বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। এইচএসসির পরপরই সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করে ভবিষ্যতের সিভিল সার্ভেন্টদের তৈরি করুক রাষ্ট্র, সশস্ত্র বাহিনীতে যেমনটা হয়। আর অনিবার্যভাবেই উচিত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির রূপরেখা প্রণয়ন।
Published : 25 Jul 2024, 08:49 AM
বাজারের দাসত্ব করা আমাদের বারোয়ারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শেষ পর্যন্ত বাজারের চাহিদার কাছেই হ্যস্তন্যস্ত হলো। এই চপেটাঘাত বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করবে। এ সেই বিশ্ববিদ্যালয় যে দিনে পড়ায় এক শ্রেণিকে, সন্ধ্যায় আরেক শ্রেণিকে। এবং দেখা গেছে, দিনের শ্রেণির চেয়ে সন্ধ্যার শ্রেণির গুরুত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে অধিকতর। দিনে বহু শিক্ষককে লণ্ঠন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু সন্ধ্যায় তাদের শ্রীমুখটি লণ্ঠন ছাড়াই স্পষ্ট দেখা যায়। বাজারের দাসত্ব আর কাকে বলে!
তথাকথিত ‘মধ্যম আয়ে’র দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ‘ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান’ হয়ে গেছে; ফলে, শিক্ষার্থীদের মন ব্যবসায়িক ও চাকুরির মনন নিয়ে গড়ে উঠবে, এ আর আশ্চর্য কী! অথচ, বলাবাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনে যে শ্রেণিটি ক্লাস-পরীক্ষায় বসে, সেই শ্রেণিটির মধ্যে কৃষকের সন্তান আছে, শ্রমিকের সন্তান আছে। আছে আরও বহু প্রজাতির মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান। এই শ্রেণিটির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিট প্রশাসনগুলোর কী অবজ্ঞা!
প্রশাসনগুলো হলের ডাইনিংয়ে ভালো খাবার দেয় না, ঠিকঠাক হলে আসন দেয় না, চারজনের কক্ষে দশজন রাখে, গণরুম সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখে, হলগুলোতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বন্দোবস্ত করে না সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য। অথচ, ওই একই প্রশাসন প্রতিটি সরকারের আমলে সরকার-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের ‘অসাধারণ শিক্ষার্থী’ তথা বড় নেতাদের কক্ষগুলো যে ‘এক নেতার এক রুম’ হয়ে যায় তা জেনেও না-জানার ভান করে, তাদের জন্য মোঘলীয় সুবিধাদির বন্দোবস্ত করে, হলের যেখানে-সেখানে টর্চারসেল খোলার অলিখিত অনুমতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের ‘সাধারণস্য’ বানিয়ে রাখে। আর ক্লাস-পরীক্ষার শ্রেণিকরণের্ কথা তো উপরে বলাই হলো।
এরকম বহুবিধ কারণেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অপমানিত ও অপদস্তবোধ করেন। কিন্তু, চুপচাপ মুখ বুঁজে সহ্য করে যান। একটা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সবচেয়ে ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অঞ্চলে’ও এ নিদারুণ বৈষম্য ও অবজ্ঞা ঠিক কতদিন উচ্চবিদ্যাপীঠ স্তরের শিক্ষার্থীরা সহ্য করবেন বলে মনে হয়? এমন শ্রেণিকরণ তারা কতদিন মান্য করে দাসত্ব বরণ করে থাকবেন?
