Published : 01 Nov 2010, 08:51 PM
দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ আবারো পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর কাতারে অগৌরব নিয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৭৮টি দেশের ভিতর পরিচালিত ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) জরীপে এবার তার অবস্থান এক ধাপ পিছিয়ে ১২তম। দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) অনুসারে গতবছরের থেকে এক পয়েন্টও এগুয়নি বাংলাদেশ, রয়ে গেছে একই স্থানে (২.৪)। বর্তমান সরকারের দুর্নীতিবিরোধী নানান ঘোষনা ও পদক্ষেপের পরেও চিত্রটিকে হতাশাজনকই বলতে হবে। বোঝা যায়, সেগুলো যত না ছিল পদক্ষেপ, তার চেয়ে বেশী ছিল ঘোষনা। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত, বিএনপি শাসনামলে, আমরা ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ। সর্বক্ষেত্রে প্রথম হওয়ার মধ্যে যে গৌরবের কিছু নেই, এমনকি চ্যাম্পিয়ন হবার হ্যাটট্রিক করার মাঝেও যে নেই কোন আনন্দ, সমগ্র জাতি তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল।
তখন হতাশামলিন হয়ে ভাবতাম দুনিয়ায় এত এত জাতি বা রাষ্ট্র থাকতে আমরা কেন? আমরা কি এতই পঁচে গেছি যে তালিকার শীর্ষে আর কোন দেশ নেই, রয়েছি আমরাই, যে আমরা ভাল কোন কিছুতে প্রথম কেন, ধারে-কাছে থাকতে পারিনা। ২০০৫ থেকে আজ অবধি শীর্ষস্থানচ্যুত হলেও অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। এমনকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বৈপ্লবিক কোন উন্নতি ঘটেনি। ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮- এই তিন বছরে আমাদের অবস্থান ছিল যথাক্রমে তৃতীয়, সপ্তম ও দশম। দুর্নীতি এমনই এক দুরারোগ্য ব্যাধি, এমনই তাঁর প্রসার যে বাঘা বাঘা দুর্নীতিবাজদের জেলে পুরেও দুর্নীতি থামানো বা তার মাত্রা কমানো যায়নি, চুনোপুটিরা অসীম সাহস নিয়ে তা চালিয়েই গেছে, আর এদের সংখ্যা অগুণিত।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি একজনকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি যিনি পাট মন্ত্রণালয়ে একজন মধ্যমসারির বিপণন কর্মকর্তা ছিলেন। ঢাকার একটি অভিজাত এলাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পাঁচ কাঠার উপরে নির্মিত তার দৃষ্টিনন্দন চারতলা বাড়িটি নির্মাণে তিনি আজ থেকে পনের বছর আগে আড়াই কোটি টাকা খরচ করেছিলেন- একথা তিনি নিজে আমাকে একদিন জানিয়েছিলেন। যে জমির উপরে বাড়িটি দাঁড়িয়ে সেটিও তিনি কিনে নিয়েছিলেন, রাজউক থেকে বরাদ্দ পাননি। এই মূল্যবান বাড়িটির বাইরে তার নিজের জেলা শহরে একটি পাঁচতলা দালান, অনত্র একটি সিনেমা হল রয়েছে। অবৈধ উপার্জন দিয়ে তিনি নিজের গ্রামের বাড়ির চেহারা শহরের মতো বানিয়ে নিয়েছেন। এই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ লোকটি কোনপ্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই তার অতীব সুখ আর স্বচ্ছলতায় মোড়ানো জীবনটি কাটিয়ে গেছেন, সন্তানদের জন্য রেখে গেছেন অঢেল সম্পদ। হ্যাঁ, দুর্নীতির দায়ে একবার তার চাকুরী চলে গিয়েছিল, আদালতে গিয়ে, সরকারপক্ষকে হারিয়ে দিয়ে সগৌরবে তিনি তা ফিরেও পেয়েছিলেন (সর্বদাই তারা তা ফেরৎ পায়)। ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে যে পড়েছিলাম পাটের অপর নাম সোনালী আঁশ, সেই সোনা কী করে তামায় রূপান্তরিত হয়েছিল, তা তখন বুঝিনি, বহুবছর পরে এসে সচক্ষে দেখলাম। শাস্তি পাবার কোন ভয় নেই বলেই দুর্নীতিবাজদের বুকের পাটা এত বড়!
আমার পরিচিত এক সরকারী কর্মকর্তা সেদিন এক পারিবারিক আসরে সদম্ভে উপস্থিত সকলকে জানালেন যে, তিনি খুব বেশী নয়, মাত্র তিনশ কোটি টাকার মালিক। যদিও তিনি এখন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় তার সম্পদ বাড়িয়ে তুলছেন, বিনিয়োগের প্রাথমিক মূলধন তার সরকারী পেশার সূত্রেই অর্জিত। অতঃপর তার লক্ষ্য কী জানতে চাইলে তিনি আরো প্রত্যয়দীপ্ত স্বরে জানালেন, তার লক্ষ্য এ সম্পদকে এক হাজার কোটিতে উন্নীত করা। অতঃপর? না, তার একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে। ঐ টাকা দিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কারের একটি বাংলাদেশী সংস্করণ চালু করতে চান। ডিনামাইটের মত বিধ্বংসী একটি রাসয়ানিক যৌগ আবিষ্কার করে আলফ্রেড নোবেলের মনে যে অপরাধবোধ জন্মেছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্যই তিনি নোবেল প্রাইজ ঘোষনা করেছিলেন কিনা কে জানে, তবে আমাদের অভ্যর্থনাকারীর মনে যে বিপুল অপরাধবোধ জন্মেছে – তাতে সন্দেহ নেই। নোবেল প্রাইজের মত কিছু একটা প্রচলন করে তিনি অমর থাকতে চান। আলফ্রেড নোবেলের অর্থের উৎস আমরা জানি, কিন্তু তার? সরকারী কর্মকর্তা অর্থাৎ আমলারা High Mach personality, যারা বিশ্বাস করে লক্ষ্য অর্জনই বড় কথা, পথ বা পদ্ধতি যাই হোক না কেন (end will justify the means)|
একবার মগবাজারে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আমরা বাইরে এসে খোলা বারান্দায় দাঁড়াই। আমাদের সমুখে পরপর তিনটি নবনির্মিত বাড়ি আধো-অন্ধকারেও অসামান্য স্থাপত্যসৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে আমি জানতে চাই বাড়িগুলোর মালিক কারা? আমার আত্মীয়টি জানালেন প্রথম বাড়িটি একজন বিচারকের, দ্বিতীয়টি একজন পুলিশ কর্মকর্তার, তৃতীয়টি একজন জেলা প্রশাসকের। সুন্দরী প্রতিযোগিতার মত এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নামা বাড়িগুলো তাদের মালিকদের পদমর্যাদার ক্রম মেনে চলেনি। সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়িটি পুলিশ অফিসারের, অপেক্ষাকৃত কম জাকজমকপূর্ণ বাড়িটি জেলা প্রশাসকের, বিচারকের বাড়িটি সেটিকে তৃতীয়স্থানে ঠেলে দিয়েছে।
আসলে এ কাহিনীর কোন শেষ নেই। আমার তিনটি উদাহরণে যদিও কেবল সরকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির চিত্রই ফুটে উঠেছে, অন্যান্য পেশার মানুষেরা – রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবিরা কেউ কারো চেয়ে কম নন। সরকারী কর্মকর্তারা হয়ত চোখে পড়েন বেশী, কেননা তাদের বেতন কাঠামো আমরা জানি। আমরা জানিনা রাজনীতিবিদদের কমিশন বাণিজ্যের পরিমাণ, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজীর মাত্রা (কিছু কিছু অবশ্য পত্র-পত্রিকায় আসে)। অতীতে কোন কোন সরকারের আমলে জাপান ঢাকা শহরের যানজট কমাতে পাতাল রেল ও উড়ালপথ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু টাকা নিজেদের হাতে না আসার জটিলতায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার তাতে সাড়া দেয় নি।
ব্যবসায়ীদের কালো টাকার পাহাড় নির্মাণের দৃশ্যও আমাদের চোখে পড়ে কম। কিছু বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে এদেশের কোটি কোটি মানুষের পকেট খালি করে ফেলেছে, আজো করছে, দরিদ্রকে ঠেলে দিচ্ছে আরো দারিদ্রের ভিতর, তার কোন তুল্য চিত্র ইউরোপ দূরে থাকুক, এশিয়াতেও নেই। কোন সরকারইতো তাদের সাথে পেড়ে ওঠেনি বরং এদের হরির লুটে দেশবাসী সর্বস্বান্ত হলেও উচ্ছিষ্টভোগীরা অবশেষে কিছু পেয়ে চুপ হয়ে যান। সরকারী খাস জমি দখল করে ভূমিদস্যুরা বিত্তের পাহাড় নয়, হিমালয় গড়েছে, নদী-খাল-বিল-জলাশয় দখল করে বসিয়েছে চটকদার আবাসিক প্রকল্প। এসব তো দিনের আলোয় সকলের চোখের সামনেই ঘটছে। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সম্পদের পরিমান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়, সেখানে ন্যূনতম একক একশ কোটি টাকা। চৌদ্দপুরুষ যে সম্পদ সঞ্চয় করতে পারতো না, এক প্রজন্মেই রাজনীতির আলাদিনের চেরাগের স্পর্শে তারা তা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কিছু বলে দেখুন, আপনাকে বলবে ষড়যন্ত্রকারী, বলবে এটা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রোপাগাণ্ডা। তাদের ভাবখানা ধোয়া তুলসী পাতার মত (ফুলের মত পবিত্র সব চরিত্র)। মজার ব্যাপার হল যাদের নামে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার অভিযোগও প্রমাণ করা যায় না, না কি প্রমাণের প্রয়োজন নেই?
কয়েক বছর আগে ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনেই দেখেছিলাম বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ বিভাগ হল পুলিশ বিভাগ। কিন্তু এর পরের বিভাগটি দেখেই আঁতকে উঠতে হয়, সেটি হল বিচারবিভাগ। যাদের প্রধান কাজ আইন শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন বজায় রাখা তারাই যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হন, তবে সাধারণ মানুষের যাবার জায়গা কোথায়? সকলের স্মরণ থাকতে পারে সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি নিজের মার্কশীট জালিয়াতি করেছিলেন, তার প্রদর্শিত সনদ ছিল ভুয়া। ২০০৮ সালে টিআই পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই সবচেয়ে বেশী দুর্নীতিগ্রস্থ। এরপরেই রয়েছে স্থানীয় সরকার ও ভূমি প্রশাসন। গবেষনায় দেখা যায় বিভিন্ন সেবা পেতে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা পেতে গড়ে প্রতি পরিবারকে ৪,১৪৩ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। সার্বিকভাবে জনপ্রতি মাথাপিছু আয়ের ৩.৮৪ শতাংশ ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে।
দুর্নীতির সূচকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে উন্নত বিশ্বের, প্রধানত খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর আধিক্য চোখে পড়ার মত (২০১০ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলো হচ্ছে ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর)। অন্যদিকে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় দুর্নীতি বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। এটা কি আশ্চর্য নয় যে পৃথিবীর চারটি শীর্ষ মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্থান ও নাইজেরিয়া দুর্নীতির তালিকাতে কিছুদিন আগেও শীর্ষে ছিল। অবস্থার কিছু হেরফের হলেও এখনো তারা দুর্নীতির চূড়ার দিকেই রয়েছে। ইদানিং যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ও ইরাক তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় দেশ দুটি তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
এটা দুঃখজনক, এটা হবার কথা নয়। এতে প্রমাণিত হয় আমরা ধর্মকে কেবল বহিরাবরণ হিসেবে নিয়েছি, অন্তঃকরণে ধারণ করিনি; শাস্তি থেকে বাঁচবার পথ হিসেবে নিয়েছি, ভাল হবার মন্ত্র হিসেবে নিইনি। এমনকি প্রত্যহ ধর্ম-কর্ম করা মানুষেরা যখন প্রতিদিন মিথ্যা কথা বলে, ঘুষ নেয়, অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করার কথা ভাবে, অপর মানুষের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে নিচে নামিয়ে দেবার হীন চক্রান্ত করে, দুঃখী মানুষ বা সমাজের জন্য কিছুই করে না, তখন তো এটাই প্রমাণিত হয়।
আমি যখনই জুম্মার নামাজ পড়তে কোন মসজিদে যাই, তখনই খেয়াল করি মসজিদের ইমাম নামাজে উপস্থিত মুসল্লীদের গুনার জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে কান্নাকাটি করেন। তিনি বারংবার বলেন, আমরা গুনাহ করেছি, হে আল্লাহ, তুমি আমাদের মাফ করে দাও। ভুল করে ক্ষমাপ্রার্থনা করা ভাল, কিন্তু তিনি একবারও বলেন না আমরা আর ভুল করব না, সজ্ঞানে ভুল করলে তুমি আমাদের আর মাফ করো না। অর্থাৎ (জেনেশুনে) আমরা বারংবার ভুল করব, আর সৃষ্টিকর্তা বারংবার তা মাফ করে দিবেন। ক্ষমা পাবার এই নিশ্চয়তা অসৎ লোকদের আরো বেপরোয়া করে তোলে। তাদের ধর্মচর্চা সৃষ্টিকর্তাকে এক ধরণের খুশী করার প্রয়াস বলেই মনে হয়। আমি অন্যায় করেছি, এই নাও কিছু প্রার্থনা ও প্রশংসার ফুলঝুরি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর এই চক্রটি ঘুরছেই অর্থাৎ আমি আবারো অন্যায় করব, তুমি আমাকে আবারো ক্ষমা করে দিবে। তাদের সকল কর্মকান্ড হীন আত্মস্বার্থ ঘিরে আবর্তিত, তারা যেমন দুর্নীতি করে নিজের আরাম-আয়েস বাড়ানোর জন্য, তেমনি ধর্ম-কর্ম করে পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে নিজেদের পিঠ বাচানোর জন্য, এর মাঝে মহত্ত্ব কিছু নেই। নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ লাগিয়ে ফেলা কর্মকর্তারা যখন নির্বিবাদে ঘুষ নেন, তখন কী বলা যায়? তবে এওতো সত্যি যে, অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ চারিপাশের ঘোলাস্রোতের ভিতরেও আশ্চর্য সংযমী, তারা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, প্রবল অভাব সত্ত্বেও লোভকে জয় করে সংগ্রামী জীবন যাপন করছেন। দুঃখ যে, তারাই এখন সংখ্যালঘু, দুর্ণীতির পাঁকে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানসমূহে রীতিমত বেমানান, এমনকি নিজের পরিবারেও অপদার্থ বলে পরিগণিত।
একটা সময় ছিল যখন দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষকে সবাই ঘৃণা করত, তারা নিজেরাও এজন্য লজ্জাবোধ করত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদকে লুকিয়ে রাখত। এখন দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষেরা নির্লজ্জভাবে তাদের বিত্ত প্রদর্শন করে, বৈভব প্রদর্শনীর কুরুচিপূর্ণ প্রতিযোগিতায় নামে। তাদের সাফল্যকে সমাজের অন্যান্যরা দেখে সপ্রশংসদৃষ্টিতে, যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্ত্বার যোগফল হিসেবে। টাকার জোরে তারা যে শুধু ক্ষমতাবানদের ম্যানেজ করে ফেলে তা নয়, টাকার জোরে তারা সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সমর্থনও আদায় করে নেয়। যে দেশের অর্ধেক লোক প্রতিদিন পর্যাপ্ত আহার পায় না, এক তৃতীয়াংশ বাস করে চরম দারিদ্রের মাঝে সে দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী গাড়ি কেনার জন্য হিড়িক পড়ে যায়, একটি বিয়ের ধূমধামে খরচ হয় পঞ্চাশ কোটি টাকা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক অভিনেতার মেয়ের বিয়েতে টাকার অঙ্কটি এর চেয়েও বেশী বলে জনশ্রতি রয়েছে। অত যে জাঁকজমক করে বিয়ে দিতে অভ্যস্ত ভারতীয় ধনীদেরও বাংলাদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পুত্র-কন্যাদের বৈবাহিক আয়োজনের ঘটা ও ব্যাপ্তি দেখে চক্ষু চড়কগাছ হবার জোগাড়।
দুর্নীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হল তা মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, দেশকে পিছিয়ে দেয়। ধরা যাক, একটি এলাকার জন্য একটি রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হল, টাকাও বরাদ্দ হল, অথচ রাস্তাটি তৈরী হল না, বা তৈরী হল এমন একটি নিুমানের রাস্তা যা চলাচলের অনুপযুক্ত। সাধারণ মানুষ যাদের দেয়া ট্যাক্সের টাকায় ঐ রাস্তাটি তৈরী হবার কথা ছিল, তারা বঞ্চিত হলেন, প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে থাকলেন, দেশের উপরি-কাঠামোর উন্নয়ন হলনা। টিআইয়ের প্রতিবেদনেই উল্লেখ আছে বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমান টাকার (৬,৭৯৬ কোটি টাকা) দুর্নীতি হয় তা দিয়ে ১২,০০০ প্রাইমারী স্কুল নির্মাণ করা যায়, কিংবা পাঁচ লক্ষ মাইল দীর্ঘ পীচঢালা সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব। বিরিশিরি যাবার পথে যে তিনটি অসমাপ্ত সেতুর কথা আগের নিবন্ধে লিখেছিলাম তারা তো ঐ অঞ্চলের মানুষদের আজো বঞ্চিত রেখেছে সেতু পারাপারের সুযোগ থেকে। ঢাকা শহরের অলি-গলির ভিতরে অজস্র খানা-খন্দ ভরা সড়ক নামধারী পথে চলতে গিয়ে নাকাল হচ্ছে নগরবাসী। বাংলাদেশ যে আজো পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ তার বড় কারণ দুর্নীতি। তাই দুর্নীতিবাজদের ক্ষমা করা যায় না।
যদিও দুর্নীতির অপবাদ সকল দেশবাসীকেই নিতে হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষকে এই অপবাদ দিয়ে লাভ নেই, কেননা তাদের দুর্নীতিগ্রস্থ হবার উপায় নেই। অনেকেই হয়ত বলবেন সুযোগ পেলে তারাও দুর্নীতি করতেন, আর দুর্নীতি ক্ষুদ্র হোক, বড় হোক সকল দুর্নীতিই এক। এটা মূল্যবোধের বিচারে এক হলেও বাস্তবে এক নয়। আমরা এক্ষেত্রে Pareto's Principle বা 80-20 Rule স্মরণ করতে পারি। একটি দেশের দুর্নীতির আশিভাগ করে বিশভাগ লোক (vital few) আর বাকী আশিভাগ লোক (trivial many) সম্মিলিতভাবে করে বিশভাগ দুর্নীতি। দুর্ণীতিদমনে সরকারের উচিৎ হবে ঐ বিশভাগ Vital Few-এর উপর মনোনিবেশ করা, তাদের কঠোরহস্তে দমন করা। ঐ তিমি মাছেরা গিলে খাচ্ছে সকল ছোট মাছ, তাদের থামাতে পারলে দুর্নীতির রথ কেবল শ্লথই হবে না, থেমেও যাবে। তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রথমদিকে রাঘব বোয়ালদের ধরে এই কাজটিই করছিল কিন্তু কিছুকাল পরেই তারা ঐ vital few আর trivial many'র মাঝে গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। একটা উদাহরণ দেই, উত্তরায় যে স্কুলে আমার সন্তানেরা পড়ে তার সংলগ্ন একটি বাড়ির গ্যারেজে একটি ছোট্ট খাবারের দোকান (Hot Deli) ছিল , স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ওখানে খাবার খেতে আসত। আমিও মাঝে মাঝে আমার সন্তানদের নিয়ে ঐ নিরিবিলি সুন্দর অভ্যন্তরভাগের মানসম্পন্ন দোকানটিতে বসেছি। একদিন সকালে দেখি সেনাবাহিনীর বুলডোজার দোকানটিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। অপরাধ? বসতবাড়ির নিচে দোকান নির্মাণ অবৈধ। তখনই বুঝেছি, ঠগ বাছতে এরা গাঁ উজাড় করবে এবং পুরো অভিযানই মুখ থুবড়ে পড়বে। হলও তাই, তারা তখন অবৈধ বলে গ্রামাঞ্চলে হাঁট-বাজার ভাঙ্গছিল। অথচ সে সময় পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছিল দেশে নীরব দুর্নীতি চলছে সেনা অভিযানকে তোয়াক্কা না করেই। সে সময়ে খাদ্য সিন্ডিকেট দফায় দফায় জিনিষপত্রের দাম বাড়াচ্ছিল। ভেবেছিলাম জনস্বার্থকে বিসর্জন দেয়া মুনাফালোভী কয়েকটি রাঘব বোয়ালকে প্রকাশ্য রাস্তায় টাঙ্গিয়ে বেত্রাঘাত করা হবে; করা হল জামাই আদর। তবে বেশ বড়সর একজন বোয়ালের রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকা স্পর্ধিত টাওয়ারটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে তারা একটি চমৎকার কাজ করেছে, যেটা কোন গণতান্ত্রিক সরকার করতে পারতেন বলে মনে হয় না। ঐ টাওয়ারটি ছিল সকল নিয়মনীতি ও আইনের শাসনের প্রতি এক দুবির্ণীত বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং ক্ষমতাবানদের প্রতাপের আইকন।
আমরা প্রায়শই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কথা বলি, কিন্তু বাস্তবে দেখি উল্টো চিত্র। জনগনের কাছ থেকে সকল প্রকার অর্থ গ্রহনের ব্যবস্থাটি তা বিদ্যুতের বিল হোক, কর বা জরিমানা আদায় হোক, কম্পিউটারাইজড ডাটাবেজের মাধ্যমে হলে দুর্নীতি অনেকখানি কমে যাবে, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন বিল আদায়ে এর সুফল আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। প্রতিক্ষেত্রেই অর্থ প্রদানকারীকে মানি রিসিপ্ট দিতে হবে। বিল কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাক্তির discretionary power কমাতে বা একেবারে শূন্য করে দিতে হবে।
আমাদের আশার জায়গা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ক্যাবিনেটের বেশ কিছু সদস্য দুর্নীতি নির্মূলের ব্যাপারে আমাদের আশা দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার ব্যপারে তাদের প্রচেষ্টা আন্তরিক বলেই মনে হয়। ভিশন ২০২০ ও ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মসূচীর বাস্তবায়ন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌছানো দুর্নীতি রোধের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সরকারী প্রতিষ্ঠানে, যেমন হাসপাতালে, একজন চিকিৎসা নিতে আসা মানুষ কোন কোন সেবা কী পরিমান ফি দিয়ে পাবার অধিকার রাখেন, তা যদি হাসপাতাল-চত্বরে বিলবোর্ড তৈরী করে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়, তবে মানুষের দুর্ভোগ কমবে। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়াও সামাজিক নিন্দার বিষয় হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা প্রয়োজন। সম্প্রতি দুর্গোৎসব শেষ হল। দুর্নীতিবাজ অসুরদের দমনে সরকারকে দেবী দুর্গার ভূমিকাই নিতে হবে বলে মনে হয়। সরকারের কেবল দশটি হাত থাকলেই চলবে না, প্রয়োজন সহস্র শক্তিশালী লোভহীন হাত। ভয়ের কথা অসুরের প্রতি ফোটা রক্ত থেকে নতুন একটি অসুর জন্মায়। তাই এ যুদ্ধ বেশ কিছুকাল চলবে, আর এতে জয়ী হতে হবে শুভ শক্তির, কেননা এ দেশের অস্বিত্ব রক্ষার জন্যই প্রয়োজন দুর্নীতির মুলোৎপাটন।
কামরুল হাসান বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া লেখেন ছোটগল্প ও প্রবন্ধ এবং অনুবাদ করেন বিদেশী সাহিত্য।