Published : 16 Apr 2020, 04:12 PM
বেশ ক'বছর ধরেই হোম স্কুলিং নিয়ে কথা বলছি। বাচ্চাদেরকে এই আঁকড়ার বাজারে গুচ্ছের টাকা খরচ করে ইশকুলে পাঠানোর কি হ্যাপা সে আমার মতো এদেশের লক্ষ-কোটি বাবা-মা'রা খুব ভাল করেই জানেন। শুধু মোটা অংকের টাকা থাকলেই হয় না, সেই সাথে ইশকুলে পাঠাতে লাগে জনবল। ভর্তি ফি, অ্যানুয়াল ফি আর বেতন দিয়েই খালাস হওয়ার উপায় নেই। বাচ্চাদের সকালে-দুপুরে আনা-নেওয়ার কাজটা করার জন্য বাড়তি একজন লোক দরকার। সেরকম বিশ্বাসী লোককে মোটা বেতনে ড্রাইভার বা আনা-নেওয়াকারী হিসেবে না রাখলে আপনাকেই কাজ ফেলে বাচ্চার পেছনে ছোটাছুটি করতে হবে ২ বেলা। এরপর আছে কোচিং। স্কুলে দেয়া বাড়ির কাজগুলো করিয়ে দেয়ার জন্য কোচিংয়ে দেবেন? সেখানেও বাচ্চাকে বিকেলে ৩ ঘন্টা বসিয়ে বসিয়ে পড়াবে আবার রাতে ছেড়ে দেয়ার সময় মধ্যরাত অবধি জেগে জেগে লেখাপড়ার জন্য ২ পাতা বাড়ির কাজও মুফতে ধরিয়ে দেবে। যেন বাচ্চাগুলোর কাছ থেকে এ সমাজে জন্মানোর পাপ এর শাস্তি শৈশবেই আদায় করে নেয়া যায়!
ঢাকা থেকে দূরে কোথাও গিয়ে বসত গড়ার ইচ্ছে ছিল বলে বাচ্চা হওয়ার অনেক আগে থেকেই হবু সন্তানদের বাড়িতে রেখে পড়াশুনা করাবার খায়েশ হয়েছিল। এমনকি বিয়েরও অনেক আগেই এমনটা ভাবতাম, একদিন বিয়ে করব, বাচ্চা হবে, সেই বাচ্চাদের নিয়ে শহর থেকে দূরে কোথাও নির্জনে গিয়ে ডেরা বাঁধব আর তাদের ঘরে রেখে লেখাপড়া করাব। শাহরিয়ার কবিরের 'সীমান্তে সংঘাত', 'নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়', 'হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা' ইত্যাদি বই শৈশবে পড়লে যা হয় আর কি! এমন অলুক্ষুণে কথা শুনে বাচ্চাদের সম্ভাব্য মায়েরা পিছপা হতে দেরী করতেন না! তাই শেষের দিকে মনের কথা চেপে রাখতাম। ভাবতাম ঝোপ বুঝে কোপ মারব!