এই শ্রেণিটির হাতেই তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁবেদার ক্ষমতাবানরা নাস্তানাবুদ হলো, বিপর্যস্ত হলো, পরাভূতও হলো। এরাই জন্ম দিলেন এক নজিরবিহীন ‘কোটা-সংস্কার আন্দোলন ২.০’-এর, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বহু যুগ-যুগান্তর।
প্রশ্ন তবুও থেকে যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব কি ‘কোটা-সংস্কার’ করা? তাদের দায়িত্ব কি লেখাপড়া-গবেষণার দায় থেকে সরে গিয়ে চাকুরির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা খোঁজার চেষ্টা করব এ লেখায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও তার দায়িত্ব
বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যে উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন, সেখানে স্নাতক হওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ গবেষক হওয়া। সারা পৃথিবীতে সেটাই আদর্শচিন্তা। গবেষণার সঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। গবেষণার জন্য যে ভয়-ভীতি-অনুশাসনহীন কর্মভূমি, যে কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয়-সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত পরিবেশ, মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় এজন্যই অন্যান্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যতিক্রম।
অথচ, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচরণ, প্রতিশ্রুতি, কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখানে স্বায়ত্তশাসন আছে কাগজে-কলমে-কেতাবে, আর বাস্তবিকঅর্থে আছে ‘করায়ত্তশাসন’ কিংবা ‘আয়ত্তশাসন’। কোটা-সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ও সিন্ডিকেট, বিশেষত ১৯৭৩’র অধ্যাদেশে চলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেভাবে ইউজিসি তথা সরকারের প্রেসনোট বাস্তবায়ন করে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করল, তা এই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করেছে।
১৯০২ সালের ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনে’র (রালেইঘ কমিশন) সুপারিশের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯০৪’র মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা রকম ইতিবাচক সংস্কারে লর্ড কার্জনের ভূমিকা থাকলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ধ্বংসে তার ভূমিকা এতটাই ন্যক্কারজনক যে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ওপর হামলা একটি সরগরম ইস্যু হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ওপর হামলা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু, কোনো আমলেই প্রত্যাঘাত ব্যতীত সেই বোধোদয় ঘটেনি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে গলাটিপে হত্যা করতে গেলে তা উল্টো বুমেরাং হয়ে যেতে পারে!
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে মূলত ‘টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ’ (পঠন ও গবেষণা) মডেলে। এছাড়াও, বাংলাদেশে আছে শুধু টিচিং মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়-কাঠামো, আছে ‘টিচিং, রেসিডেন্সিয়াল ও রিসার্চ’ মডেল, আর আছে ‘এফলিয়েটিং’ বা পরীক্ষাকেন্দ্রিক সনদদাতা মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা। অর্থাৎ পুরো ব্যবস্থাটিই আসলে জোড়াতালি দেওয়া। একের মধ্যে বহু— এগুলো ব্রিটিশরাই তৈরি করে গিয়েছিল, তারাই কিছু সংস্কার করেছিল এবং সেভাবেই চলছে। অথচ, এতেদিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো বি-ঔপনিবেশিক চিন্তা রাষ্ট্র করেইনি।
এদেশের জগাখিচুড়ি বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থায় পঠন তথা পরীক্ষাকেন্দ্রিক পঠনপাঠনের রাজত্ব এমন যে, চিন্তার নতুন দিক উন্মোচনকারী গবেষক হওয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়ন খুব কঠিন। যারা নামকাওয়াস্তে পিএইচডি না করে প্রকৃতার্থেই গবেষক হতে চান, প্রায় সবাইকেই উচ্চতর গবেষণার জন্য বিদেশমুখী হতে হয়। যাওয়ার পথটাও সহজ নয়, কেউ সফল হন, কেউ হন না। ফলে, সহজপন্থা হিসেবে গবেষক হওয়ার চেয়ে সিংহভাগেরই মনোযোগ থাকে উন্নত চাকুরিজীবী হওয়ার। প্যারাডক্স বটে, যে দেশে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্বায়ত্তশাসন ‘নেই’, সে দেশে গবেষণা থাকে কী করে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর গণতান্ত্রিক দায় ও দায়িত্ব
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে এককভাবে যদি কোনো রাজনৈতিক দল কৃতিত্ব নেওয়ার ফয়সালা করে রাখে, তাহলে তা শিক্ষার্থীদের, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের, রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করার সামিল হবে। এই জনপদকে গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করতে বারবার-বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মত্যাগ করেছেন। হয়তো কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও কর্মীও ছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে কিংবা বড়জোর ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে অধিকাংশজনই তাদের ওপর ইতিহাস-অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন।
বায়ান্নো সালে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের কেউই কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সেখানেও শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদান আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আশির দশকের প্রায় পুরো সময় জুড়ে চলা স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন থেকে সবশেষে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের শিরোপাধারী ছিলেন এই শিক্ষার্থীরাই। ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘অগাস্ট-বিদ্রোহে’র শুরুও ছাত্রদের বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই। ২০১৩ সালের গণজাগরণ আন্দোলনও শিক্ষার্থী-তরুণ-যুবাদেরই সৃষ্টি। কিন্তু, প্রত্যেকটি সময়েই লাভের গুড় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল খেয়েছে। সত্য এতই নিষ্ঠুর!
