংবা ভাষার, যে কোনো ফেনোমেনন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হলে, সে বানানই হোক না কেন, একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাকে বিচার করে দেখা আবশ্যক। ভাষার ক্ষেত্রে বিচিত্র দৃষ্টিকোণের অধিকারী হতে হলে, ব্যাকরণের বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে হবে। যুগন্ধর বাংলা বৈয়াকরণ, যেমন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, শহীদুল্লাহ কখনও তাঁদের লেখায় স্যসুর, চমস্কি এইসব আধুনিক বৈয়াকরণদের কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করেছেন বলে আমার অন্তত চোখে পড়েনি। এর 'ফলশ্রুতি': আমাদের নমস্য বৈয়াকরণেরা চোখ বুঝে একমেবদ্বিতীয়ম্ পাণিনিকে অনুসরণ করেছেন, সংস্কৃত ব্যকরণের ছাঁদে ও ছাঁচে বাংলা ছাত্রপাঠ্য ব্যাকরণ লিখে গেছেন, বানানের শুদ্ধাশুদ্ধও বিচার করেছেন।
আমাদের নিকটতম পূর্বসুরীরা সম্ভবত উপরোক্ত ত্রিমুণির বাইরে আর প্রায় কিছুই পড়েননি। একদেশদর্শী জ্ঞানের উপর নির্ভর করে পাণিনির অতিব্যবহৃত চশমা চোখে শব্দের শুদ্ধাশুদ্ধ বিচার করে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তারা বানানের এবং ব্যাকরণের একেকটা ম্যানুয়েল লিখে রেখে গেছেন। বাপকা বেটা সিপাহিকা ঘোড়া। তেনাদের উত্তরসূরিরাও একই পথে হেঁটেছেন, হাঁটছেন, অর্থাৎ একপেশে, একদেশদর্শী পড়াশোনা করেছেন, করছেন, ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে অন্তত। সুতরাং ভাষাবিজ্ঞানের অতি সহজ স্বতঃসিদ্ধগুলোর কোনো প্রভাব তাদের চিন্তা-ভাবনা কিংবা সিদ্ধান্তের উপর পড়েনি, পড়ছে না। আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ব্যাকরণের যত তত্ত্ব আমি নিজে শিখেছি, প্রত্যেকটি বাংলায় লিখে প্রচার করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু লাভ কি হয়েছে কিছু? অতি সাধারণ বিষয়ও লোকজন বুঝতে চায় না, বোঝার ক্ষমতাও হয়তো নেই, কিংবা আমিই হয়তো বোঝাতে পারি না, পারিনি, গত পঁচিশ বছর ধরে ভাষা-ব্যাকরণ-বানান হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও। দিনশেষে এ আমারই অক্ষমতা বটে।