Published : 18 Aug 2020, 08:41 PM
অবশেষে মাটিপূজার মাধ্যমে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করলেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এসময় তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থানে চল্লিশ মণ ওজনের একটি রুপার ইট স্থাপন করেন।
এর মাসখানেক আগে দীর্ঘ ৮৬ বছর পর তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের হায়া সোফিয়ায় ২৪ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এ দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ায় বিশ্বের অনেক দর্শক তা দেখার সুযোগ পেয়েছেন।
১০ জুলাই তুরস্কের সাংবিধানিক আদালত মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের হায়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। সাংবিধানিক আদালতের এই ঘোষণার পর সরকারের পক্ষ থেকে হায়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরের ফরমান জারি করা হয়। ৮৬ বছর ধরে ভবনটি একটি জাদুঘর হিসেবে লাখ লাখ পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
হায়া সোফিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন নেই কারণ গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার কারণে এ সম্পর্কে কমবেশি জানা হয়েছে সবার। তারপরেও লেখার ধারাবাহিকতার প্রয়োজনে সামান্য উল্লেখ করতে চাই।
৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান ইস্তাম্বুলের গোল্ডেন হর্ন নামক স্থানে এই গির্জাটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় এই গির্জাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা ও স্থাপনা বলে মনে করা হতো।
৫৩৭ থেকে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে হায়া সোফিয়া ব্যবহৃত হয়। চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ক্যাথলিক খ্রিস্টানেরা অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং হায়া সোফিয়াকে অর্থোডক্স গির্জা থেকে ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তরিত করে। যার দরুন হায়া সোফিয়া ১২০৪ থেকে ১২৬১ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান মেহমেত কনস্ট্যান্টিনোপল তথা আজকের ইস্তানবুল দখলে নিলে হায়া সোফিয়া অটোমানদের অধীনে আসে।
ইস্তানবুল দখলপরবর্তী সময়ে হায়া সোফিয়ার ভাগ্য নিয়ে প্রধান দুটি কথন বিদ্যমান। প্রথমত, তৎকালীন যুদ্ধনীতি অনুযায়ী সুলতান মেহমেত হায়া সোফিয়াকে দখল করে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, সুলতান মেহমেত খ্রিস্টান পাদ্রিদের কাছে থেকে হায়া সোফিয়া ক্রয় করে নিয়েছিলেন। যাই হোক, সুলতান মেহমেত হায়া সোফিয়াকে একটি ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করেন এবং নিজের নামে ফাউন্ডেশন গঠন করে তার ওপর হায়া সোফিয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
১৯২৩ সালে মুস্তাফা কামাল অটোমানদের উৎখাত করলেও প্রথমাবস্থায় হায়া সোফিয়া মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মুস্তফা কামাল হায়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সরকার ১৯৩৫ সালে হায়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করে। দীর্ঘ এই পরিবর্তনের পরিক্রমায় হায়া সোফিয়া ৯২১ বছর গির্জা, ৪৮২ বছর মসজিদ এবং ৮৫ বছর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
কামাল আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক সরকার ৮৬ বছর পর একটি জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তর করে যখন সেখানে জুমার নামাজ আদায়কে কেন্দ্র করে উৎসবের আয়োজন করছিল তখন তুরস্ক থেকে হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি রাষ্ট্র ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের বাসিন্দা রাইসা আনসারী রাজপথে দাঁড়িয়ে ক্রন্দন করছিলেন এবং ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছিলেন। প্রায় একই সময়ে ঘটা এই ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ ভারত ও তার আশেপাশের দেশে ভাইরাল হয়েছে। সে ঘটনা তুলে ধরে সংবাদ পরিবেশন করেছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারসহ দিল্লি থেকে প্রকাশিত আরও কয়েকটি ইংরেজি দৈনিক। ভিডিওটি আপলোড করে আনন্দবাজার লিখেছে, 'তিনি একজন মহিলা সব্জি বিক্রেতা, নাম রাইসা আনসারি। মধ্যপ্রদেশের ইনদওরের বাসিন্দা তিনি। তার ইংরাজি শুনে সেখানে উপস্থিতরা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা জিজ্ঞাসা করেন। তার উত্তরে সব্জি বিক্রেতা বলেন, তিনি ইনদওরের দেবী অহল্যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেটেরিয়াল সায়েন্সে পিএইচডি করেছেন।
প্রতিবাদের সময় ইংরেজিতে তিনি বলছেন, ''বাজার বন্ধ। খরিদ্দার নেই। আমি রাস্তার ধারে গাড়ি নিয়ে ফল ও সব্জি বিক্রি করি। কিন্তু পুরসভার লোকেরা সেটাও করতে দিচ্ছেন না। আমার পরিবারে ২০ জন ব্যক্তি। কী করে রোজগার করব? কী খাব? কীভাবে বাঁচব?''
মেটেরিয়াল সায়েন্সে পিএইচডি করে তিনি কেন সব্জি বিক্রি করছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ''আমার প্রথম প্রশ্ন, কে আমায় চাকরি দেবে?'' তার অভিযোগ, ''করোনাভাইরাস মুসলিমদের জন্য বেড়েছে এই ধারণা সর্বত্র। যেহেতু আমার নাম রাইসা আনসারি, কোনও কলেজ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমাকে কাজ দিতে উৎসাহী নয়।''
এই দুটি ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য কোথায় তা নিয়ে পাঠকরা খানিকটা চিন্তায় পড়বেন। এই চিন্তা থেকে মুক্তির জন্য দুটি ঘটনার সূত্রপাত এবং সময়ের পরিবর্তনের দিকে দৃকপাত করতে চাই। আঠারো শতকের রেনেসাঁর ফলে ইউরোপ ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এর ফল হয়েছিল ইতিবাচক। এর ফলে রাষ্ট্রে গির্জার প্রভাব, সামন্ততন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য গির্জাকে তথা ধর্মকে ব্যবহার এবং ধর্মের নামে গণমানুষের অধিকার ও মুক্তি ছিনিয়ে নেওয়ার দিন শেষ হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ইউরোপীয়রা সেকুলার নীতি গ্রহণ করে। এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, আজ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইউরোপের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা রেনেসাঁরই ফল। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পরিচালিত হলেও ইউরোপের প্রতিটি রাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করে থাকে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য একই আচরণ করে। এভাবে ইউরোপে আজ কল্যাণ রাষ্ট্র তথা ওয়েলফেয়ার স্টেট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে এখনো বর্ণবাদ রয়েছে, অনেকের মধ্যে বর্ণবাদী আচরণ আছে তবে তা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের দেশগুলো এখনো মানুষ বসবাসের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। আমি মনে করি ইউরোপের বেশ কিছু দেশ এখন বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
১৯২৩ সালে মোস্তফা কামাল অটোমানদের উৎখাত করে নতুন এক তুরস্কের জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্তি, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যবহার দূর করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনেক সংস্কার সাধন করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা এবং সংবিধানে তা সন্নিবেশিত করা। সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ১৯৩৪ সালে তিনি হায়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করেছিলেন।
আতাতুর্কের তুরস্ক এখন আর নেই। দিনদিন রাষ্ট্রটিতে ইসলামী মৌলবাদী ও রক্ষণশীলদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে এবং আজ যেভাবে এরদোয়ানের নেতৃত্বে দেশটি পরিচালিত হচ্ছে তা কামাল আতাতুর্কের আদর্শের বিপরীত এবং ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ধর্মকে ব্যবহার করে এরদোয়ান ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং আগামী নির্বাচনে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় ক্ষমতা লাভের আশায় ৮৬ বছরের একটি জাদুঘরকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তর করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তিকে নাকচ করে দিয়েছেন। এরদোয়ানকে যারা সমর্থন করেন তারা যুক্তি দেখান যে জেরুজালেম ও মসজিদুল আকসায় ফিলিস্তিনিদের অধিকার হারানোর প্রতিশোধ হিসেবে এরদোয়ান হায়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্ত একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের বৃষ্টিতে এরদোয়ানের রাজনীতিকে দেখলে বোঝা যাবে এতদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সেবাদানকারী এরদোয়ান সে আবেগ থেকে কাজটি করেননি। তিনি এটি দেখিয়ে মূলত তুরস্কের রক্ষণশীল ভোটারদের কাছে টানতে চাইছেন এবং মুসলিম জাহানের নেতা হওয়ার চেষ্টা করছেন।
হায়া সোফিয়াকে রক্তপাতহীনভাবে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তর করার ঘটনায় অনেকে তুরস্ক সরকারের আপাতত কোনো দোষ খুঁজে না পেলেও এটি চিন্তাশীলদের জন্য একটি অশনি সংকেত প্রদান করছে এবং এই উপমহাদেশ তথা ভারতের একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাচ্ছে। অযোধ্যার বাবরি মসজিদের স্থান নিয়ে ভারতের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং সবশেষে মাটিপূজার মাধ্যমে রাম মন্দিরের নির্মাণ শুরুর সঙ্গে এই ঘটনার পূর্বাপর একটি যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে।
১৯০ বছরের বৃটিশ শাসনের পর ভারত যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্পষ্ট করে বললে ধর্মীয় ভাবে বিভক্ত হচ্ছিল তখন একজন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদসহ অনেক প্রগতিশীল রাজনীতিক তার বিরোধিতা করেছিলেন। তারা বোঝাতে চেয়েছেন যে, এমন বিভক্তি শুধু সাম্প্রদায়িক রেষারেষি ও বিভাজন বৃদ্ধি করবে শুধু। তারপরও বিভক্তি বা দেশ ভাগের পর ভারত ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিল। এই নীতি গ্রহণের কারণে বহু ধর্ম, বহু বর্ণ, বহু সংস্কৃতির বিশাল দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে সংগঠিত হতে পেরেছিল। দীর্ঘকাল ভারত তার অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি ধরে রাখতে পারলেও গত শতকের শেষ দিক থেকে ভারতে কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষবাদী রাজনৈতিক দলটি শক্তি হারাতে থাকে এবং সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, বাবরি মসজিদ ইস্যু ইত্যাদি তো ছিলই সে সঙ্গে ছিল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, বিভাজন ও অবিশ্বাস এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে বিসর্জন দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর মতো নির্বুদ্ধিতা।
প্রগতিশীলদের এই ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে বিজেপি, শিবসেনা, আরএসএস-এর মত দলগুলো সংঘটিত হয় এবং ভারতের শাসনভার তাদের হাতে তুলে নেয়। শুধু তাই নয় গুজরাটের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী চরমভাবে নিন্দিত নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র রাজনীতি হলো চরম হিন্দুত্ববাদ যা ভারতের মতো বহু ধর্মের, বহু বর্ণের, বহু সংস্কৃতির দেশের অখণ্ডতার জন্য হুমকি। আজ সেখানে ধর্মীয় রেষারেষি এমন পর্যায়ে গেছে যে অনেকের কাছে একজন মুসলমানের প্রাণের চেয়ে গরুর জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণা আজ কতটা বিস্তৃত হয়েছে তা রাইসা আনসারির কথায় উঠে এসেছে।
এরপর জল আরও গড়িয়েছে উপমহাদেশের নদীগুলোতে। ভারতের অযোধ্যায় যেখানে প্রায় ৫০০ বছর পুরনো বাবরি মসজিদ ছিল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত, সেই জায়গাতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৫ অগাস্ট রাম মন্দির নির্মাণের সূচনা করেছেন। উদ্বোধনপর্বের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শেষে মি. মোদী এক ভাষণ শুরুই করেন রামায়ণের একটি পংক্তি উদ্ধৃত করে। তিনি বলেন, "ভগবান রামের কাজ না করলে আমার শান্তি কিসে হবে?" (হিন্দুদের কাছে ভগবান রামের ছোট বয়সের রূপকে রামলালা বলা হয়) অনেকদিন ধরেই একটি অস্থায়ী তাবুতে থাকছেন। কয়েক শতাব্দী ধরে যা চলে আসছে – একবার ধ্বংস আরেকবার নির্মাণ – এই চক্র থেকে আজ রাম জন্মভূমি মুক্তি পেল। এই উপলক্ষ্যে ১৩০ কোটি ভারতবাসীকে আমার প্রণাম।" রামচন্দ্রকে ভারতীয় সংস্কৃতির আধার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তার কথায়, "ভগবান শ্রীরামের মন্দির আমাদের সংস্কৃতির আধুনিক প্রতীক, শাশ্বত আস্থার প্রতীক হয়ে উঠবে। এই মন্দির কোটি কোটি মানুষের মিলিত শক্তির প্রতীক হয়ে উঠবে।"
গত শতকের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকেরা ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার থেকে আলাদা করে যে মানবিক, উদার ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে চেয়েছিলেন প্রায় পৌনে শত বছরের শেষে এসে সে দেশ, সে রাষ্ট্রকে আবার পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন বর্তমানে ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা যার পরিণাম আমরা জানি।
এ বিষয়ে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেসের সাংসদ শশী থারুর তার একটি কলামে লিখেছেন, 'ভারত যখন তার ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করতে যাচ্ছে, ঠিক এমনই এক সময়ে এসে ক্রমবর্ধনশীল সংখ্যক ভারতীয়র মনে এই বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে, ১৯৪৭ সালে যে গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই চেতনা ধরে রাখার লড়াইয়ে ইতোমধ্যেই গণতন্ত্রকামীদের পরাজয় ঘটে গেছে। অনেক বিশ্লেষক উপসংহার টেনেছেন, মোদী সরকার ইতোমধ্যেই দেশের মধ্যে 'দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র' কায়েম করে ফেলেছে। এই বিশ্লেষকদের মতে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা উচ্ছেদ করে গত বছরের ৫ অগাস্ট এই 'পুনঃপ্রতিষ্ঠার' আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, যার সমাপ্তি হলো ঠিক এক বছর পর; অযোধ্যায়।
টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারে কয়েক ঘণ্টার উৎসব অনুষ্ঠান হলো, ভূমিপূজা ও বাবরি মসজিদের স্থলে শুরু হওয়া রামমন্দিরের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করলেন মোদী। ভিত্তিপ্রস্তরের স্থলে ৪০ কেজি ওজনের রুপার ইট বসানো হলো।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কার্যত কোন চরিত্রের, তা দিন দিন বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ছে। যারা ভারত রাষ্ট্র গড়েছিলেন, তাদের আদর্শকে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিলাষ রাখা মোদী ও তার বিজেপি চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।
ছয় বছর ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থকেরা এক বায়বীয় মুক্তির স্বাদ আস্বাদ করছেন, কিন্তু ভারতের প্রকৃত মুক্তির লড়াই আজও শেষ হয়নি। ৫ অগাস্টের বিভক্ত ভারত কখনোই ১৫ অগাস্টের ঐক্যবদ্ধ ভারতের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবে না।'
কিন্তু এভাবে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। মানুষের কোনো কল্যাণ হবে না। দেশে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখ্যালঘুর মর্যাদা যদি ক্ষুণ্ন হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যদি ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যদি সংখ্যালঘুদের জান-মাল হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয় তাতে কোনো দেশ বা জাতি আখেরে শান্তিলাভ করবে না। বিশ্বশান্তিও তাতে প্রতিষ্ঠিত হবে না। মানুষে মানুষে মমত্ববোধ বাড়াতে হলে, সৌভ্রাতৃত্ব বাড়াতে হলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের দেয়ালটি উপড়ে ফেলতে হবে। রাষ্ট্রগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
মহামারীতে আক্রান্ত বিশ্ববাসী যখন একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের আশায় গবেষণালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সেসময় এরদোয়ান ও মোদীর মতো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিকরা ধর্মকে পুঁজি করে নোংরা ও হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে যা মানুষের কল্যাণ তো করবেই না উপরন্তু মানুষে মানুষে বিভাজন ও বিদ্বেষ আরও বাড়িয়ে দেবে।
রাইসা আনসারির বিষয়টি তুলে ধরে ফেসবুকে একজন লিখেছেন, 'ওপারে আপনারা এপারে আমরা, চুপ ম্যাক্সিমামরা'। বলার কি অপেক্ষা রাখে পোস্টদাতা এদেশের একজন সংখ্যালঘু, যার কণ্ঠে বিশ্বের সকল সংখ্যালঘুর ক্ষোভ ও বঞ্চনা উঠে এসেছে?