Published : 28 Jun 2016, 12:58 PM
১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবরের সকাল। স্থান মিশরের রাজধানী কায়রো। প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত বার্ষিক ভিক্টোরি প্যারেড পরিদর্শন করছিলেন। ১৯৭৩ সালে সংঘটিত বদর যুদ্ধে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে মিশরীয় বাহিনী ইসরাইল-অধিকৃত সিনাই উপত্যকার কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল। সে উপলক্ষে প্রতি বছর এ ভিক্টোরি প্যারেডের আয়োজন হত। আকাশে বিমান বাহিনীর অনেকগুলো মিরেজ জেট উড়ছে। আনোয়ার সাদত ও মঞ্চে উপস্থিত দেশি-বিদেশি অতিথিরা তখন উপভোগ করছিলেন জেটগুলির নান্দনিক ওড়াওড়ি।
ওদিকে মঞ্চের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে সৈন্যবাহী ট্রাকগুলি, প্রেসিডেন্টকে অভিবাদন জানিয়ে। হঠাৎ থেমে গেল একটি ট্রাক। ট্রাকটির নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট খালিদ ইস্তাম্বুলি। আসলে ওই ট্রাকের আরোহী সেনারা ট্রাকচালকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে ট্রাক থামাতে বাধ্য করেন। তারপর মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান ইস্তাম্বুলি। প্রেসিডেন্ট সাদত ভেবেছিলেন, সেনারা তাঁকে স্যালুট দিতে আসছে, এটিও বুঝি প্যারেডের অংশ। তাই স্যালুট নিতে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন তিনি।
ঠিক সে সময় মাথার হেলমেটে লুকিয়ে রাখা তিনটি গ্রেনেড সাদতের দিকে নিক্ষেপ করলেন ইস্তাম্বুলি। সর্বশেষ গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হল।
ওদিকে, গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার পরপরই ট্রাকে থাকা ডেথ স্কোয়াডের চার সদস্য নেমে আসেন। এই চার জনের মধ্যে তিন জনই প্যারেড কর্মসূচিতে তালিকাভুক্ত ছিলেন না। তাদের বদলে যারা মূলত তালিকাভুক্ত ছিলেন তারা অসুস্থ বলে এদের যুক্ত করেন ইস্তাম্বুলি। বাকি একজন আবার জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য।
পরিকল্পনামতো সবই হল। ডেথ স্কোয়াডের সদস্যরা একে ৪৭ রাইফেল দিয়ে ভাণ্ডার ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদতের দিকে গোলাগুলি চালিয়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট ততক্ষণে মঞ্চে লুটিয়ে পড়েছেন। তখনই হেলিকপ্টারে তাঁকে মিলিটারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এগার জন ডাক্তার তাঁর অপারেশন করেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ঘণ্টা দুয়েক পর মারা যান তিনি।
সেদিন কিন্তু সাদত যে মঞ্চে বসেছিলেন তার চারদিকে তাঁর জন্য চার স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। আটজন বডিগার্ড ছিল একদম পাশেই। তাঁর নিজস্ব নিরাপত্তা ছাড়াও শত শত কর্মী সেদিন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। প্যারেডে তালিকাভুক্ত কোনো সদস্যের গোলাবারুদ বহনও ছিল নিষিদ্ধ।
এতসব নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে সফল ইস্তাম্বুলিরা সেদিন বাধাহীনভাবে প্রায় দু মিনিট গুলি চালাতে সমর্থ হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তাকর্মীরা হন্তারকদের দিকে গুলি চালালে ডেথ স্কোয়াডের এক সদস্য নিহত ও তিন জন আহত হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করে যে, ইস্তাবুলিসহ তিন হন্তারক 'মিশরীয় ইসলামিক জিহাদ' নামের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আনোয়ার সাদত তাঁর শাসন ক্ষমতার প্রথমদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার একটি ছিল, আবদেল নাসের হুসাইনের সময় গ্রেফতারকৃত ধর্মীয় উগ্রবাদীদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া। এতে তাঁর সঙ্গে দেশটির ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সম্পর্ক প্রথমে ভালো হলেও এর স্থায়িত্ব বেশি হয়নি।
১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইসরাইলের সঙ্গে 'ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ড' নামে ইতিহাসখ্যাত একটি চুক্তি সাক্ষর করে মিশর। মূলত তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মার্কিন প্রেসিডেন্টদের গ্রামীণ নিবাস ক্যাম্প ডেভিডে বার দিনের গোপন আলোচনা চলে ইসরাইলের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের সঙ্গে মিশরীয় প্রেসিডেন্টের। এরপর হোয়াইট হাউসে মিশর-ইসরাইলের মধ্যে দুটি ফ্রেমওয়ার্কের এই এগ্রিমেন্টের প্রথমটি স্বাক্ষরিত হয়। পরেরটি হয় বছর খানেক পর, ১৯৭৯ সালে, যেটি 'মিশর-ইসরাইল শান্তি চুক্তি' নামে পরিচিত।
