Published : 27 Mar 2021, 06:51 PM
মুন্সিগঞ্জের সোনারং গ্রামের সোনালী মনের মানুষ সত্যেন সেন জন্ম নিয়েছিলেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি। ৭২ বছর ৭ মাসের এক বর্ণাঢ্য জীবন তার।
বর্ণাঢ্য বলছি একারণে তিনি ৭২ বছরের অধিক সময় বেঁচে ছিলেন নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে। কিন্তু কখনো তার ভেতরে হতাশা প্রশ্রয় পায়নি। সকল সময় জীবনের সাধ খুঁজে বের করেছেন। কারণ তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন, মানুষকে ভালোবাসতেন। স্বপ্ন দেখতেন বৈষম্যহীন একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। যা তিনি তার গানের মধ্যদিয়েও প্রকাশ করেছেন- 'মানুষেরে ভালোবাসি এই মোর অপরাধ, মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান, মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ।' মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এই কথাগুলি আবলীলায় উচ্চারণ করা যায়, গানের ভেতর দিয়ে এভাবে জীবন্ত করে তোলা যায়- তা সত্যেন সেন সম্পর্কে, তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম সম্পর্কে অনুশীলন না করলে বোঝা যাবে না।
সত্যেন সেনের মধ্যে এ বোধ সঞ্চারিত করেছিলেন তার শৈশব-কৈশোরের সাথী, ঠাকুরমার পালিত পুত্র মাহাঙ্গু বানিয়া। সত্যেন সেনের শৈশব কেটেছে এই মাহাঙ্গু বানিয়ার কোলে-পিঠে চড়ে। এ সময় মাহাঙ্গু তাকে পশুপাখির গল্প, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার গল্প থেকে শুরু করে ক্ষুদিরাম, সত্যেন বসু, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, নীরেন, চিত্তপ্রিয়সহ অজস্র বিপ্লবীদের ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের রোমা কর গল্প শোনাতেন এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নিয়ে যেতেন, যা সত্যেন সেনের মানস গঠনে ভূমিকা রেখেছে। সত্যেন সেন মাহাঙ্গু বানিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে 'বড়ো হয়ে তিনি দেশের কাজ করবেন।' মাহাঙ্গুর কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি আমৃত্যু পালন করে গেছেন এবং তা কোনও অবস্থাতেই হারিয়ে ফেলেন নি।
সত্যেন সেন জেলের মধ্যেও মহানন্দে থেকেছেন, থেকেছেন আপন সৃষ্টির মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে। গরাদের পেছনের একাকিত্বের জীবন, বিত্ত-বৈভবহীন নিরানন্দময় জীবনকেও অর্থবহ করে তুলতেন। কয়েদিদের গান গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন। তাদের জন্য একটা গানও লিখেছিলেন। গানটি হলো- 'পায়খানাতে যাই জল ভরে খাই/ এই ঘটিতেই সব চলে/ জেলখাতে দুঃখ আছে কে বলে?' কমিউনিস্ট কর্মী ব্রজেন সাহার বক্তব্য অনুযায়ী 'সত্যেন সেনের এই গানটি কয়েদিরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে জেলখানা মাতিয়ে তুলতো।' সত্যিই তিনি দুঃখের তিমিরে কখনো নিজেকে নিমর্জ্জিত করেন নি। একটা সময় জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ, বাইবেল, কোরান ছাড়া অন্যকোনও পুস্তক সরবরাহ করা হতো না তখনো তিনি তার থেকে রস আস্বাদন করেছেন, ছড়িয়েছেন আলো। বাইবেল পাঠ করে তার নির্যাস থেকে লিখেছেন 'পাপের সন্তান', 'অভিশপ্ত নগরী'র মত যুগান্ত সৃষ্টিকারী উপন্যাস। যেখানে তিনি অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে তুলে ধরেছেন ইহুদী সমাজের ধারাবাহিক ট্রাজেডির পেছনে সমাজের কোন কোন শক্তি কীভাবে কাজ করেছে, রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ধর্মের আচার অনুষ্ঠানস্বর্বস্ব অন্তঃসারহীনতার বিরুদ্ধে বিবেকের বিদ্রোহ।
মানবপ্রেম এবং গণশক্তিতে বিশ্বাস সত্যেন সেন ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন এবং বহরামপুর জেলে টানা পাঁচবছর বন্দিজীবন কাটান। এ সময় রেবতী বর্মণ, ভবানী সেনসহ বেশ কয়েকজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এর সংস্পর্শে আসেন এবং কমিউনিজমের দীক্ষা নেন। ১৯৩৮ সালে জেল থেকে বেরিয়েই কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এ সময় তিনি পায়ে হেঁটে সারা বিক্রমপুর চষে বেড়াতেন। বিশ-পচিশ মাইল রাস্তা তিনি অনায়াসে হেঁটে চলে যেতেন। শারীরিক দুঃখ-বেদনা বা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তিনি কাতর হয়ে পড়তেন না। কখনো কখনো দেখা যেত হাঁটতে হাঁটতে তার পা দুখানি অনুভূতিহীন পাথরের মত হয়ে পড়ত। এ প্রসঙ্গে কমরেড সুনীল রায়ের একটি বর্ণনা এখানে তুলে ধরছি-
তিনি একবার গ্রাম থেকে ঢাকাতে এলেন, কিম্ভূতকিমাকার এক চেহারা নিয়ে। দেখতে পেলাম তার পা দুটো ফেটে চৌচির হয়ে আছে, রক্ত ঝরছে। এ হাল অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করাতে বললেন, অনেক গ্রাম ঘুরলাম তো তাই, অসুবিধা নেই ফাটার মধ্যে আমের আঠা লাগিয়ে দিয়েছি।
কত সহজভাবে তিনি বিষয়টিকে নিয়েছিলেন, মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তবে তার ভেতরে ছিলো অগ্নিগিরির গলিত লাভার মত বিপ্লবের আগুন। যে আগুন দিয়ে তিনি সংগ্রামের, প্রতিবাদের পথ রচনা করেছেন।
সত্যেন সেন জীবনের রঙ খুঁজেছেন সর্বত্র। তিনি তার কর্মে-সৃজনে, নিজের রচনায় যেমন রঙ ছড়িয়েছেন তেমনি রবীন্দ্রনাথের গানের ভেতরেও রঙের সন্ধান করেছেন অতি নিবিড়ভাবে। সত্যেন সেনের অস্থি-মজ্জায় মিশে ছিলো রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্র চর্চা যেন তার ভেতরে ফল্গু ধারার মত প্রবাহিত হতো। তিনি পরম তৃপ্তিতে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতেন। বিশেষকরে 'যাও, যাওগো এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও'- গানটি তার অতি প্রিয়। এ গানটি যখন শুনতেন তখন এক অপরূপ সৌন্দর্য সৌকর্যের বোধ সেখানে পাখা মেলে দিত। তিনি নিজেও অসংখ্য গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন এবং স্বকণ্ঠে গেয়ে বেড়িয়েছেন। গানের মধ্য দিয়ে তাঁর মেজাজ, লোকমুখিতা, দর্শন ও চিন্তার প্রতিফলন ভীষণভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
সত্যেন সেনের কিছু গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়, কিছু গান উদীচীর শিল্পীরা এখনো বিভিন্ন গণসমাবেশে সমস্বরে গেয়ে থাকেন। সত্যেন সেনের এই গানের মধ্যে গণমুখীতার পরিচয় মেলে। তার প্রতিটি গানই অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের ঐক্য, অসংগতির মাঝে সংগতির সুর ও সাম্য প্রতিষ্ঠার মনস্কামনা বারংবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালের দিকে মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বে দেশের মধ্যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষগুলোর মধ্যে যখন ফাটল ধরতে আরম্ভ করেছে, তখন সত্যেন সেন রচনা করেন, 'ও আমার দেশের ভাই রে আমার মিনতি শোনো শোনো/ শোনো রে ভাই দেশের মানুষ মুখ তুলিয়া চাও/ ঘরের ইন্দুর বাঁধ কাটে ভাই দেখতে কি না পাও।' সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষকরে বাম আন্দোলনের কর্মীদের জন্য গানটি বর্তমানে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
আমরা জানি ব্রিটিশরা এদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হলেও দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতার আগুন। যে আগুনে অঙ্গার হয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান। হিন্দু-মুসলিম ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা হয়েছে। দাঙ্গার বিরুদ্ধে মানুষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সত্যেন সেন লিখেছিলেন, 'ও যারা দাঙ্গা করে মানুষ মারে/ বুঝে না রে পথের গতি,/ ও যারা দাঙ্গা করে/ সে কি কভু চিন্তা করে/ এটাই আমার দেশের ক্ষতি […]'। দাঙ্গা বলতে যা বুঝায় আজকে তার রূপ বদল হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা বিষাক্ত ফনা তুলে দাঁড়িয়েছে এবং তা শুধু যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার তা-ব চলছে। সত্যেন সেনের সৃষ্টি ও কর্ম এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামে আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।