গুড় ভবিষ্যতেও খাবে। তবুও, এই জেন-জি বলি কিংবা বোকাবাক্স-প্রজন্ম, তারাও যে পূর্বসূরিদের পথ ধরে জেগে উঠতে পারেন, তা এই জনপদের ইতিহাসেরই শিক্ষা। ফলে, সেই শিক্ষাকে আমলে না নিয়ে স্বেচ্ছাচারীর মতো শিক্ষার্থীদের অবজ্ঞার চোখে খোটা মেরে কথা বললে তারা যে কোটা-সংস্কারের মতো আপাত নিরীহ পথ ধরে পুরো জাতিকে কাঁপিয়ে দিতে পারেন, তা আজ প্রমাণিত সত্য। সত্য যে কঠিন!
এই কঠিন সত্যটিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র-শাসকদের আগামী বহুবছর নাকে খত দিয়ে মনে রাখতে হবে। সর্বক্ষণ গেজেট-গিয়ার নিয়ে পড়ে থাকে বলে এই জেন-জিকে অবজ্ঞা করা যাবে না। তারাও তাদের সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের দায় ও দায়িত্ব পালন করছেন। কী সে দায়িত্ব?
সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি শিক্ষার্থীদের বহুবিধ গণতান্ত্রিক দায়িত্ব আছে। সে দায় যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক। সেটি তারা বিদ্যায়তনিক জায়গা থেকেই মেটাতে পারেন, উচিতও। কিন্তু, রাজনৈতিকভাবে যে মেটাতে হচ্ছে, কিংবা রাষ্ট্রের অসংগতিগুলো যে তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তার একটি কারণ অবশ্যই এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আরেকটি কারণ পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা তথা নানাপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য।
এত বৈষম্য থাকতে, চাকুরিই কেন তাদের কাছে প্রাধান্য পেল?
আগেই বলেছি, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আসেন পড়তে, গবেষণা করতে, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিগত ও আদর্শিক অবস্থান থেকে মাপলে শিক্ষার্থীদের চাকুরি নিয়ে ভাবার চেয়ে, জ্ঞানার্জনের দিকেই মনোযোগী হওয়ার কথা। তাছাড়া কে কোন চাকুরি করবে তার নিশ্চয়তা প্রদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ না, চাকুরি নিয়ে আলাপ করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ না। কিন্তু, সেসব লঘু হয়ে গিয়ে চাকুরিই কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল? কেন বিভাগীয় পরীক্ষাকেন্দ্রিক পঠনপাঠন নিয়ে দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকুরির পড়া পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, বিভাগীয় সেমিনার গ্রন্থাগারগুলোতে ভিড় করেন? জটিল প্রশ্ন, কিন্তু এর উত্তর এক কথায় সহজে দেয়া কঠিন আর এই আলাপের শুরু অন্তত এখনকারও নয়।
ভারতবর্ষের আদি ও নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থায় এ আলাপ ছিলও না। এ বয়ানটি ঔপনিবেশিক আমল থেকে বদলে গেছে। ১৮৩৫ সালে মেকলে-প্রযোজিত তথাকথিত যে ‘আধুনিক শিক্ষা’ চালু হয়েছিল এবং ১৮৫৭ সালে উড-প্রযোজিত যে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার মর্মমূলেই ছিল শিক্ষার সঙ্গে মুখস্থবিদ্যা নির্ভর পরীক্ষা ও চাকুরির সম্পর্ক। সেটির পুরোভাগে ছিল সরকারি চাকুরি। আর সরকারি চাকুরি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই পেতেন, যাদের ইংরেজি-জ্ঞান মোটামুটি চালিয়ে নেয়ার মতো ছিল। ফলে, সেকালে ইংরেজি হয়ে উঠেছিল বাজারের সবচেয়ে দামি বিষয়। আর শিক্ষাকে দেখাই হয়েছিল শাসকের অনুগত একটি শ্রেণি তৈরি করার প্রকল্প হিসেবে।
ফলে, যে উদ্দেশ্যে এই তথাকথিত ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা এবং আমরাও সেই মডেল অনুসরণে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলছি, ঠিক একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার্থীরাও একপায়ে খাড়া হয়ে গেছে। ব্যবস্থা চেয়েছে, শিক্ষার্থীরাও চান— এমনই লীলা তব!
ব্রিটিশ খেদিয়ে ভারত ভেঙে পাকিস্তান, তারপর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়েছে বটে, কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশের এই ‘চাকুরিবাদী শিক্ষাসংস্কৃতি’র কবর আমরা রচনা করতে পারিনি। ধারাটি বরাবরই ছিল। ছিল বলেই, কন্যাদের পিতা পাত্র হিসেবে যে কোনো সেক্টরের চাকুরিজীবির চেয়ে সরকারি চাকুরিজীবিকেই বেশি প্রাধান্য দেন! ছিল বলেই, গাত্রবর্ণের রকমভেদে অপেক্ষাকৃত ‘অশ্বেতাঙ্গ’ মেয়ের অভিভাবককূল মনে করেন, একটা সরকারি চাকুরি জুটিয়ে ফেললেই মেয়ের গাত্রবর্ণ আর বিয়ের প্রস্তাবে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না! ভয়ানক ঔপনিবেশিক মনোজাগতিক এ ট্যাবুটি আজও এমনই শক্তিশালী!
আর আজকের তারিখে নানারকম ইন্ডিকেটর মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সোনার হরিণ চাকুরিটি আদতে সরকারি চাকুরিই। ফলে, পুরো প্রজন্মটিই হামলে পড়েছে। আগেও সরকারি চাকুরির আকাঙ্ক্ষা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের ছিল, কিন্তু হামলে পড়ার মতো এতোটা প্রাদুর্ভাব ছিল না। সরকারি চাকুরিতে নিরাপত্তা আছে, নিয়মিত বেতন পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে, পরিবার গড়ার ক্ষেত্রে ‘উন্নত’ মর্যাদার তকমা আছে, আছে ক্ষমতার হাতছানি, সঙ্গে নানারকম প্রাতিষ্ঠানিক লাঞ্ছনা-বঞ্চনার প্রতিশোধ নেয়ার সমূহ সুযোগ— সব মিলিয়ে দারুণ একটি বাজারি প্যাকেজ।
বাজারের বন্দোবস্ত ও প্রকৃত চিত্র
প্যাকেজ যত ভালোই হোক, তা কি সবার রুটিরুজির নিশ্চয়তা দেয়? দেয় না। কারণ, পদ তো সীমিত। তাহলে বাকিরা যায় কোথায়? নিশ্চয়ই বেসরকারি খাতে, যেখানে রয়েছে কর্পোরেট পুঁজির ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনের চাকুরির দাসত্ব। তথাপি, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে যে পরিমাণ চাকুরির পদ ফি-বছর সৃষ্টি হয়, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হন। জেলায় জেলায় পরিকল্পনাহীন বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর মহাযজ্ঞ একদিকে বিপুল বিক্রমে এগিয়ে চলেছে, অন্যদিকে বেকারত্ব সমস্যা বাড়ছেই, কারণ সরকার শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা করছে না।
প্রমাণ হিসেবে হাজির হয়েছে, গত ৬ মে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৪। যা বলছে, দেশীয় বাজারে শ্রমশক্তির পরিমাণ ৭ কোটি ৩৭ লাখ, কিন্তু বিপরীতে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। শিক্ষা থাকলেও বেকারত্বের জগদ্দল পাথরে হুমড়ি খাবার হুমকির মুখে কত তরুণ, ভাবা যায়! এই সংখ্যাটি নিশ্চয়ই ফেলে দেবার মতো নয়!
