রাজনীতিকদের মধ্যে যে ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখছি, তারা নিজেরা তা দেখতে পাচ্ছেন না। কেননা, তাদের তো নেংটো রাজাকে তোমার জামা কই বলার মতো কেউ নেই। তাদের ঘিরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই তৈরি হয়েছে স্তাবকশ্রেণি।
Published : 01 Nov 2023, 06:39 PM
রাজনীতি নিয়ে আলোচনা এখন দেশের আনাচে-কানাচে। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শহরের আলোকিত ফুটপাত আর ড্রইংরুমে মানুষের উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কোনো কমতি নেই। বাবা ফোন করছেন মেয়েকে, সন্তানরা বাবাকে, পরিবারের প্রতিটি মানুষ একে অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত। কমবেশি দেশের অধিকাংশ মানুষই চিন্তামগ্ন, অনেকেই ঘুমহীন। এই অবস্থার পরিবর্তন কবে হবে কেউ বলতে পারে না।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের কথা মনে পড়ছে। আমাদের বয়স খুবই কম তখন। তবে ছোট্টবেলার অনেক স্মৃতি এখনও দগদগে। আমাদের একটি তেলের ডিপো ছিল। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলায় দেখলাম একদল মানুষ, তাদের সবাই হাতে কি একটা নিয়ে তেলের ড্রামে চুবাচ্ছে আর অন্য কেউ আগুন জ্বেলে দিচ্ছে। পরে জানতে পেরেছিলাম এরই নাম মশাল। এই বস্তুটি হাতে নিয়ে করা মিছিলের নাম মশাল মিছিল। তবে সেই কৈশোরের আলো ঝলমলে মশাল মিছিলটি কিন্তু আমাদের জন্য খুবই আনন্দের ছিল। সেই সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কিছুটা আঁচ ও প্রভাব আমাদের শিশু মনেও পড়েছিল। তখন সেই উপজেলা পর্যায়ে মশাল মিছিলটি প্রতীকীই ছিল। কেউ মশাল মিছিল থেকে কোথাও আগুন দিয়ে দিয়েছে সেটা সচরাচর শোনা যেত না। যদিও আজকের প্রসঙ্গ ভিন্ন। এখন কোথাও আগুন দিতে, হামলা করতে আর মিছিল করতে হয় না। কে কোথায় থেকে কি করছে তা বলাই মুশকিল।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটা ভয়াবহ সংকটের আঁচ ও ধাঁচ আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। রাজনীতিতে আবারও এক নতুন মেরুকরণ ও সংকটের সৃষ্টি যে হয়ে গেছে তা আর নতুন করে কাউকে বলে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আদর্শবাদী রাজনীতি, দেশপ্রেম আর জবাবদিহিতার জায়গায় একমাত্র জায়গা দখল করে আছে ক্ষমতার স্বাদ ও দুর্বিনীত লোভ। একটি মোর্চা যেনতেনভাবে ক্ষমতায় বসেই থাকতে চায় আর আরেকটি অংশ যেভাবেই হোক ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে চায়। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশকে কেন্দ্র করে যা যা ঘটেছে তা কি এদেশের রাজনীতির জন্য শুভ কোনো লক্ষণ? এই ঘটনাপঞ্জি থেকে কি আমরা কোনো কিছু অর্জন করতে পেরেছি যা আমাদের সামনে কাজে লাগবে?
রাজনীতিটা কোথায়?
হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল বিগত এক-এগারো সরকারের কিছু সময়কাল। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন যেটা পরে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। এমনই এক বিরূপ পরিস্থিতিতে সেদিন সেনাসমর্থিত সরকার দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল। মানুষ যখন আর কোনো আলোর সন্ধান পাচ্ছিল না তখন এক নবতর রাষ্ট্রকাঠামো গঠিত হয়েছিল। কিন্তু একটা কথা আছে, যার কাজ যেটা করা। সেই সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই দেশের মানুষ শুরুতে তাকে স্বাগত জানালেও অল্প কিছুদিনেই তার অসারতা প্রমাণিত হয়েছিল। একটি ছাত্র বিক্ষোভকে তারা যে কায়দায় দমন করেছিল তা অতীতের সব উদাহরণকে হার মানিয়েছিল। সেই সময়কালে আমরা দুই নেত্রীসহ বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার হতে দেখেছিলাম দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগে। মানুষ কিন্তু শুরুতে সকল প্রক্রিয়াকেই স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ মানুষের সামনে বিকল্প আর কোনো ব্যবস্থা খোলা ছিল না। কিন্তু সেই সরকারও জনগণের আস্থায় খুব বেশিদিন থাকতে পারেনি। দলীয় রাজনীতির সংকট সেদিনও আমরা খেয়াল করে থাকব। দুই নেত্রীকে সেদিন মাইনাস টু ফর্মুলায় ফেলার জন্য দলের মধ্যেই আওয়াজ তুলেছিল অনেকেই। যদিও সেই মাইনাস টু ফর্মুলা টেকেনি, টেকেনি সেই সরকারের লোক দেখানো যাবতীয় কার্যক্রম। আমাকে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি সফলতা রয়েছে সেটি হলো বিজয় সরণি লিংক রোডের জন্ম। যাইহোক সেদিন আমরা যারা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তারা দেখেছিলাম যে, ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা দুই দলের এত এত শক্তি, জনবল থাকার পরও তারা কীভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়েছিল। দুই নেত্রী যখন গ্রেপ্তার হলেন তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করেছিলাম। তাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মাত্র কয়েকজন ছাত্রনেতাকেই সেদিন সরব হতে দেখেছিলাম।
মাইনাস টু ফর্মুলা দিয়েছিল বড় রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতারা। তারা তাদের নিজেদের অপকর্মের দায় গছিয়ে দিতে চেয়েছিল দুই নেত্রীর ওপর।
আজকে দুই রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে দেশের জনগণ যে ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করে তা কি পাওয়া যাচ্ছে? মূল বিষয়টাই হলো রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং রাজনীতি থেকে রাজনীতিটাই নাই হয়ে গেছে। রাজনীতিকদের মধ্যে যে ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখছি, তারা নিজেরা তা দেখতে পাচ্ছেন না। কেননা, তাদের তো নেংটো রাজাকে তোমার জামা কই বলার মতো কেউ নেই। তাদের ঘিরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই তৈরি হয়েছে স্তাবকশ্রেণি। এখানে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কোনো কথা না থাকলেও ক্ষমতায় যাবার জন্য প্রয়োজনে বিদেশী কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনো ধরনের চুক্তিতে যেতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকাটাকেই নিশ্চিত করতে হবে।
৩৩ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি!
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে হিসেব করলে প্রায় ৩৩ বছর। এই ৩৩ বছরে কথা না রাখার রাজনীতি শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে জায়গা দখল করে নিয়েছে পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজার অর্থনীতি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই দেশে শ্রেণি শোষণ বন্ধ হবার কথা থাকলেও, এখনও একটি বড়লোক ও পুঁজিবাদী শ্রেণি সকল সুবিধা ভোগ করে। আমাদের রাজনীতিও সেই বড়লোক, লুটেরা ও দুষ্টচক্র দখল করে নিয়েছে। এদেশের কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবকিছুকেই দখল করে নিয়েছে সেই পুঁজিবাদী দর্শন। নব্বইয়ের ছাত্র গণ-আন্দোলনের একটি মৌলিক দিক ছিল এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ছাত্র সমাজের দশ দফার ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে হবে, কিন্তু সেই কথাও রাখেনি ক্ষমতাসীনরা। বরং বিগত ৩৩ বছরে দেশকে আরও বৈষম্য ও লুটপাটের ধারায় প্রভাবিত করেছে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল। এরা ভাগ ভাগ হয়ে আজও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কিন্তু জনগণের স্বার্থের পক্ষে তারা কেউ কথা রাখেনি। তারা সবাই যেনতেন পন্থায় কেবল ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়। তাই তো বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীপক্ষ যে পন্থায় রাজনীতি করছে তা দেশের জন্য মারাত্মক সংকটই ডেকে আনবে। বিগত ২৮ অক্টোবর দুই দলের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় দুই দল যে ধরনের আচরণ করে যাচ্ছে তাতে নির্বাচন, গণতান্ত্রিক চর্চা, ভোটাধিকার, জনগণের নিরাপত্তা সবকিছুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রশাসনে দল, দলে প্রশাসনের আধিপত্য
