Published : 25 Nov 2021, 08:48 PM
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাসে শিক্ষার্থীদের 'হাফ ভাড়া' নিয়ে দেড় দশক আগেও হাতাহাতি ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। আমার বাসা মিরপুর-১ নম্বরের আগে, বাংলা কলেজের পাশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে নীলক্ষেত পর্যন্ত বাসে ওঠার পর পথিমধ্যে মিরপুর বাংলা কলেজ এবং ঢাকা কলেজ- দুইটি সরকারি কলেজ পড়ে। তাছাড়া সিটি কলেজ ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরাও এ রুটে নিয়মিত যাতায়াত করে। কখনো শাহাবাগ মোড় হয়ে গেলে ফার্মগেইটে পড়ে তেজগাঁও কলেজ। প্রায়ই দেখতাম মূলত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই পরিবহন শ্রমিক বা বাসের কন্ডাক্টরের হাতাহাতি হচ্ছে। একটা সময় প্রায় নিয়মিতই মিরপুর বাংলা কলেজ মাঠে ভাড়া নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে বচসার কারণে ছাত্ররা বাস আটকে রাখতো। পরে নানা ধরনের সালিস হওয়ার পর, সেটি পরিবহন মালিক ছাড়িয়ে আনতেন।
কখনো কখনো দেখেছি, বাসের যিনি ভাড়া কাটেন তিনি আইডি দেখতে চেয়েছেন, তখন কোনও কোনও মধ্যবয়স্ক যাত্রী কোনও একটা আইইএলটিএস বা কম্পিউটার শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড বের করে বলেছেন, 'হাফ ভাড়া রাখো'। পরিবহন শ্রমিকরাও তো দুনিয়ার হাল-হকিকত বোঝেন। ফলে ঝগড়া লেগেছে। পা ভেঙে যাওয়ার পর অনেকদিন বাসে চড়া হয় না বলে এখন এ ধরনের ঝগড়ার হাল-হকিকত কী জানি না। প্রতিদিন হাতাহাতি হয় কিনা তাও জানি না।
ঢাকায় বাসে হাফ ভাড়ার ব্যাপারটি নিয়ে প্রথম বিপত্তি শুরু হয়, সম্ভবত 'গেইটলক', 'সিটিং সার্ভিস' 'ডাইরেক্ট বাস' এবং ছোট পরিবহন 'ম্যাক্সি', লেগুনা ইত্যাদি 'সাভিস' নামধারী বাস চালু হওয়ার পর। পরিবহন শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা ভাড়া নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে চলে যান। কেননা, এসব অদ্ভুতুড়ে নামধারী 'সার্ভিসে' যেসব পরিবহন শ্রমিক কাজ করেন, তাদের দিনশেষে সিটের বিপরীতে ভাড়া কত আদায় হয়েছে সে ব্যাপারে হিসেব দিতে হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে আবার মালিকপক্ষ 'চুরি' ঠেকাতে চেকার রাখেন। কাজেই সিটের বিপরীতে ভাড়া কম উঠলে মালিকরা নানা চাপ দেন। ধরা যাক কোনও দূরত্বের 'বিরতিহীন ভাড়া' ২৫ টাকা। সেখানে যদি একজন বা দুইজন শিক্ষার্থী ওঠেন এবং ভাড়া সাড়ে ১২টাকা হারে দিতে চান, তাহলেই বিপত্তি। বাকি সাড়ে ১২ টাকা তো হেল্পার বা যিনি ভাড়া কাটেন তিনি পকেট থেকে দেবেন না! গাড়ির মালিককেও তারা বোঝাতে পারেন না। ফলে এ নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই ঝগড়া প্রথমে মারামারি এবং পরে রক্তারক্তিতে গড়ায়।
গণমাধ্যমের খবরে জেনেছি, এ দফা বাস ভাড়া বাড়ানোর আগে, সব ধরনের 'ডাইরেক্ট সার্ভিস'-জনিত মালিকপক্ষের চালাকি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। কতোটা কার্যকর হয়েছে বা হবে কে জানে!