বাজারের বন্দোবস্ত ও প্রকৃত চিত্র যখন এমন আঁতকে ওঠার মতো, তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকারি-বেসরকারি সবখাতেই ধাক্কাধাক্কির ঝক্কি থাকবেই। বেসরকারি চাকুরির বাজারে তুমুল অনিশ্চয়তা তো আছেই। বেসরকারি খাত মানে হলো প্রতিযোগিতার বাজারে মানুষকে পাগলপ্রায় যন্ত্র বানানো, ওভারটাইম উইথ নো পেমেন্ট, কথায় কথায় ছাঁটাইয়ের ভয়, সময় মতো বেতন না-পাবার আশঙ্কা। আর পুরো সমাজ ব্যবস্থাটাই এমন যে, দ্বারে দ্বারে প্রত্যাখ্যানের জুজুর ভয়, বাজারকে অস্থির করে রাখার রাজনীতি সারাক্ষণই মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়।
ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে-না-হতেই শিক্ষার্থীরা আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েন সরকারি চাকুরির প্রস্তুতিতে। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বসে থাকলে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব নেবে না, সমাজ তার দায়িত্ব নেবে না, পরিবারের কাছে অবাঞ্ছিত হতে হবে। ইত্যাদি নানা চ্যালেঞ্জের আতংকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের সামনে খুব বেশি বিকল্পও থাকে না। ঠিক তখনই সরকারি চাকুরিটি আরও বড় আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো প্রতিভাত হয়।
কিন্তু, তাতেও অশান্তি! যাওবা এতোদিন পরিশ্রমের পরে কোনো রকমে পরীক্ষা যুদ্ধের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে পারে কেউ কেউ, দেখা যায়, কয়েকবারের চেষ্টাতেও হার্ডল পার করতে পারেন না। এর কারণও নানাবিধ। একটা তো অবশ্যই রাজনৈতিক দলীয়করণ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। সঙ্গে, কার হাতে খাতা যায়, কোন বোর্ডে মৌখিক পরীক্ষা হয়, সেটাও কখনও কখনও নির্ধারক হয়ে ওঠে, কেননা পরীক্ষক থেকে পরীক্ষকে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আছে উৎকোচের মাধ্যমে ফলাফল জালিয়াতির দুশ্চিন্তাও। এর সঙ্গে থাকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আতংক, যা মাত্র কয়েকদিন আগেই মিডিয়ার কল্যাণে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
মুশকিল হলো, এগুলো লেবেল-প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট করার আশঙ্কা তৈরি করলেও, সবগুলোই অদৃশ্য ও প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে, স্পষ্টত দৃশ্যমান লেবেল-প্লেয়িং ফিল্ড বিনষ্টকারী কিংবা বৈষম্য সৃষ্টিকারী উপাদান কোনটি, সেটির খোঁজে চাকুরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা বহুকাল থেকেই ছিলেন বলে মনে হয়। শুধু বলার মতো সংগঠিত শক্তি বা ‘অরগানাইজড ফোর্স’ তাদের ছিল না।
বৈষম্য সৃষ্টিকারী উপাদান আবিষ্কৃত, যার নাম ‘কোটা’
২০১৫ সালে সরকারি চাকুরিতে নতুন বেতন স্কেল প্রণয়ন করে সরকার, যা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে সরকারি চাকুরিকে অনেক বেশি ‘আবেদনময়ী’ করে তোলে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকারি চাকুরিপ্রার্থীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে শুরু করল। সময় ও সুযোগ পেয়ে তখন এই শিক্ষার্থীরা অসংগঠিতভাবেই একটি সংগঠিত আওয়াজ তুললেন যে, ‘ইউরেকা! ইউরেকা! লেবেল-প্লেয়িং ফিল্ড বিনষ্টকারী তথা বৈষম্য সৃষ্টিকারী দৃশ্যমান উপাদানটি পাওয়া গেছে!’ তারা আবিষ্কার করলেন বাংলাদেশে কোটায় চাকুরি হয় ৫৬%, মেধার ভিত্তিতে মাত্র ৪৪%। এটা ২০১৮ সালের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার তথৈবচ অবস্থা হলেও, চাকুরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা ‘গবেষণা’ করেই দেখিয়ে দিলেন, এ বড় অন্যায়! চাকুরিক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা ‘অন্যায়’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।