ইসরাইলের সঙ্গে সমঝোতায় আসার জন্য সাদত ১৯৭৮ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেগিনের সঙ্গে যৌথভাবে। কিন্তু এ ঘটনার পর আরব বিশ্বের বহু দেশ সাদতের বিপক্ষে চলে যায়। মিশরের ওআইসি সদস্যপদ বাতিল করা হয়।
একই সময়ে দেশের ভিতরে কিছু রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীও নেন সাদত। এসব কিছুই উগ্র গোষ্ঠীগুলোকে খেপিয়ে তুলে। তারা সরকারের একটি অংশের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেদের লোকদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ব্যবস্থা করে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, আনোয়ার সাদতসহ সরকারের উপরের স্তরের সকল নেতাকে হত্যা করা।
আনোয়ার সাদতের কাছে বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট এমনই ছিল যে, তাঁকে হত্যার চক্রান্ত চলছে। তিনি সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের ভিতরের ও বাইরের চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্য বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেন। তবে ইস্তাবুলিরা এক অজ্ঞাত কারণে সে অভিযান-জালের বাইরে থেকে যায়।
মূলত আনোয়ার সাদতদের মতো ব্যক্তির নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশাসন দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যদি সামাজিক স্তরে নিরাপত্তা-ঝুঁকি বিনির্মাণ-বান্ধব উপাদান থাকে, তাহলে কেবল প্রশাসন দিয়ে মোকাবেলা অসম্ভব। পশ্চিমা বহু দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য তেমন প্রশাসনিক নিরাপত্তার আয়োজন থাকে না। সামাজিক ব্যবস্থাই তাদের নিরাপত্তার প্রধান হাতিয়ার।
সামাজিক স্থিতিশীলতা নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের জীবনের ঝুঁকি সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণে বেড়ে যায়। এমন নির্মম বাস্তবতার প্রমাণ বাঙালির ইতিহাসেই আছে। নির্মোহ সত্য এই যে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সুবিধাবাদিতার বহুমাত্রিক সাক্ষ্য রয়েছে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। এক দল বিপথগামী সেনা ১৫ আগস্টের জন্য দায়ী, সেটি একমাত্র বিষয় নয়। এ সেনা সদস্যদেরকে হন্তারক হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল সেই সময়ের সরকারবিরোধী দলগুলির রাজনৈতিক উগ্রবাদিতা ও আদর্শিক আপোষকামিতা। হন্তারকের জন্য বড় বোনাস ছিল আওয়ামী লীগের ভিতরকার একটি ক্ষুদ্র অংশের বিশ্বাসঘাতকতা। পাকিস্তানপন্থী আদর্শটি সমাজের নানান অনুষঙ্গ থেকে বহুমাত্রিকভাবে উজ্জীবিত হয়ে এই কালো ইতিহাস রচনা করে।
জাসদের বেপরোয়া রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিপথগামী সেনাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সমান্তরালে অবস্থান করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্মাণে তাদের একক দায় অনেক। এটি অবশ্যই একাডেমিক গবেষণার বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জাসদের ভূমিকা অন্যান্যদের ভূমিকার উপর কতটুকু প্রতিক্রিয়াশীল ছিল বা তার প্রভাবের আকৃতি কতটুকু।
বিদেশি চক্রান্তকারীদের উস্কানি ও সমর্থনদানের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ভিতরে মুশতাকরা ছিল খুনিদের অনুপ্রেরণার আরেকটি উৎস। এদের সমর্থন ছাড়া ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হত না। সে সময়ে দলটিতে ঐক্যের অভাব ছিল। তাজউদ্দীন আহমেদের মতো মৌলিক ধারার প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের জায়গায় মুশতাকদের উপস্থিতি ও প্রাধান্য খুনিদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, সময়ের পরিক্রমায় আওয়ামী লীগে আবারও ছদ্মবেশী ক্যামেলিয়নদের সংখ্যা বহুগুণে বেড়েছে। এদের ফিল্টার করে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়তো দুরুহ। তবে এদের উপস্থিতির প্রতিফলন আজকাল সহজেই আঁচ করা যাচ্ছে। সংশয় হয়, পটভূমি পরিবর্তনের জন্য এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নব্য মুশতাক হিসেবে আবির্ভূত হন কি না!