কিন্তু বিবাহ হচ্ছে দিল্লি কা লাড্ডু। না খেলে সারাজীবন পস্তাবেন, আর খেলে কি হয় সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন! আমিও সংসারে ঢুকে, বাচ্চা-কাচ্চাদের বাপ হয়ে, সমাজের আর দশজনের দেখাদেখি জনতার কাতারে মিশে গিয়েছিলাম। খেয়ে না খেয়ে এতদিন মিশেই ছিলাম। কিন্তু গত ১৭ মার্চ থেকে এক অদৃশ্য অনুজীবের হুমকিতে যখন সারাদেশে একযোগে স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেল এবং আজ এই এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে যেভাবে বিশ্বব্যাপী এই অভূতপূর্ব লকডাউনের মেয়াদ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে বাড়িতে অলস বসে থাকা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আমার আবার সেই হোম স্কুলিং এর কথাই ক'দিন যাবত মনে আসছে।
এদেশে কোটি কোটি শিক্ষার্থী এখন করোনাভাইরাস এর কারণে চলমান লকডাউনে নীল ডাউন হয়ে বাড়িতে বসে আছে। এক মাস পেরিয়ে গেছে, চলছে এই দেশব্যাপী, ইনফ্যাক্ট বিশ্বব্যাপী হোম কোয়ারেন্টিন। ফিসফিসানীতে শোনা যাচ্ছে, এ অবস্থা চলবে আরও অনেকদিন। কতদিন চলবে সে কথা বলা যাবে না আর আমিও কোনো স্পেকুলেটিভ সময় সীমার কথা বলব না। কিন্তু এই অনির্দিষ্টকাল ধরে ঘরে বসিয়ে রাখলে আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের লেখা পড়ার কী হবে? সারাদিন যতই বলি, বই নিয়ে পড়তে বস, কোনো কাজ হয় না। আমার বাবার আমল হলে অবশ্য কোনো কথা ছিল না। হালকা চোখ রাঙ্গানিতেই কাজ হয়ে যেত। যতক্ষণ রিলিজ অর্ডার না আসে, ততক্ষণ বইয়ের টেবিলেই ঘাটি মেরে বসে থাকা লাগত। এরপরেও সন্ধ্যায় পড়া ধরার সময় বোনাস হিসেবে কী কী পেতাম সে আলাপে নাই বা গেলাম!
কিন্তু এখন? আগের অস্ত্র এখন অচল। এখনকার আপডেটেড ভার্সনে ওসব অস্ত্র প্রয়োগ করলে পুরা ফ্যামিলিই হ্যাং হয়ে যাবে। হোম স্কুলিং এর কথা মাথায় রেখে আমিও ক'দিন ধরে দুই মেয়েকে সকাল বিকাল পড়তে বসানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু একজ্যাক্টলি কিভাবে পড়াব? মাথায় আছে শৈশবে বাড়িতে টেবিলে বসে বসে পড়ার স্মৃতি। কিন্তু সেটা তো ঠিক হোম স্কুলিং ছিল না। ছিল বাড়িতে বসে স্কুলের দেয়া হোমওয়ার্ক শেষ করার কাজ। এখন তো অবস্থা ভিন্ন। স্কুল-কলেজই চলছে না। এদের প্রত্যেকের ১০-১২টা করে বই, প্রতিটি বইয়ে ১৫-২০টা করে চ্যাপ্টার। এগুলোর কোনটা পড়বে? কে পড়াবে? আমি না হয় হরফুন মৌলা, কিন্তু বাকীরা? অনেক বাবা-মা'তো বাচ্চার ইংরেজি বই এর চ্যাপ্টারের উচ্চারণই ঠিকমতো করতে পারেন না কিংবা অংক-বিজ্ঞানের বই দেখলে আমার মত তাদেরও মাথা ঘুরায়! তাদের বাড়িতে কী হবে? আর পড়ানো না হয় হলো, কিন্তু এদের নিরীক্ষা/মুল্যায়নের কাজটি কে করবে? অনেকদিন ধরে স্কুল খোলা না গেলে, পরের ক্লাসের জন্য গ্রেডিং বা পাশ করাবে কে? ফেল কথাটা মুখেই আনলাম না, ক্লাস সিক্স-এ ফার্স্ট টার্মিনালে অংকে ফেল করার আতংক এখনো পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি আমাকে!
দু'দিন আগে আমার এক বন্ধুর শেয়ার করা ভিডিওতে দেখলাম, তার টেন-এ পড়ুয়া মেয়ে ক্লাস ফাইভের জ্যোগ্রাফি বইয়ের এক চ্যাপ্টার এর লেসন সলভ করাচ্ছে ইউটিউবে আপলোড করা ভিডিওতে। উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ঘরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় হেল্প করা। অনলাইন ঘেটে আরো মজার জিনিস দেখতে পেলাম। টেন মিনিট স্কুল, আমার ঘরে আমার স্কুল (সংসদ টিভি), ঘরে বসে শিখি, বিডি হোম স্কুল ইত্যাদি নামে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান/উদ্যোগ এখন ইউটিউব-এ সক্রিয় ভাবে অনলাইনে পড়াশুনা করানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। পাশের দেশগুলোতে আর সারাবিশ্বে হোম স্কুল কন্টেন্ট-এর যেন অভাব নেই এখন আর!
