Published : 26 Apr 2020, 01:26 PM
নিজেদের উদ্ভাবন করা করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নির্ণায়ক (করোনা টেস্টিং কিট) এর নমুনা হস্তান্তরের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল গণস্বাস্থ্য সংস্থা। সেই অনুষ্ঠানে সরকারের কোনও প্রতিনিধির উপস্থিত না থাকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হচ্ছে।
যারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, তাদের প্রায় সবাই এর পেছনে রাজনীতি দেখছেন এবং তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ধরনের মধ্যেও রাজনীতিই প্রকট। টেস্টিং কিট এর কার্যকারিতা কিংবা নতুন একটি কিট এর অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কের চেয়েও রাজনীতিটাই মুখ্য সেসব আলোচনায়। সেই রাজনীতিটা অবশ্যই সরকারের বিরোধিতা এবং সমালোচনার।
গণস্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজন করেছিল তাদের উদ্ভাবিত কিটের নমুনা হস্তান্তরের অনুষ্ঠান। কিন্তু যারা এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন- তারা এটিকে বানিয়ে দিয়েছেন 'কিট হস্তান্তরের' অনুষ্ঠান। তারা যে না জেনে এটি করছেন, তা নয়। সচেতনভাবেই তারা প্রচার করতে চাচ্ছেন- গণস্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস নির্ণয়ের কিট বানিয়ে সরকারকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সরকারের কেউ সেটি নিতে আসেনি। এই মিথ্যা প্রচারণাটাও করা হচ্ছে রাজনীতি থেকেই।
গণস্বাস্থ্য সংস্থার কিটটি এখন পর্যন্ত কোনও 'কম্পিটেন্ট অথরিটি' কর্তৃক পরীক্ষিত এবং অনুমোদিত নয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিজস্ব পরীক্ষায় এটি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন তাদের অনুমোদনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে জমা দেয়ার পালা। তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রথমেই যাওয়ার কথা বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের কাছে। সেখান থেকে এর কার্যকারিতার সপক্ষে সনদ পাওয়া সাপেক্ষে ওষুধ প্রশাসনের কাছে যাবে এর বাজারজাতের অনুমোদনের জন্য। এই দুটি প্রক্রিয়ার কোনোটাতেই অনুষ্ঠান করে মন্ত্রী-এমপিদের ডেকে এনে দেখানোর কিছু নাই। তবু গণস্বাস্থ্য সংস্থা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্নটা কেউ তাদের করেননি- যে জিনিস পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনুমোদন দেয়া হবে, সেটি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের জন্য অনুষ্ঠান করতে হবে কেন? কর্তৃপক্ষকেই বা অনুষ্ঠানে এসে সেটি নিতে হবে কেন?
কম্পিটেন্ট কোনও অথরিটি কর্তৃক এর কার্যকারিতা পরীক্ষিত এবং অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত এটি সম্ভাবনা মাত্র। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষকরা তাদের উদ্ভাবিত নানা কিট সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে অনুমোদনের জন্য জমা দিচ্ছেন। অনুমোদন পাওয়ার পর সংস্থাগুলো জানিয়ে দিচ্ছেন- তাদের কিট অনুমোদিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও সেটি হওয়াই উচিৎ। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং তার গণস্বাস্থ্য নিশ্চয়ই এই নিয়মগুলো জানেন। তাহলে তারা সরাসরি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে নমুনা জমা দিতে গেলেন না কেন?
গণস্বাস্থ্যের হয়ে যারা কথা বলছেন, তাদের বক্তব্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের নানা সময় অসহযোগিতা করেছে, তাদের নমুনা দিতে চায়নি। এসবই সত্য এবং যখনই এ অসহযোগিতার তথ্য প্রকাশ হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চমহল থেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন এবং উৎসাহ দিয়েছেন। গণস্বাস্থ্য সংস্থার করোনা টেস্টিং কিটের আবিষ্কারক ড. বিজন কুমার শীলও তো বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না'।
এটা তো সত্য, কাঁচামালের আমদানি, শুল্ক সুবিধা দেয়া ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ নিজেও অনুষ্ঠানে এই তথ্য স্বীকার করে তাদের ধন্যবাদ দিয়েছেন। তাহলে সরাসরি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে গিয়ে নমুনা জমা না দিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গেল কেন গণস্বাস্থ্য? নমুনা জমা দিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়ে দিলেই তো প্রচার পাওয়া যেত, সংবাদ মাধ্যমে সেটি রেকর্ডেড হয়েও থাকতো।
গণস্বাস্থ্য সংস্থা এমন সময় নমুনা হস্তান্তরের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে, যখন সারাদেশকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সারা দুনিয়ার মানুষকে ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দিচ্ছে, বাংলাদেশেরও সভাসমাবেশ স্থগিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভা করছেন, করোনাভাইরাস বিষয়ক দৈনন্দিন ব্রিফিং হচ্ছে অনলাইনে। এমন একটি পরিস্থিতিতে দেশের বিজ্ঞানীরা লোকজনকে ডেকে এনে সভার আয়োজন করেন কিভাবে?
