Published : 18 Sep 2016, 10:33 AM
আকতার জাহান উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, তাঁর একটি পেশা ছিল যেখানে তিনি সাফল্য পেয়েছিলেন। অথচ তিনি নিজের এই কৃতিত্ব নিজের বলে তৃপ্তিবোধ নিয়ে জীবন কাটাতে পারলেন না। বিয়ে করেছিলেন, প্রেমও ছিল সেই বিয়ের মূলে। স্ত্রী হয়েছিলেন তিনি, হয়েছিলেন একটি বাড়ির পুত্রবধূ, সন্তানের মা-ও হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষিত, সফল পেশার অধিকারী, সংসারী আকতার জাহান কোনোটাতেই সাফল্যের স্বাদ পাননি। আর তাই তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
স্ত্রী হিসেবে আকতার জাহান সাফল্য পাননি। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি। স্বামীর মন পেতে তিনি নিজের হাতে সংসারের সব কাজ করতেন। অফিসিয়াল মিটিংয়ে যাবেন কি যাবেন না, তা স্বামীদেবতা ঠিক করে দিতেন আর তিনি যেতেন। পানি ফুটিয়ে স্বামীকে জীবাণুমুক্ত থাকতে সাহায্য করতেন আর এ জন্য নিজের পিঠে ব্যথার জন্মও দিয়ে ফেলেছিলেন। এরপরও তিনি প্রেমিক স্বামীর মন পাননি, সংসার টেকাতে পারেননি।
পুত্রবধূ হিসেবে তিনি সাফল্য পাননি। শ্বাশুড়ি মা কালো গায়ের রঙের পুত্রবধূকে ভালোবাসতে পারেননি। গায়ের রঙ বদলানো এই জীবনে আর হল না, তাই শাশুড়ি মায়ের মন পাওয়া হল না।
সন্তানের মা হিসেবে আর সব মায়ের মতো আকতার জাহান সন্তানকে কাছে চেয়েছেন, পাননি। স্বামী আবার যখন বিয়ে করেছেন, স্বামী যখন সন্তানকে 'কাবাবের হাড্ডি' মনে করেছেন, তখন তিনি সন্তানকে ফেরত পেয়েছেন। শিশুরা নাকি মায়ের কোলেই শোভন– এই সামাজিক বাক্য তাঁর আর তাঁর সন্তানের বেলায় খাটেনি। বেঁচে থাকলে হয়তো মা হিসেবে সফল কি না দেখতে পেতেন। হয়তো না-ও দেখতে পেতেন। হয়তো সন্তানের কাছেও অসফল মায়ের তকমা জুটে যেত!
আকতার জাহান যদি বিয়ে না করে কেবল উচ্চশিক্ষা আর পেশার সাফল্য নিয়ে দিন কাটাতেন, তাহলে কি আত্মহত্যা না করে বেঁচে থাকতেন? সমাজ নামক মানুষের তৈরি 'আজব প্রতিষ্ঠান' তাঁকে বাঁচতে দিত কি না, দিলে কীভাবে দিত, সে প্রশ্নের জবাব একরাশ দীর্ঘশ্বাস হয়েই থাক! কেননা, উত্তরটা আমাদের সবারই জানা। আকতার জাহান বিয়ের পর যখন টের পেলেন স্বামীটি 'প্রভুদেবা', তখন যদি বড় হাড়িতে পানি না ফোটানোর সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েই স্বাধীন হতেন, তবে কি বাঁচতে পারতেন? তাঁর দিকে বাঁকা চোখে পুরুষ তাকাত, নারীও কি তাকাত না? এই তাকাতাকিতে মরে যাওয়ার স্বাদ কি জাগত না? সেই মৃত্যু কি তাঁকে সবার সহানুভূতি পেতে সাহায্য করত?
আকতার জাহান আবার যদি বিয়ে করতেন, তবে আলোচনাটা আরও জমত সন্দেহ নেই। তিনি আরেক বার বিয়ে করেননি, আরেক বার পানি ফোটানোর রিস্ক নেননি, তার পরও সাবেক স্বামী মরে বেঁচে যাওয়া আকতার জাহানের চরিত্র নিয়ে বাণী দিতে পারছেন আর সামাজিক মানুষ তা গিলছেন।
মেয়ে মানুষের বড় ঝামেলা এই 'চরিত্র' নিয়ে! উচ্চশিক্ষিত, সফল পেশার নারীদের ক্ষেত্রে চরিত্র নিয়ে ভাবনা একটু বেশি। ঘরের বাইরে যাওয়ার গোপন অপরাধবোধ চরিত্রকে 'সাবান' দিয়ে নিয়মিত সাফসুতরো করতে সচেতন রাখে। কেননা, পান থেকে চুন খসলেই চরিত্রে টান পড়ে যাবে। তখন না মরলেই বরং শুনতে হবে, বেহায়া বেটি মরেও না!
না হয় আকতার জাহান নিজেই মরেছেন, তা-ই বলে যে তাঁকে মরতে বাধ্য করল, তার গলায় গামছা দিয়ে টেনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না? তাহলে তো বেশ মজা, চাপতে চাপতে ঝামেলাকে মরার মুখে ঠেলে দিয়ে নিজের আরাম নিশ্চিত করা কোনো ব্যাপার না। তাহলে তো দিব্যি চালিয়ে যাওয়া যায় মেরে ফেলার খেলা! দিব্যি তা চলছেও!