কিন্তু শুধু কন্টেন্ট দিয়ে কি করব? প্রথম দরকার সকল ক্লাসের, সকল সাবজেক্টের, প্রতিটি চ্যাপ্টার অনুযায়ী সারিবদ্ধ ভাবে সব কন্টেন্ট সাজিয়ে রাখা। যেন শিক্ষার্থী সহজেই খুঁজে পায় তার ইপ্সিত সাবজেক্টের নির্দিষ্ট চ্যাপ্টার এর ভিডিও এবং অন্যান্য কন্টেন্ট। তারপর দরকার সেই সব বিষয়ে অনলাইনে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ আর সেই পরীক্ষার মূল্যায়ন। আর সবার শেষে যথাযথ সার্টিফিকেশন। এই সার্টিফিকেশনের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে তার শিক্ষা বোর্ড অথবা উন্মুক্ত বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে।
সাধারণ দুই শিক্ষার্থীর ততোধিক সাধারণ এক বিদ্যোৎসাহী পিতা আমি। (আরো একটা আছে, তবে সেটা টেরিটোরির বাইরে থাকে!) জ্যাক অফ অল ট্রেড কিন্তু মাস্টার অফ নান! অল্প অল্প সবই বুঝি কিন্তু তার চেয়ে বেশি নয়। আমার পক্ষে এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি বলা বা লেখা সমীচিন না। আমি কেবল সাধারণের দৃষ্টিতে অনলাইন পড়াশুনা বা হোম স্কুলিং-এর প্রয়োজন, সম্ভবনা এবং বিদ্যমান সুযোগ সামান্য পরিমাণে তুলে ধরলাম। এটাকে জরুরি ভাবে নেয়া এখন সময়ের দাবি। জরুরি ভাবে নিয়ে এর দ্রুত একটা সিস্টেম চালু করা দরকার। যারা ইতোমধ্যে এ নিয়ে দেশে কাজ করছেন তাদের নিয়ে, সেই সাথে আইটি সেক্টর, শিক্ষা সেক্টর, উন্নয়ন সেক্টর যেমন ব্র্যাক এর শিক্ষা বিষয়ে অনেক কাজ রয়েছে এদের থেকে এক্সপার্ট নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে হোম স্কুলিং নিয়ে একটা কাঠামো চালু করা দরকার।
করোনাভাইরাস নিপাত যাক, কোভিড-১৯ ভাইরাস সর্বাংশে ধ্বংস হোক, আর সবার মত আমিও চাই। কিন্তু ততদিনে আমাদের সন্তানেরা লেখাপড়ার অভাবে সেই সময়ের জন্য পিছিয়ে যাক, সেটা মোটেই চাই না। আর কেবল করোনাভাইরাসের জন্যে নয়। সব কিছু ঠিক থাকলে এবং ঠিক হয়ে গেলে আমিও খুব বেরিয়ে পড়তে চাই ঢাকা ছেড়ে। বাচ্চাদের নিয়ে দূরে কোথাও, কোলাহলের বাইরে। রাস্তা লাগবে না, পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশনের কোনো সেবা লাগবে না, কেবল হোম স্কুলিং এর কাঠামো করে দেন, আমি সোলার জ্বালিয়ে, ফোন-ল্যাপটপ চালিয়ে ঠিক বাচ্চাদের মানুষ করে ফেলব। কওমী-আলিয়া-বাংলা মিডিয়াম-ইংলিশ মিডিয়ামের ডামাডোলে না রেখে আমি বরং হোম স্কুলিং এর কন্টেন্ট এর সাহায্য নিয়ে ওদের নিজ হাতে পড়াব, আর সেই সাথে গাছপালা,পশুপাখীতে ভরা প্রকৃতি শেখাবে যা কিছু সত্য আর সুন্দর!