বিশ্বে জাতিসংঘ স্বীকৃত দেশের সংখ্যা ১৯৫টি। তার মধ্যে ৪২টি দেশ বর্তমানে যুদ্ধ বা যুদ্ধের মতো সংঘর্ষে জড়িত– এ হিসাব দিচ্ছে ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ। বিশ্ব শান্তি সূচক (জিপিআই) মোতাবেক বর্তমানে বিশ্বে ৫৬টি সংঘর্ষ চলমান রয়েছে, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যা সবচেয়ে বেশি; ৯২টি দেশ তাদের সীমান্তে সংঘর্ষে লিপ্ত; ১১০ মিলিয়ন মানুষ হয় শরণার্থী বা সহিংস সংঘাতের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত।
Published : 10 Nov 2024, 02:06 AM
গাছের আপেল ঝরে গেলে আদিকাল থেকে তা নিচেই পড়েছে; লক্ষ কোটি মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে এবং ভক্ষণ করেছে। কারো মস্তিষ্কে কোন প্রশ্নের উদ্রেক হয়নি। কিন্তু একজন ভেবেছিলেন আপেল নিচের দিকে না এসে উপরের দিকে যাচ্ছে না কেন? আইজ্যাক নিউটন সেই ভাবনা থেকে মধ্যাকর্ষণ শক্তির খোঁজ পেয়েছিলেন; জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগৎকে সমূলে কাঁপিয়ে দেওয়া গতিসূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। জলভরা চৌবাচ্চায় স্নান করতে নামলে জল সবসময়ই উপচে পড়েছে। কেন উপচে পড়ছে, এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা ছিল না। একজনের ছিল। আর্কিমিডিস যখন উত্তরটা খুঁজে পেলেন, তখন ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ মানে ‘পেয়েছি’ ‘পেয়েছি’ বলে চিৎকার করতে করতে নগ্নদেহে দৌড়ে রাজপথে চলে এসেছিলেন। প্রাপ্ত উত্তর দিয়ে তিনি শুধু স্বর্ণের খাঁটিত্ব নিরূপণ নয়, বিজ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্লবতার সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, যার উপর ভিত্তি করে ২ লক্ষাধিক টন ওজনের জাহাজ পানিতে ভাসছে, অথচ একটা সুঁই পানিতে ডুবে যাচ্ছে।
আসন্ন ‘শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস’-এর প্রেক্ষাপটে দুটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পটভূমির অবতারণা করা হলো। ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্রতি বছর ১০ নভেম্বর দিবসটি পালিত হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে, মনের নির্দেশনায় এবং বলিষ্ঠ ভবিষ্যৎ নির্মাণে’। তাছাড়াও আমরা এখন জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান দশক’-এর প্রথম বছরে অবস্থান করছি।
বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞানের যে কোনও ক্ষেত্র যা ভৌত জগৎ এবং এর ঘটনাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং যা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং পদ্ধতিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ সত্য বা মৌলিক সূত্রের ক্রিয়াপদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করে এমন জ্ঞানান্বেষণই বিজ্ঞান। নাশা (এনএএসএ) বলছে বিজ্ঞান হল বিশ্ব এবং এটি কীভাবে আচরণ করে সে সম্পর্কে চিন্তাশীল কর্মের কৌতূহল। অধ্যয়নের বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানকে বিভিন্ন শাখায় ভাগ করা যায়। ভৌত বিজ্ঞান অজৈব জগৎ অধ্যয়ন করে এবং জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং পৃথিবী বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলোকে সম্পৃক্ত করে। জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং ওষুধের মতো জৈবিক বিজ্ঞানগুলো জীবনের জৈব জগৎ এবং এর প্রক্রিয়াগুলো অধ্যয়ন করে। নৃবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো সামাজিক বিজ্ঞানগুলো মানুষের আচরণের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিকগুলো অধ্যয়ন করে। তবে যে ধরনেরই হোক, বিজ্ঞানের আওতায় পড়তে হলে ওই জ্ঞানটিকে সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে। আর একই শর্তের অধীনে যে গবেষকই পরীক্ষণটি করুন না কেন ফলাফল একই হতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তি চেতনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষণের ফলাফল কখনও পরিবর্তিত হতে পারে না।
নিউটন বলেছিলেন, ‘প্লেটো আমার বন্ধু, অ্যারিস্টটল আমার বন্ধু– কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু সত্য।...আমি কেবল সমুদ্রসৈকতে ক্রীড়ারত একটি ছেলের মতো এবং কিছূ মসৃণ নুড়ি বা সাধারণের চেয়ে সুন্দর কিছু ঝিনুক খুঁজে পেয়েছি; সত্যের মহাসমুদ্র আমার কাছে আজো অনাবিষ্কৃত।’ বিজ্ঞানের ধর্ম তাহলে দাঁড়ালো সত্য প্রতিষ্ঠা করার কর্ম এবং তা একটি অনিঃশেষ প্রক্রিয়া। প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, ভাবনা-নির্ভাবনা, সংস্কার ভেদ করে প্রমাণাদির মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। গ্যালিলিও যেমন ধর্মযাজকদের মতবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘সূর্য ঘুরছে না, সে স্থির। পৃথিবী ঘুরছে, সূর্যের চারিদিকে’। এজন্য তাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘যাহোক, পৃথিবী ঘুরছে’। কারো কারো ধারণা চারপাশে দৃশ্যমান যত কলকব্জা, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, ইন্টারনেট, প্রযুক্তি– এইই বুঝি বিজ্ঞান। কিন্তু না, এটি তার চেয়ে অনেক গভীর কিছু। রসায়নবিদ হ্যারি ক্রোটোর মতে ‘বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমার কাছে একমাত্র দার্শনিক গঠন, যা মানবজাতি নির্ভরযোগ্যভাবে যা সত্য তা নির্ধারণ করার জন্য তৈরি করেছে।’ স্মরণ করা যেতে পারে যে, পদার্থবিদ্যা ১৮ শতকের শেষ পর্যন্ত ন্যাচারাল ফিলোসফি অর্থাৎ প্রাকৃতিক দর্শন হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৯ শতকে পদার্থবিদ্যা দর্শন এবং অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে আলাদা একটি শৃঙ্খলা হিসাবে নামায়িত হয়েছিল। বিজ্ঞান যদি সত্য প্রতিষ্ঠার দর্শন হয়, তাহলে আশেপাশে চোখ বুলালে সেই সত্য বাস্তবে কতটুকু এবং কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার একটা চিত্র দেখে নেয়া যেতে পারে। যুগে যুগে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অসাধারণ উদ্ভাবন উপহার দিয়েছে, যা মানবজাতির জন্য উপকারী হয়েছে। মানুষের আয়ুষ্কাল উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, অনেক দুরারোগ্য রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হচ্ছে, কয়েকটি প্রাণঘাতী রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাচ্ছে। ইঞ্জিন, জ্বালানিশক্তির বহুমুখী ব্যবহার, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মানুষকে কঠিন কায়িক শ্রম থেকে রেহাই দিয়েছে; জীবনযাপনকে আরামদায়ক করেছে। পাখির মত আকাশে ওড়ার, গ্রহের মত মহাকাশে ভাসার, মাছের মত অতল জলে থাকার, চিতাবাঘের চেয়ে অনেক দ্রুত ছোটার মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন যোগাযোগ পদ্ধতি ও তথ্য ব্যবস্থাপনা আর্থিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক খাতে অভূতপূর্ব কর্মপরিবেশ ও গতিশীলতা সৃষ্টি করেছে।
তাহলে বিজ্ঞানের ভুরি ভুরি অবিসংবাদিত সাফল্যের সঙ্গে এ বছরের বিজ্ঞান দিবসের প্রতিপাদ্যের সংযোগ কোথায়? এতে বলা হচ্ছে বিজ্ঞানকে যথাযথ মূল্য দিতে হবে, বিজ্ঞান যেন মনের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মানবজাতির জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে দেয়। উদাহরণ দিয়ে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
মানবজাতি এখন পর্যন্ত ২টি বিশ্বযুদ্ধে জানমালের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সহ্য করেছে। ৩য় বিশ্বযুদ্ধ এখনও সংঘটিত না হলেও পৃথিবী জুড়ে দেশে দেশে যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বে জাতিসংঘ স্বীকৃত দেশের সংখ্যা ১৯৫টি। তার মধ্যে ৪২টি দেশ বর্তমানে যুদ্ধ বা যুদ্ধের মতো সংঘর্ষে জড়িত– এ হিসাব দিচ্ছে ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ। বিশ্ব শান্তি সূচক (জিপিআই) মোতাবেক বর্তমানে বিশ্বে ৫৬টি সংঘর্ষ চলমান রয়েছে, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যা সবচেয়ে বেশি; ৯২টি দেশ তাদের সীমান্তে সংঘর্ষে লিপ্ত; ১১০ মিলিয়ন মানুষ হয় শরণার্থী বা সহিংস সংঘাতের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। জেনিভা অ্যাকাডেমি অব ইন্টারন্যাশনাল ল বলছে তারা ইন্টারন্যাশনাল হিউমেনিটারিয়ান ল অনুসরণপূর্বক এখন ১১০ টিরও বেশি সশস্ত্র সংঘাত পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের মধ্যে কিছু সম্প্রতি শুরু হয়েছে, অন্যগুলো ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল, সেখানে ৪৫টিরও বেশি সশস্ত্র সংঘর্ষ চলমান। এশিয়ায় ২১টি সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছে। আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা অনুযায়ী বিশ্বে ১৮০০ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৩৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অসলো (পিআরআইও)-র তথ্য মতে ২০২৩ সালে যুদ্ধে ১২২,০০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যুদ্ধের কারণে মারা যাওয়া বেসামরিক নাগরিক, সংঘর্ষ উপজাত ক্ষুধা ও রোগের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা এবং যুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত ছোট সংঘাতে মৃত্যুকে বিবেচনা করলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হবে। যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২২ সালে পরপর অষ্টম বছরের মত বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় বেড়েছে এবং তা পৌঁছেছে আনুমানিক ২২৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। বিশ্ব গড়ে তার বাজেটের ৬.২ শতাংশ ব্যয় করেছে সামরিক খাতে; জনপ্রতি খরচ করছে ২৮২ ডলার। সহিংসতা নিরসনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বরাদ্দ ২০২৩ সালে বেড়ে ১৯.১ ট্রিলিয়ন ইউএসডি হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী জিডিপির ১৩.৫%।
যুদ্ধে বিজ্ঞানের ভূমিকা কী? যদি শুধু একটি ভূমিকার কথা বিবেচনা করি তাহলে সেটি হবে অস্ত্র উৎপাদন। কত বিধ্বংসী অস্ত্র উৎপন্ন করা যায়, কত সহজে গণহত্যা ঘটানো যায়, সে উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। যুদ্ধের জন্য বিজ্ঞানকে ব্যবহার করার দোষ বিজ্ঞানের নয়। চাকুকে দোষ দিয়ে লাভ কি! সন্ত্রাসীর হাতে থাকলে সে মানুষ খুন করতে পারে, চিকিৎসকের হাতে সে মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। বিজ্ঞান যে ব্যবহার করছে সমস্যা তাকে নিয়ে, সে আর কেউ নয়, সে মানুষ, সে মানবজাতি। লোকালয়ে ২টি আনবিক বোমা বিস্ফোরণের মর্মান্তিক ফলাফল আমরা দেখে ফেলেছি। এই অমানবিক আনবিক বোমার জনক আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহেইমারকে নিয়ে নির্মিত হলিউডের একটি চলচ্চিত্র সাম্প্রতিককালে আলোড়ন তৈরি করে, অনেকগুলো অস্কারও জিতে নেয়। তাতে বৈজ্ঞানিক মেধার চাতুর্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু সারকথা কী? গণহত্যা সংঘটনে সফলকাম একজন বিজ্ঞানীকে বীরের মর্যাদা দেওয়া। সমস্যাটা সেখানেই। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য কি তাই? পাশ্চাত্য সভ্যতা গণতন্ত্রের পূজারী। অথচ জাতিসংঘে ৫টি দেশকে তথাকথিত ভেটো ক্ষমতা দিয়ে রাখা হয়েছে। কেন? কেউ যদি বলে তাদের আনবিক বোমা আছে বলে, তাহলে কি ভুল বলা হবে! আনবিক বোমার অধিকারী বাকি ৪টি দেশও ভেটো ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারকে এমনভাবে মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে। তাহলে মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর নৈতিক কাজটি তো বিজ্ঞান করতে পারছে না। মানুষকেই যদি বিজ্ঞানের কারণে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তাহলে তো বিজ্ঞান নৈতিকতার প্রশ্নে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ। বিশ্বশান্তির প্রধান প্রতিপক্ষ যুদ্ধ। দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান যুদ্ধকে প্রতিহত করতে পারছে না, বরং উস্কে দিচ্ছে। কারণ ব্যুৎপত্তির বাস মস্তিষ্কে, উৎপত্তির স্থান মনে। বিজ্ঞানের বাস মানুষের মস্তিষ্কে, আর যুদ্ধের স্থান মনে। এজন্যই এ বছরের বিজ্ঞান দিবসের প্রতিপাদ্যে বলা হচ্ছে বিজ্ঞান যেন মানুষের মনের দ্বারা পরিচালিত হয়। বিজ্ঞানী এবং তাদের বিজ্ঞান ব্যবহারকারীদের মন যেন মস্তিষ্ককে মনে করিয়ে দেয়- সবার উপরে মানুষ সত্য- যে কথা বলে গেছেন বৈষ্ণব পদাবলীর আদিকবি বড়ু চণ্ডীদাস।
কবি-সাহিত্যিকের প্রসঙ্গ যখন আসলো, তখন কবিগুরু রবিঠাকুরকে একটু নিয়ে আসি। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বোস ও আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে তার আন্তরিক সখ্য ছিল। জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ১৯০১ সালে ‘বঙ্গদর্শন’-এ রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘জড় কি সজীব?’ শিরোনামের প্রবন্ধ পড়ে বিজ্ঞানী নিজেই বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কবি না হইতে তো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হইতে পারিতে।’ ১৯৩৭ সালে তিনি পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেন। কবি এবং বিজ্ঞানী উভয়েই কল্পলোকের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে মিল যেমন আছে, পার্থক্যও আছে। এ নিয়ে জগদীশচন্দ্র বসু ‘কবিতা ও বিজ্ঞান’ শিরোনামে অসাধারণ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি লিখছেন, ‘বৈজ্ঞানিকের পন্থা স্বতন্ত্র হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব-সাধনার সহিত তাঁহার সাধনার ঐক্য আছে। দৃষ্টির আলোক যেখানে শেষ হইয়া যায় সেখানেও তিনি আলোকের অনুসরণ করিতে থাকেন, শ্রুতির শক্তি যেখানে সুরের শেষ সীমায় পৌঁছায় সেখান হইতেও তিনি কম্পমান বাণী আহরণ করিয়া আনেন।....বৈজ্ঞানিক ও কবি, উভয়েরই অনুভূতি অনির্ব্বচনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। প্রভেদ এই, কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপেক্ষা করেন না। কবিকে সর্ব্বদা আত্মহারা হইতে হয়, আত্মসম্বরণ করা তাঁহার পক্ষে অসাধ্য। কিন্তু কবির কবিত্ব নিজের আবেগের মধ্য হইতে তো প্রমাণ বাহির করিতে পারে না! এজন্য তাঁহাকে উপমার ভাষা ব্যবহার করিতে হয়। সকল কথায় তাঁহাকে ‘যেন’ যোগ করিয়া দিতে হয়।’ তার মানে বিজ্ঞানীর আত্মহারা হওয়া চলে না, তাকে আত্মসম্বরণ করতে হয়। এই কাজটা তাকে করে দিতে পারে তার মন। বিজ্ঞান প্রস্ততকরণের কারখানা মস্তিষ্ক জানে না তার ঠিকানা। বিপথগামী হয়ে বিপদকামী হলে মস্তিষ্ককে মন যেন কপালকু-লার মত বলে দেয় ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’। শুধু সশস্ত্র বিজ্ঞানকে নিরস্ত্র করা নয়, জীবজগতের জন্য অকল্যাণকর যে কোন বৈজ্ঞানিক কাজে মস্তিষ্ককে মন যেন নিরস্ত করে, বিশ্ববাসীর জন্য নিরাপদ টেকসই ভবিষ্যৎ যেন সে নির্মাণ করে।
টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২০২৩ সালের অগাস্টে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ২০২৪-২০৩৩ সময়কালকে বিজ্ঞান দশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দশকের লক্ষ্য সমাজ, অর্থনীতি এবং পরিবেশে রূপান্তরমূলক পরিবর্তনে অবদান রাখার জন্য মৌলিক এবং ফলিত বিজ্ঞান, সামাজিক এবং মানব বিজ্ঞানের পাশাপাশি আন্তঃবিভাগীয় এবং উদীয়মান ক্ষেত্রগুলোসহ বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক শাখাগুলোকে একত্র করা। বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা প্রচার করে এবং সরকার, জাতিসংঘ সংস্থা, বেসরকারি খাত এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে দশকটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে এবং সবার জন্য একটি নিরাপদ ও আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে কাজ করার জন্য বিজ্ঞানের ভূমিকা বাড়াবে- এমনটাই প্রত্যাশা। বিজ্ঞান বিভিন্ন এসডিজিকে প্রভাবিত করছে। এসডিজি-৪ (মানসম্পন্ন শিক্ষা): বিজ্ঞানে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত শিক্ষাকে উৎসাহিত করা, একটি বৈজ্ঞানিকভাবে শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলা; এসডিজি-৯ (শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামো): টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবনের প্রচার; এসডিজি-১৩ (জলবায়ু কার্যক্রম): একটি টেকসই গ্রহের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ক্ষমতায়নের কথা বলছে।
আমরা সবাই একই গ্রহে বাস করি এবং জীবজগতের অংশ। মানুষসহ জীবজগতের সকল সদস্য ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পরিবেশে বিরাজমান এবং আমাদের ভবিষ্যত বিশ্বের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের সংরক্ষণ এবং সকল ধরণের জীবনের বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বিজ্ঞানের আগ্রাসন এ সম্পর্ককে ক্রমাগত বিশৃংঙ্খল করে তুলছে। আমাদের গ্রহটি ২১০০ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দিকে যাচ্ছে, যা ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ইতোমধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে; কারণ খরা, বন্যা, ঝড়, সুনামি, তাপপ্রবাহ, বজ্রপাত এবং অন্যান্য আবহাওয়া-সম্পর্কিত বিপদ আরো ঘন ঘন এবং আরো গুরুতর হয়ে উঠেছে। জল ও বায়ু হচ্ছে জলবায়ুর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান হচ্ছে। অথচ প্রায়শ নীতি এবং গবেষণা সামাজিক চ্যালেঞ্জ যেমন অনিরাপদ জল-বায়ু, রাসায়নিক দূষণ বা জলবায়ুর কারণে বিপন্ন ফসলের দিকে দৃষ্টি দেয় না। ইউনেস্কোর একটি গবেষণায় প্রকাশ করা হয়েছে যে, টেকসই বিজ্ঞান বিশ্বব্যাপী একটি অগ্রাধিকার নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণার দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১২-২০১৯ সময়কালের মধ্যে মাত্র ০.০২% বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা জলবায়ু-সহনশীল ফসলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে; মাত্র ০.০১% বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার বিষয়বস্তু ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য স্থানীয় কৌশলসমূহ এবং মাত্র ০.০৩% বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা প্লাস্টিকের পরিবেশবান্ধব বিকল্পের উপর দৃষ্টিপাত করেছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে গত দুদশকে বিপ্লব ঘটে গেছে। কিন্তু সেই বিপ্লবের জন্য বিশ্বাবাসীকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। আমাদের জীবন মোবাইল ফোনে বাঁধা পড়ে গেছে। প্রযুক্তি আসক্তি ব্যাপক হয়ে উঠেছে; শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নয়, কিশোর এবং শিশুরা বরং আরো বেশি আক্রান্ত হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে এর ক্ষতিকর প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার নামের প্রতি মোটেই সুবিচার করতে পারছে না। বরং তা সামাজিক দক্ষতা বিনষ্ট করে এমন অভিযোগ জোরদার হচ্ছে। হাজার হাজার বন্ধু জোটানোর প্রতিযোগিতা চলছে। কিন্তু বন্ধু হিসাবে ‘সত্যবাবু’কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, হাত রাখার জন্য প্রকৃত বন্ধুর কাঁধটা পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া এ মাধ্যম এমন একটি সংস্কৃতি প্রচার করছে যেখানে মাদকসেবন এবং যৌনতার সীমানার অভাব উৎকটভাবে স্পষ্ট। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা চরম হুমকির মুখে, হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিতে থাকছে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকার। অন্তর্জালে ভূঞা খবর ও গুজবের ছড়াছড়িতে মানুষ প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছে। অপরাধ জগতে আতঙ্কের নতুন নাম সাইবার ক্রাইম। মোবাইল ফোন, এআই অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষের গতিবিধি, পছন্দ-অপছন্দ ব্যাপকভাবে অপরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করবে, না বিজ্ঞান মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে তা একটি বিরাট প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রায় ২০০ বছর আগে লেখা ইংরেজ লেখক মেরী শেলীর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন; অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ এই ডিজিটাল যুগে নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। জার্মান গবেষক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গবেষণার মাধ্যমে একটি বিশেষ ধরনের বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে সমর্থ হয়, যার মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির মধ্যে প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব। সে এ পরীক্ষাটি এক মৃত ব্যক্তির উপর করলে মৃত ব্যক্তি ঠিকই বেঁচে উঠে, কিন্তু পরিণত হয় এক ভয়ঙ্কর দানবে। দানবটি প্রথমে হত্যা করে ফ্রাংকেনস্টাইনের সহকারী ড. নীল ও একজন আয়াকে, এরপর তার সৃষ্টিকর্তার ভাইকে; অতঃপর শত শত সাধারণ লোককে। ফ্রাঙ্কেনের বিয়ের রাতে হত্যা করে তার স্ত্রীসহ পরিবারের বাকী সদস্যদের। ফ্রাঙ্কেন তাকে হত্যা করার জন্য ধাওয়া করতে থাকে, কিন্তু এক পর্যায়ে সে ক্লান্ত হয়ে মারা যায়। দানবটি হারিয়ে যায়, তাকে আর কখনও দেখা যায়নি। পাপ বাপকেও ছাড়ে না, আর বিজ্ঞানের অপসৃষ্টি সৃষ্টিকর্তাকেও ছাড়ে না।
প্রযুক্তির পাশর্^প্রতিক্রিয়াসমূহ কি বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করছে না? কিছু সম্প্রদায় কিন্তু রয়েছে যারা বহু আগে থেকেই সচেতনভাবে বিজ্ঞান থেকে নিজ সমাজকে বিচ্ছিন্ন রাখছে। অ্যামিশ তেমন একটি সমাজের নাম। অ্যামিশ ঐতিহ্যবাদী অ্যানাব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টান গির্জার একটি ফেলোশিপ দল; ১৬৯৩ সালে সুইজারল্যান্ডে জ্যাকব আম্মানের নেতৃত্বে সুইস এবং অ্যালসেটিয়ান গোষ্ঠীদের নিয়ে অ্যামিশ গির্জা শুরু হয়েছিল; যারা আম্মানকে অনুসরণ করেছিল তারা অ্যামিশ নামে পরিচিত হয়েছিল। বর্তমানে অ্যামিশদের জনসংখ্যা ৪,০১,০০৫; অধিকাংশের বসবাসস্থল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের শীর্ষদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ইন্ডিয়ানা, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া ইত্যাদি রাজ্যে) এবং কানাডা (অর্ধ লক্ষাধিক)। অ্যামিশদের তিনটি প্রধান উপগোষ্ঠী রয়েছে; এদের মধ্যে ‘ওল্ড অর্ডার অ্যামিশ’ অধিকতর ঐতিহ্যবাহী। তাদের জীবনধারা সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মাবলি ‘অর্ডনং’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; নারীরা অর্ডনং-এর সভায় ভোট দিতে পারেন। অ্যামিশরা গ্রামীণ সাধারণ জীবনযাপন, পারিবারিক সম্পর্ক ও ঈশ্বরের ইচ্ছার বশ্যতার উপর জোর দিয়ে থাকে। কথায় আছে, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়েছে আবেগ’। অ্যামিশরা ধীরগতির জীবন পছন্দ করে, যাতে পারিবারিক সময় ব্যাহত না হয়, যখনই সম্ভব মুখোমুখি কথোপকথন করা যায়। এজন্য তারা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক সুবিধা গ্রহণ করে না। পাওয়ার-লাইনের বিদ্যুৎ, টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট, ক্যামেরা, রেডিও, টেলিভিশন