বলবে কী! সত্যি বলতে, বাংলাদেশের সরকারি চাকুরিতে যে এমন একটি বন্দোবস্ত আছে, সেটি জানতেন বোধহয় দেশের ১ ভাগ মানুষ। এই বিষয়টি সর্বজনীনরূপ পেয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল, যখন ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা-সংস্কারের জন্য আন্দোলনে নামলেন। আর মুখ্যত, এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছিল সর্বোচ্চ ৩০% থাকা ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’র কথা। ফলে, দৃশ্যত মনে হচ্ছিল, আন্দোলনকারীরা বোধহয় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদেরই বিরুদ্ধে!
বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ জাতিরাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী আবেগ ও অহংকারের কারণেই হয়তো এমনটা শুনতে খারাপ লাগছিল, হজম করতেও স্বভাবতই কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধোত্তর সরকার যে মানবিক কারণে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% করেছিলেন, সেটি তখনকার বাস্তবতায় যথোপযুক্ত হলেও, বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতায় এতো ভাগ প্রয়োজন আছে কি নেই, তা অনুধাবন না করেই একটা পক্ষ বিষয়টিকে রাজনীতি করার হাতিয়ার বানিয়ে ফেললেন।
কোটা বাতিল থেকে কোটা সংস্কার
এরপর নানাভাবে জল ঘোলা হলো। প্রধানমন্ত্রী সংসদে ‘বিরক্ত হয়ে’ ঘোষণা করলেন, ‘সব কোটা বাতিল।’ প্রজ্ঞাপনে অবশ্য জানা গেল, সরকারি চাকুরিতে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত কোটা বাতিল। বিগত ৬ বছর সেভাবেই চলল। যদিও, আন্দোলনকারীদের দাবি বাতিল নয়, ছিল সংস্কারের। সংস্কার না হওয়ায় অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলোর অনেকেই অসুবিধায় পড়লেন, যা ছিল সংবিধানবিরুদ্ধ। কিন্তু, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, তখন না সরকার না আন্দোলনকারীরা, কোনো পক্ষই এদিকটি ভেবেও দেখেননি, যথাযথ ব্যবস্থাও নেননি।
২০২১ সালের এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালে এসে (৫ জুন) নির্বাহী বিভাগের জারি করা সেই প্রজ্ঞাপনটি বাতিল ঘোষণা করলেন। এরপরেই ২০১৮ সালের সেই আন্দোলেনর ধারাবাহিকতায় ‘কোটা-সংস্কার আন্দোলন ২.০’ জমে উঠল। জমতে অবশ্য একটু সময় লাগল। ১ জুলাই থেকে বারোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশন স্কিম (প্রত্যয়) ইস্যুতে কর্মবিরতিতে যাওয়ার পরপরই, ক্লাস-পরীক্ষার দুশ্চিন্তামুক্ত শিক্ষার্থীরা সর্বত্রভাবে আন্দোলনে যোগ দিলেন। তারপর, একের পর এক যা যা ঘটল, তা এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে নজিরবিহীন, অভূতপূর্ব ও বিরল। বারোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খালি করে ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ করে দেবার পর আন্দোলন যখন আপাত স্তিমিত হয়ে গেল মনে হচ্ছিল, তখন প্রায় বিনা আকাঙ্ক্ষাতেই কোটা-সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে, নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা একযোগে রাস্তায় নেমে নিজেরাও আত্মাহুতি দিলেন, আহত হলেন— এ দৃশ্য কবে দেখেছে বাংলাদেশ!