সেই সময়ের সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনকে পাকিস্তানপন্থী ভাবধারার প্রভাব থেকে মুক্ত করা যায়নি। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের একটি কৌশলী সমর্থনও ছিল। সেটি নিশ্চিতভাবেই হন্তারকদের অনুপ্রাণিত করেছে। প্রশাসনের আচরণ ও ভূমিকার প্রভাবটি ছিল বহুমাত্রিক। এটি জাসদের বেপরোয়া ভাব বাড়িয়ে তুলেছিল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকেও দ্বিধাগ্রস্ত করে রাখে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরবে একটি সফল সফর শেষে দেশে ফেরার সময় তাঁকে বহনকারী বিমানটিকে প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট আকাশে অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিমানবন্দরের রানওয়েতে পাওয়া গেছে ধাতব পদার্থ। দায়িত্বে অবহেলার জন্য সরকার কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারকে অস্থায়ীভাবে বরখাস্ত করেছে। কিন্তু কতজনকে বরখাস্ত করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে? প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধে ছদ্মবেশীরা ক্ষিপ্র বাঘের মতো ওঁত পেতে আছে। যে বিমানবন্দরে একাত্তরের ঘাতকদের বাতিঘর গোলাম আজমের মতো পাকিস্তানি এজেন্টকে ভিআইপির মর্যাদা দেওয়া হয়, সেখানে বঙ্গবন্ধু-তনয়াকে বহনকারী বিমান বিলম্বে অবতরণ ও রানওয়েতে ধাতব পদার্থের উপস্থিতি ভালো ইঙ্গিত দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি বড় বড় খেলোয়াড়দের জন্য শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। দেশের বেশ কটি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের বড় একটি অংশ ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁর এই সাফল্য বিনাশ করতে উঠেপড়ে লাগবে না, এমনটি ভাবার কারণ নেই।
বহু চেষ্টা করেও অপুষ্টিতে আক্রান্ত বিএনপি রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার রাজনীতি মোকাবেলা করতে পারছে না। দেশের সাধারণ জনগণের দ্বারা চক্রান্ত-নির্ভর বিএনপিকে আস্থায় নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। ফলে আওয়ামী লীগ প্রধানকে যদি কোনো গোষ্ঠী সরিয়ে দেয়, একক বড় দল হিসেবে বিএনপির মতো খুশি আর কোনো দল হবে না। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী নিজেও লন্ডন-কেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করেছেন।
বিএনপির জুনিয়র পার্টনার ও দেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর একমাত্র উৎপত্তিস্থল জামায়াতে ইসলামী ২০০১ সালের পর থেকেই শেখ হাসিনাকে টপ টার্গেট করেছে। ২০১০ সালের পর থেকে তারা বেশ কয়েকটি নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী কৌশল নিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তাঁর অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে এবং প্রশাসনের নানা অঙ্গে নিজেদের লোকদের জায়গা করে দিচ্ছে তারা। এদের মধ্য থেকে কেউ যে ইস্তাবুলি হয়ে উঠতে চাইবেন না তার নিশ্চয়তা কী!
আওয়ামী লীগের ভিতরে থাকা লোভী অংশটিকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে কাজটি করছে তারা। ফলে, এক সময়ের ইসলামিক ছাত্র শিবিরের নেতা পুলিশ প্রশাসনে নিয়োগ পায়। নিয়োগের আগে দাড়ি কেটে নিজের ফেবু প্রোফাইলে বঙ্গবন্ধুর ছবি সাঁটিয়ে একাত্তরের চেতনার শ্লোগান দিত। যে ছেলেকে শুনেছি শেখ হাসিনাবিহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার কথা ফেরি করত, সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
শেখ হাসিনাকে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে অক্টোপাসের মতো চারদিক থেকে জড়িয়ে ধরার সকল চেষ্টাই করা হচ্ছে। বরাবরই আওয়ামী লীগ দেশি-বিদেশি সে সব চক্রান্ত বেশ সফলতার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করেছে।
তবে এবারের প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন। আওয়ামী লীগের ভিতরের আদর্শহীন জীবাণুগুলি নিজের অর্থনৈতিক ও স্থানীয় রাজনৈতিক স্বার্থে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে একটি সামাজিক অস্থিতিশীল প্রেক্ষাপট নির্মাণে ভূমিকা রাখছে।
দলটির ভিতরে লোভী-লীগ নামক একটি নতুন সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে। এই শ্রেণিভুক্ত আওয়ামী লীগাররা নিজেদের স্বার্থের জন্য জাতপাত বিচার করছে না। এরা অর্থের জন্য পাগল হয়ে গেছে। এরা শেখ হাসিনার সম্ভাব্য হন্তারক ও তাঁর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত এমন মানুষদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে আগ্রহী নয়। একটি উদাহরণ দিই।
দেশের একজন কথিত আওয়ামীপন্থী প্রযুক্তিবিদ প্রযুক্তি খাতের একটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচনী প্যানেলে এমন একজন নারী ব্যবসায়ীকে নিলেন, যিনি কি না ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কট্টর বিরোধী ছিলেন। নিজের ফেবু ওয়ালে নির্বাচনের বিরোধিতা করে অনেক পোস্ট করেছেন। উক্ত সংগঠনের অনেক সদস্য এই নারী ব্যবসায়ীকে আওয়ামী লীগ-বিদ্বেষী হিসেবেই চিনেন। অথচ সেই নারী এখন আওয়ামী লীগের প্যানেলে যুক্ত হয়ে জাতির পিতার আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন!
