Published : 22 Apr 2020, 05:09 PM
ইউনিভার্সেল বা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা যে কয়েকটা দেশে আছে তার ভেতরে কানাডা অন্যতম। কানাডাতে দীর্ঘ ১০ বছর শিক্ষা ও চাকুরির প্রয়োজনে থাকার কারণে এই ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার সিস্টেম খুব কাছে থেকে দেখা এবং প্রয়োজনে সেবাও গ্রহণ করা হয়েছে। আর এই লেখা সেই কারণেই। কিভাবে সেই সিস্টেম কাজ করে এবং বাংলাদেশে যে সিস্টেম চালু আছে সেটা কিভাবে আরো ভাল করা যায় সেই ব্যাপারটায় আলোকপাত করার চেষ্টা করব। আমি নিজে ইঞ্জিনিয়ার হবার কারণে, টেকনিক্যাল পার্থক্যগুলো অনেক বেশি চোখে পড়েছে। কানাডা ছাড়া এই সিস্টেম ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডে আছে।
ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার সিস্টেমের মূল উদ্দেশ্য দেশের জনগণকে সুস্থ রাখা, কারণ অসুস্থ জনগণ দেশ এগিয়ে নিতে পারে না। একজন মানুষ অসুস্থ অনেক কারণেই হতে পারে। কিন্তু তার চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেখানে হাসপাতালগুলোতে শুধু যে চিকিৎসা ফ্রি তাই নয়, সরকারি ইন্সুরেন্স আছে ঔষধ কেনার জন্য। তারমানে আপনি অসুস্থ হলে চিকিৎসাজনিত কারণে দেউলিয়া হবার স্বম্ভাবনা নেই।
শুরুতে যে ব্যাপারে আলোকপাত করতে চাই তা হলো, তাদের 'হেলথ কেয়ার কার্ড'। এই কার্ড থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসা ফ্রি। কারা পায় এই কার্ড? এই কার্ড সাধারণত কানাডার পান নাগরিক, স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী ইমিগ্র্যান্ট এবং ৬ মাসের বেশি সময় অবস্থানকারী (যেমন ছাত্র)। অনেকটা আমাদের দেশের জাতীয় পরিচয় পত্রের মতো। এই কার্ডে আপনার পূর্বের অসুখ এবং তার চিকিৎসার রেকর্ড সংরক্ষণ করা থাকে। সেই সংরক্ষিত ডাটাবেজ একজন ডাক্তার চাইলে তার নিজস্ব লগ ইন আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে দেখে নিতে পারে। যে পোর্টাল ডাক্তাররা ব্যবহার করে, সেটাকে তারা নেট কেয়ার বলে। আমাদের হেলথ কার্ডের মতো একটা কার্ড করা প্রয়োজন এবং সরকার দেশে প্রতিবছর কতজনকে কী কী রোগের সেবা প্রদান করছে তারও একটা সঠিক হিসাব পাওয়া যাবে যদি নেট কেয়ারের মতো সফটওয়্যার বানানো হয়।
এখন কেউ যদি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায় তাহলে প্রথমে তাকে এই হেলথ কেয়ার কার্ড এবং নিজের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। এর পরে নার্স আপনার ভাইটালগুলো নিয়ে নেবে এবং আপনাকে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই অপেক্ষার সময় হবে আপনার সমস্যা কতটা গুরুতর তার উপরে। যেমন ধরেন শিশুদের অগ্রাধীকার আগে। আপনার ডাক এলে আপনাকে একজন ডক্তার দেখবেন এবং আপনার রোগ নির্ণয়ের জন্য টেস্ট প্রয়োজন হলে তা হাসপাতালের ভেতরে থাকা ল্যাবে করা হবে। এরপরে সেই ল্যাব রিপোর্ট চলে যাবে ডাক্তারের কাছে এবং ডাক্তার সেই রিপোর্ট অনুযায়ী পথ্য, সার্জারী অথবা অন্য কিছু লাগলে তা বলে দেবেন। এখন যদি ডাক্তার মনে করেন, অবস্থা তেমন খারপ নয় রোগীর, তাহলে সেক্ষেত্রে তিনি সেই রোগীকে বাহিরের ল্যাবে টেস্ট করতে বলবেন। কানাডার সরকার এই বাহিরের ল্যাবগুলো পরিচালনা করেন সাধারণত হাসপাতালের উপরে চাপ কমানো এবং সিস্টেমকে এফিসিয়েন্ট করার জন্য। তবে একই ল্যাবে সব টেস্ট করানো হয় না। বাংলাদেশে সরকারের টেস্ট ল্যাব শুধু হাসপাতালেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে এখন হাসপাতালের পাশাপাশি প্রতিটি জেলায় এমন ল্যাব করা প্রয়োজন। কানাডাতে প্রাইভেট টেস্টও করানো যায়। কেউ যদি অপেক্ষা করতে না চায় সেক্ষেত্রে সে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে টেস্ট করাতে পারে। যেমন এমআরআই মেশিনের দাম অনেক বেশি তাই এই মেশিনের সংখ্যা সীমিত এবং টেস্টের জন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়।
হাসপাতালের চিকিৎসা ছাড়া আরো কিছু ক্লিনিক আছে যেখানে ডাক্তার রোগী দেখে এবং হেলথ কেয়ার কার্ডের বিপরীতে সেই ডক্তার সরকারকে একটা বিল করে। সরকার সেই বিল ঐ ডাক্তারকে দিয়ে দেয়। এই ব্যবস্থা আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর বহিঃবিভাগের মতো যেখানে ইমার্জেন্সি নয় এমন রোগীই শুধু দেখা হয়। কানাডার এই ক্লিনিকগুলোতে যে ডাক্তার বসেন তারা সাধারণত জেনারেল ফিজিশিয়ান। এদেরকে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানও বলে। একই ভাবে স্পেশালিস্ট ডাক্তার যেমন জি আই, অর্থপেডিক, পেডেট্রিশিয়ান, গাইনোকোলজিস্টসহ অন্যান্যরাও বসেন তাদের ক্লিনিকে। এরা রোগী দেখে ক্লিনিকে কিন্তু টাকা নেয় সরকারের কাছে থেকে। বাংলাদেশে প্রতিটি হাসপাতালে এই বহিঃবিভাগ আছে। আমার বিশ্বাস, এই বহিঃবিভাগ শুধু হাসপাতালে বন্দী না রেখে, তা ক্লিনিক আকারে দেশে ছড়িয়ে দিলে জনগণ আরো বেশি স্বাস্থ্যসেবা পাবে।
পয়েন্ট আকারে লিখলে আমাদের ৪টি জিনিস প্রয়োজন সেবা বাড়ানোর জন্যঃ
১। হেলথ কেয়ার কার্ড
২। রোগী ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার
৩। ডেডিকেটেড বহিঃবিভাগ
৪। প্রত্যেক জেলা শহরে টেস্ট ল্যাব।
উপরের পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন হবার কথা নয়। কিন্তু এরপরেও সিস্টেম ভালভাবে বা আশানুরূপ কাজ নাও করতে পারে। কেন করতে পারে না তার কয়েকটি কারণ এবং সমাধান উল্লেখ করা গেল।
ক) আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর ডিজাইন সঠিক নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং পয়েন্ট থেকে দেখলে, আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর হিটিং, ভেন্টিলেশান এবং এয়ার কন্ডিশানিং-এর ব্যবস্থা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রিন্সিপাল মেনে করা হয় না। সেজন্য হাসপাতালগুলোতে দুর্গন্ধ এবং একটা গুমোট পরিবেশ থাকে সবসময়। হাসপাতালগুলোতে বাতাস জরুরি, কারণ তা রোগ জীবানু ছড়ানো বন্ধ করে এবং একজন মানুষ থেকে অন্যজনে জীবণু ছড়াতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্যাপারটা করোনাভাইরাস রোগের ক্ষেত্রেও অনেক বেশি প্রয়োজন। নতুন হাসপাতাল ডিজাইনে দক্ষ আর্কিটেক্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার কাজে লাগানো প্রয়োজন।
খ) টেস্ট ল্যাব করার জন্য এবং হাসপাতালের যন্ত্র কেনার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেকনিক্যাল প্রফেসরদের নিয়ে একটা স্টিয়ারিং কমিটি করতে হবে। এই কমিটি সরকারের উদ্দেশ্য এবং ডাক্তারদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট করে, তার জন্য টেন্ডার ইস্যু, ক্রয় এবং মালামাল সরবরাহকারীদের কাছে থেকে বুঝে নেবেন। এই কমিটি শুধু প্রধানমন্ত্রীর নিকট দায়বদ্ধ থাকবেন আর কারো কাছে নয়।
গ) সরকার দুটি টেকনিক্যাল টিম করবে। একটা টিম হাসপাতালের এসেনশিয়াল যেমন জেনেরেটর, অক্সিজেন সাপ্লাই, এয়ার কন্ডিশানিংসহ অন্যান্য ব্যাপারগুলো দেখবে। অন্য টিম দেখবে টেস্টের যন্ত্র যেন সচল থাকে। টেস্ট করার যন্ত্রগুলোর নিয়মিত প্রিভেন্টিভ মেইন্টেন্যান্স, ক্যালিব্রেশান এবং স্পেয়ার পার্টস ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট, অপারেটর ট্রেনিং ইত্যাদি কন্ট্রোল করবে।
আমার ধারণা, উপরের ব্যাপারগুলো নজরে আনলে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান অনেকাংশেই বাড়বে। আমার ধারণা সেন্ট্রাল ল্যাব স্থাপন করলে তা আমাদের জন্য অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে। আমাদের দেশ প্রতিবছর অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাঠায় শুধু চিকিৎসার জন্য। আমাদের সময় এসেছে, নিজেদের স্বাস্থ্যসেবা নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার।