গত দুই-তিন দশকে আমাদের জীবনযাত্রা, চিন্তা-মূল্যবোধ, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির ধারাও পাল্টে গেছে। রাজনীতি থেকে ক্রমে বিদায় নিচ্ছে আদর্শ। ছাত্ররাজনীতিও আদর্শহীনতার চর্চায় পরিণত হয়েছে।
Published : 06 Feb 2024, 03:15 PM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। মনোমুগ্ধকর এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সবুজ বনভূমির মাঝে লাল ইটের তৈরি ইমারত মনোরম ক্যাম্পাসকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে। চমৎকার বনজঙ্গল, ব্যতিক্রমধর্মী সব দালানের নকশা, বিস্তৃত লেক, অসংখ্য পরিযায়ী পাখির আনাগোনা, সন্ধ্যার পর শেয়াল-ঝিঁঝিঁ আর পাখপাখালির সম্মিলিত ঐকতান, জোনাকির মিটিমিটি আলো জ্বলা, জোছনা রাতে মায়াবি রূপ— সব মিলিয়ে এক অনন্য সাধারণ পরিবেশ! এখানে এলে যে কারো মন ভালো হয়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগরের অপরূপ সৌন্দর্যের টানে এখনো অনেকে এখানে বেড়াতে যান। ছুটির দিনগুলোতে পুরো ক্যাম্পাস পরিণত হয় মেলায়।
কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্রমেই যেন নরককুণ্ডে পরিণত হচ্ছে। ছাত্রীনিপীড়ন ও ধর্ষণের কারণে সংবাদ-শিরোনাম হচ্ছে বার বার। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যধন্য, শান্ত-স্থিত, লেখাপড়া-গবেষণা-ক্রীড়া-সংস্কৃতির সাধনায় মগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হচ্ছে। শিক্ষা, গবেষণা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চা ছাড়া সব কিছুই এখানে হচ্ছে সুনিপুণভাবে।
সম্প্রতি সেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান তার বহিরাগত বন্ধু মামুনুর রশিদের সহযোগিতায় এক দম্পতিকে ক্যাম্পাসে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রাখেন। পরে মোস্তাফিজুর ও মামুন মিলে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন। এই ঘটনা জানাজানি হবার পর গত তিনিদন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবারো উত্তাল হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ ও ধর্ষকমুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য লাগাতার আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। শিক্ষকরাও যোগ দিচ্ছেন আন্দোলনে। এমন আন্দোলন অবশ্য এই বিশ্ববিদ্যলয়ে খুবই পরিচিত একটি বিষয়। ইতিহাসে এমন প্রতিবাদ এর আগেও অনেকবার হয়েছে। সবচেয়ে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে ১৯৯৮ সালে, ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিমউদদীন মানিকের ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি’র বিরুদ্ধে। বলা হয়ে থাকে মানিক সেই সময় দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে একশরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করে তা উদযাপন করেছিল। এ জন্য তার নাম হয়েছিল ‘সেঞ্চুরি মানিক’। তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশ্য ‘মানিক গ্রুপ’ ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।
মানিক ক্যাম্পাস ছাড়লেও তার প্রেতাত্মারা ঠিকই রয়ে গিয়েছিল। তাইতো কিছু দিন পর পর জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণ ও নারী লাঞ্ছনার ঘটে। আর প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো না কোনো নেতার নাম উচ্চারিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ধর্ষণ যেন সমার্থক হয়ে গেছে!
গত নয় বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বহিরাগত নারীকে শারীরিক হেনস্তার ১০টিরও বেশি ঘটনা ঘটেছে। যার সব ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও অধিকাংশই সময়েই পার পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। কারণ তাদের সবাই ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মী। অপরাধীদের অভয়স্থল হচ্ছে হলের ভিআইপি রুমগুলো! তারা একেকজন সিঙ্গেল রুম বা একাধিক রুম নিয়ে থাকেন। হলের বিভিন্ন ইস্যুতে তারাই প্রশাসনের সঙ্গে সভা করে, তারাই প্রশাসক হিসাবে ভূমিকা পালন করে!
এটা একটা আজব ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনোই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। কারণ তারা ছাত্রলীগের সমর্থন নিয়ে এখন প্রশাসন চালায়। ছাত্রলীগের সমর্থন হারালে তাদের গদি হারানোর ভয় থাকে। আর ছাত্রলীগ প্রথমে দায় অস্বীকার করে। বেশি বিপদে পড়লে অভিযুক্ত এক-দুইজনকে সামায়িক বহিষ্কার করে দায়মুক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে মনে হয় না।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ, তবু এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের কোনো অনুশোচনা নেই, কোনো ভাবান্তর নেই। যেন তারা যা করছে, যা করেছে সবই ঠিক করছে। উচিত কাজ করছে। এই সংগঠনটির যারা ‘মা-বাপ’ তারাও নির্বিকার! সন্তানের ‘বীরত্ব’ নিশ্চয়ই তাদের গৌরবান্বিত করছে! তা না হলে তারাও তো কিছু বলতেন, কিছু একটা করতেন!
