Published : 27 Jul 2021, 02:21 AM
প্রত্যেক সন্তানের জীবনেই তার বাবা সুপার হিরো, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। অন্যদের কাছে সে মানুষটা যেমনই হোন না কেন, সন্তানের চোখে তার বাবা একজন আদর্শ মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়েই বেঁচে থাকেন। আমার বেলায় অবশ্য ঘটনাটা একটু অন্যরকম। আমার কাছে আমার আব্বু তো স্বাভাবিকভাবেই একজন আদর্শবান মানুষ, আমার জীবনের বাতিঘর। কিন্তু একজন অপরিচিত মানুষও যখন জানতে পারেন আমি সৈয়দ হাসান ইমামের সন্তান, তখন তার প্রথম কথাটিই হয়, 'আমার না ওনাকে আমার 'বাবা বাবা' লাগে। দেখলেই মনে হয় উনি খুব স্নেহপ্রবণ'। এ ধরনের কথাগুলো আমার মতো আমার ভাইবোনরাও নিশ্চয়ই শুনে থাকেন। আব্বু এমন একজন মানুষ, যাকে আমার আশেপাশের অনেক মানুষই পিতার প্রতীক মনে করেন। এ আমার এক পরম গৌরব। সবাই জানতে চান, 'তোমার আব্বু কি খুব নরম মানুষ? উনি নিশ্চয়ই তোমাদের কখনো বকেন না'। কতভাবেই না মানুষ জানতে চান আব্বুর সম্পর্কে!
আমার আব্বু সৈয়দ হাসান ইমামের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ জুলাই অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় তার মামাবাড়িতে। তার বাবার বাড়ি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বাগেরহাট মহকুমায়। এক রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিয়ে তিনি ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন। বাম রাজনীতির আবহে শৈশব থেকে পালিত বলে প্রান্তিক অবহেলিত মানুষের কষ্টে তিনি আজীবন সমব্যথী ও ত্রাতা। দুই বছর বয়সে পিতৃবিয়োগের পরে মামাবাড়িতেই বড় হন তাঁরা দুই ভাই– সৈয়দ আলী ইমাম ও সৈয়দ হাসান ইমাম। বর্ধমান জিলা স্কুল ও বর্ধমান পলিটেকনিক কলেজে পড়া শেষে যখন ঢাকায় চলে আসেন, তখন হাসান ইমাম বর্ধমানের ফুটবল, নাটক ও গানের জগতে এক সুপরিচিত নাম।
তিনি ঢাকায় আসেন ১৯৫৭ সালে। ততদিনে ভারত ভাগ হয়ে গেছে। ঢাকা তখন পূর্ব পাকিস্তান। ঢাকায় তিন বছর ফার্স্ট ডিভিশন লীগে ক্রিকেট খেলেছেন। দু বছর খেলেছেন ইস্টএন্ড ক্লাবের হয়ে। এ ক্লাবে আব্বুর সঙ্গে ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন আমাদের সকলের প্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সদ্য প্রয়াত আলী যাকের। ক্রিকেট খেলা আর সেই সঙ্গে মঞ্চ ও রেডিওতে পেশাদার নাট্যশিল্পী। সাতান্ন সালে ঢাকায় ফিরেই তিনি দর্শনা সুগার মিলে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে চাকরি শুরু করেছিলেন। পরে অভিনয় আর গানের জন্যেই তিনি ঢাকায় চলে আসেন, চাকরি নেন তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে।
এ চাকরির পাশাপাশি চলে মঞ্চ অভিনয়, আর সেই সূত্রেই ১৯৬১ সালে তার চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু। তার পাশাপাশি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়া। চলচ্চিত্রের নায়ক হয়েও ১৯৬১ সালে প্রতিবাদী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। সে সময় প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই ড্রামা সার্কেলের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের তিনটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। রাজা ও রাণী এবং তাসের দেশ নাটক দুটোতে আব্বু করেছিলেন রাজপুত্র ও প্রণম্য অভিনয়শিল্পী মাসুদ আলী খান করেছিলেন যথাক্রমে কোটালপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র। রক্তকরবীতে আব্বুর চরিত্রটি ছিল বিশু আর মাসুদ কাকু করেছিলেন ফাগুলাল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি মাইলফলক প্রযোজনা ছিল রক্তকরবী (প্রযোজক: মুস্তাফা মনোয়ার)। এই নাটকেও আব্বু বিশু পাগলের চরিত্রটি করেছিলেন।
১৯৬৮ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির জন্মশতবর্ষে পল্টন ময়দানে আব্বুর নির্দেশনায়মা নাটকটির কথা এখনও সে সময়ের মানুষজন তাদের স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন। ১৯৬৯ সালের সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য তিনি অনেকগুলো নাট্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলা একাডেমির বটতলায় মঞ্চস্থ রক্তকরবী। মুক্তিসংগ্রামের সেই দিনগুলোতে শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন 'বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ'। এর আহ্বায়ক ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। আর যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন আতিকুল ইসলাম ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন যেমন করেছেন, তেমনি ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত মানুষের কাছে ছুটে গেছেন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে, সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন 'দুর্যোগ নিরোধ আন্দোলন কমিটি' (এ নামটি দিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান)। এ সংগঠনের আহ্বায়ক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। এ সংগঠনের উদ্যোগেই জলোচ্ছ্বাসে উপকূলবর্তী ঘরহারা মানুষদের তারা ঘর তুলে দিয়েছিলেন।
দুই
আমার কাছে মনে হয়, যে কোনও মানুষের জন্যই সবচেয়ে গৌরবের বিষয়টি হলো, তার পরিবারে যদি কেউ বীর মুক্তিযোদ্ধা থাকেন। আমার আব্বু এবং আম্মু দুজনেই বীর মুক্তিযোদ্ধা– আমার কাছে এর চেয়ে গৌরবের আর কোনো প্রাপ্তি নেই। আব্বু মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই ঘর ছাড়েন যুদ্ধে যোগ দেয় জন্য। কোলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠিত হলে সৈয়দ হাসান ইমাম ও তাঁর সহযোদ্ধারা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে (তথ্য, বেতার এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও ছিল তাঁর কাছে) একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার চেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি সংবাদ ও নাটক বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। পরে নাটক ও কথিকা বিভাগের দায়িত্ব নেন। আব্বু 'সালেহ আহাম্মেদ' ছদ্মনামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন, যার নাম– 'বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি'। এর সভাপতি ছিলেন চলচ্চিত্রনির্মাতা শহিদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। এই সংগঠনের পক্ষ থেকেই চলচ্চিত্র শিল্পীদের জন্য মাসিক ভাতা ও নানা ত্রাণ সামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে ভারতে শরণার্থী চলচ্চিত্রশিল্পীরা সামান্য খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন ওই দুঃসময়ে। তাছাড়াও, আরেকটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল এই সংগঠনটি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্যদলিল জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড এই সংগঠনের প্রযোজনাতেই নির্মিত হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর আব্বু দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। আজকের যে শিল্পকলা একাডেমি, তার প্রতিষ্ঠার সার্বিক ব্যবস্থাপনাই সম্পন্ন হয়েছিল তার হাতে। শিল্পশিক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা অর্জনের জন্য ভারতে বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। দুস্থ শিল্পীদের ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব নানা কাজের পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনার সংস্থা গড়ে তোলেন। চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজও করেন।
আব্বু কখনোই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে কোনো আপোষ করেননি। পঁচাত্তরের সেই নৃশংস রাত্রির পর দেশে কত রকম পট পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কখনোই কোনো প্রলোভন তাঁকে আদর্শ থেকে টলাতে পারেনি। কখনো কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিয়েও তিনি আপাদমস্তক একজন রাজনৈতিক মানুষ। দেশের মানুষের যে কোন দুর্যোগে ঝাঁপিয়ে তাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের নির্মূলের আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থেকে সারা বাংলাদেশের জেলা-উপজেলায় ঘুরে ঘুরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে জনমত গঠন করেছেন। নানাভাবে যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মগুলো তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির একজন সংগঠক আমার আব্বু।
তিন
বাইরে এত কাজের পরেও আব্বু একজন ঘরোয়া মানুষ। আমাদের লেখাপড়ার খোঁজ, বাড়িতে বাজার করা, বাসায় থাকলে আম্মুকে ঘরের কাজে তাঁকে সবসময় সাহায্য করতে দেখেছি। আজও দেখি এই বয়সেও তিনি নিজের কাজটি নিজে করতেই ভালোবাসেন। আমরা সবসময় দুবেলা না হলেও একবেলা অন্তত একসাথে টেবিলে বসে খাই। খাবার টেবিলই আমাদের সংসারের কথা থেকে সংস্কৃতি-রাজনীতি সব আলোচনা, চর্চা আর বৈঠকের জায়গা।
আমরা তিন ভাইবোনই ছোটবেলা থেকে আব্বুর কাছে স্পষ্ট কথা বলতে শিখেছি। শিখেছি– যে অন্যায় করে না, তার কাউকে কখনোই ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। সত্যভাষণে ভীত না হবার শিক্ষা আব্বুই আমাদের দিয়েছেন। বেশ একটা মুক্ত পারিবারিক পরিবেশে আমরা বড় হয়েছি আব্বুর কারণেই। তিনি কখনোই তার সন্তানদের বলেননি– ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা তেমন কিছু হতেই হবে। শুধু বলেছেন– মানুষ হতে হবে, মানুষের সমব্যথী হতে হবে। ছোটবেলার একটি দৃশ্য আজো আমার চোখে ভাসে। আব্বু গাড়ি চালাচ্ছেন আর পিছন থেকে আমি তার গলা জড়িয়ে ধরে আছি। তিনি স্টিয়ারিংয়ে তাল ঠুকে একের পর এক গান করছেন। আমিও গলা মিলিয়ে গাইছিলাম সেই গানটি 'আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি…'।
সে সময়ই আব্বুর কণ্ঠে গানের একটি চরণ আজও আমার কানে বাজে প্রায়ই- 'আমার প্রাণের গানের ভাষা শিখবে তারা ছিল আশা…'। জানি না আব্বু, তোমার প্রাণের গানের ভাষা আমরা শিখতে পেরেছি কি না; সে কথা তো তুমিই বলবে। তবে তোমার দেখানো পথে চলছি, তোমার আদর্শকে ধারণ করে তাকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়াকেই ব্রত বলে মনে করে সে কাজটি করে চলেছি। দেশকে, দেশের মানুষ আর মাটিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছ তুমি। সে ভালোবাসা বুকে ও কর্মে ধারণ করেছি আমরা। আজকে তোমার জন্মদিনে তোমাকে কথা দিচ্ছি– এ দেশকে তোমার মত করেই ভালোবাসবো আমৃত্যু। তোমার মত করেই মানুষের দুঃখ-কষ্টকে নিজের করে তাঁর পাশে দাঁড়াবো। শুভ জন্মদিন আব্বু।