Published : 10 Dec 2011, 05:47 PM
প্রেসক্রিপশন বেশ সহজপ্রাপ্য হয়ে পড়েছে। যেখানেই যান না কেন কোন না কোন বিষয়ে প্রেসক্রিপশন পাবেনই। খররের কাগজ, টিভি, বক্তৃতায়, বিল বোর্ডে নানা রকমের প্রেসক্রিপশন। দোকানে কাপড় কিনতে গেলে এক নম্বর খাঁটি জাপানি সুতা দিয়ে তৈরি বলে ক্রয়ের জন্য প্রেসক্রিপশন দিয়ে দেবে। ধাঁধায় পড়ে যেতে হবে। ভালো করে পরীক্ষা করলে পছন্দ হবে না। সন্দেহ হবে, কোন ধরণের সুতো দিয়ে তৈরি। কী করে জাপান থেকে সুতি কাপড় এনে এই দামে বিক্রি করছে? প্রতিবাদ করলে প্রেসক্রিপশন দিয়ে দেবে, "আপনি কাপড় চেনেন না।" এইভাবে ঘড়ি, চশমা, কাগজ, কলম, পেন্সিল, কসমেটিকস্, রেডিও, টেলিভিশন, গাড়ীর যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কিনতে গেলে জাপানি, কোরিয়ান, তাইওয়ানি অথবা দেশে তৈরি এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বলে কেনার প্রেসক্রিপশন দেবে। আসলে এগুলোর বেশীরভাগই নিম্নমানের। ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
মাছ, সব্জি, গোস্ত, চালের দোকানে যান সবাই আপনাকে এক নম্বর খাঁটি বলে তাদের নিজ নিজ সামগ্রী কিনতে প্রেসক্রিপশন দেবে। অথচ এরা নকল বা ভেজাল জিনিষ বেশি দামে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা করে যাচ্ছে। এদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। পৃথিবীতে অন্য কোন দেশে এত ধোঁকাবাজি আছে কি না জানি না। এদের দমনের কোন উদ্যোগ বা ব্যবস্থা নেই। সরকারী অফিসে কোন প্রয়োজনে গেলে অনেক ঘোরাঘুরির পর কাজটা খুব জটিল, বর্তমানে সরকারী বিধিনিষেধ আছে, বিশেষ ব্যবস্থায় করা যেতে পারে ইত্যাদি শোনার পর আপনার পরবর্তী দায়িত্ব সম্পর্কে একটা প্রেসক্রিপশন পেয়ে যাবেন। ডাক্তারের কাছে গেলে শুরুতে জটিল ও পুরানো রোগ বলে প্রথমে মৌখিক প্রেসক্রিপশন পাবেন। তারপরে অনেকগুলো পরীক্ষার জন্য প্রেসক্রিপশন দিবে। আসল প্রেসক্রিপশন পাওয়া যাবে আরও পরে। সেটাও আবার ভুল হতে পারে। সর্দি লেগেছে? বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী, সহযোগী সবাই প্রেসক্রিপশন দিতে থাকবে। হরেক মতের এত প্রেসক্রিপশন পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।
সব দেখে মনে হবে আপনি প্রেসক্রিপশন সভ্যতায় আছেন। দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আমরা অন্য দেশের শরণাপন্ন হচ্ছি প্রেসক্রিপশন পেতে। রাষ্ট্রদূতের বাড়ীতে পর্যন্ত অনাগোনা করছি। দেশীবিদেশী টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রপত্রিকায় অবিরত প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছে দেশ কীভাবে চলবে। রাজনৈতিক নেতারা নিত্যনতুন প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। এক এক সরকার আসছে আর নতুন নতুন মন্ত্রীরা নানা বিষয়ে প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছেন। এক সময় প্রেসক্রিপশন দেয়া হলো বেশি করে গমের আটা খেতে। আটার দাম কম, বেশি খেলে চালের চাহিদা