চালের বাজারে চলমান অস্থিরতা উদ্বেগজনক। দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি চিন্তিত হয় চালের দাম বাড়লে। রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে।
Published : 15 Mar 2025, 05:01 AM
রোজা শুরুর কিছুদিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেই একখানা নিবন্ধ লিখে বলেছিলাম, এবার পণ্যবাজার সম্ভবত ‘শান্ত’ থাকবে। এটা মোটেও অসাধারণ কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়। পণ্যবাজারের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে এমনটা বলা কঠিন নয় অর্থশাস্ত্রের একজন ছাত্রের পক্ষে।
রমজানে যেসব পণ্যের দাম আলাদা করে বাড়ার প্রবণতা থাকে, সেগুলোর বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইউনূস সরকার স্পষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল বেশ আগে, সেটাও লক্ষণীয়। রোজা যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ে আসে, তাই আগেভাগে পদক্ষেপ নেওয়াটা গুরুত্ববহ। কয়েকটি জরুরি পণ্য আমদানিতে জোর দিয়েছিল সরকার। ব্যবসায়ীদের সহায়তা জুগিয়েছিল কর-শুল্ক কমিয়ে এবং ব্যাংকিং সহায়তা বাড়িয়ে। তাতে নতুন আমদানিকারকও এসে ব্যবসা শুরু করেছেন।
দেশের কৃষি খাতও ভালো ‘পারফর্ম’ করছিল, বিশেষত শীতে। এটাকে বলা হয় উৎপাদন মৌসুম। এটি সফল হওয়ার পেছনে কেবল আবহাওয়ার সহায়তা নয়; সরকারের সহায়তাও ছিল। অন্তত অসহযোগিতার খবর পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় আলুর উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে এবার। তার প্রভাবে দাম গেছে পড়ে। রমজানে মূল মৌসুমের পেঁয়াজ উত্তোলন চলছে। তাতে এর দামও যাচ্ছে আরও কমে। গেল রমজানের তুলনায় এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম এখন অর্ধেক কিংবা আরও কম। এ দুটি পণ্যই কিন্তু আমদানি করা হচ্ছিল। এখন এগুলো রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাতে যদি চাষিদের মুখে কিছুটা হাসি ফোটে। এ রমজানে তাদের কিন্তু পেঁয়াজ বেচে ছোলা, চিনি, খেজুর ইত্যাদি কিনতে হচ্ছে।
এসব পণ্যের দামও এবার স্থিতিশীল কিংবা কমতির দিকে। উল্লিখিত পণ্যগুলোয় আমরা আবার আমদানিনির্ভর। চিনির চাহিদার সিংহভাগ মেটানো হয় বিদেশ থেকে এনে। রোজায় খেজুরের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু হলে এ সময়ে এর দামও হয় আলোচিত। সরকার এবার বিশেষত বহুল ব্যবহৃত সাধারণ মানের খেজুরের দাম কমাতে উদ্যোগী হয়েছিল। ছোলাও কম দামে পাওয়া যাচ্ছে।
রমজানে টিসিবির মাধ্যমেও ছোলা আর খেজুর দেওয়া হয়। অন্যান্য পণ্যও সংস্থাটি জোগায় বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে। রমজানে টিসিবির কার্যক্রমকে অনেক বিস্তৃত করা হয়েছে। সব জেলা শহরে তাদের ‘ট্রাক সেল’ চলছে বলে খবর স্বস্তির। এ কার্যক্রমে ফ্যামিলি কার্ড নেই, এমন লোকজনও পণ্য কিনতে পারে। তবে পর্যাপ্ত পণ্য জোগানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে বিশৃঙ্খলা কম হচ্ছে না। হতাশাও কম নয়।
বছরের পর বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে থাকা মানুষজন আরও বেশি করে এ ধরনের সহায়তা পেতে আগ্রহী বলে আসলে পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উচিত হবে কাজটিকে আরও বিস্তৃত ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা। ওএমএসসহ অন্যান্য খাদ্য সহায়তা কার্যক্রমও এ সময়টায় জোরদার থাকতে হবে। তাতে পণ্যবাজারে পড়বে সুপ্রভাব। আরও বেশি মানুষ সরকারের কাছ থেকে কম দামে পণ্য পেলে বাজারে কমবে চাহিদার চাপ। এতে পণ্যবাজার আরও কিছুটা ‘শান্ত হয়ে আসবে বলে আশা।
