Published : 03 Jun 2020, 12:02 AM
বিজ্ঞান এবং উপন্যাসের জন্য পারষ্পরিক অভিজ্ঞতার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন ক্রিস্টোফার কডওয়েল। এ নির্দেশিকা যেন উনিশ শতকের নবজাগরণ স্নাত, বিশ শতকের উত্তোলনকালে পথিক সত্যেন সেনের (১৯০৭-১৯৮১) মধ্যে একটা চিরকালীন সত্য হিসেবে আমাদের সামনে উঠে এসেছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের অভিধারাতে, অভ্যুত্থানের পর অভ্যূত্থানের সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে গত শতাব্দীর আটের দশকের সূচনা লগ্ন পর্যন্ত আমাদের চেতনার প্রতিটি তন্তুকে রসসিক্ত করে গিয়েছেন যারা, সত্যেন সেন তাদের মধ্যে অন্যতম ।
মানব মুক্তির লক্ষ্যে একটার পর একটা দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে, এক অনন্য সাধারণ উদ্যোগে পুরুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে সত্যেন সেন যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন আজকের প্রজন্মের কাছে তা প্রায় অজানা। সত্যেন সেনের গোটা জীবনের কর্মকাণ্ডের প্রায় সবটাই ব্যাপ্ত ছিল বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। বহুধাবিভক্ত তার কর্মকাণ্ড। একদিকে রাজনৈতিক অভিধা, অপরদিকে বাংলা ভাষায় ধ্রুপদী ধারার উপন্যাস এবং চরিত্রের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে যে এক অনবদ্য অবদান সত্যেন সেন রেখে গিয়েছেন, তার প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।
বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী পরিবারের সত্যেন সেন জন্মেছিলেন। পদ্মা, ধলেশ্বরীর বিপুল জলধারার এক রসসিক্ত ভূমি ছিল সত্যেন সেনের মানসলোক গঠনের প্রধান বিষয়। কৈশোর কাল থেকেই বিপ্লবী জীবনে যেন প্রতি পরতে তিনি কখনো এগিয়েছেন ঝঞ্ঝার বেগে, কখনো এগিয়েছেন শান্ত ধীর পদক্ষেপে । এমন দীর্ঘপথ চলার পর ১৯৮১ সালে ৭৪ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে নিজের দিদির বাড়িতে তার জীবন দীপ নিভে যায়।
পদ্মা- ধলেশ্বরীর অববাহিকায় বেড়ে ওঠা মানুষটি একদম জীবন সায়াহ্নে, যখন তিনি দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন, শারীরিক শক্তিও প্রায় নি:শেষিত- এরকম একটা সময়ে তারুণ্যের, যৌবনের দিনগুলিকে ধরতে ছুটে গিয়েছিলেন কোপাই নদীকে দেখতে। অথচ কোপাই তখন জলহীন, শীর্ণ। কোপাইকে দেখে যেন সত্যেন সেন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাঁর জীবনের অস্তমিত সূর্যের আলোতে বাঙালি মনীষার এক চরম ক্রান্তিকাল ।
এ সময়ের ছায়াতে সত্যেন সেনকে কাছ থেকে দেখবার সুযোগ যারা পেয়েছিলেন, তাদের বুঝতে পেরেছিলেন, তার মধ্যে কেন শেখ সাদির মত কবিতা লেখার জন্য দুটো জীবনকালের আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে। শেখ সাদি চেয়েছিলেন- একটা জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। আর একটা জীবন অভিজ্ঞতাকে কবিতার মানস প্রতিমা প্রাণদানের জন্য।
৭৪ বছর বয়সে জীবনদীপ নির্বাপিত হওয়ার সময়, বিপ্লবতাপস সত্যেন সেন যেন তার প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে, নিজ সাহিত্যকে আবার নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন।
জাতীয় আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবী ধারায় সেই কোন্ ছোটবেলা সত্যেনের হাতেখড়ি। তিরিশের দশকের শুরু থেকেই তার পলাতক জীবন সশস্ত্র ধারার জাতীয় আন্দোলনের স্বার্থে। এসব একদিকে যেমন তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে পরিপূর্ণতা দিয়েছে, অপরদিকে তেমনি তার বোধের জায়গাতে সমাজতন্ত্রের চেতনাকে একটা দৃঢ় সংবদ্ধ অভিধারাতে প্রতিষ্ঠা করেছে।
দীর্ঘ সাত বছর জেল এবং অন্তরীণ জীবন তাকে দিয়েছে- জীবন সম্বন্ধে এক বেদনার বেড়াজালে বন্দি এক 'আনন্দঘন' অভিজ্ঞতা। এ সময়ে কারাবাস থেকে মুক্তির পর, কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা, কমিউনিস্ট পার্টির একজন তুখোড় সংগঠক হিসেবে কৃষক সমিতির ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গের গ্রাম-গ্রামান্তরে জীবন-জীবিকার লড়াইকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি। সমাজতন্ত্রের শেকড়কে মাটির একদম গভীরে পৌঁছে দেওয়ার যে তাগিদ- এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের খুব কমই আছে।
