‘মোর দ্যান মিটস দ্য আই: এসেস অন বাংলাদেশি পলিটিকস’ বইটির প্রকাশনা উৎসবে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিকস অ্যান্ড গভর্নমেন্ট বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন এমআইএসটির সহকারী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা।
Published : 25 Jul 2022, 09:27 PM
প্রথমে অভিনন্দন অধ্যাপক আলী রিয়াজকে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা সংকলনটিই প্রকাশের জন্য। বলে রাখি, আপনার লেখা ‘মোর দ্যান মিটস দ্য আই: এসেস অন বাংলাদেশি পলিটিক্স’ বইটি পড়ার ইচ্ছা রয়েছে। তবে এই লেখাটি মূলত আপনার ওই বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে বলা কথাবার্তা নিয়ে।
আমি দীর্ঘদিন কানাডা ছিলাম, তাই পশ্চিমা রাজনীতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার ছাত্রাবস্থায় বিএনপি–জামায়াত ক্ষমতায় ছিল। ক্যাম্পাসে তাদের রাজনীতি চোখে দেখার এবং পিঠে খাবার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাই এ দুইটি সংগঠনের নাড়ি-নক্ষত্র চেনা বলতে পারেন। তাই তাদের রাজনীতিতে কী কী মধু মিশে থাকে তা আমাদের জানা আছে। আপনার জীবনে আপনি হয়তো এই দুই দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, তাই খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই। যদি থাকতো তাহলে এই দুইদলের সঙ্গে জনগণকে রাস্তায় নামার কথা বলতে পারতেন না।
দেশে বিএনপি-জামায়াত, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সকল দলের সমর্থকরাই বসবাস করেন। বিএনপি-জামায়াতের সময় আমাদের দেশে যে জঙ্গি তাণ্ডব, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ‘অপারেশান ক্লিন হার্ট’- এর নামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার, হাওয়া ভবনের কীর্তিকলাপ, ‘দেশের তথ্য পাচার হওয়া’র অজুহাতেসাবমেরিন কেবল সংযোগ না নেওয়া, বিদ্যুতের নামে খাম্বা কেলেঙ্কারি, ইয়াজউদ্দিন মার্কা নির্বাচন, ভুয়া ভোটার তালিকা, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাসহ- যা হয়েছে তার খেসারত আমাদের আরও অনেকদিন দিতে হবে।
আপনি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন বলে অনেক কিছুই জানেন না, অথবা যা জানেন তার সবই পত্রিকা নির্ভর, মাঠের রাজনীতি আলাদা। বর্তমান বাংলাদেশে সরকারের যেসব প্রকল্প চলছে, তার তুলনায় ধরেন পদ্মা সেতু শুধু প্রচারের আলোয় আসা একটি মাত্র প্রকল্প।
আপনি আমাদের পারমাণবিক কেন্দ্রের কর্মযজ্ঞ দেখেছেন? সেখানে একটা পুরো শহর গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ সেখানে কাজ করছেন। কাজগুলো টেকনিক্যাল এবং নন-টেকনিক্যাল। এই কাজগুলো আমাদের দেশের টেকনিক্যাল মানুষদের জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ। একইভাবে কর্ণফুলি নদীর নিচ দিয়ে টানেল, রেল-সংযোগ সড়ক, রেলওয়ের লাইন বাড়ানো, যমুনা রেল সেতু, মেট্রো রেলসহ অনেক অবকাঠামোর কাছ চলছে, কোনও কোনওটি শেষের দিকে।
এসব প্রকল্প আমাদের টেকনিক্যাল জ্ঞান এবং প্রফেশনালিজম এর পরিধি বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেগাপ্রকল্প ছাড়াও ছোট ছোট কিছু কাজ হচ্ছে। সেগুলো চোখে না পড়লেও বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
যেমন, বাংলাদেশে এখন ইলেক্ট্রনিক্সের চিপ ডিজাইন হয়, অনেক ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি এখন নিজেরাই নিজেদের পণ্য তৈরি করে, যা একসময় চিন্তাও করা যেত না। আমাদের আইসিটি মন্ত্রী এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছেন, মাইক্রোচিপ তৈরি করার ব্যাপারে বাংলাদেশের সক্ষমতা তৈরি এবং এ সেক্টরে বাংলাদেশি দক্ষ কর্মী ও টেকনিশিয়ান তৈরির জন্য।
বাংলাদেশে এখন স্টার্টাপ ফান্ড দেওয়া হয় এবং তা পুরো বছর জুড়ে।
শুরুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন বলতো ডিজিটাল বাংলাদেশ, তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছে। তাচ্ছিল্য করেছে। দেখুন গত এক দশকে কতোটা পরিবর্তন হয়েছে যে, এখন আমাদের কেউ বিদ্যুত, গ্যাস বা কোনও ইউলিটি বিল যদি অনলাইনে দেওয়ার সুযোগ না পান, তাহলে বিরক্তি প্রকাশ করেন।
মোবাইলে টাকা পাঠানো, ডিজিটালি কর দেওয়ার সুবিধা, কৃষকের জন্য তথ্য বাতায়ন ইত্যাদি কত কত উদাহরণ টানবো?
আজকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যা পদক্ষেপ নিচ্ছে তা নন-টেকনিক্যাল মানুষদের পক্ষে তা বোঝা কঠিন।
আমাদের পেছনে তাকানো, যুদ্ধাপরাধী কোনও সংগঠনের লেজুড় ধরা, কিংবা গাড়িতে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে ফেলার রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ার সময় ও সুযোগ আছে?
যেসব ব্যক্তি ও সন্ত্রাসবাদী শক্তি একসাথে দেশের প্রায় সবজেলায় বোম ফাটিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল- তাদের পক্ষে আপনার কথার সুর যাওয়াটা কেমন হতভম্ব করে দেয়। কেন মানুষ তাদের পেছনে নামবে বলুন তো?
আপনি যে পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেন, সেই পত্রিকা গণজাগরণ মঞ্চকে নিয়ে কী লিখেছিল? বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘আমার দেশ’ বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার মানুষদের চিহ্নিত করে তাদের খুন করিয়েছে মৌলবাদীদের দিয়ে। সংবাদপত্র নামধারী এসব প্রপোগান্ডা মেশিন ও সাংবাদিক নামধারীদের জন্য অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে বিচার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হয়নি। আপনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সেদেশেও তো ফক্স নিউজের বিরুদ্ধে কট্টর ডানপন্থিদের পক্ষে ভোটিং মেশিন নিয়ে ‘প্রপাগান্ডা’ চালিয়ে বিদ্বেষ ছড়নোর জন্য বিলিয়ন ডলারের মামলা হয়েছে!
কিন্তু কেন এসব আপনাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আমাদের একটি প্রথম শ্রেণির ইংরেজি দৈনিক তো খবর যাচাই না করে পত্রিকার ছাপিয়েছিলেন, কোন বিচার হয়েছে এ জন্য? উনি কি লজ্জায় পদত্যাগ করেছেন? ‘পদ্মা সেতু হচ্ছে না’ বলে বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করেছিল। সেতু হওয়ার পরে কি তারা দু:খপ্রকাশ করেছে?
মাঝে মাঝে মনে হয়, এরা কি হতাশাবাদী মানুষ? নাকি আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর। এরা কি কখনো বড় ও ব্যাপক জনগোষ্ঠির পরিবর্তনের জন্য স্বপ্ন দেখেছেন? স্বপ্ন কী- এরা বোঝেন? ইতিবাচক পরিবর্তন কাকে বলে- তা কি এদের কাছে বোধগম্য?
স্বপ্ন হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রয়াত প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে ডেকে বলেন, ‘আপনারা দেশের ইঞ্জিনিয়ারেরা পদ্মাসেতু বানাতে পারবেন না?’ আর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার বলেন ‘পারবো’ এটাই স্বপ্ন।
বড় বড় প্রকল্পের কারণে আমাদের দেশে এখন অনেক পরার্মশক প্রতিষ্ঠান ও বড় শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখাটা আমাদের জরুরী।
বিএনপি-জামায়াত পদ্মা সেতু, বিদ্যুতসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে বক্তব্য দেয় তা এতোটাই বাস্তবতাবর্জিত যে এদের নিয়ে দেশের মানুষের স্বপ্ন দেখা কঠিন। তাই দেশের মানুষ এদের পেছনে নামবে না। আর নামবে যে কয়জন সে কয়জনের জন দেশের স্বপ্ন তুলে দেওয়া কঠিন। অন্তত আমরা তা হতে দিতে পারি না।
আমরা চাই, দেশের এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক, দেশে রপ্তানিতে এগিয়ে যাক আরও অনেক দূর। শুধু এটুকু বলতে চাই, বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতি বিক্রি করে খাওয়া লোকেদের জন্য কঠিন দিন আসছে। কেননা, উন্নয়ন কথা বলে। গণিত ও পরিসংখ্যান শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের ভিত্তি। সে জায়গা থেকে আপনারা যা বলছেন, দেশের জনগণ হিসাবে সে ব্যাপারে মোটেই আগ্রহ নেই।
বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যারা সরকারবিরোধী তারা নিজেরা বিশ্বাস করে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমান এবং জামায়াত ও মৌলবাদীরা ক্ষমতায় আসলে দেশ চালাতে পারবে?
তাই বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষে সফট ও কৌশলী প্রচারণা না চালিয়ে বরং উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের বিষফোঁড়া মৌলবাদকে কিভাবে কমানো যায়, মানুষ যেন তার বিশ্বাসকে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে রাখে এবং এই ব্যাক্তিগত বিশ্বাস যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়, এইসব নিয়ে কথা হোক। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে যেনো সকল ধর্মের মানুষ নিজের দেশ মনে করতে পারে নিসঙ্কোচে।
রাষ্ট্র এবং ধর্ম এখনো যে জায়গাগুলোতে জড়িয়ে আছে সেগুলোর মাঝে দাগ দিয়ে কিভাবে সুন্দরভাবে আলাদা করা যায়- সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন।
আমাদের বুঝতে হবে, পৃথিবী খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের সেই উন্নয়নের ট্রেন মিস করা যাবে না। সব দেশে একই প্রসেস ফলো করতে হবে এমন কোন কথা নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি তাই আপনার বইয়ের নামের মতো ‘বাংলাদেশি পলিটিক্স’ হোক, বিদেশি মন্ত্রণাদাতাদের প্রেসক্রিপশনের সংকলন না হোক।