এ নিবন্ধ লেখার সময়েও বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি বলে খবর রয়েছে। এই একটা পণ্য নিয়ে কী যে হচ্ছে, তা জনসাধারণের কাছে অস্পষ্ট। সয়াবিনের আমদানি গেলবারের চেয়ে বেশি; তারপরও সরবরাহে সংকট। এর আগেও এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার পরে দাম বাড়াতে সম্মত হলে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। এবারও তেমনটি হচ্ছে বলে অনুমান। বাজারে অবশ্য খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের ঘাটতি নেই। সরিষার তেলের বিক্রি নাকি বাড়ছে এ অবস্থায়। বাড়ছে রাইস ব্রান তেলের বিক্রি।
সংকটে এভাবে কিছু পণ্যের বিক্রি বাড়ে; মানুষের অভ্যাসও বদলায়। তবে মনে হয়, সয়াবিনের ওপর নির্ভরতা নানা কারণেই থাকবে দীর্ঘদিন। এর বাজারে তাই বজায় রাখতে হবে স্বচ্ছতা। কোম্পানিগুলো যৌক্তিকভাবে দাম বাড়াতে চাইলে তাদের সঙ্গে বসে কথা বলা যেতে পারে। তবে তাদের কি উচিত– রমজানেও ভোক্তাদের সঙ্গে বৈরি আচরণ করা? সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী কোনো কোম্পানি তো ছোট নয়। তারা অন্যান্য নিত্যপণ্যও, যেমন আটা-ময়দা, চিনি উৎপাদন করে। সব পণ্য থেকে একযোগে মুনাফা না করলেও তাদের চলবে বলেই ধারণা। এ ধারার কোনো কোনো কোম্পানি অবশ্য সরাসরি পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছে কিছু পয়েন্টে; সাশ্রয়ী দামে। এতে কোম্পানির ব্র্যান্ড ইমেজ ভালো হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে বাজারে এর সুফল তারা পাবে।
সয়াবিনের পাশাপাশি চালের বাজারে কিছু অস্থিরতার খবর রয়েছে। গেল রমজানেও চালের দাম বাড়ার প্রবণতা ছিল। চালে যে কিছু ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেটা সরকার অস্বীকার করছে না। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন পর চাল আমদানি করা হচ্ছে। কম দাম নিশ্চিত করতে এতে শুল্কও কমানো হয়েছিল ব্যাপকভাবে। তা সত্ত্বেও চালের বাজারে অস্থিরতা থাকলে এর কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। রমজানে চালের চাহিদা বাড়ার তো কথা নয়। এ সময়ে নানারকম ডালের চাহিদা বরং অনেক বাড়তে দেখা যায়। ছোলার পাশাপাশি ডালের বাজারও কিন্তু এবার স্থিতিশীল। এর প্রধান কারণ বিপুল আমদানি।
ডলারের দাম বেশি হলেও আন্তর্জাতিক বাজার অনুকূলে থাকায় সহনীয় দামে পণ্যসামগ্রী জোগাতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না ব্যবসায়ীদের। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক সময় এমনও হয়, চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য চলে আসায় লোকসান গুনতে হয় তাদের। চাহিদা হ্রাসের কারণেও বিক্রি কমে গিয়ে বিপর্যয় ঘটতে পারে। সেটা ঘটে তখনই, যখন বিপুলসংখ্যক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা একযোগে কমে যায়। টানা মূল্যস্ফীতির শিকার জনপদে এবার এমনটি ঘটছে কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পর বিদ্যমান ব্যবসা থেকে শ্রমিক ছাঁটাইসহ কর্মসংস্থানে নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলতে থাকায় মানুষ যথাসম্ভব কম ব্যয় করে অর্থ ধরে রাখতে উৎসাহী, এমনটাও ঘটতে পারে। আর তার প্রভাব পড়তে পারে রোজার বাজারে। ইফতার আইটেমের ব্যবসাও এবার জমজমাট নয় বলে জানাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। ইফতার তৈরির উপকরণের দাম কমায় তারা এর দাম কতটা কম রাখছেন, সে প্রশ্নও অবশ্য তাদের করা যেতে পারে।
রোজার আট-দশদিন চলে গেলে প্রতিবারই পণ্যবাজার কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। এবার আরও বেশি করে সেটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সবজির মধ্যে বেগুন, লেবু, শসার দাম যথারীতি বেড়েছিল এবারও। এগুলোর দাম সহনীয় হয়ে আসতেও সময় লাগছে না। কাঁচামরিচ, ধনেপাতা ও গাজরের দাম এবার বেশ কম। গাজরের দাম এত কমেছে যে, এটা মনে হয় সংরক্ষণ করা দরকার। এর দাম তো বাড়তে বাড়তে ২০০ টাকা কেজি হয়ে যেতেও দেখা যায়। একই কথা টমেটোর বেলায় আরও বেশি করে প্রযোজ্য। সস্তায় পেয়ে টমেটো পেস্ট করে অনেকে ডিপ ফ্রিজে রাখছেন।