তারা ব্যবহার করে না। কায়িক শ্রম সাশ্রয়ী প্রযুক্তি তারা প্রত্যাখ্যান করেছে; ট্রাক্টর, যান্ত্রিক রেফ্রিজারেটর, ফ্লাশ টয়লেট, চলমান জলের স্নানের টব, ওয়াশিং মেশিন তাদের ব্যবহার্য সামগ্রী নয়। অটোমোবাইল গাড়ির পরিবর্তে তারা ঘোড়া এবং বগিতে ভ্রমণের জন্য পরিচিত, কারণ তারা মনে করে যে ঘোড়ায় টানা যানবাহন জীবনকে ধীর গতিতে রাখে। নিরাপত্তার জন্য তারা কোন সামরিক পরিষেবা চর্চা করে না। পুরুষত্ব, বৈবাহিকতা ও নশ্বরতা প্রদর্শনের জন্য তারা লম্বা দাড়ি রাখে, কিন্তু গোঁফ রাখে না, গোঁফকে সামরিক প্রতীক বলে মনে করে।
নিও-লুডিজম নামে আরেকটি মতবাদ রয়েছে যা আধুনিক প্রযুক্তির বিরোধিতা করে থাকে। এ মতাবাদে বিশ্বাসীরা কিছু বা সমস্ত প্রযুক্তিকে আরও আদিম স্তরে ফিরিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী। তারা বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলন এবং গভীর পরিবেশবাদের অনুসারী। তারা বিশ্বাস করে যে বর্তমান প্রযুক্তিগুলো মানবতা এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং ফলশ্রুতিতে সামাজিক পতন অনিবার্য। কম্পিউটার দ্বারা মানুষের প্রতিস্থাপনের কারণে মানবতার জায়গায় পরিবর্তন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের অভাবে মানুষের জেনেটিক ক্ষয়, মানুষের জৈবিক প্রকৌশল, প্রযুক্তিগত শক্তির অপব্যবহার ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। নিও-লুডিজম তাই সমস্ত নতুন প্রযুক্তির জন্য সতর্কতামূলক নীতির ব্যবহার বেঁধে দেয়, জোর দেয় যে প্রযুক্তি গ্রহণের আগে সম্পূর্ণ নিরাপদ প্রমাণিত হতে হবে। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োতে এবং ২০০১ সালে নিউ ইয়র্কে সমমনাদের সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। মাঝে মাঝে তারা সহিংস আচরণ করে থাকে। ইতালিতে ২০১২ সালের মে মাসে ‘আনসালদো নিউক্লিয়ার’ কোম্পানির কর্মকর্তা রবার্তো অ্যাডিনোলফিকে গুলিবর্ষণের কারণের সঙ্গে নিও-লুডিজমের সংযোগ পাওয়া গেছে। অ্যাডিনোলফি দাবি করেছিলেন যে ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং সুনামির পরে কোনো মৃত্যুই ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক কেন্দ্রের বিপর্যয়ের কারণে হয়নি। আক্রমণকারীদের ভাষ্য– ‘অতীতের বিজ্ঞান আমাদের স্বর্ণযুগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এটি (পারমাণবিক শক্তি) আমাদের আত্মধ্বংস এবং দাসত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
এসব আলোচনার উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের প্রয়োগের সঙ্গে নৈতিকতার প্রসঙ্গটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার সময় এখনই। বিজ্ঞান দশকের লক্ষ্য- বিজ্ঞান এবং সমাজের মধ্যে একটি চুক্তি গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি পক্ষ স্বীকার করে নেবে যে উন্নতি সাধনে একে অপরের জন্য অপরিহার্য। বিজ্ঞানের জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তি লিখতে হবে, যদি আমরা জলবায়ু বিপর্যয়, জীববৈচিত্রের ক্ষতি, সম্পদ হ্রাস এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের মতো ভয়ঙ্কর সংকটগুলোকে প্রশমিত করতে চাই। এটি নীতি এবং গবেষণাকে অন্তর্ভুক্ত করবে, বিজ্ঞানকে নিরাপদ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে, যাতে টেকসই উন্নয়নের জন্য একই কৌশলগত দিকনির্দেশনা লাভ করা যায়। যে সমাজ বিজ্ঞান বুঝবে সে তার সম্ভাবনাকে চিনতে পারবে এবং তার সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্বীকার করবে। বিজ্ঞানের ভূমিকা আবিষ্কার ও অন্বেষণে তরুণ এবং অ-বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহনের উপর মনোযোগ আকর্ষণ করে ইউনেস্কো বলছে, ‘এসডিজির অর্জনকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিতে জনসাধারণের বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি করে এবং বিজ্ঞানের প্রতি অধিকতর আস্থা বৃদ্ধি করে এমন একটি পরিবেশ গঠনের মাধ্যমে আমাদের বিজ্ঞানকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে।’
বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করার সময় নৈতিক পরিণতি বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন গত কয়েক বছরে আরও জরুরি হয়ে উঠেছে; বিজ্ঞান দিবস তথা দশক সে বার্তাই দিচ্ছে। বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং বৃহত্তর সমাজে উন্মুক্ত বিতর্ক প্রয়োজন। যদিও জনসাধারণের বোঝাপড়া এবং বিজ্ঞানের সচেতনতা যথাযথ নৈতিক নির্দেশিকা এবং পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবু বিজ্ঞানীদের নিজেদেরকেই তাদের নৈতিক দায়িত্বগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নাশা পরবর্তী দশকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্মুক্ত বিজ্ঞান সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্য প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। এজন্য তারা ওয়েবসাইটে ‘ওপেন-সোর্স বিজ্ঞান’ চালু করেছে; এর অর্থ হলো বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সফটওয়্যার, ডেটা এবং জ্ঞানের (অ্যালগরিদম, কাগজপত্র, নথি, আনুষঙ্গিক তথ্য) খোলামেলা ভাগ করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
দাবা খেলায় বরাবরই রাশিয়ানদের দাপট ছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ববি ফিশার বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশীপে রাশিয়ান কিংবদন্তী বরিস স্প্যাসকিকে পরাজিত করে তামাম দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দেন। ম্যাচটি আইসল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটিকে ম্যাচ অফ দ্য সেঞ্চুরি বলা হয়। ববি ফিশার আজও যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ গ্রহণকারী প্রথম ও একমাত্র দাবা গ্রান্ডমাস্টার এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করার পর থেকে তিনি একরকম নির্বাসিত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। বিভিন্ন দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত তিনি আইসল্যান্ডে এসে শান্তি খুঁজে পান। জীবনের শেষ ৩ বছর সেখানে কাটিয়ে ২০০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে বিশ্ব শান্তি সূচক (জিপিআই) সূচিত হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর আইসল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ জাতি হিসাবে তার মর্যাদা বজায় রেখে চলেছে। লক্ষ্যণীয় যে, আইসল্যান্ডের নাগরিকদের কাছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে; ৩,৪৩,০০০ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১,০৯,০০০ জনের কাছে বন্দুক রয়েছে। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো শিকারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপের সর্বনিম্ন অপরাধের হারের অধিকারী দেশটি, সহিংসতা প্রতিরোধে বা দমনে তাদের ব্যয়ও খুবই কম। এবারের ‘শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস’-এ তাই আইসল্যান্ডকে স্মরণ করতে হলো।
ববি ফিশার দাবাকে বিজ্ঞান এবং নিজেকে বিজ্ঞানী মনে করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের স্পর্শের মতো কোনো কিছুই কষ্টকে সহজ করে না।..একদিন কম্পিউটার আমাদের সকলকে অপ্রচলিত-সেকেলে করে ফেলবে’। বিজ্ঞানের সৌজন্যে মানবজীবনে যন্ত্রনির্ভরতা বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে যন্ত্রের যন্ত্রণা আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা কি শেষ পর্যন্ত তা সহ্য করতে পারবো! কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ যে লিখেছিলেন,
‘দিচ্ছো ভীষণ যন্ত্রণা
বুঝতে কেন পাচ্ছো না ছাই
মানুষ আমি, যন্ত্র না!’