কী ঘটল, কীভাবে ঘটল, কেন ঘটল, কোন পরিস্থিতিতে ঘটল, তা এই লেখার বিষয়বস্তু নয় বলে আমরা সেদিকে বিস্তারিত যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলি, এতোগুলো প্রাণ অকাতরে ঝরে গেল শুধু সরকার ও তার তল্পিবাহক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো সঠিক সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই নয়, একইসঙ্গে দায়িত্বরতদের দুর্দমনীয় অহমবোধ ও ধরা-সরা জ্ঞান না করাও এর বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইবে ইতিহাসে।
কতগুলো কাল বিলম্ব করার পর, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার পর উদ্যোগ নেয়া হলো শুনানির দিনক্ষণ এগিয়ে আনার। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দিলেন— ৯৩% মেধাভিত্তিক ও ৭% কোটাভিত্তিক নিয়োগ হবে সরকারি চাকুরির নবম থেকে বিশতম গ্রেড পর্যন্ত। যদিও আদালত বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ তথা সরকার চাইলে তার মতো করে এই কোটাবণ্টন পুনর্বণ্টনের অভিপ্রায়ে ‘বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার’ করতে পারে, কিন্তু, সরকার কোনো প্রকার ঝুঁকি আপাতত নিল না। যদিও বিভিন্ন সময়েই সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন তাঁদের তরফে ৮০% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রস্তাব করা হলো, তবুও সুপ্রিম কোর্টের রায় হুবুহু মান্য করে সরকার কোটাবণ্টনে ৫% বরাদ্দ করেছে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য (নাতি-নাতনীদের জন্য নয়)। ১% করে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ এবং ‘প্রতিবন্ধী’ ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য।
কোটা-সংক্রান্ত ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে’র আন্দোলনকারীরা বরাবর নির্বাহী বিভাগের কাছেই কোটা-সংস্কার প্রসঙ্গে সমাধান চেয়েছেন। নির্বাহী বিভাগ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে সমাধান দিল, তা আদালতের নির্দেশনার আংশিক প্রতিপালন। প্রজ্ঞাপনের আগে একটি বহুপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে আন্দোলনকারীসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কোটা-সংস্কার বিষয়ে তাদের প্রস্তাব ও মতামত জেনে নেয়া হতো সবচেয়ে উত্তমপন্থা। তাতে প্রক্রিয়াটি অধিকতর গণতান্ত্রিক হতো।
স্বভাবতই, এই নতুন বণ্টনব্যবস্থায় বাদ পড়ে গেল নারী কোটা ও জেলা কোটা। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৬ ভাগের ৫ ভাগই কমে গেছে, কিন্তু, নিঃসন্দেহে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ কোটা একবারে এতোটা কমে যাওয়া এবং নারী কোটা একেবারেই অবলুপ্ত করা বৈষম্য বাড়াবে বৈ কমাবে না। এই দুটি কোটা প্রসঙ্গে নির্বাহী বিভাগের আরও জোরালো ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল, তারা আপাতত সেটি করেনি।
কোটার ক্ষেত্রে আরও দুটি বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের জোরালোভাবে ভাবা উচিত। একটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কোনো পোষ্য কোটা থাকা যাবে না, কেননা এই পোষ্যরা সংবিধান অনুযায়ী ‘অনগ্রসর’ নন। আরেকটি হলো, সরকারি প্রজ্ঞাপনে যেসব কোটার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি জীবনে একবারের বেশি সুবিধা নিতে পারবেন না— হোক তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে, বা হোক সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে।
অন্যদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ৬০% নারী কোটা রয়েছে। এই প্রজ্ঞাপনে সে বিষয়েও কিছু বলা হয়নি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও বিস্তারিত কিছু বলেনি। ফলে, সার্বিক বিবেচনায় এখন কোটা-সংক্রান্ত সমস্যাটির আরেকটি জানালা উন্মুক্ত হলো বলে মনে হচ্ছে।
আপাত এই সমাধান উচ্চশিক্ষার ভগ্নদশার মেরামত করবে?