আমাদের দেশের কোথাও কোনো জবাবদিহিতার জায়গা নেই। কিন্তু এ কথা আপনি বলতে পারবেন না। প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে থাকে ক্ষমতাসীনরা, সেখানে অন্য যে কেউই প্রান্তিক। সরকারি প্রশাসন রূপ নিয়েছে ক্ষমতাসীনদের প্রধান শক্তিতে। রাষ্ট্র পরিচালনায় পুলিশের ভূমিকা খুবই জরুরি। অথচ সর্বসাধারণের ধারণা, সরকারের টিকে থাকার প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে পুলিশ প্রশাসন। শুধু পুলিশ নয়, প্রশাসনের প্রতিটি স্তর শাসকের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
এই স্বেচ্ছাচারিতা ও যাচ্ছে-তাই ব্যবস্থার বদল চায় বাংলাদেশের জনগণ। একটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রশাসনকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ও সবার জন্য সহনশীল ও জবাবদিহিতামূলক হতে হবে। তা না হলে মানুষের আস্থার জায়গায় যেতে পারবে না। নির্বাচন কমিশন একটি নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিতামূলক নির্বাচন করতে পারলেই কেবল তার প্রতি রাজনৈতিক শক্তি ও মানুষের আস্থার জায়গাটি তৈরি হয়। নয়তো নির্বাচন নিয়মরক্ষার কাজ ব্যতীত আর কিছুই থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ চায় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সত্যিকারের ভাবমূর্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াক। মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হোক। আমরা যেন খুব গর্বভরে বলতে পারি, আমাদের নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, আমাদের পুলিশ প্রশাসন দল নিরপেক্ষ।
জনগণ কী চায়?
বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে আমাদের গ্রামের এক প্রবীণের বক্তব্য ছিল এমন বাঙালি জিতার পক্ষে ধ্বনি দেয়। হুজুগে বাঙালি বলে তো একটি বক্তব্য সবসময়ই পাওয়া যায়। এত সরলীকরণ না হলেও বাঙালি আবেগ ও অনুভূতির ওপর ভিত্তি তার বড় সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আবেগের আরেকটি বড় জায়গা। কিন্তু বিগত ৫২ বছরে বাঙালির এই আবেগকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে এদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক শক্তি। সবাই ক্ষমতায় যাবার জন্য এদেশের জনগণকে সিঁড়ি বানিয়েছে। কেউ জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে কোনো মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা কী? ক্ষমতাসীন কিংবা বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ বলবে না যে দ্রব্যমূল্য। আকাশচুম্বি দ্রব্যমূল্যের যাতাকলে পিষ্ট হলেও সরকারের এদিকে ন্যূনতম ভ্রূক্ষেপ নেই। বরং নির্বাচনী তফসিল নিয়ে আজকের দিনে তার প্রধান আগ্রহ। অপরপক্ষে বিরোধী পক্ষও জনগণের ভোটাধিকার ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে জনগণও বিভ্রান্ত। মূলত একটি বড় অংশের জনগণই বিরাজনীতিকীকরণে প্রভাবিত। তারা মনেই করে এদেশে গণতান্ত্রিক যে বিধি ব্যবস্থা চলছে তা সঠিক নয়। কেবল ভোটাধিকারের ওপর এদেশের জনগণের আর আস্থা আছে বলে আমার মনে হয় না।
সংঘাত নাকি শান্তি
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা প্রগতিশীল আন্দোলনে একটি কথা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতাম। বলতাম কোন পক্ষে যাবে তুমি, সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব-সাম্প্রদায়িকতা-চাঁদাবাজির পক্ষে নাকি প্রগতির পক্ষে। আজও খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে ইচ্ছে করে আমরা কি সংঘাত নাকি শান্তি চাই। নিশ্চয়ই এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তাই যে কোনো ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে আমরা এড়াতে চাই। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে এখন পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের জীবন গেল। যে পুলিশ ভাইটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো এটি যেমন আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একইভাবে সারাদেশে নির্বিচারে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, দমনপীড়নকেও আমরা সমর্থন করি না। সারাদেশে অবরোধ চলছে, প্রতিদিনই অস্থিরতা বাড়ছে। আমেরিকা, ইউরোপসহ পৃথিবীর তাবৎ দেশ বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নানারকম বক্তব্য রেখেই যাচ্ছে। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হিসেবে তারা নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। আমাদের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতালিপ্সু শক্তি দুটিই সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।