আমার এক সহকর্মী কিছুদিন আগে লাশ হয়ে ফিরেছেন বিদেশ থেকে। কীভাবে কেন মরে গেল, কেউ জানে না। তবে সবাই জানে, প্রেম করে বিয়ে করার পর স্বামীপ্রবরের বদমেজাজের ঝাল সহ্য করতে হত। অফিস এসেও স্বামী নাকি ঝাল ঝাড়তেন। গায়ে হাত দিতেন। স্বামীর পরিবারও যোগ দিয়েছিল এই আয়োজনে। মেয়েটি সন্তানের মুখ চেয়ে টেনে গেছেন সংসার। কাউকে মুখ ফুটে বলেননি কিছু, তাতে নাকি ঘরের কথা পরে জেনে যায় আর তাতে নাকি সম্মান ক্ষুণ্ন হয়।
ডিভোর্স দিতে পারেননি বাপ-ভাইয়ের মুখ রাখতে। না, তিনি আত্মহত্যা করেননি। উচ্চশিক্ষিত, সফল পেশার অধিকারী আমার সেই সহকর্মী হঠাৎ মারা গেছেন। শুনছি ব্রেইন হেমারেজ অথবা লিউকেমিয়া অথবা নিউমোনিয়া ওকে মেরে ফেলেছে। সমাজের কোথাও টুঁ শব্দটি পর্যন্ত হল না। হলেই বা কী হত, এই শতাব্দীতে টুঁ শব্দের আয়ু কতটুকু?
এক বড় আপার কথা বলি। আকতার জাহানের মতো তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, স্বামী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। দরজা খুলতে সামান্য দেরি হলে তাঁর গালে কষে চড় বসাতেন স্বামী। স্ত্রীকে প্রহার করা যাবে না– এমন আইন কোথায় আছে? রাস্তায় বেরুলে রিকশাওয়ালা কেন তাকাল, তা নিয়ে বিশেষ আলোচনা-প্রহারোলচনা চলত। আকতার জাহানের মতো তাঁর গায়ের রঙ কালো ছিল না। দুধে-আলতা গায়ের রঙ নিয়েও তিনি সফল হতে পারেননি।
বাপ-ভাইয়ের মান রক্ষার্থে সংসার ছাড়তে পারেননি, তবে আত্মাভিমানে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। এক যুগ বাকশূন্য, বোধশূন্য হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। হাসপাতালে যখন তাঁর শেষ সময় কাটছিল, তখন তাঁকে দেখে সত্যিই মনে হয়েছিল, একটা জীবনের এই যে অপচয়, তাতে আসলেই কী এসে যায় কারো! আর যিনি বা যারা এর জন্য দায়ী, তাদের কি কিছু হয়? হয় না। তবে এরপরও আসে আর যায় দুঃখরা!
আমার এক আত্মীয়াকে দেখছি প্রায়ই আমাদের বাসায় এসে স্বামীর সম্বন্ধে নানা অভিযোগ করছেন আর আমরা কেবলই যুক্তি খুঁজছি কীভাবে সে সমাধানে আসবে। কেউ সংসার ভেঙে দিতে বলি না, কেউ বলি না যেভাবে বাঁচতে চাও বাঁচ। মেয়েটার স্বামীকে পরোক্ষভাবে মেয়েটার খেদের কথা জানাতে গেলে জ্ঞানপ্রাপ্তি ঘটেছে যে মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে! স্বামী প্রতিবেশিনীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে স্বামী জ্ঞান ঝেড়েছে, প্রতিবেশিনী আসে কেন?
পাশাপাশি গলিতে থাকি আমরা। প্রায়ই দেখি আত্মীয়া মেয়েটি রাস্তায় হাঁটছে। মুখে প্রাণের কোনো ছাপ নেই। কেন হাঁটছে– জানে না। কোথাও গন্তব্য নেই, তবু হাঁটে। পা টেনে টেনে চলে যেন জীবন নামক বোঝাটাকেই টেনে নিয়ে চলছে। এভাবে টানতে টানতে ক্লান্তি আসে যদি, তাহলে মশারির ভেতর চুপচাপ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে হতে পারে, মনে হতে পারে সন্তানকে নিয়ে রেললাইনে ঝাঁপ দেওয়াই ভালো, মনে হতে পারে আরও অনেক কিছু, যার দায়ভার কেউ নেয় না; সমাজ তো নেয়ই না। কেননা, এই জ্বলন একলা নারীর, এই জ্বলনে আর কিছুই জ্বলে না; আগুন তো নয়ই।
আর হ্যাঁ, ঠাণ্ডা শরীরকে এই যে আমরা নানান উপদেশ দিচ্ছি, মরে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়, তারাও জানি, এসব উপদেশও অকাজের। মৃতকে বেঁচে থাকার উপায় শিখিয়ে কী লাভ? বেঁচে থাকতে মানুষ হয়ে বাঁচার উপায় শেখাতে পারলে কাজে দিত, তাই না?