এখানে আরেকটি হাইপোথিসিস দিতে চাই। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ডাকাতি করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পটভূমির পরিবর্তনে সেই টাকার অংশ শেখ হাসিনাকে উৎখাত প্রকল্পে ব্যবহার হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মনে রাখতে হবে যে, জঙ্গিবাদের অর্থ যেমন কালো টাকা, ঠিক তেমনি ব্যাংক ডাকাতির টাকাও কালো টাকা।
আওয়ামী লীগের আরেকটি নতুন সমস্যা হল 'জিকা ভাইরাস' ওলামা লীগ। আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছি, লীগের ভিতরের একটি অংশের সঙ্গে সংগঠনটির যোগাযোগ রয়েছে। ইসলামের প্রতি আওয়ামী লীগ উন্নাসিক সেই বার্তা যেন বিরোধী দলগুলি প্রান্তিক পর্যায়ে দিতে না পারে সে জন্যেই ওলামা লীগের সাম্প্রদায়িক দাবির লহর।
এটি বেশ ভয়ংকর একটি খেলা। ওলামা লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ নেই এমন দাবি দলের উচ্চ পর্যায় থেকে দুয়েকবার করা হলেও ওলামা লীগ যে সকল সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলছে, তা আওয়ামী লীগের ব্যানারেই খেলছে।
সাপের ধর্মই ফণা তোলা। আজ যে ওলামা লীগ খেলাধুলা বন্ধের দাবি জানাছে, কাল কিংবা পরশু তারা নারী-নেতৃত্ব হারাম সেই দাবি তুলবে না, সেটির নিশ্চয়তা নেই। ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হল, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যেমন বিএনপিতে পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন, ওলামা লীগের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের ভিতরে জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীর নীরব প্রতিনিধি।
দেশের সুশীল সমাজের বড় একটি অংশ শেখ হাসিনার ঘোর বিরোধী। বিশেষ করে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের আজন্ম শত্রু। এদের মধ্যে আবার ভারতবিরোধী রাজনৈতিক রেটরিক ব্যবহারের একটি নতুন প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এটি সম্ভবত ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্কের কারণে। বিশেষ করে, মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত আওয়ামী লীগের সঙ্গে মনমোহন প্রশাসনের মতো সম্পর্ক বজায় রাখবে না বলেই সুশীল সমাজের এই অংশ আশা করেছিল।
দেশের ভিতর ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নিয়েও এদের অবস্থান স্পষ্ট নয়। তারা একটি ধোঁয়াশা পরিবেশের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন। প্রসঙ্গত, হিলারি ক্লিনটন হোয়াইট হাউজে গেলে আওয়ামী লীগকে হোয়াইটওয়াশ করা হবে, তারা আপাতত এমন স্বপ্নে বিভোর।
উপরে উল্লিখিত দেশি ফ্যাক্টরগুলির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে দেশের বাইরের নানা অপশক্তির। তুরস্ক ও পাকিস্তানের মতো দেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার পর ওই দেশগুলি থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাই, তা কি আওয়ামী লীগের প্রতি দেশগুলির ক্ষোভ বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়? দেশগুলির অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই অপশক্তিগুলির সঙ্গে দেশের হাসিনাবিরোধী খেলোয়াড়দের গোপনে জার্সি বদল ঠিকই হয়। এ ক্ষেত্রে বাড়ির পাশে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিও হালকা করে দেখার কিছু নেই। আওয়ামী লীগ সরকার যদি দেশের ভিতর শক্ত হাতে জামায়াত দমন করে, তবে অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গই হবে বাংলাদেশের জামায়াতের হেডকোয়ার্টার।
সরকারের পক্ষের ও প্রতিটি শুভাকাঙ্ক্ষীর সাবধানতার তাই বোধহয় বিকল্প নেই।