Published : 23 Apr 2020, 11:27 PM
যখন কোন একটি বিষয়ে বিভ্রান্তি থাকে, থাকে আতঙ্কের ছড়াছড়ি- তখন মানুষ আশ্বস্ত হতে চায়, ভরসা পেতে চায়। যুগে যুগে মানুষই মানুষকে ভরসা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ কিছু না বুঝেই আতঙ্ক বহন করে যেমন নিজের ক্ষতি করে; তেমনি পরিবারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর সেই প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পুরো সমাজে। অবশ্য কৃত্রিম আতঙ্ক তৈরিকারী দুষ্ট কিছু মানুষের সংখ্যাও রয়েছে পৃথিবীতে। কিছু মানুষ আতঙ্ককে পুঁজি করে ফায়দা লোটে। এতে সমাজের ক্ষতি হয়। পিছিয়ে যায় জাতি। একসময়ে আতঙ্কের বিনাশ ঘটে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। আতঙ্কের উল্টো পিঠে পড়ে থাকে অজানা অনেক অমানবিক গল্প। পড়ে আতঙ্ক থেকে সৃষ্ট অনেক কান্না।
আসলে সত্যকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু থাকে না। করোনাভাইরাস নিয়ে এবারও এমনভাবে আতঙ্ক প্রচার করা হয় যে সবাই ভাবতে বাধ্য হচ্ছে, ইংল্যান্ডে পাঁচ লাখ আর আমেরিকায় নাকি ২২ লাখ লোক মারা যাবে!
কিন্তু বাস্তব সত্যটা আসলে কী? ডিসেম্বরের শেষে চীনে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ল। চীনে কত লাখ, কত কোটি লোক মারা যেতে পারে শুরু হলো তারই নানানরকম জল্পনা-কল্পনা। আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। দেশ-বিদেশে ছোটাছুটি করতে থাকল মানুষ। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে গেল পুরো পৃথিবীতে। এরপর বিমান চলাচল বন্ধ। যোগাযোগ বন্ধ। বাস্তবে হলো কী? আজ ২২ এপ্রিল। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬১ জন। মারা গেছেন এক লাখ ৭৮ হাজার ৮৪৯ জন। মৃত্যু সব সময়ই বেদনার। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে তথ্য উপস্থাপনের ধরন যদি মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত।
পয়লা জানুয়ারি থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ১১৩ দিনে করোনাভাইরাসে যত জন মারা গেছেন তাতে গড়ে দৈনিক মারা গেছেন এক হাজার ৫৮২ জন (সূত্র: ওয়ার্ল্ডওমিটার)। অন্যদিকে দৈনিক সারা বিশ্বে হৃদরোগ ও স্ট্রোকজনিত কারণে মারা যান প্রায় ৪২ হাজার মানুষ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের রিপোর্ট)। সে হিসেবে এই ১১৩ দিনে পৃথিবীতে হৃদরোগ ও স্ট্রোকজনিত কারণে মারা গেছেন ৪৭ লাখ ৪৬ হাজার মানুষ। দুইটি সংখ্যার মাঝে তুলনা করলেই সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন বিষয়টি। আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি এই ফাঁকে। প্রতিদিন পৃথিবীতে নানা কারণে মারা যান প্রায় এক লাখ ৫৬ হাজার মানুষ। সে হিসেবে এই ১১৩ দিনে মারা গেছেন এক কোটি ৭৬ লাখ ২৮ হাজার জন। আশা করি, এই তথ্যগুলোই যথেষ্ঠ একজন সচেতন পাঠকের জন্য। প্রশ্ন হল, প্রতিদিন গড়ে ৪২ হাজার মানুষ যখন মারা যান তখন কোথাও কোন প্রশ্ন কেন তোলা হয় না আর গড়ে দেড় হাজার মানুষ যখন মারা যান তখন কেন এত ফলাও করে প্রচারণা চালানো হয়?
২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সব কারণ মিলিয়ে মারা যান আট লাখ ৯০ হাজার ৩৬২ জন। প্রতিদিনের হিসেবে মারা যান দুই হাজার ৪৩৯ জন। একই বছর এক লাখ ৮৮ হাজার ৫৬০ জন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। প্রতি বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এক লাখেরও বেশি মানুষ। এবং প্রতি বছর ক্যান্সারে নতুনভাবে আক্রান্ত হন ১৫ লাখ মানুষ। বছরে এতো এতো মানুষ যে মারা যাচ্ছেন, সেটা নিয়ে আমাদের আতঙ্ক নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসে মৃত্যু নিয়ে আমরা অতিরিক্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি, স্বাভাবিকতা নষ্ট করছি। স্বাস্থ্যগত পাঁচটি প্রধান ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম কারণ যে ধূমপান, সে ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা না বাড়িয়ে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ছি?
