Published : 09 May 2020, 08:20 PM
পরিযায়ী পাখি প্রতি বছর যে ভৌগলিক পথে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নিয়মিতভাবে পরিভ্রমণ করে থাকে তাকে 'উড়ন্ত পথ' বলে। দেশান্তরী হওয়ার মূল কারণ গুলোর মধ্যে ঋতু পরিবর্তন খাদ্যের স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও বংশানুক্রমিক ধারা অন্যতম। শীত মৌসুমে হিমালয় পর্বতমালা এবং সাইবেরিয়া থেকে, কদাচ উত্তর মেরু থেকেও কিছু পাখি আমাদের দেশে প্রতি বছরই আসে এবং আবার ফিরে যায়। বার্ষিক এই আসা-যাওয়াই হচ্ছে পাখির পরিব্রজন, অভিপ্রায়ন। অভিপ্রায়ত পাখিকে আমরা বলি শীতের পাখি, অতিথি পাখি, পরিব্রাজক, যাযাবর বা পরিযায়ী পাখি।
আমাদের দেশে দু'দলের শীতের পাখি বা অতিথি পাখি আসে। এদের এক দল কেবল এদেশেই আসে এবং এখান থেকেই ফিরে যায়। অন্য দল বাংলাদেশ থেকে আরো দক্ষিণে যায়। তারা এই আসা যাওয়ার সময় বাংলাদেশে কিছু সময় ব্যয় করে। এদেশে যাবার জন্য শীতের পাখিদের দেহে কিছু বাহ্যিক এবং কিছু আভ্যন্তরীণ উদ্দীপক কাজ করে। প্রথম উদ্দীপক হচ্ছে চামড়ার নিচে খুব পুরু হয়ে জমে উঠা চর্বি। দ্বিতীয় হচ্ছে, আবহাওয়াগত যেমন দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, দৈনিক গড় তাপমাত্রা এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ।
সারা দুনিয়ার পাখির প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৯৯০০ থেকে ১০০০০ বলে পাখি বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন। সালীম আলী এবং এস ডি রিপলের মতে বাংলাদেশ, "ভারত ও পাকিস্তান উপমহাদেশে পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১২০০। প্রফেসর ড. মনিরুল এইচ খান (২০১৮) সাম্প্রতিক প্রকাশিত Photogrphy Guide to Wildlife of Bangladesh বইটিতে ৫৬৬ প্রজাতির পাখির তালিকা প্রকাশ করেছেন এবং তিনি ধারণা করছেন বাংলাদেশে ৬৯০ প্রজাতির পাখি আছে। অন্যদিকে Siddique et. al (২০০৮) সম্পাদিত Encyclopedia of Flora and Fauna of Bangladesh Vol. 26 গ্রন্থে ৬৫০ প্রজাতির পাখি আছে বলে উল্লেখ করেছেন। যারা মোট ২৯৫ গণের ৬৪ টি পরিবারের ১৬ টি বর্গের অন্তর্ভূক্ত। বিগত কয়েক দশকে আমাদের দেশ থেকে উনিশ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে, ১০ প্রজাতি পাখি মহাবিপদাপন্ন, ১২ প্রজাতি বিপন্ন, ১৭ প্রজাতি সংকটাপন্ন, ২৯ প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। প্রফেসর ড. মনিরুল এইচ খান এর মতে ৬৯০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৩৭টি আবাসিক, ২০৮টি শীতকালীন পরিযায়ী, ১২টি গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী, ১৩৩টি অন্তর্ভুক্তিকালীন পরিযায়ী পাখি।
সম্প্রতি IUCN বাংলাদেশ (২০১৫) রেডবুকে ৫৫৬টি প্রজাতির বিস্তৃতি ও বর্তমান জীবনদশা সংক্ষেপে তুলে ধরেছে। দু'টি তালিকা তুলনা করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং তা হলো এদের অবস্থার বা জীবনদশার বিস্তর পরিবর্তন। বিগত দু'দশকে কিছু কিছু প্রজাতি ব্যাপকহারে কমে যাওয়ায় এদের অবস্থা বা জীবনদশা আশংকাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। অনেক প্রজাতির ক্ষেত্রে তাদের বিস্তার বা বাসস্থান ও অবস্থার উপর তেমন কোনো তথ্যই নেই। এদেরকে তথ্য অপর্যাপ্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্থানীয় পাখি প্রজাতির মধ্যে এ সংখ্যা ১৫৮টি এবং পরিযায়ী পাখিতে ৪টি। হুমকিগ্রস্ত বর্গগুলোর মধ্যে Ciconiiformes এর জীবনদশা সবচেয়ে বেশি শংকাগ্রস্ত। এরপর রয়েছে Passeriformes ও Galliformes বর্গ। হুমকির সম্মুখীন প্রজাতির মধ্যে ১৯টি মহাবিপন্ন, ২০টি বিপন্ন, ৮টি সংকটাপন্ন এবং ৬টি কম সংকটাপন্ন। খান (১৯৮২) ও আইইউসিএন বাংলাদেশ (২০০০) কর্তৃক প্রকাশিত তালিকার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে পাখির অতীত ও বর্তমান অবস্থা এবং বিস্তৃতির তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অত্যাধিক কীটনাশক ও প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার, পাখির বসতি ধ্বংস, পরিবর্তন, খণ্ডায়ন, অতিমাত্রায় পাখি শিকার, বনাঞ্চল উজাড় এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব ইত্যাদি পাখির জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
জাতিসংঘের UNEP (United Nation Environment Programme), CMS (Convention on Migratory Species of Wild Fauna) ও অন্যান্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর ৯-১০ মে তারিখে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল হতে জাতীয়ভাবে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে ২০২০ সালে প্রতিপাদ্য বিষয় 'Birds Connect Our World' যার ভাবার্থ "পাখির মাধ্যমে যুক্ত সমগ্র বিশ্ব" নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী শীতের পাখি আসে ভরা শীতে মানে পৌষ ও মাঘে। অধিকাংশ শীতের পাখি আসে সাইবেরিয়া থেকে। এ দুটি ধারণা বহুলাংশে মিথ্যা। অনেক সময় জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এবং অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রথম শীতের পাখি বাংলাদেশে আসে। সাধারণ চা পাখি (Common Sandpiper) দেশের প্রায় সব এলাকায় অল্প বিস্তর পৌঁছায়। এ সময় হাজারো আবাবিল পৌঁছায় টেকনাফ থেকে কুমিল্লা এবং জামালপুর ময়মনসিংহের গারো পাহাড় এলাকায়। ঢাকা শহরে অগাস্টের মধ্যে চলে আসে বাদামী কসাই (Brown Shrike), লালবুক চটক (Taiga Flycatcher) এবং শীতের ভূবন চিল (Pariah Kite/Black Kite)। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আসে খঞ্জন, চাপাখি, কাদাখোঁচা, চ্যাগা, গুলিন্দা, বাটান, জিরিয়া, জল কবুতর, ওয়ার্বলার, চটক প্রভৃতি দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ছেয়ে ফেলে। হাওরে চরায় এবং খাড়ি অঞ্চলে হাঁস আসতে শুরু করে অক্টোবরে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাস দেশের সর্বত্র শীতের পাখি সর্বাধিক দেখা যায়।
পরিযায়ী পাখির চলাপথ
পরিযায়ী পাখি নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। কোন প্রজাতির পাখি কখন আসে যায় সেটা জানার জন্য জাল পেতে পাখি ধরে তাদের পায়ে, এক ধরনের হালকা এলুমিনিয়ামের তৈরি নম্বরযুক্ত আংটি পরিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জন্য বিভিন্ন সাইজের আংটি থাকে। আংটির উপর নম্বরের সাথে এও লেখা থাকে যে কোন লোক যদি আংটিযুক্ত পাখি পায় তবে যেন সে ওই আংটির খবর যারা আংটি পরিয়েছেন তাদেরকে জানায়। যেমন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির আংটিতে লেখা থাকে Inform Bombay Nat. Hist. Soc. যে বছর আংটি পরানো হলো পরের বছর সেখানে জাল পেতে পাখি ধরে তাদের পায়ের আংটির সাথে মিলালে দেখা যাবে আগের বছরের পাখিরা ফিরে এসেছে কিনা। এছাড়া বর্তমানে সেটেলাইট কলার (Satellite Colar), রেডিও কলার, ডিজিটাল ট্যাগ ও মাইক্রোচিপস ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য ও উপাত্ত পাখিবিদগণ সংগ্রহ করছেন।
পৃথিবীতে ৯টি উড়ন্ত পথের নেটওয়ার্ক বা ফ্লাইওয়ে নেটওয়ার্ক আছে যা নিম্নরূপ:
বাংলাদেশ East Asian- Australasian Flyway (EAAF) ও Central Asian Flyway এর অন্তর্ভুক্ত। এই ফ্লাইওয়ের আওতায় বাংলাদেশ, ক্যাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, উত্তর আমেরিকা (আলাস্কা), মঙ্গোলিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কুরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ফিলিপিন্স, সিংঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, লাওপি.ডি.আর, মায়ানমার, ব্রুনেই, পাপুয়া নিউগিনি, নিউজিল্যান্ড ও পূর্বতিমুরসহ ২২টি দেশে পরিযায়ী পাখিরা আনাগোনা করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, EAAF এই উড়ন্ত পথে পৃথিবীর ২৫০ প্রজাতির প্রায় ৫০ মিলিয়ন পরিযায়ী পাখি (৫ কোটি) চলাচল করে থাকে। এর মধ্যে প্রায় ২৮টি পরিযায়ী পাখি অন্তর্জাতিকভাবে মহাবিপন্ন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান পরিযায়ী পাখি
বাংলাদেশে প্রায় ২৫০-৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আছে। এর মধ্যে প্রায় ২১০টি শীতকালীন অতিথি পাখি এবং অবশিষ্ট পাখি বৎসরের অন্য সময় বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে আমাদের দেশে এসে থাকে। অতিথি পাখির মধ্যে উল্লখযোগ্য রাজহাঁস, দাগী রাজহাঁস, রাজ সরালি, পাতি সরালি, মান্দারিন হাঁস, ঝুঁটি হাঁস, চকাচকি, লেঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, বালি হাঁস, তিলি হাঁস, লালশির, নীলশির, গিরিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, ভূতি হাঁস, স্মিউ হাঁস, পাতি মারগেঞ্জার, শুমচা, পাপিয়া, খঞ্জন, ফুটকি, সাহেলি, চ্যাগা, গুলিন্দা, সারস, গ্রিধিনি, মানিকজোড়, এশিয় শামোকখোল, নীলকন্ঠ, বৈরী, চামচ ঠুটো বাটান ও বিভিন্ন জাতের সৈকত পাখি (shore bird) ইত্যাদি।
পাখির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ
পাখির আবাসস্থল ধ্বংস; বন ও গ্রামীণ গাছগাছালি হ্রাস; প্লাস্টিক দূষণ; জলাভূমির জবরদখল; পরিযায়ী পাখির নীলাভূমি হাওড়-বাওরে ব্যাপকহারে মাছ শিকার; নদী ও সমুদ্রের নতুন চরে জেলে এবং শিকারীদের উৎপাত; যথেচ্ছভাবে পাখি পাচার ও নিধনের ফলে ইতোমধ্যে আমাদের দেশে আশংকাজনকভাবে পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া জলাভূমিতে কৃষি সম্প্রসারণ; অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদনের জন্য যথেচ্ছভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ; চোরা শিকারি কর্তৃক ব্যাপকহারে অতিথি শিকার ও বাজারজাতকরণ; কলকারখানার প্লাস্টিক ও রাসায়নিক বর্জ্য ও কীটনাশকের প্রভাবে পানি দূষণ; বৈশ্বিক উঞ্চতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন; সমুদ্রের পানি লবণাক্ততার বৃদ্ধি এবং নতুন জেগে ওঠা চরে মানুষের বসতি ও কৃষি জমির সম্প্রসারণের কারণে পাখির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
পাখি সংরক্ষণের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
পাখিদের অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা বলে শেষ করা দুরূহ। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে ডিম, মাংস ইত্যাদি আহার করে থাকি তা আসে প্রধানত: খামারজাত পাখি থেকেই। তবে অনেক দেশে প্রকৃতি থেকে পাখি ধরে মাংস হিসাবে বাজারজাত করছে। সুতরাং খাদ্যের উৎস হিসেবে পাখি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাখি ইঁদুর এবং অন্যান্য কীট পতঙ্গ খেয়ে আমাদের শস্যের উপকার করছে এবং একই সাথে নোংরা আবর্জনা খেয়ে আমাদের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। শকুন, কাক, চিল না থাকলে গ্রামাঞ্চলের একটি প্রাণীর মৃতদেহ থেকে পুরো এলাকার আবহাওয়া দূষিত হতে পারতো। কোন কোন বীজ আছে সেগুলো কাক বা অন্য পাখির পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ঘুরে না এলে তা থেকে উদ্ভিদ হবে না। আর এসব পাখিদের সাহায্যে দূর-দূরান্তের গাছের বীজ চলে আসে নতুন জায়গাতে।ফুলের পরাগায়নেও পাখিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষত ছোট ছোট পাখিরা যখন এক ফুল থেকে অন্য ফুলে যায় তখন পালকে ফুলের পরাগরেণু মেখে নেয়। এভাবে পরাগায়ন হয়ে ফুল থেকে ফল হয়। চড়ুই বা অন্য পাখিরা খেতের ধান খেয়ে আদৌ কোন ক্ষতি করে কিনা, বা কতটুকু ক্ষতি করে সেটা নির্ণয় সাপেক্ষ। বাংলাদেশে চড়ুইসহ অন্যান্য পাখি কেবল ধানই খায় না, ধানের ক্ষতিকারক বিভিন্ন কীটপতঙ্গও খেয়ে থাকে। সুতরাং এদেরকে শস্যের ক্ষতিকারক বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এভাবে আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত গভীরভাবে জড়িত হয়ে আছে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। পাখি আমাদের ইকো-সিস্টেমের অংশ এবং এদের সংখ্যা হ্রাস পেলে তার প্রভাব আমাদের উপর পড়বে।
আমাদের দেশের হাওর-বাওর ও চরাঞ্চলে শীতের অতিথি পাখি দেখার জন্য হাজার-হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে থাকে। পরিবেশ পর্যটনকে উৎসাহিত করার জন্য পরিযায়ী পাখি ও আবসস্থল সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে পাখি মরার সঠিক তথ্য ও উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। তবে প্রতিদিন সারাদেশে বিভিন্ন জাতের পাখি শিকার, পাঁচার ও নিধনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই আমাদের দেশ থেকে পাখি বিলুপ্ত ও বিপন্ন হয়ে যাবে।
জলাভূমি সংরক্ষণের গুরুত্ব
বাংলাদেশে প্রায় ৬.৮ মিলিয়ন হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। এর মধ্যে নদ-নদী,খাল-বিল, হাওড়-বাওর, লেক-পুকুর, ঝর্ণা, সমূদ্র, উপকূল ইত্যাদি। এ সকল এলাকায় বছরের বিভিন্ন সময় পরিযায়ী পাখি বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে শীতকালে আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা সর্বাধিক। বিশেষ বৃহত্তর সিলেট এলাকার টাঙ্গুয়ার হাওড়, হাকালুকি হাওড়-বাওড় ও বাইক্কা বিলসহ বিভিন্ন জলাভূমি এলাকায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। এ সমস্ত এলাকা একদিকে যেমন মিঠা পানির মাছের জন্য সমৃদ্ধ অন্যদিকে পাখির আবাসস্থলের জন্য খুবই উপযোগী। গত বছর আগাম পাহাড়ী ঢলের কারণে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রায় সকল হাওরের উঠতি ফসল, মাছ, হাঁস ও গবাদিপশুসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে হাওড়ে জলজ জীব বৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে এবং এর ফলে এ বছর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব
প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে ৩০০ মিলিয়ন টনের অধিক প্লাস্টিক সামগ্রী মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য পচনশীল নয় এবং প্রায় ২০ থেকে ৫০০ বছর ব্যবধানে পঁচে মাটি বা পানিতে দ্রবীভূত হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার অনেক বেশি। বিশেষ করে প্লাস্টিক ব্যাগ, পানি বা তৈল জাতীয় পদার্থের বোতল, গ্লাস, থালা ও অন্যান্য সামগ্রী ওজনে কম এবং পরিবহনের সুবিধার কারণে দিন দিন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবহারের পরে এসকল প্লাস্টিক দ্রব্যাদি যত্রতত্র আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেওয়ার কারণে জলজ ও স্থলজ পরিবেশ ব্যাপক হারে দূষিত হচ্ছে। অধিকাংশ পরিযায়ী পাখির চারণভূমি সমুদ্র সৈকত, নদী, খাল, হাওড়-বাওর ইত্যাদি তীরভূমি। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়। প্লাস্টিক সহজে পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং পানি, সূর্য ও বায়ু প্রবাহের কারণে ছোট ছোট টুকরায় বিভক্ত হয়ে পানিতে ভাসমান অবস্থায় থাকে। বিশেষ করে পানির শ্যাওলা জাতীয় গাছ প্লাষ্টিক বর্জ্যরে উপর আশ্রয় করে ভাসমান থাকে এবং পাখি ও মাছ সহ অন্যান্য জলজ প্রাণী খাদ্যের সাথে প্লাস্টিক পাকস্থলিতে ঢুকে যায় এবং পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতিসাধন ও জটিল রোগ সৃষ্টি করে। এছাড়া নাইলন ও প্লাস্টিকের জালে আটকা পড়ে অনেক পাখি মারা যায়। মৃত পাখির দেহবশেষ পরীক্ষা করে পেটের ভিতর অনেক ছোট ছোট প্লাস্টিক টুকরা ও কণা পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্র সৈকতে আসা পাখি খাদ্যগ্রহণের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে প্লাস্টিকের ছোট ছোট অংশ খাদ্যনালীতে চলে যায়। শুধু তাই নয় পাখির ছোট বাচ্চাদের খাবার গেলার সময় প্লাস্টিক কণা পেটে চলে যায় এবং অকালে বাচ্চা মারা যায়।
পাখি সংরক্ষণে বন বিভাগের গৃহীত পদক্ষেপ
পাখি আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আপনারা জেনে খুশি হবেন বাংলাদেশ বন বিভাগ অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজে বিশেষভাবে নিবেদিত। ইতোমধ্যে সারাদেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট গঠন করা হয়েছে এবং ২০১৮ সালে প্রায় ১০ হাজার পাখি উদ্ধার করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়েছে। পাখিসহ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকার নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন:
১. বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ সংসদে পাশ হয়েছে এবং উক্ত আইনের ১নং ও ২নং তফসীলে ৬৫০ প্রজাতির পাখি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২. পরিযায়ী পাখি শিকার হত্যার জন্য সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১(এক) লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
৩. সুন্দরবন ও টাংগুয়ার হাওরকে Ramsar Site ঘোষণা করা হয়েছে।
৪. বাংলাদেশ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১ সালে EAAFP (East Asia Australasian Flayway Partnership) এর সদস্য হয়েছে এবং ৫টি এলাকাকে Flyway Site ঘোষণা করেছে এর মধ্যে টাংগুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, সোনাদিয়া ও নিঝুম দ্বীপ।
৫. সারাদেশে পাখি ব্যবসায়ীদেরকে বন্যপাখি ধরা বা বিক্রয় না করার জন্য সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
৬. পাখিসমৃদ্ধ এলাকা ও পাখিপ্রেমী ব্যাক্তিদেরকে উৎসাহিত করার জন্য Bangabandhu Award for Wildlife Conservation প্রদান করা হচ্ছে।
৭. স্কুল/কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন করার জন্য সারাদেশে সভা সমাবেশ আয়োজন করা হচ্ছে।
৮. বিরল প্রজাতির শকুনের মরণঘাতী ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সুন্দরবন ও সিলেটের দুটি Vulture Save Zone ঘোষণা করা হয়েছে।
৯. সারাদেশে ৪টি অঞ্চলে উদ্ধারকৃত ও আহত পাখিকে সেবাদান করার জন্য বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখিদের সংরক্ষণের গুরুত্ব সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি আমাদের দেশের পরিবেশ ও পর্যটন শিল্পকে প্রসারিত করবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিযায়ী পাখির ইতিবাচক ভূমিকা সমন্ধে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদসহ সকলকে সোচ্চার হতে হবে। পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল সমুদ্রতট, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর ইত্যাদি জলাভূমি সমূহ জবর দখলের হাত থেকে সুরক্ষা, পরিবেশ ও প্লাষ্টিক বর্জ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। পাখ-পাখালির কলতানে আমাদের দেশ ভরে উঠুক এই প্রতাশা করছি।