সত্যেন সেনের সহযোগী সোমেন চন্দের যে অভিজ্ঞতা ছিল কৃষক- শ্রমিক সমাজের মধ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে, একদম প্রত্যক্ষভাবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করার ভেতর দিয়ে, তেমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-গোপাল হালদার, পরে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিছুটা হলেও সমরেশ বসু।
জেলজীবন কালেই সত্যেন সেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জীবনকে সম্পৃক্ত করে, মানব মুক্তির লক্ষ্যে নিজের জীবনকে পরিচালিত করার তাগিদে, তিনি পারিবারিক দারিদ্র সত্ত্বেও শিক্ষকতার পেশাকে গ্রহণ করেননি। সে যুগে কৃষক সমিতির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে এভাবে রাজনৈতিক জীবন বেছে নেওয়ার ঘটনা কিন্তু খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না।
হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে-র মত মানুষজন, এরাও কিন্তু সেই সময় কখনই রাজনীতির সর্বক্ষণের কর্মী হননি। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এই দিক থেকে সত্যেন সেন, গোপাল হালদার, সোমেন চন্দ ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
পারিবারিক সূত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে সত্যেন সেনের একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের জেরেই তিনের দশকের শেষদিকে জেল জীবনের বেশ কিছুদিন পরে তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় শান্তিনিকেতন থেকে গবেষণার জন্য একটা বৃত্তি পর্যন্ত পেয়েছিলেন। পারিবারিক স্তরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে ঐতিহ্য সত্যেন সেনের ছিল, তাকে তিনি পরিচালিত করেছিলেন নিজের জীবনে গণসংগীত রচনা ভেতর দিয়ে। সেই গণসংগীতকে তিনি পরিচালিত করেছিলেন ঢাকা জেলার কৃষকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে । এ সময়ে কলকাতার কৃষক সমিতির বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সত্যেন সেনের লেখা গণসঙ্গীত পরিবেশিত হতো।
সোমেন চন্দের পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পর তার অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কমরেড সত্যেন সেন শহীদ বন্ধুর বেয়নেট তার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দেশভাগের পর , তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা আন্দোলনের যে ব্যাপ্তি, তাকে সাধারণভাবে আমরা রাজশাহী জেলার নাচোল অঞ্চলের কৃষক আন্দোলন এবং ইলা মিত্রের কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইলা মিত্রের উপর নাচোল থানায় পাকিস্তানি পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণ এবং ইলা মিত্রের আদালতে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক জবানবন্দি- সেগুলি একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেলেও, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের একটা চরম পরিণতি হিসেবে তেভাগা কর্মকাণ্ডকে ব্যক্ত করার ভেতর দিয়ে, পশ্চিম পাকিস্তান যে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন মুসলিম জাতীয়তাবাদের চিন্তা ধারণাকে চাপিয়ে দিয়ে, বাঙালির ভেতরের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করে তুলতে চেষ্টা করেছিল, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে জোরদার করে দেওয়ার একটা তাগিদ দেখাতে শুরু করে দিয়েছিল- সেসব বদমায়েশির বিরুদ্ধে সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ এবং সত্যেন সেন, কৃষক সভার ভেতর দিয়ে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বস্তুত সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, সত্যেন সেন প্রমুখের নেতৃত্বে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক আন্দোলন ভূমিতে শেকড় বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তার জেরেই কিন্তু সেই দেশের মাটি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে অপসারিত করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামক অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠাতার একটা প্রস্তুতকালীন পটভূমি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা আন্দোলনের যে কর্মকাণ্ড মনসুর হাবিবুল্লাহ এবং সত্যেন সেন ও তাদের সহযোগিরা মিলে ব্যপ্ত করতে পেরেছিলেন, সেই গোটা পটভূমিকে কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনার সামাজিক ভিত্তিভূমির একটি অঙ্কুরোদগম হিসেবে দেখা দরকার। এ পরিস্থিতি নিজেকে যেভাবে মেলে ধরতে পেরেছিল, তাই-ই পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রচনা করেছিল।
দেশভাগের অব্যবহিত পরে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের নানাভাবে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা। এই কাজে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে যেসব সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতো জাতীয় আন্দোলনেরকালে, সেসব কর্মকাণ্ডের সংগঠকদের খুব একটা যে নিরপেক্ষ ভূমিকা ছিল, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সংযুক্ত লোকেরা এই সময়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার রাজনৈতিক পটভূমি অনুযায়ী, ক্রমশ নিজেদের 'ট্রটস্কিপন্থি' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে। তারা কমিউনিস্টদের প্রধান শত্রু হিসেবে ধরে নেয়। সুভাষচন্দ্র বসুর প্রথম জীবনের রাজনৈতিক সহকর্মীরাও বিশেষভাবে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শোনাতে শুরু করে।
এই সম্মিলিত শক্তি-ই কিন্তু সোমেন চন্দকে খুন করে। সেই সম্মিলিত শক্তি-ই কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিকে পূর্ব পাকিস্তানে নানাভাবে অসুবিধার মধ্যে ফেলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে একযোগে এই দ্বিমুখী আক্রমণকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহ এবং সত্যেন সেন, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
সোমেন চন্দ শহীদ হওয়ার পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষিত বেশ ভালো রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষতি হয়। কমিউনিস্টরা যাতে কোনো অবস্থাতেই পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে, এজন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি চিন্তা ধারায় যে সমস্ত ব্যক্তিরা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, তারা কমিউনিস্টদের উপরে নানা ধরনের পাশবিক রাষ্ট্রীয় অত্যাচার নামিয়ে আনে।
এ অত্যাচারের উদাহরণ হিসেবে আমরা রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালানো ঘটনার উল্লেখ করতে পারি। অপরদিকে এককালে যারা সশস্ত্র বিপ্লবী চিন্তাধারার ভেতর দিয়ে ইংরেজকে এদেশ থেকে তাড়ানোর ধারণায় জীবনপণ করে লড়াই করেছিলেন, সেইসব মানুষদের একাংশের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে যে কমিউনিস্টবিরোধী মানসিকতা তৈরি হয়েছিল, তাকে খুব জোরদারভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা, পূর্বপাকিস্তানে কমিউনিস্টরা যাতে কোনভাবে শক্তিশালী হতে না পারে, তার জন্য ব্যবহার করেছিল। এই লক্ষ্যে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় পূর্বতন অনুশীলন সমিতির লোকজনেরা। এরাই পরবর্তীতে 'ট্রটস্কিপন্থি' হয়ে কমিউনিস্টবিরোধিতায় মেতে উঠেছিল। এঁরা পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র পরিচালিতের লক্ষ্যে আরএসপি নামক একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করে।
অপরপক্ষে ছিলেন সুভাষচন্দ্রের অনুগামীরা। তবে এসব সুভাষচন্দ্রের অনুগামীরা কিন্তু ছিলেন আইএনএ প্রতিষ্ঠার আগে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন ছিলেন- ফণিভূষণ মজুমদার। যিনি খুনি খোন্দকার মোশতাক মন্ত্রীসভার সদস্যও ছিলেন। আইএনএ প্রতিষ্ঠার পর এই সমস্ত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সংযোগ প্রায় সম্পর্কই ছিল না বলা যেতে পারে।