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছ থেকে প্রথম হাফ বাস ভাড়া দেওয়া শিক্ষার্থীদের নৈতিক অধিকার এবং প্রচলিত রীতি বলে শুনে আসলেও এ নিয়ে কখনোই তেমন কোনও আন্দোলন আমার ক্যাম্পাস জীবনে দেখিনি। এ নিয়ে কখনও কোনও আন্দোলন হয়েছে কিনা, কিংবা কোনও আইন রয়েছে কিনা- তাও সংগঠনের বড়ভাই কিংবা নেতারা সঠিকভাবে বলতে পারেননি। অবশেষে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, সেই ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে ১১ দফা দাবি দিয়েছিল তার একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। দাবির ১ (ঢ) দফায় ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যাপারটি কখনও কোনও আইনে পরিণত হয়নি।
২০১৮ সালে যখন জার্মানি যাই, তখন অবাক হয়েছিলাম এটি দেখে, সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট অঞ্চল ও গণ্ডিতে যাতায়াত ফ্রি। এরজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের একটি পাস দিয়ে দেয়। পরে জেনেছি, পুরো ইউরোপজুড়েই এ প্রথা চালু।
ওই বছরই দুই স্কুল শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে, ঢাকার রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকদিন স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তখনই আন্দতোলনরত বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের ফোরাম থেকে অনেকগুলো দাবির একটি প্রধানতম দাবি হয়, শিক্ষার্থীদের বাস ভাড়া 'হাফ' করতে হবে।
উত্তাল সেই আন্দোলনে প্রথমবারের মতো ঢাকা রাজপথে স্কুল ও কলেজপড়ুয়া হাজার হাজার শিশু-কিশোর নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার আন্দোলন করে। একসময় নানা আশ্বাসে সরকার আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে পারলেও, কার্যত সে-ই আশ্বাস বা দাবিগুলোর প্রায় কোনওটাই পূরণ হয়নি বলেই জানি। কোভিড সংক্রমণে গণপরিবহন সীমিত আকারে চলায়, বছর দুয়েক সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা কমলেও, বিধিনিষেধ শিথিল করার সঙ্গে সঙ্গে আবার দুর্ঘটনা বেড়েছে। কাজেই দৃশ্যত এবং বস্তুত সরকারের তরফ থেকে গণপরিবহনে শৃঙ্খলার ব্যাপারটি- 'যেই লাউ, সেই কদু'-ই রয়ে গেছে।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডিজেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে সব ধরনের পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর জন্য বাস ও লঞ্চ মালিকরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। তিনদিন অচলাবস্থা ও ধর্মঘট চলার পর পরিবহনমালিকদের আন্দোলনে সরকার কেবল ডিজেলচালিত পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর সম্মতি দেয়।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ঢাকার ৯৫ শতাংশ গণপরিবহন সিএনজিচালিত হলেও, পরিবহনমালিকরা সব গণপরিবহনেরই ভাড়া বাড়িয়ে দেন। অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ 'বিআরটিএ'-এর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সে সময়েই সাবধান করে বলেছিলেন, "সিএনজিচালিতে বাসের ভাড়া এক পয়সাও বাড়ানো যাবে না, তাদের জন্য এই ভাড়া প্রযোজ্য নয়, আগের রেটে নেবে।"
কয়েকদিন মোবাইল কোর্ট বসে ধরপাকড়, জরিমানা করা হলো বটে, তবে শেষ পর্যন্ত বাড়তি পরিবহন ভাড়াই গা সওয়া হয়ে গেল নগরবাসীর। আবার বিআরটিএ ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর অনুমোদন দিলেও রাতারাতি ঢাকা ও অন্যান্য শহরে চলা গণপরিবহনগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে আগের ভাড়ার প্রায় দেড়গুণ আদায় করতে থাকে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর শহরের একটি বিপুল জনগোষ্ঠি কাজ হারিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। গত কয়েকমাস ধরে তারা মহানগরীতে আবার ফিরে আসছেন। কাজ হারিয়ে চলে যাওয়া মানুষের একটি বড় অংশ তাদের জমানো টাকা ভাঙিয়ে খেয়েছেন। আবার একটি বড় অংশ শহরে আসলেও এখনো পুরোপুরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারেননি। এ অবস্থায় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যপরিবহন খরচ বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। খবরে প্রকাশ, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদনেও খরচ বাড়বে ১৮ শতাংশ। শীতের মওসুম শুরু হলেও এরইমধ্যে বাজারে ৫০ টাকা কেজির নিচে উল্লেখযোগ্য সবজি নেই।