কমে যাবে ও দাম স্থীতিশীল থাকবে। সরকারী টিভিতে নানা রকম প্রচার শুরু হলো এ ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে। মনে আছে এ প্রসঙ্গে বিটিভিতে এক নাটিকা প্রচার করা হতো। সবশেষ দৃশ্যটা ছিল এরকম যে বান্ধবী দুপুরে রমনা পার্কে হাজির হয়ে প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করছে। সময়মত হাজির না হওয়ায় বান্ধবী রেগে অগ্নিশর্মা। যাহোক প্রিয়জন দেরিতে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয়ে মাফ চেয়ে বলল, "ক্লাস শেষ করে দুপুরে হলে ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।" "ভাত না খেয়ে রুটি খেতে পারো না," বান্ধবী প্রেসক্রিপশন দিল। দেশে যখন গমের আটার দাম চালের দামের থেকে বেড়ে গেল তখন জনগণ কী করবে সে ব্যাপারে অবশ্য কোন প্রেসক্রিপশন পাওয়া গেল না। গেল আর্মীটেকার (আর্মী ও কেয়াটেকার সংক্ষিপ্ত করে) বা সামরিধায়ক (সামরিক ও তত্বাবধায়ক সংক্ষিপ্ত করে) সরকারের সক্রিয় নায়ক জেনারেল মঈন সবাইকে বেশি করে আলু খাওয়ার প্রেসক্রিপশন দিলেন। তিনি বোধহয় জানতেন না যে গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স বা সূচক অধিক হওয়ায় বেশ আলু খাওয়া ভালো নয়, বরং অস্বাস্থ্যকর। দেহ স্থূল হয়ে যায়।
নেতাদের কোন বিষয়ে প্রেসক্রিপশন দেয়ার আগে ফলাফল কী হবে সে ব্যাপারে পর্যালোচনা করা উচিত। নিজের ধারণার উপর ভিত্তি করে কিছু করা, বলা বা পদক্ষেপ নেয়া মনে হয় উচিত নয়। বিশেষ করে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা রেখে এবং তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে কাজ করা ভালো। নিজস্ব ধারণার উপর চিন্তাভাবনা কোন কোন সময়ে হাস্যরসে পরিণত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে অনেক আগে প্রতিবেশী এক দেশের বিদ্যুৎ ও সেচ মন্ত্রীকে নিয়ে কৌতুক করে এশীয় উইক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গল্প মনে পড়ে গেল। মন্ত্রীজি হাইড্রোইলেক্ট্রিক কেন্দ্র পরিদর্শনে এসেছেন। প্রধান প্রকৌশলী তাকে সবকিছূ দেখাতে শুরু করলেন। "এই যে এগুলো হল টারবাইন," বললেন প্রধান প্রকৌশলী । "এই টারবাইনগুলো পানি থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি নিষ্কর্ষণ করে। এরপরে এই পানি বিভিন্ন নালা দিয়ে জমিতে সরবরাহ করে ফসলে সেচ দেয়া হয়"। প্রধান প্রকৌশলীর বর্ণনা শুনে মন্ত্রী আশঙ্কিত হয়ে পড়লেন। "এখন বুঝতে পারলাম আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন এত কম কেন। পানি থেকে যদি সমস্ত শক্তি তুলেই নেয়া হয়, তাহলে কীভাবে ভালো ফসল আশা করবেন"।