এরকম একটি সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে, কমিউনিস্টদের সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে ৪৭ এর পরে সত্যেন সেনের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলনকে একটা সুসংবদ্ধ রূপ দিয়েছিল। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ নেতৃত্বে একটা ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রম চলেছিল। তেমনি ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে, সমাজতন্ত্রের চিন্তায় নিজের জীবনকে উৎসর্গীকৃত করে- কমিউনিস্ট পার্টিকে কেন্দ্র করে থাকা, কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজনদের সঙ্ঘবদ্ধ করা, গোপন সংগঠন পরিচালনা করা , আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ৪৭ এর পরের সময়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন সত্যেন সেন।
এ সময়ে আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের ত্রিমুখী আক্রমণে কমিউনিস্টদের একটা ভয়ঙ্কর রকমের কোণঠাসা অবস্থা ছিল। সদ্য গঠিত পূর্বপাকিস্তানে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেনের কর্মকাণ্ড, সেটি অবশ্য তিনি খুব বেশিদিন চালাতে সক্ষম হননি। কারণ ১৯৪৯ সালে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। ১৯৫৩ সালে মুক্তিলাভ করেন এবং থেকে যান ঢাকা পূর্বপাকিস্তানেই।
১৯৫৩-৫৪ সালে অবিভক্ত পাকিস্থানের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হওয়ার প্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি হয়, সেটাকে কাজে লাগিয়ে সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে আবার কমিউনিস্টদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড শুরু হয় । তবে পাকিস্তানের শাসকেরা আধা সামরিক শাসন জারি করে । যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভাকে অপসারিত করে এবং মুক্তবুদ্ধির পক্ষের সমস্ত ধরনের মানুষজনদের উপরে নামিয়ে আনে অত্যাচারের স্টিমরোলার ।
এ সময় আবার জেলে যেতে হয় সত্যেন সেনকে। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিন বছর 'সংবাদ' এ তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সংবাদ পত্রিকায় শহীদুল্লাহ কায়সারের মত মানুষজনদের সহকর্মী হিসেবে সত্যেন সেন পেয়েছিলেন। এই সময়কালে তেভাগা আন্দোলন এবং হাজং আন্দোলনের উৎস সন্ধানে পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে ধরনের ক্ষেত্রসমীক্ষা সত্যেন সেন করেছিলেন, তাকে এককথায় আন্তর্জাতিক স্তরের ক্ষেত্রসমীক্ষা বলে উল্লেখ করতে হয়।
সেসব ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং ব্যক্তিগত নানা অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি রচনা করেছিলেন, 'গ্রাম বাংলার পথে পথে' নামক এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ। পূর্ব পাকিস্তানের গোটা বাঙালি সমাজের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে সত্যেন সেনের লেখা 'গ্রাম বাংলার পথে পথে' গ্রন্থখানি একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে। কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি, মেহনতি জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি- যার মূল লক্ষ্য ছিল- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। এ দাবি পরিচালনার লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উৎপাটন করে, একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা, যা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পরিচালিত হবে- সত্যেন সেনের এই গ্রন্থটি জনতার অভিষ্পার একটি জ্বলন্ত স্বাক্ষর।
এ সময়েই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে 'মহা বিদ্রোহের কাহিনী ' নামক সত্যেন সেন যে গ্রন্থটি রচনা করেন সেটিও বাংলা ভাষায় লেখা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল।
