Published : 30 Jan 2020, 03:17 PM
যেনতেন প্রকারেণ জেতার নামই এখন 'নির্বাচন'। তাই নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণাও রীতিমতো উৎপাতে পরিণত। 'সয়লাব' বলতে যা বোঝায় ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের পোস্টারের ছড়াছড়ি তাকেও হার মানিয়েছে। ইট-পাথরের নগরীতে যতটুকুই আকাশ দেখা যেত, সেটুকুও ঢেকে দিয়েছে হাজারো-লাখো পোস্টার। তাও আবার সেগুলো পলিথিনে মোড়ানো, লেমিনেটেড। ভোট গ্রহণের মধ্য দিয়ে এসব পোস্টারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু এর 'অস্তিত্ব' থাকবে অনন্তকাল! মাটিতে মিশবে না, পানিতে গলবে না, হাওয়ায় উবে যাবে না। আগুনে পোড়ানো হলেও দূষণে ভূমিকা রাখতে এতটুকু ছাড় দেবে না প্রার্থীদের 'দূরদর্শী' চিন্তার এই ফসল। শীতের শিশির বা হঠাৎ বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে তারা পোস্টার পলিথিনে মুড়ে দিয়েছেন, কিন্তু একবারও এর পরিণতি ভেবে দেখেননি। পরিবেশের বারোটা বাজানোর এমন আনুষ্ঠানিক আয়োজনটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!
আরও আছে। ঢাকাবাসীকে কানে তালা লাগানোর অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দিয়েছে প্রার্থীদের প্রচারযন্ত্র—সাউন্ডবক্স। গাঁক গাঁক শব্দে বেজে চলেছে অহর্নিশ, যা কানের পোকা মারার জন্য যথেষ্ট। চটুল ভাষার বেসুরো গান যেন প্রার্থীদের 'ডিজিটাল শাহনামা'। কিন্তু এটি 'শব্দ-সন্ত্রাস' ছাড়া আর কিছু নয়। শিশু থেকে বয়স্ক ব্যক্তি বা রোগী—কেউই দুদণ্ড এর অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
২.
প্রচারই যদি নগরবাসীর স্বস্তি কেড়ে নেয়, তাহলে কেমন ব্যক্তিরা এই নগর দেখভালের দায়িত্ব পেতে চলেছেন—কেউ কেউ এমন তো প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
নয়া জামানার একটা নিজস্ব দাবি থাকে। তাই প্রচারণার বড় জায়গা এখন ইন্টারনেটও। সাবেকি ঢাকঢোল-মাইকের জায়গা দখল করেছে ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম। পোস্টারের স্থায়িত্ব বাড়াতে এসেছে উন্নত কাগজ-কালি। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে মিডিয়া। প্রতিদিনই মেয়র প্রার্থীদের গণসংযোগ-প্রচার সরাসরি সম্প্রচার করছে টেলিভিশনগুলো। অনলাইন পত্রিকাগুলো ভিডিওসহ তাৎক্ষণিক সব খবরাখবর দিচ্ছে। এতে কেবল নির্বাচনী এলাকার ভোটাররাই নয়, পুরো দেশবাসীও নির্বাচনের হাল-হকিকত সম্পর্কে সমান জানতে পারছে। এত এতভাবে মানুষের দুয়ারে-চৌকাঠে পৌঁছে যাওয়ার বন্দোবস্ত থাকার পরও কেন প্রতিটি রাস্তার ওপর পোস্টারের 'ছাউনি' তৈরি করতে হবে, যাতে ঢাকা পড়ে ইমারতের জঙ্গলে কোনোরকমে টিকে থাকা টুকরো-টাকরা আকাশ? এর মাধ্যমে কি নগরবাসীর আকাশ দেখার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়নি? জনপ্রতিনিধিদের কাজ তো জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, হরণ তো নয়।
আর, এই বিপুল অপচয়েরই বা কী মানে? লাখ লাখ পোস্টারে ব্যবহৃত টন টন পলিথিনের কী হবে? রিকশা-ভ্যান-কাভার্ড ভ্যানে বসানো ভ্রাম্যমাণ সাউন্ডবক্সের লাগাতার বিকট শব্দ কি এমন উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করছে? সস্তা জনপ্রিয় যেসব গানের রিমিক করা হয়েছে নির্বাচনী প্রচারের জন্য সেগুলোর বেশির ভাগেরই কথা শুনলে পিলে চমকে যায়! 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে' গানের অনুকরণেও এক প্রার্থী তার নির্বাচনী গীত গেয়েছেন!
৩.
ভোটারদের মনের কথা মনেই থাক, প্রার্থীরাও কি মনে করেন ভোট এখনও উৎসব? উৎসবের গোড়ার কথাটিই তো স্বতঃস্ফূর্ততা। ক্ষমতা, অর্থ, পেশিশক্তি, কারচুপি, কেন্দ্র দখল, মারামারি—এসব যখন নির্বাচনের 'ভূষণ', সাধারণ ভোটারদের স্বেচ্ছায় নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার নজির তখন অতীত থেকেই টানতে হবে। দলীয় প্রার্থীদের সুবিধাভোগী চ্যালাচামুণ্ডাদের দাপাদাপির নাম তখন নির্বাচনী মিছিল, শোভাযাত্রা; ভোটাররা স্রেফ দর্শক-শ্রোতা।
ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা এখনো এক হাত থেকে অন্য হাতে যায় বটে (পড়ুন—শক্ত হাতেই ক্ষমতা থাকে!), তবে এতে জনগণের ভূমিকা সামান্যই!