তারপরও মৃত্যু করোনাভাইরাসে না অন্য কারণে সে রহস্যেরও কোনো শেষ নেই। এখন ফ্লুর এই সিজনে বয়স্ক যারা মারা যাচ্ছেন তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন নাকি অন্য রোগ তাদের মৃত্যুর কারণ- এটি নিয়েও যুক্তরাজ্য, ইতালি এবং বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের সংশয় রয়েছে, সন্দেহ রয়েছে। ইতালিতে যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগই আগে কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলেন। যুক্তরাজ্য, স্পেন কিংবা ইতালির মৃত্যুর হার যদি আমরা দেখি, তাহলেও এটি খুব সুস্পষ্ট যে, করোনাভাইরাসে তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন; যারা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন।
এ ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে বক্তব্য দিতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর গ্লোবাল ইনফেকশাস ডিজিজ অ্যানালাইসিস-এর প্রফেসর নীল ফার্গুসন খুব পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন যে, আসলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে কতজন মারা গেছেন এটা বলা মুশকিল। কারণ যারা এসময় মারা গেছেন তাদের দুই-তৃতীয়াংশ বা কমপক্ষে অর্ধেক, তাদের বয়স এতোটাই ছিল যে তারা যে কোনোভাবেই এসময়ে মারা যেতে পারতেন। 'করোনাভাইরাস' না হলেও তারা মারা যেতে পারতেন। এদের বয়স ৭০- এর উপরে।
করোনাভাইরাসে মৃত্যুর তথ্যগুলো অন্যদিক থেকে সামান্য বিশ্লেষণ করা যাক। যারা এসময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের মৃদু লক্ষণ দেখা গেছে। আর বাকি তিন শতাংশের অবস্থা 'গুরুতর'। অন্যদিকে, যেসব রোগীর করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে ফলাফল পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ সুস্থ হয়েছেন আর ২০ শতাংশ মারা গেছেন (সূত্র: ওয়ার্ল্ডওমিটার ওয়েবসাইট)।
করোনাভাইরাস নিয়ে এতো আতঙ্ক এতো ভয় বাসা বেঁধে মনের অবস্থা এমন হয়েছে যে, 'করোনাভাইরাস' যেন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। কাউকে পাওয়ামাত্র টুকরা টুকরা করে খেয়ে ফেলবে- তার আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু বাস্তব সত্য ভিন্ন। অতএব আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সতর্কতার প্রয়োজন আছে।
প্রথম উদ্যোগটা নিতে হবে নিজের তরফ থেকে। কেননা যেকোনও রোগ থাকুক, খারাপ জিনিস থাকুক বা অসুস্থতা থাকুক সেটার ব্যাপারে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। এবং বাসায় থেকে প্রথমেই নিজের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাও জরুরি। কেননা, আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরছেন। প্রাথমিক অবস্থায় পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত স্বাভাবিক হচ্ছেন এমন সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
তাই টিভির খবর নির্দিষ্ট সময় ধরে দিনে শুধু এক-দুইবারের বেশি দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেইসাথে এই মুহূর্তে স্মার্টফোন থেকে নেতিবাচক কোনো প্রচার শেয়ার না করাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নেতিবাচক কোনো কিছু এলে সেটাকে আমরা ভাইরাসের মতো ডিলিট করে ফেলতে পারি। পেশাগত প্রয়োজন ছাড়া ফেসবুকও ডিলিট করা যায়।
অযথা আতঙ্কের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের শক্তির দিকে মনোযোগ দেয়াটাই হতে পারে যুদ্ধজয়ের প্রথম পদক্ষেপ। নিজেদের যত্ন-আত্তিতে মনোযোগ প্রয়োজন। মনোবলটা সবল রাখলে যুদ্ধজয়টা সহজ হবে। মনোবল সবল রাখতে ইতিবাচক কথা বলুন আর আশ্বস্ত আশাবাদী মানুষের সাথে থাকুন। স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ যত আশ্বস্ত মানুষের সাথে থাকবে, তত তার আস্থা এবং বিশ্বাস বাড়বে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক জীব হিসেবে তাই সংঘবদ্ধ থাকাটাই জরুরি এখন। সমমর্মিতা নিয়ে একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নিজেকে আতঙ্কমুক্ত রেখে অন্যের মনোবল ফেরানোটাও এখন আমাদের দায়িত্ব। তাহলেই আতঙ্ক কাটিয়ে এ ভয়কেই আমরা শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারবো।