Published : 22 Jun 2013, 01:24 AM
কেউ উচ্ছেদ হয় ভিটেমাটি থেকে, কেউ উচ্ছেদ হয় আদর্শ থেকে। মানুষ আদর্শ থেকে উচ্ছেদ হয় তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি আর স্থূল ভোগের আশায়। আর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয় বাধ্য হয়ে। তখন তাকে সরে যেতে হয়, পালাতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন কোনো নাগরিককে 'শত্রু' হওয়ার অপবাদ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয় তখন ওই কথিত গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়।
সেই স্বৈরতন্ত্র আবার সাধুর পোশাক পরে, গণতন্ত্রী সাজে। ভৌগলিক আর রাজনৈতিক উপনিবেশ অনেক মানুষকে তার অধিকার কেড়ে নিয়ে পরবাসী করে। নিজ দেশে থেকেও অনেকে তাদের অত্যাচারে পরবাসী হন। স্বাধীন নাগরিককে 'শত্রু' বলা হয়। শত্রুর অপবাদ দিয়ে তার ভিটেমাটি সহায়-সম্বল কেড়ে নিয়ে তাকে মূলধারার বাইরে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এসব উৎসাদনের প্রক্রিয়ার শিকার হন ধর্মীয় সংখ্যালঘু। যদিও প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীও সংখ্যালঘু ধর্মীয় সত্ত্বার মানুষদের মতোই একই প্রক্রিয়ার শিকার হন।
ভূমির উপর হারিয়ে যাওয়া সে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অর্পিত সম্পত্তি (শত্রু) আইনের বিলোপ ও অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর থেকে চার দশক ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার কর্মীরা যুক্ত রয়েছেন নানা মাত্রায়। আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ২০০১ সালে 'অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন' ও পরবর্তী পর্যায়ে ২০১১ সালে 'অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধনী ) আইন' সংসদে পাশ ও গৃহীত হয়। উল্লিখিত আইন কার্যকরের উদ্যোগ নেন সরকার। এ উদ্যোগের শ্রুতিফলে বিভিন্ন জেলায় ট্রাইব্যুনাল ও কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে দু লাখের উপর ভুক্তভোগী আবেদনও দায়ের করেছেন। কিন্তু একটু আলোর দিশা পেলেও আবার হতাশার অন্ধকার গ্রাস করতে চাচ্ছে এত কিছু অর্জনকে। কারণ আবেদন করার জন্য খুব স্বল্প সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
যাদের আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে কোনো দিন কেউ ভারতে যাননি তাদের সম্পত্তিও ক ও খ তফসিলের গেজেটে স্থান পেয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের বিভিন্ন জেলার অনেক সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জানি। শুধুমাত্র ভূমিসংক্রান্ত সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, স্থানীয় রাজনৈতিক চামুণ্ডাদের অতলস্পর্শী লোভের কারণে এ সব অনাচার হচ্ছে। এ অনাচারের হাত থেকে মুক্তি পেতেই ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া- তারই একটুখানি পরিমার্জন ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
ঘটনাটি এরকম। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে ক ও খ তফসিলের গেজেট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করতে না পারায় সরকার দু দফায় গেজেট প্রকাশের সময়সীমা বাড়ায়। এর মধ্যে ৫ মে তারিখে সংসদে গৃহীত এতদসংক্রান্ত ২০ নম্বর নতুন সংশোধনী আইনে গেজেট প্রকাশের সময় আরও তিনশ দিন বাড়ানো হয়। অথচ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিষয়ে আবেদন দায়েরের সময়সীমা ৫ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র ৫৭ দিন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের এ সময়সীমা বাড়ানোর দাবি ৩ শ দিনের। বিষয়টি সরকারকে জানানোর জন্য তারা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছেন। কিন্তু সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা নিরতিশয় উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত।
এ বিষয়ে তাদের মতো আমারও উৎকণ্ঠা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানের ক ও খ তফসিলভূক্ত গেজেট প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পরও তা প্রতিকারপ্রার্থী জনগণের কাছে পৌঁছুচ্ছে না; বরং পৌঁছুনোর ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার ফাঁদে পড়েছে। অনেক রকমের গড়িমসি হচ্ছে প্রতিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে। গেজেট প্রাপ্তির পর বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রতিকারের আবেদনের সঙ্গে দাবির সমর্থনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্তির বিধান করা হয়েছে।
কিন্তু একদিকে গেজেট প্রকাশের পর অধিকতর বিলম্বে গেজেটটি জনগণের হাতে আসা, অন্যদিকে ভূমি-বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এসএ খতিয়ানসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহে ভূমির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়া এবং নগদ নারায়ণ দাবি করার ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। উপরন্তু, ভূমি অফিসের সরবরাহ করা ছেঁড়া ও ঘষামাজা রেকর্ড অব রাইটসের (অধিকার ও দখল-সংক্রান্ত ধারাবাহিকতার প্রামাণ্য পর্চা কাগজ ও দলিল) কাগজপত্র গ্রহণে ট্রাইব্যুনালের অনীহা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো কাজ করছে। আদালতের বাৎসরিক ছুটির কারণে দেশের অনেক জায়গাতেই আবেদন দায়েরের সময় পার হয়ে গেছে।
এ সব আলোচনা যাদের বিরুদ্ধে যাবে তারা সরকারের দুর্নীর্তিগ্রস্ত কায়েমী স্বার্থচর্চাকারী একটি অশুভ চক্র। এসব অপকর্ম, রিরংসার কথা আর অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত ইতিহাস আমি ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বরে বিডিনিউজ ২৪ ডটকমে অন্য একটি মতামত বিশ্লেষণে লিখেছি।
এদিকে ঢাকার ট্রাইব্যুনাল নিজে সরেজমিনে ঘুরে দেখেছি ওই আবেদনের নিষ্পত্তির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিচারকদের উদাসীনতা; দেখেছি নিষ্পত্তির কাজে তাদের শম্বুকগতি। আর ভূমি অফিসগুলোর দ্রুত জমির পর্চা ও দলিল সরবরাহে গড়িমসি তো রয়েছেই; তার উপর রয়েছে অনায্য ও অন্যায়ভাবে টাকা-পয়সার দাবি। একই সঙ্গে হচ্ছে নতুন নতুন সম্পত্তিকে অর্পিত হিসাবে গণ্য করে গেজেট আকারে প্রকাশের চক্রান্ত।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সংশোধনীতে অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। হোলসেল এবেটমেন্টের ন্যায়সঙ্গত সংশোধনীও জরুরি হয়ে পড়েছে। জরুরি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিষয়ে কমিটির সিদ্ধান্ত ও ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত ভূমি মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। প্রতিকারপ্রার্থী জনগণের কাছে আইনের বলয়ের মধ্যে থেকে তাদের বরাবরে ওই সব সম্পত্তি প্রত্যপর্ণে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ। তা হলেই প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামোতে যতটুকু সম্ভব ততটুকু অধিকার চর্চার নিশ্চয়তা থাকবে সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর।
তাতে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কিছু অর্জন যদি থাকে সেটা কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও বহাল রাখতে পারব।
প্রকাশ বিশ্বাস : আইনজীবী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।