Published : 12 May 2014, 04:21 PM
ভারতের নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেল। শেষ পর্যায়ের ভোটগ্রহণও চলছে। ১৬ মে চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। 'এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত' কিংবা 'সবার সঙ্গে সবার বিকাশ'-এর মতো চটকদার নির্বাচনী স্লোগান সম্বলিত ইশতেহার প্রকাশ করলেও, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনী প্রচারণায় বিপরীত চিত্রটিই নজরে এসেছে বেশি।
গান্ধী হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) কর্তৃক আশীর্বাদধন্য নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী, যিনি গুজরাট রাজ্যের তিন তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী এবং সেই সুবাদে যিনি গুজরাটের মডেলে দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কর্পোরেট মিডিয়ার কোলে চেপে ফুলে ফেঁপে আগ্রাসী নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন, তিনি এই দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কতটা নিরাপদ সেটি ভাবতেই আতঙ্কিত বোধ করছে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়ো তুললেও ভারত সামাজিক বা সাংস্কৃতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে চরমভাবে। একটি দেশের সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন না হলে রাষ্ট্রীয় দর্শন অকার্যকর হয়ে পড়ে আপনা থেকেই। হয়েছেও। গদির পানে মোদীর যে আপাত জোয়ার দৃশ্যমান সেটিকে আর যাই হোক রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রতি সম্মান রেখে উত্থান বলা যাবে না। বরং রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন বলা যেতে পারে।
যদিও নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি বলেছে 'সরকারের দর্শন হবে ভারত প্রথম' কিংবা 'সরকারের ধর্মগ্রন্থ হবে ভারতের সংবিধান'। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় সুড়সুড়ি মাখা বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণা কতটা সংবিধান বা নির্বাচনী আইনসম্মত সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
সাংস্কৃতিক সংগঠনের আদলে পরিচালিত আরএসএস দীর্ঘদিন ধরেই প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপির ঘাড়ে বসে। এই আরএসএস এতটাই শক্তিশালী যে, ইতোপূর্বে সরকার চালানো অটল বিহারী বাজপেয়ীকে নিমিষেই এরা মাটিতে নামিয়ে এনেছে গুরুত্বের বিবেচনায়। কারণ ক্ষমতায় বসার পর ১৯৯৯ সালে কারগ্রিল যুদ্ধ, ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক বিস্ফোরণ এবং গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর পরও, বিজেপিকে মডারেট হিন্দুত্ববাদী সংগঠন করার প্রয়াস বাজপেয়ী চালিয়েছিলেন। যেটি আরএসএসের পছন্দ নয়। তাদের চাই কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকার।
সেই সমীকরণ থেকে বাজপেয়ী, আদভানী, যোশি, সুষমা স্বরাজের মতো ডাকসাইটে আরএসএস সদস্যকে পিছনে ঠেলে দৃশ্যপটে আসে গুজরাট হত্যাকাণ্ডের রক্তের দাগ লেগে থাকা মোদীর দানবীয় হাত। সত্যি অসাম্প্রদায়িক ভারতের জন্য এটি ভয়ঙ্কর সিগন্যাল বটে। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে মুসলিমদের জন্য নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকরণের কথা বলা হলেও অয্যোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপনের কথাও বলা আছে।
ফলে ২৮ কোটি মুসলিমের ভোট যে তারা পাবে না এটা তারা ভালো করেই জানে। তাই সুব্রামানিয়ামকে দিয়ে চালিয়েছে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি মাখা নির্বাচনী প্রচারণা। সুব্রামানিয়ামের আস্ফালনের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থাকুক আর নাই থাকুক, বাজার গরম করতে এটি বেশ কাজ দিয়েছে। কারণ ভোটের বাজার এখনও সেক্যুলার ভারতে বসে ধর্মান্ধতা লালন করে সঙ্গোপনে। কিন্তু বিপরীতে আমাদের মতো ছোট দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ভিতরকার প্রস্তুতি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করছে। যেটির বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বিজেপির ছোটখাটো কোনো আহাম্মকিতে।
কোথায় যেন পড়েছিলাম দুই লাইনের মারাত্মক একটি কবিতা–
শুকনো কাঠের চেলার মতো শুকনো মাটির ঢেলা
আগুন পেলে জ্বলবে হেতা জাহান্নামের খেলা'।
এদিকে কর্পোরেট মিডিয়ার কল্যাণে নরেন্দ্র মোদী নিজেকে মানসিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর আসনে ইতোমধ্যে বসিয়ে নিয়েছেন। সেটি নিয়েছেন বলেই এদিক সেদিক ঢুঁ মেরে জানান দিচ্ছেন অস্তিত্ব। চীনের মতো বৃহৎ শক্তিকেও একহাত নেওয়ার হুমকি উনি দিয়ে রেখেছেন নিজের মেরুদণ্ডের জোর দেখাতে। চীনকে উদ্দেশ্য করে উনি সম্প্রতি বলেছেন 'অরুণাচলের কথা ভুলে যান, শক্তিতে কুলাবে না'।