এ অবস্থায় উচ্চবিত্ত ছাড়া প্রায় সবশ্রেণির মানুষেরই নাভিশ্বাস উঠেছে। এদিকে প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাওয়ায় আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে হিমশিম খাওয়া পরিবারগুলোকে সন্তানদের সেখানে পাঠাতেও বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে। ফলে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির খরচটি তাদের জন্য বহন করা সত্যিকার অর্থেই দুরূহ হয়ে পড়েছে। বাসের ভাড়া বৃদ্ধি ও পণ্যের দাম বৃদ্ধির অসন্তোষ মানুষের মধ্যে চাপা ছিল।
গত ২৪ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকের ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কে দিনভর অবরোধ-বিক্ষোভ করে সে কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর পরে একে একে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে আসে। নটর ডেম ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর জন্য দোষীদের বিচার ও বাসে 'হাফ ভাড়ার' দাবি পূরণে ঢাকার রাস্তা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এর আগে-পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে 'হাফ ভাড়া' নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের হাতাহাতি-মারামারি হয় বেশ কয়েক জায়গায়। একথা বলা ভুল হবে না যে, শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলনে তাদের ভুক্তভোগী পরিবারগুলোরও নৈতিক সমর্থন রয়েছে। দৈনন্দিন জীবন চালাতে খরচের দিক থেকে নাভিশ্বাস ওঠা এসব শিক্ষার্থী পরিবারের অভিভাবকরাও এ আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে করছেন।
দুইদিন আন্দোলনের পর শনিবার পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বেঁধে দিয়ে রাস্তা ছেড়েছে শিক্ষার্থীরা। আশার কথা হচ্ছে, অন্যান্য আন্দোলনে সরকারী দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের যেরকম ভূমিকা দেখি, এবার কিছুটা হলেও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বাসে হাফ ভাড়ার দাবি মেনে নিতে পরিবহন মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়।
সড়কে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান এর আগেই সমর্থন জানিয়েছিলেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস বৃহস্পতিবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমাবেশে গিয়ে একাত্মতা জানিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, "কিছুদিন থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা একটি আন্দোলনে নেমেছেন। আন্দোলন করছেন, আজও দু-এক জায়গায় অবরোধে আছেন, রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। সেটা হচ্ছে- তারা হাফ ভাড়ার দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন। আমি এই বিষয়ে একটি কথা বলতে চাই, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছাত্ররা কনসেশন ভোগ করে থাকে। আমরাও পাকিস্তান আমলে যখন ছাত্র ছিলাম, এই কনসেশন পেয়েছি- এটা হল সত্য কথা।"
আবার শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবির বিষয়ে শিক্ষা সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিআরটিএতে বৈঠকও করেছেন।
কাজেই এবারের আন্দোলন হয়তো ইতিবাচক একটি ফল নিয়ে আসবে। তবে সরকারের এটা মনে রাখা প্রয়োজন এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য সুদূরপ্রসারী চিন্তাই শ্রেয়। সেক্ষেত্রে আইনের পাশাপাশি আরও বেশকিছু বিষয় নিয়ে এখনই কাজ করার সময়। তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এটির ফল সুদূরপ্রসারী করতে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে 'ট্রান্সপোর্ট পাস' পৌঁছে দিলে, এটির হয়তো আপাত স্থায়ী সমাধান হবে।
মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন কেবল 'হাফ বাস ভাড়া'র দাবি ভাবলে ভুল হবে, বরং অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়া তাদের পরিবারগুলোর হাঁপ ছাড়ারও একটি জানালা।