গণ আন্দোলনকে সাহিত্যের অঙ্গনে একটি ধ্রুপদী ধারাতে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের দুটি নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। একজন হলেন- শহিদুল্লাহ কায়সার এবং আরেকজন সত্যেন সেন। শহীদুল্লাহ কায়সার জেলে বসে 'সংশপ্তক' নামক যে অসামান্য গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, গণআন্দোলনকে প্রেক্ষিত হিসেবে উপস্থাপিত করে, এমন ধ্রুপদী অঙ্গের সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ঠ অবকাশ আছে।
'গণদেবতা' ইত্যাদি উপন্যাসের ভেতর দিয়ে গণ-আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠা করার একটা চেষ্টা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু গণআন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে শহীদুল্লাহ কায়সার, সোমেন চন্দ, সত্যেন সেনদের মতো কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তার ছিলনা।
তাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সৃষ্টি বা সত্যেন সেনের সৃষ্টিকে তারাশঙ্করের উপন্যাসগুলোর পাশাপাশি রেখে যদি তুলনামূলক আলোচনা করা যায়, তাহলে খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যাবে, গণআন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে শহীদুল্লাহ কায়সার বা সত্যেন সেনের সৃষ্টির পূর্ণতা , আর তারাশঙ্করের সৃষ্টির অপূর্ণতা এবং খামতির দিকগুলো।
আমাদের দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী সাহিত্য-সমালোচকরা পূর্বতন পূর্ব-পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশের সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যকে বা সেসব সাহিত্যের স্রষ্টারা যখন জন্মসূত্রে মুসলমান হন, তাদের ক্ষেত্রে কাগজ কলমের আঁচড় ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্পণ্য দেখিয়ে থাকেন। তাই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সোমেন চন্দ, সত্যেন সেন- শহীদুল্লাহ কায়সার বা তার ভাই জহির রায়হান যে সমস্ত অমূল্য সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে রেখে গিয়েছেন- সেসব সম্পর্কে এপারের (পশ্চিমবাংলার) বাঙালিদের সচেতন করার কোনও চেষ্টাই পণ্ডিত মহল করেন নি।
সংগঠক সত্যেন সেন কিন্তু কখনো সাহিত্যিক সত্যেন সেনের ব্যাপ্তিকে অতিক্রম করেন নি। আবার সাহিত্যিক সত্যেন সেন ছাপিয়ে যাননি সংগঠক সত্যেন সেনকে। অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে মেলে ধরতে সত্যেন সেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন শ্রেণি চেতনাকে। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিশ, সত্যেন সেনের জেল জীবনকে তার বই লেখার কারখানা বলে বর্ণনা করেছিলেন।
শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে গভীর দর্শনের উপর কিভাবে সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সত্যি-ই যেন জেল জীবনকে সত্যেন সেন একটা 'ব্লাস ফার্নেস' হিসেবেই নিজের উপলব্ধিতে এনেছিলেন। তা বলে সত্যেন সেনের সাহিত্য সাধনাকে পরবর্তী সময়ে রাণী চন্দ, জয়া মিত্র , মীনাক্ষী সেনের মতো 'প্রিজিন লিটারেচার' বলে একটি কৌণিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া যাবেনা। শ্রেণি-চেতনার অভিষ্পাকে সাহিত্যে ধ্রুপদী ভঙ্গিমায় খোদাই করবার ক্ষেত্রে কেবল বাংলা ভাষার প্রেক্ষিতেই নয়, সার্বিক ভাবে দেশ- কাল- ভাষার নিরিখে সত্যেন সেনের অবদান ঐতিহাসিক। এই প্রেক্ষিত ধরেই বলতে হয়, ১৯৬৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ঢাকা কেন্দ্রিক কিছু প্রগতিশীল তরুণ-তরুণীকে নিয়ে, বিশেষ করে কলিম শরাফীকে সঙ্গী করে 'উদীচী'-র প্রতিষ্ঠা সত্যেন সেনের কেবল সাংস্কৃতিক সংগঠকের ভূমিকা হিসেবেই দেখা ঠিক না। এই 'উদীচী'-র ভেতর দিয়ে শ্রেণি সচেতনতার নিরিখে শিল্পকে পরিচালিত করবার রাস্তাটিকে সত্যেন সেন প্রসারিত করেছিলেন।
'উদীচী' তৈরির সময়েই জেলে পাকিস্থানি পুলিশের অত্যাচারের দরুণ তার দৃষ্টিশক্তি প্রায় ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক শক্তির দিক থেকে, প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছ থেকে যখন উদীচী-কে- দধিচী, ব্যাঙাচি- ইত্যাদি বিদূষণ বাক্যে জর্জরিত করা হয়, তখন কলিম শরাফীকে সঙ্গে নিয়ে যে লড়াই সত্যেন সেন করেছিলেন বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা একটি অধ্যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মূলত শহিদুল্লাহ কায়সারের ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত কৌশলে ঢাকা শহর থেকে বের করে বুড়িগঙ্গা অতিক্রম করে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ভারতে পৌঁছে দেন। কলকাতায় তার বামপন্থি বন্ধুদের ব্যবস্থাপনাতে এই সময়েই চোখের চিকিৎসার জন্যে সত্যেন সেন মস্কোতে যান।
মস্কোর হাসপাতালে তার সাথে নিবিড়ভাবে পরিচয় হয় ভারতের হাজেরা বেগম, আফগানিস্তানের বিপ্লবী নেত্রী আনাহিতা, দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট নেতা মোজেস বোটেন প্রমুখের সঙ্গে। লাওসের এক মুক্তিযোদ্ধা এবং মেক্সিকোর এক বিপ্লবী দম্পতিও তখন সেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এদের সাহচার্য্য কথাসাহিত্যে এই ঘটনাক্রম একটা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আবর্তে উত্তরীত হয়ে, বৈপ্লবিক সংহতির পরিপূর্ণতায় উপনীত হয়।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ফিরে এসে উদীচী-কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতর দিয়ে রাজনীতি সচেতন নাগরিক তৈরির কাজের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখতে শুরু করেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়। মস্কোতে সত্যেন সেনের চিকিৎসায় সেভাবে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় নি। এ চোখের সমস্যা থেকেই তার শারীরিক সমস্যা এতোটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, বায়াত্তর সালের শেষ দিকে সত্যেন সেন চলে আসেন শান্তিনিকেতনে তার দিদির বাড়িতে। শান্তিনিকেতনেও তার শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। এই সময়েও সেবিকাদের সাহায্য নিয়ে সত্যেন সেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যে মানুষটির চিন্তাচতনার সামগ্রিকতাকে একটা চরম পরিপূর্ণতা দিয়েছিল, সেই সত্যেন সেনই ওল্ড টেস্টামেন্টের মত একটি ভাববাদী ধারাভাষ্য করে নামিয়ে আনেন পুরুষের আবেগাপ্লুত অবস্থান আর নারীর দ্বন্দ্বের ভেতরে তার 'অভিশপ্ত নগরী' আর 'পাপের সন্তান' আখ্যান দুটির ভেতরে।
তখন এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে- একজন যথার্থ বস্তুবাদী, ভাববাদের সমাজতত্ত্বের ভেতরেও শ্রেণি সংগ্রামের শেকড়কে কতোখানি সফলভাবে অনুসন্ধান করতে পারেন- সেই বৈজ্ঞানিক সত্যটি। প্রাচীন যুগের বিশ্বাস আর সাফল্যহীনতার দোলাচালে সমাজবীক্ষণে সেইসময়ের ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব- এমনভাবে সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বাংলাতে সত্যেন সেনের আগে কেউ দেখেছিলেন বলে মনে হয় না।
পুরুষমেধ, কুমারজীব, আলবেরুণী, মসলার যুদ্ধ, অভিযাত্রী, অপরাজেয়, মেহনতি মানুষ, বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম, ভোরের বিহঙ্গী, পদচিহ্ন, উত্তরণ, মনোরমা মাসীমা, সীমান্ত সূর্য গফফর খান, সেয়ানা- এগুলো বাংলা সাহিত্যের এক চিরকালীন সম্পদ। সত্যেন সেনের মত মানুষ পশ্চিমবঙ্গের বুকে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। অথচ এ মানূষটিকেঘিরে পশ্চিমবঙ্গে কোনও চর্চাই নেই বলা যেতে পারে। আপাদমস্তক মার্কসবাদী সত্যেন সেনকে ঘিরে 'দেশহিতৈষী ' পত্রিকার অরুণ চৌধুরী (যার পত্নী রেখা বাগচির রাজশাহী জেলায় তেভাগা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা ছিল) কিছু আলোচনা করেছিলেন। সেই আলোচনা বই আকারে একটা সময়ে প্রকাশও হয়েছিল। কালের নিয়মে অরুণ চৌধুরীর সেই বই এখন আর পাওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি ধারার কোনো স্তরেই বিগত কুড়ি বছরে সত্যেন সেনকে নিয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে কিনা সন্দেহ।