উন্নত দেশগুলোতে নেতা, সংসদসদস্য, মন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের থেকে মতামত নেন। অনেকে অর্থনৈতিক, পররাষ্ট্র, রাজনীতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাক্তিগতভাবে পরামর্শক নিয়োগ করেন। শুধুমাত্র নিজ ধারণার উপর অভিমতে অন্যরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। কিছুদিন আগে সরকারের এক মন্ত্রীর প্রেসক্রিপশন দেখে বেশ মজার মনে হল। ভেজাল খাবার থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য 'কম খাওয়ার' প্রেসক্রিপশন। মনে হল এই সদ্য প্রেসক্রিপশনটার অনেকগুলো ফয়দা আছে। প্রথমত খাওয়া কমিয়ে দিলে খরচও কমে যাবে। ফলে কম উপার্জন করলে হবে। এতে খাটুনি কমে যাবে। অফিস সময় অর্ধেক কমিয়ে শুধুমাত্র সকালে অথবা বিকালে করলে হবে। অথবা দিনের সংখ্যা অর্ধেক করে করে সপ্তাহের শুরুতে অথবা শেষে আড়াই দিন নিয়ম করে দিলে হবে। এতে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। বিশাল যানজটের জন্য সরকারকে কেউ সমালোচনা করতে পারবে না। খাওয়া কমিয়ে দেয়ায় রান্নার জন্য গ্যাস কম খরচ হবে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে। কৃষকেরা চাষাবাদও কমিয়ে দিতে পারবে। কম উৎপাদন করলে চলবে। ফলে তাদেরও খাটুনি কমে যাবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করার মত কষ্ট লাঘব হবে। খাদ্যের চাহিদা কম হওয়ায় পরিবহন কমে যাবে। ফলে রাস্তাঘাট ভালো থাকবে বা কম মেরামতের প্রয়োজন হবে। খাদ্য বাবদ অর্থ সাশ্রয়ের ফলে বাংলাদেশীরা নির্বাচনে আরও বেশি অংশ নিতে পারবে। নির্বাচনে বেশি ব্যয় করতে পারবে। আরও কত ফয়দা। এ ব্যাপারে নতুন আইন পাশ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে খাদ্য ভেজালমুক্ত রাখার দায়িত্ব পরিবর্তন করে জনগনকে কম খেতে বাধ্য করার নতুন দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তবে এই 'কম'-এর সংজ্ঞাটা বা কতটা কম খেতে হবে সেটা মনে হয় নির্ধারণ করে দেয়া ভালো। ঘুষখোর, চাঁদাবাজি বা অতি মুনাফাখোর নয়, বাধা আয়ের একটি পরিবারে গিয়ে যদি খোঁজ নিতেন তাহলে মন্ত্রী বুঝতে পারতেন, মানুষ আর কত কম খাবে। এ প্রসঙ্গে হোজ্জার গাধার প্রসঙ্গ এস গেল। গাধাটা খুব বেশি খেত। এ নিয়ে হোজ্জা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকত। এ দেখে এক বন্ধু তাকে প্রেসক্রিপশন দিল গাধাটাকে না খেয়ে থাকার অভ্যাস করাতে। জন্তু-জানোয়ার অভ্যাসের দাস। যে ভাবে অভ্যাস করানো যাবে সে ভাবেই অভ্যস্ত হবে।
প্রেসক্রিপশনটা হোজ্জার বেশ পছন্দ হল। পরের দিন থেকে সে তার গাধাকে একদিন পর খাবার দেয়া শুরু করে দিল। কিছুদিন পর দুই দিন অন্তর। তারপর এক সপ্তাহ পরপর। এইভাবে এক পর্যায়ে এসে এক মাস অন্তর। হোজ্জা দেখতে পেল গাধাটা এক মাস না খেতে পেয়েও দিব্যি বেঁচে আছে। এবার তার আস্থা হল, গাধাটা না খেয়ে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হোজ্জা পরদিন থেকে গাধাটাকে একেবারেই খাবার দেয়া বন্ধ করে দিল। এর কিছুদিন পরে গাধা গেল মরে। হোজ্জা এবার গাধার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে বলে উঠল, "নেমকহারাম, তোকে যখন না খেয়ে বেঁচে থাকার অভ্যাস করালাম তখন তুই গেলি মরে।"
যাহোক, মন্ত্রী হয়ত খুশি হবেন যে শুধু কম নয়, যদি খাওয়ার অভ্যাস একবারেই পরিত্যাগ করতে পারে। জিনিষপত্রের দাম যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে ঘুষখোর, মুনাফাখোর আর চাঁদাবাজ ছাড়া কারও খাদ্য কেনার ক্ষমতা থাকবে না। মন্ত্রী সাহেব নিজেই একটু কষ্ট করে তার শীতাতপ অফিস থেকে বের হয়ে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ী থেকে নেমে বাজারে যেয়ে, বাসে, রিক্সায় চড়ে পরীক্ষা করলে এটা টের পাবেন। গত তিন বছরে তাদের শাসনামলে কতটা দাম বেড়েছে এবং কী হাবে দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে তা তো তিনি জানেন। পঁচিশ টাকার চাল পঞ্চাশ, ষাট টাকার ডাল নব্বই, পয়ত্রিশ টাকার চিনি পয়ষট্রি, গরুর গোস্ত এক শ' ষাট থেকে দুই শত ষাট টাকা। এমনকি পঞ্চাশ টাকার গুড় এখন শ'টাকা। আড়াইশ টাকার শাড়ী চা'রশ টাকার উপরে। পনের টাকার বাস ভাড়া ত্রিশ, আর রিক্সায় উঠলেই দশ টাকা। বাড়ীভাড়া শতকরা বিশ/ত্রিশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে প্রতিটি সামগ্রীর দাম বেড়েছে এবং এই বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সরকার নিজেই গ্যাস, বিদ্যুত, পানি, জ্বালানি তেল আর চিনির দাম বাড়িয়েছে। প্রধান মন্ত্রী আন্তর্জাতিক বাজার দর বৃদ্ধির দোহাই দিয়েছেন। যে কারণেই দাম বৃদ্ধি হোক না কেন ব্যবসায়ীরা খুশি থাকলেও সাধারণ জনগণ এখন আতংকের মধ্যে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এবার একটা গল্প বলে শেষ করি। ছোটখাটো এক শহরে বাড়ীর এক কর্তা পুকুর থেকে বড়সড় একটা জ্যান্ত মাছ ধরে নিয়ে এসে গিন্নীকে বললেন রাত্রে খাওয়ার জন্য ভাজি করতে। "মাফ চাই", গিন্নী বললেন। "রান্নার তেল প্রায় শেষ, যা আছে তাই দিয়ে মাসের বাকি দিনগুলো চলতে হবে। যে দাম, এ মাসে আর কেনা যাবে না। ঠিক আছে, তাহলে চুলার আগুনে রোস্ট করে ফেল, আবেদন করলেন কর্তাব্যক্তি। "এলপি গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, আমি এত গ্যাস খরচ করে রোস্ট করতে পারবো না"। তাহলে এক কাজ কর ইলেক্ট্রিক ওভেনে বেক করে ফেল, অনুরোধের সুরে বললেন কর্তাব্যক্তি। উত্তরে গিন্নী বললেন, "কারেন্ট সেই বিকেলে চলে গেছে। সন্ধ্যার সময় এলেও সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে। রাত বারোটার আগে আর আসবে না। ততক্ষণে মাছ পচে যাবে। তাছাড়া সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।" ঠিক আছে তাহলে চল কাঠের আগুনে পুড়িয়ে নেই। "মাফ কর, চারশ' টাকা মণ দরে কাঠ কিনে আমি মাছ পোড়াতে পারবো না," গিন্নী বললেন। উপায়ান্তর না দেখে মাছটি আবার পুকুরে ছেড়ে দিয়ে এলেন কর্তাব্যক্তিটি। ছাড়া পেয়ে মাছটি সাতার কাটতে কাটতে পানির উপরে মাথা বের করে বলে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলঃ "জয় হোক সরকারের। দাম বদলের এই সরকার, ফিরে আসুক বারবার। "
কিউ আর ইসলাম: গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশীপের স্থানীয় চ্যাপ্টার বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশীপের নির্বাহী কমিটির সদস্য।