সেটি যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার ব্যাপারে ভুল বার্তা দেয়, সেটা কি তারা ভেবেছেন! এমন পরিস্থিতিতে সরকারের কোনও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারই কোনও ধরনের সভা-সমাবেশে যাওয়া অনুচিৎ।
বাংলাদেশের আমলাদের একটা সমস্যা হচ্ছে তারা পরিষ্কারভাবে কোনও কথা বলেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের যখন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তখনই তাদের বলা দরকার ছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো সভা বা অনুষ্ঠান করা যাবে না। তারা আসবেন না, সেই কথাটাও সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয়া দরকার ছিল। কেউ আমন্ত্রণ জানালে সেখানে যেতে না পারলে, আগেভাগে জানিয়ে দেয়াটা যে ভদ্রতা- সেটি তো তাদের অজানা নয়। তাহলে সেটি তারা করলেন না কেন?
গণস্বাস্থ্য সংস্থার কিটটি কতোটা কাজ করবে সেটি আগামীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এখনই তার কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া বা সন্দেহ করার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু এই ধরনের উপাদান নিয়ে বিশ্বের কোনও দেশই তাড়াহুড়ো করছে না। এমনকি যেসব দেশে প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে তারাও না। তবে একটা কথা সত্য, অধিকাংশ দেশেই করোনার পরীক্ষা হয় সোয়াবের মাধ্যমে। রক্তের মাধ্যমে পরীক্ষাটা এখনো সার্বজনীন হয়ে ওঠেনি এবং অনেক দেশেই এটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। গণস্বাস্থ্য সংস্থার কিটটিও রক্তের মাধ্যমেই করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়। ফলে এই পদ্ধতি নিয়ে সতর্ক হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে।
কানাডা এখনো চীন থেকে আমদানি করা কিটের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের টেস্ট করছে। কানাডার দুটি কোম্পানি নিজেদের টেস্টিং পদ্ধতি বের করেছে। যে কোম্পানিটি সোয়াবের মাধ্যমে টেস্ট করে সেটিকে কানাডা অনুমতি দিয়েছে এবং তাদের পণ্য নিতে শুরু করেছে। দ্বিতয়ি কোম্পানিটিকে হেলথ কানাডা এখনো অনুমতি দেয়নি। হেলথ কানাডার বিশেষজ্ঞরা তাদের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য রেখেছে। কবে নাগাদ সেই কার্যকারিতা পরীক্ষা শেষ হবে তার কোনো সময় সীমা তারা জানায়নি। নিয়মিত ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে চেপে ধরেছিলেন সাংবাদিকরা। তিনিও সতর্কভাবেই তার উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন, বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনার পরই এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। কানাডায় কোনো কোম্পানির কাজ নেয়া বা না নেয়ার পেছনে রাজনীতি কাজ করে না, রাজনীতির প্রভাবও থাকে না। কিন্তু কানাডার স্বাস্থ্য বিভাগ মনে করছে, সোয়াব থেকে করোনাভাইরাসের পরীক্ষাটাই বেশি নির্ভরযোগ্য, রক্তেরটা নয়। ফলে তারা রক্তের পরীক্ষায় কার্যকারিতা যাচাই করে দেখতে চাচ্ছে। দেশে করোনা আছে বলেই তাড়াহুড়ো করছে না।
বাংলাদেশ অবশ্যই বাংলাদেশের মতো সিদ্ধান্ত নেবে। অবশ্যই কার্যকারিতা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা চাইবো দ্রুত এর কার্যকারিতা পরীক্ষা হবে। রাজনীতির কারণে যেন ডা. জাফরুল্লাহর গণস্বাস্থ্যের কিটকে ফিরিয়ে না দেয়া হয়। কার্যকারিতা বিবেচনায় এই কিট অনুমোদন না পেলে তা নিয়ে যেন রাজনীতি না হয়।