এবার এমন সময়ে রোজা হয়েছে– যখন বাজার দুই মৌসুমের সবজিতে সয়লাব। সীমান্তপথে বেগুন, লেবু আর শসা আমদানির উদ্যোগ থাকলে তো মনে হয়, এগুলোর দামও সহনীয় থাকত। এটা অবশ্য লেবুর মৌসুম নয়। প্রতিবেশী দেশ থেকেও কি সহজে লেবু আনা যেত? লেবু আমদানির কথায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনেক দেশই এটা আমদানি করে প্রয়োজন মেটায়। আর রমজানে এখানে প্রতিবারই এটা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। আমরা তো কাঁচামরিচও আমদানি করি– সংকটে পড়লে। গাজরও আমদানি হয়ে থাকে। আসে নতুন আলু।
ডিমের সংকটে পড়ে আমরা এর আমদানিও শুরু করেছিলাম বিগত সরকারের শেষ সময়ে। রমজানে ডিমের দাম কমেছে আরও কিছুটা। ১২০-১৩০ টাকায় এক ডজন ডিম পাওয়া যাচ্ছে। রোজায় ডিমের চাহিদা কমে বেকারিতে। তবে ইফতার আইটেম তৈরিতে বাড়ে এর চাহিদা। রোজার সপ্তাহখানেক চলে যাওয়ার পর থেকে মাছ, মুরগির দামও কমে আসতে দেখা যাচ্ছে। এ সময়টায় মুরগির দাম হ্রাসের বড় কারণ অবশ্য সামাজিক অনুষ্ঠান কমে আসা। শীতে গ্রাম অবধি এ ধরনের অনুষ্ঠান বাড়ে। বাড়ে সুগন্ধি চালের চাহিদা। এ চালের উৎপাদন বেড়েছে দেশে। বড় কোম্পানিগুলোও এর ব্যবসায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। ‘চুক্তিতে চাষাবাদ’ করাচ্ছে তারা।
রমজানে সুগন্ধি চালের দাম বাড়ার খবর নেই। তবে সেদ্ধ চালের বাজারে চলমান অস্থিরতা উদ্বেগজনক। দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি চিন্তিত হয় চালের দাম বাড়লে। রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে। এ সময়ে আলুর দাম কম থাকাটা অবশ্য ইতিবাচক। তবে বেশি করে আলু খেয়ে ভাতের ওপর চাপ কমানোর কথা বললে লোকে এখনও সেটা গ্রহণ করতে রাজি নয়। অতিউৎপাদনের প্রেক্ষাপটে সরকার বাজার থেকে কিছু আলু কিনে সংরক্ষণে যেতে পারে কিনা, সেটা অবশ্য খতিয়ে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে নিজস্ব হিমাগার গড়তে হবে সরকারকে। খাদ্য নিরাপত্তায় আলুর গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে বৈকি। দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে কিন্তু বোঝা যায়, আলু কতখানি গুরুত্বপূর্ণ।
রমজানের মধ্যভাগ থেকে জামাকাপড়সহ অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার প্রবণতা বাড়বে। এ কারণে চাহিদার চাপ কমবে পণ্যবাজারে। তার প্রভাবও কি থাকবে না? দাম বেশি কমে যাওয়াটা অবশ্য কাম্য নয়। এতে উৎপাদক আর বিক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কোনো কোনো ঈদের আগ দিয়ে মসলার অধিক আমদানিতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির খবর কিন্তু মিলেছিল। চোরাচালান বেশি হলেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তখন স্বভাবতই দামে পাল্লা দিতে পারেন না তারা। রমজানে এবার আদা, রসুনের দামও কমতির দিকে। চাহিদা কম বলে দেশি আদা, রসুনের দাম আমদানিকৃত পণ্যের চেয়ে অনেক কম।
এমন পরিস্থিতি কতদিন থাকে, সেটা অবশ্য দেখতে হবে। গ্রীষ্মে সবজির বাজার গরম হতে সময় লাগবে না। চালের বাজারে অস্থিরতায় চলমান বোরো মৌসুম ফসল করে তোলার দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। গরম বাড়তে থাকার সময়টায় বিদ্যুৎ ও সেচ পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে। রমজানে এবার লোডশেডিং অবশ্য কম। গ্যাস সরবরাহও সংকটজনক নয়। তবে ঈদের পর জ্বালানি পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা রয়েছে পুরোপুরি। এর প্রভাব উৎপাদন ও দামের ওপর থাকবে। সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে জ্বালানির দাম না বাড়ানোর ব্যাপারে। পণ্যবাজার ও অর্থনীতি ‘ম্যানেজ’ করে চলতে পারলে গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে যাওয়াটাও সহজ হবে।