অযাচিত এই টোকার কারণ, মোদী জানেন চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধ আছে এবং এই বিষয়ে জনগণ এক ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রটেকশন আশা করে। ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষের আত্মরক্ষার প্রস্তুতি দীর্ঘদিনের। বেইজিং কাশ্মীরকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে বলে যে অভিযোগ আছে সেটির সত্যতা প্রমাণ করে চীন কর্তৃক কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জন্য ভারতীয় পাসপোর্টের বদলে আলাদা কাগজে ভিসা প্রদান দেখে।
তাছাড়া চীন ইতোমধ্যে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে সমুদ্র বন্দর নির্মাণে ব্যাপক সহায়তা করেছে। ভবিষ্যতে হংকং থেকে সুদান পর্যন্ত আরও বেশ কিছু সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা চীনের আছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর পাওয়া যায়। এর সবগুলোই জিও-পলিটিক্সে প্রভাব বিস্তারের জন্য করা বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে ভারতও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপানসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাস্ত্র কিনে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করছে। সম্প্রতি তাজিকিস্তানে প্রথমবারের মতো সেনা ঘাঁটি স্থাপন করেছে ভারত। ফলে স্পষ্টতই দুপক্ষ নিরব প্রস্তুতি সেরে রাখছে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য।
এত এত ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরও, দিল্লি এবং বেইজিং ২০১৪ সালকে বন্ধুত্বের বছর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কারণ একটাই। বাজার। ভারতে চীনের প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। চীনেও ভারতের কম বড় বাজার নয়। ফলে বাজারের স্বার্থে তাদের সামরিক মহড়া সংঘাতের দিকে মোড় না-ও নিতে পারে।
নির্বাচনী দৌড়ের অপর বড় প্রতিযোগী ধর্মনিরপেক্ষতার 'মূর্ত প্রতীক' কংগ্রেস আছে বড় বিপদে। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এই কংগ্রেস জমানায়। তথ্য অধিকার আইনের জোরে কেজরিওয়াল এই দুর্নীতি পুঁজি করে শীলা দীক্ষিতকে দিল্লির রাজ্যসভা থেকে টেনে নামিয়েছেন। দুর্নীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক দ্বায়বদ্ধতাহীন জাতিসংঘের সাবেক ডাকসাইটে আমলা মনমোহন সিংকে দিয়ে দেশপরিচালনা করতে গিয়ে এবং নেপথ্যে সোনিয়া গান্ধী কলকাঠি নাড়তে গিয়ে বেশ ক'বারই মনমোহনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে মান-সম্মান খোয়াতে হয়েছে।
খাদ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে ইউপিএ-এর উপদেষ্টাদের সঙ্গে ফাইল চালাচালি কিংবা সর্বশেষ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের নির্বচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে অর্ডিন্যান্স জারি করতে গিয়ে রাহুল গান্ধীর আপত্তিতে পারেননি। ফলে কমেছে কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা। আবার নরসিমা রাও-এর সময় বাবরী মসজিদ ভাঙা নিয়েও কংগ্রেস সঠিক সময়ে সঠিক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, যেটি তাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে অনেকখানি।
মনমোহন সিং-এর দারিদ্র দূরীকরণে গুচ্ছ রাষ্ট্রীয় প্রকল্প খুব একটা কাজে আসেনি। কারণ অর্থমন্ত্রী থাকাকালে উনি যে উদার অর্থনীতি চালু করেছিলেন তাতে করে খাদ্য, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকুচিত হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। ফলে এই কর্মসূচীও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই মানুষ বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসের উপর।
ভারতের নির্বাচনের অতীত ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালের পর এককভাবে কোনো দল ৫৪৩ আসনের মধ্যে ২৭২ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব বেড়েছে ক্রমাগতভাবে এবং বড় দলগুলো নির্ভরশীল হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলোর উপর। কর্পোরেট মিডিয়ার দাপাদাপিতে এবার যদিও মনে হচ্ছে মোদী অনেকখানি গদির কাছাকাছি, কিন্তু বাস্তবে সেটা এককভাবে হবার সম্ভাবনা কম। ফলে গুরুত্ব বাড়বে ছোট দলগুলোর বা ছোট দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ফ্রন্টের।
এখন পর্যন্ত পাঁচটি অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছে। যেমন, এনডিএ, ইউপিএ, থার্ড ফ্রন্ট, বামফ্রন্ট এবং আম আদমি পার্টি। সার্বিকভাবে ধারণা করা হয় যে, অকংগ্রেস এবং অবিজেপি ভোটের সংখ্যা পঞ্চাশ ভাগ। ফলে এনডিএ এবং ইউপিএ জোটের বাইরের জোটগুলো দৃশ্যপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে পরবর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়ায়।
কিন্তু এখানেও জটিলতা আছে। কারণ সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব বহুজন সমাজ পার্টির মায়াবতীর সঙ্গে এক জোটে যেতে চাইবেন না। অন্যদিকে অল ইন্ডিয়া আন্না ডিএমকে নেতা জয়ললিতা ডিএমকের এম করুণানিধির সঙ্গে জোটবাঁধাও অসম্ভব প্রায়। বামফ্রন্ট-তৃণমূল দ্বন্দ্ব তো আছেই।
ফলে বিভিন্ন নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে ভোটের ফলাফল আসার পরও। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে!
দেবপ্রসাদ দেবু: কলামিস্ট, ব্লগার।