বছর কয়েক আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের অপকর্ম ক্ষমতাসীনদের মাথা নিচু করে দিয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক। তাই ছাত্রলীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তার দেওয়া এই বক্তব্যের পর আমরা ভেবেছিলাম, এরপর নিশ্চয়ই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ভালো হয়ে যাবে। ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাবে, তাদের ঠিকানা হবে জেলখানা। যদিও তা হয়নি।
বছরখানেক আগে নারায়ণগঞ্জের ইসদাইরে ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে’ আয়োজিত ছাত্রলীগের এক বিশেষ কর্মীসভায় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ছাত্রলীগে লাঞ্ছনাকারী, নিপীড়নকারী, চাঁদাবাজদের কোনো স্থান নেই। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রেমিক হবে, ভালোবাসতে শিখবে৷ তারা মেয়েদের কাছে প্রেমের চিঠি লিখবে৷ তারা নিপীড়নকারী হবে না৷ একইসঙ্গে মেয়েদের ওপর যারা আঘাত ও নিপীড়ন করার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে৷
ভালো ভালো বাক্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছাত্রলীগের সভাপতির কথা, তাদের মুরুব্বি ওবায়দুল কাদেরের কথা কেউ কানে তোলেনি। ছাত্রলীগ আপন গতিতে এগিয়ে চলছে নষ্টামির যাবতীয় কর্মতিলক এঁকে। বাধাহীনভাবে। আমাদের দেশে হবুচন্দ্রের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। শিক্ষকের বদলে দলদাসকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এই দলদাসরা নিজেরে যাবতীয় অপকর্মের পক্ষে লাঠিয়াল হিসেবে পেয়ে যান ছাত্রলীগ নামের এই দলীয় গুণ্ডাবাহিনী, সেই বাহিনীকে ব্যবহার করে তারা ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করেন। প্রয়োজনে হামলা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর, শিক্ষকদের ওপরে।
গত দুই-তিন দশকে আমাদের জীবনযাত্রা, চিন্তা-মূল্যবোধ, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির ধারাও পাল্টে গেছে। রাজনীতি থেকে ক্রমে বিদায় নিচ্ছে আদর্শ। ছাত্ররাজনীতিও আদর্শহীনতার চর্চায় পরিণত হয়েছে। কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে এখন আর কেউ এসব ছাত্রসংগঠনে নাম লেখান না। কেউ কেউ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন সিটের জন্য। আর বেশিরভাগ অংশ যুক্ত হন নগদ-নারায়ণের লোভে। ছাত্ররাজনীতি এখন স্রেফ মালপানি কামাবার একটা ব্যবস্থা। আর মালপানি এমনি এমনি আসে না, আনতে হয়। এর উৎস হচ্ছে চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি। এগুলো করতে হলে ক্ষমতা এবং প্রভাব লাগে। এর জন্য চাই ক্ষমতাসীন দলে নাম লেখানো।
ক্ষমতাসীন দলে নাম লেখালে যে কেউ চাঁদা দিতে বাধ্য। কোনো বিনিয়োগ ছাড়া উপার্জনের এমন সুন্দর ব্যবস্থা ছেলেমেয়েরা ছাড়বে কেন? তাই অন্য সব সংগঠনের মিছিল ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হলেও ছাত্রলীগের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এর কারণ টাকা। সবাই ছাত্রলীগ করতে চায় কেন? ছাত্রলীগে এত কোন্দল কেন? ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়ত সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন কেন? অল্পকিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সবাই গাড়ি-বাড়ি ব্যাংক ব্যালান্স করছেন কীভাবে? ছাত্রলীগের নেতা হেলিকপ্টার ভাড়া করে ট্যুরে যান কীভাবে? বিলাসী জীবনযাপন করেন কীভাবে? এর একমাত্র কারণ টাকা। নগদ অর্থ ছাত্রলীগকে এবং একই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিকে গ্রাস করেছে। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পারভারসান।
বাঘ নাকি একবার নরমাংসের স্বাদ পেলে নরখাদক হয়ে যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও টাকার স্বাদ পেয়ে এখন টাকাখেকো হয়ে গেছেন। তাদের অন্তরে এখন টাকা ছাড়া কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু, জননেত্রী কেবলই ঢাল, আসল মোহ টাকা। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ছাত্র-অধিকারের কোনো ইস্যু নেই। নেই কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যু। এখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগে নাম লেখান পদ-পদবির আশায়। এরা এক ধরনের সিন্ডিকেট রাজনীতি করেন। সিন্ডিকেট রাজনীতি হলো ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানানো। তারা ছাত্ররাজনীতির চরিত্রই বদলে দিয়েছেন। এখন ছাত্রনেতারা অনেকেই নিজস্ব গাড়িতে চলাফেরা করেন। এই গাড়ি কেনা বা রক্ষণাবেক্ষণের টাকা তারা কোথায় পান, সে প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করেন না। ছাত্রনেতাদের বেশিরভাগেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এখন হয় তাদের নিজস্ব বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থাকে নয়তো এ ধরনের কোনো বাসায় তারা ভাড়া থাকেন।
২০০৯ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আর এই সময়ে সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যেসব বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্ম দিয়েছেন তা সংগঠনটির অতীত গৌরব এবং অর্জনের ওপর কালিমা ফেলেছে। একজন ছাত্রলীগকর্মী হবে আর দশজন মানুষের ভরসা। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। নারীর নিরাপত্তার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল হবে। অথচ এখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারাই নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বেশি। তারা ইচ্ছেমতো, ধর্ষণ করছে, হয়রানি করছে। গণমাধ্যমে আর এসব ঘটনার কয়টা প্রকাশিত হয়?
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধর্ষণ করছে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়াচ্ছে. জড়াচ্ছে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে। অন্য শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজেও লিপ্ত হচ্ছে তারা। বিরোধীদের হল ও ক্যাম্পাস থেকে বের করে তো দিচ্ছেই এমনকি শিক্ষকদের ওপরও হামলা করতে ছাড়েনি এই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। কোথাও কোনো বাধা নেই, প্রতিকার নেই। নেই সাংগঠনিক কোনো উদ্যোগ, প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা।
প্রশ্ন হলো, এত সমালোচনার পরও কেন ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাদের দমন করা হচ্ছে না? তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না?