সমস্যা এমন একটি বিষয়, যার সমাধানের রূপ অনেকক্ষেত্রেই সর্বজনীন হয় না। কোটা-সংস্কারের নতুন প্রজ্ঞাপনটিই যেমন কাউকে কাউকে সন্তুষ্ট করলেও, কাউকে কাউকে অসন্তুষ্ট করেছে। কিন্তু, সেটি কোটাকেন্দ্রিক ইস্যু। আমাদের দেখার বিষয়, এর ফলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হবে কি না? সোজা উত্তর: হবে না। বরং, সরকারি চাকুরিতে অংশগ্রহণেচ্ছুর নাগরিক অধিকারবোধ আরও সর্বব্যাপী-সর্বগ্রাসী হবে এবং উচ্চশিক্ষা আরও গভীর তিমিরে পতিত হবে।
যতদিন রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসন বন্ধ না হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক চর্চা কেতাব থেকে গোয়ালে দৃষ্টিগোচর না হবে এবং অতিআবশ্যিকভাবে পুরোদস্তুর বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার না হবে, ততদিন সরকারি চাকুরি এমন এক অবিনশ্বর আলাদীনের জাদুর প্রদীপ হিসেবে জ্বলতে থাকবে, যা একজন ‘নিম্নবর্গীয়’ সাব্যস্ত হওয়া নাগরিকের উচ্চশিক্ষাজীবনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কুড়োনো সমস্ত অবজ্ঞা, অপমান, ভর্ৎসনা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনার জবাব দেয়ার সবচেয়ে বড় মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হবে। আর এই তরিকাতেই কেউ কেউ বেনজির বা মতিউর হয়ে উঠবেন!
সরকারি চাকুরি করা কিংবা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে প্রশাসন-পররাষ্ট্র-পুলিশ-কাস্টমসে চাকুরি করার আকাঙ্ক্ষা কোনো মহান দেশসেবা, দেশপ্রেম, নীতিনৈতিকতা বা সততা থেকে উৎসারিত হয় না। রাষ্ট্র-বিশ্ববিদ্যালয় তথা সর্বত্র রাজনৈতিক অগণতান্ত্রিকতাই নাগরিকদের এ পথে ঠেলে দেয় এবং এভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। কোটা-সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত কারও কাছেই তাই এসব চিন্তাকাঠামোর বাইরে গিয়ে ‘অলৌকিক’ কিছু আশা করা উচিত হবে না, কেননা তারা বাংলাদেশের বাইরের কোনো পূত-পবিত্র দ্বীপে জন্মাননি।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনার উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা ভাঁড়মে গেলেও, কারও কিছু করার নেই— এই ভগ্নদশার মেরামত করতে গেলে অনেক গভীর থেকে আগে সংস্কার কাজ শুরু করতে হবে। ভেঙে ফেলতে হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থার কাঠামো। গড়তে হবে নতুন করে।
উদাহরণস্বরূপ ছোট্ট করে বলে রাখি, বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। এইচএসসির পরপরই সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করে ভবিষ্যতের সিভিল সার্ভেন্টদের তৈরি করুক রাষ্ট্র, সশস্ত্র বাহিনীতে যেমনটা হয়। আর অনিবার্যভাবেই উচিত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির রূপরেখা প্রণয়ন। তাতে যদি মৃতপ্রায় বিশ্ববিদ্যালয় ও তার উচ্চশিক্ষার মুমূর্ষু-দশা আপাতভাবে দূর হয় আর কী। প্রস্তাব এবং কাজ তো আরও ঢের বাকি!