যে যার ধর্ম পালন করবে, কোনো বিদ্বেষ নয়, হিংসা নয়, ভালোবাসা ও প্রীতির বন্ধনে একে অপরের সম্মানের ভিত্তিতে। তাই প্রকৃত সর্বজনীনতা। এই সর্বজনীনের অঙ্গ হবার সুযোগ আজ আর সুলভ নয়, এখন ব্যক্তিনাগরিকের দৈনন্দিন জীবন বহুলাংশে আপন আপন বিচ্ছিন্ন বলয়েই অতিবাহিত হয়।
Published : 12 Oct 2024, 07:00 PM
মানুষ যখনই বিপদে পড়েছে, অসহায় অনুভব করেছে, কখনই কোনো এক কল্পিত শক্তির কাছে পরিত্রাণ চেয়েছে। নিজের কল্যাণকামনায় এবং অপশক্তি বধে মানুষ যুগে যুগে নানা দেব-দেবীর কল্পনা করেছে। দুর্গাও তেমনই এক দেবী। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দুর্গা যেমন অসুরবিনাশী দেবী, তেমনি তিনি দুর্গতিনাশিনী, যিনি জীবের দুর্গতি নাশ করেন। দেবী দুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তার এই জয়ের মধ্য দিয়ে অশুভ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল।
পুরাণ মতে, ‘দুর্গম’ নামে এক অসুর ছিল। তার কাজ ছিল জীবজগতের জন্য দুর্গতি সৃষ্টি করা। যে দেবী সেই দুর্গম অসুরকে বধ করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবতাদের হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং জীবজগৎকে চিরকাল দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। ভারতবর্ষের বাঙালি হিন্দু মানসে দুর্গা প্রতিবাদের দেবী, প্রতিরোধের দেবী। একই সঙ্গে তিনি ‘মাতৃরূপেণ’ ও ‘শক্তিরূপেণ’। এ উৎসব শরৎকালে উদ্যাপিত হয় বলে এটিকে শারদীয় দুর্গোৎসবও বলা হয়।
দেবীর দুর্গার শুরু কোথায়? দেবীর ইতিহাস কি? সেই প্রাচীন যুগে দেবীর কনসেপ্টটা এলো কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। দেবী দুর্গার ঘটনা সবচেয়ে বিশদ ভাবে লেখা মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী-মাহাত্ম্যে’ (যাকে শ্রীশ্রী চণ্ডী বলা হয়)। অন্য সব পুরাণে দেবীকে পাওয়া যায় অন্যভাবে!
তবে দুর্গা— এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে দেবীমূর্তি, তার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যারা সেকেলে নিয়মে প্রতিমা বানান, তাদের প্রতিমার পেছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুরদেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যারা আধুনিক, তারা প্রতিমার মাথার উপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছরের পর বছর ধরে দেখে আমরা অভ্যস্ত।
বর্তমানে যে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়, এই উৎসবকে অনেকে রামায়ণে বর্ণিত দুর্গা পূজার রূপ বলে মনে করেন। মা দুর্গার অকালবোধন এবং এর রামায়ণ যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। অযোধ্যাপতি রাম ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। ১৪ বছর বনবাসকালে তার স্ত্রী সীতাকে দৈত্যরাজ রাবণ অপহরণ করেন। রাবণের কবল থেকে সীতাকে মুক্ত করার জন্য রাম দৈত্য রাজা বধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভগবান রামচন্দ্র রাবণের প্রাণনাশে সাফল্য অর্জনের জন্য দেবী দুর্গার কৃপা কামনা করেন ও সেজন্য তিনি আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। ঐতিহ্যগতভাবে দেবী দুর্গা বসন্ত ঋতুতে পূজিত হতেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রামচন্দ্র শরৎ ঋতুতে দেবীর আশীর্বাদের জন্য প্রার্থনা করেন। যদিও শরৎকাল দেবদেবীদের ঘুমের সময় বলেই পরিচিত। কারণ, এসময় দিন ছোট ও রাত বড় হয় এবং রাত সাধারণত রাক্ষস জাতির পরিচায়ক বলে গণ্য করা হয়।
প্রথা অনুযায়ী দেবী দুর্গার অষ্টমীবিহিত সন্ধিপূজায় ১০৮টি নীল পদ্মের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও রামচন্দ্র শুধু ১০৭টি পদ্মের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। এসময় নিরুপায় হয়ে তিনি ১০৮তম পদ্মস্বরূপ তার নিজের চোখ উপড়ে নিতে উদ্যত হন। কথিত আছে যে, পতিতপাবন রামের চোখকে নীল পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হত বলে তার অপর নাম ছিল ‘পদ্মলোচন’। যাহোক, মা দুর্গা রামের একনিষ্ঠতা দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং রামের সামনে আবির্ভূতা হন এবং দৈত্যরাজ রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করেন। মা দুর্গার এই অসময়ে আবাহন বাংলায় ‘অকালবোধন’ হিসাবে পরিচিত হয়। তারপর থেকেই শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা প্রচলিত হয়। শরৎকালীন দুর্গাপূজা শারদোৎসব নামে পরিচিত হয় এবং সমস্ত বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বৃহদাকারে পালিত হয়। বসন্তকালীন দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত যা ঐতিহ্যগতভাবে মূল দুর্গাপূজা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের উন্মাদনায় তা প্রায় হারিয়ে গেছে।
বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে যে অন্তর্নিহিতভাবে সর্বপ্রাণবাদী, নারী তথা মাতৃচরিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে, দুর্গাপূজার মধ্য দিয়ে তা ফুটে ওঠে। এই গুণাবলি যতটা ধর্মীয় বিশ্বাস, ততটাই সংস্কৃতির প্রাণরসে ঋদ্ধ। দুর্গাপূজা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও সব ধর্মের মানুষ এর আনন্দ ভাগ করে নেয়। শত শত বছর ধরে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান যেমন পাশাপাশি বসবাস করে আসছে, তেমনি তারা একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিয়ে সেই সামাজিক সম্প্রীতি আরও সুদৃঢ় করেছে। এটাই বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য।
এ বছর বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। এক শ্রেণির মানুষের সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা, প্রতিমা ভাঙচুর, গুজবসহ বিভিন্ন কারণে পূজার নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারিভাবে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সবাই তা মেনে নিয়েছেন। তারপরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আশা থাকবে, ভবিষ্যতে কোনো রকম বিধিনিষেধ ছাড়াই এ দেশের সব ধর্মের ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিজ নিজ উৎসব উদ্যাপন করবে। উৎসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য আরও শক্তিশালী হবে।
সপ্তমীতে যে পূজা শুরু, দশমীতে তা শেষ হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, দশমীতে স্বামীগৃহে ফিরে যান উমা। 'দশমী' কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আবেগ ও মনখারাপ মিশ্রিত একটি অনুভূতি। দশমী এলেই বাঙালির মনে আসে মায়ের ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে পিতৃগৃহ ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে পাড়ি দেন দেবী। সেই কারণেই এই তিথিকে 'বিজয়া দশমী' বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনি মতে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিলেন মা দুর্গা। তাই তাকে 'বিজয়া' বলা হয়।
সর্বজনীন দুর্গোৎসবের প্রধান চেতনা মিলিত হওয়া। সব কিছুই একত্রে মেলানো। যদিও বাস্তবে সব মিলছে না। সর্বজনীন প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন হয়ে উঠছে না। এক বৃহৎ আপাত-সর্বজনীনের মাঝে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট সর্বজনীনের বৃত্ত। বিভিন্ন দলের, মতের, ধর্মের, মধ্যবিত্তের, উচ্চ-মধ্যবিত্তের, নিম্নবিত্তের, দরিদ্রদের, নেতা-মন্ত্রী ও সাঙ্গোপাঙ্গদের, মফস্বলের, গ্রামের... বহু সর্বজনীন পাশাপাশি থাকছে, কিন্তু এক যথার্থ বৃহৎ সর্বজনীন তৈরি হচ্ছে না। এবং এই ছোট সর্বজনীনগুলো নিজের বৃত্তের সর্বজনীনতার আনন্দটুকু নিয়েই তৃপ্ত, একে অপরের প্রতি উদাসীন। বস্তুত, পরস্পর সম্পর্কে হয়তো বা তাদের মনে কাজ করে ঔদাসীন্য, ক্রোধ, বিরক্তি ইত্যাদি নানা নেতিবাচক অনুভূতি। এত অপছন্দ সত্ত্বেও, পূজার সময় সব সর্বজনীন পাশাপাশি অবস্থান করে। কিন্তু মিলতে পারে না।
মিলতে পারা সত্যই কি অসম্ভব? মিলতে পারাই কি স্বাভাবিক নয়? সকলের আনন্দ থেকে আপন আনন্দ সংগ্রহ করে নেয়াই কি প্রকৃত সামাজিকতা নয়? সমাজকাঠামোটি কিন্তু সর্বজনীন সহাবস্থানের ভিতেই দাঁড়িয়ে আছে। শারদোৎসব সেই সহাবস্থানকে অনিবার্য করে তোলে।
বহু মানুষই এখন নিজস্ব গণ্ডির সুখে ও দুঃখে মশগুল, বৃহত্তর সমাজ সম্পর্কে তারা আগ্রহী নন, বস্তুত ওয়াকিবহালই নন। তারা দৈনন্দিন আনন্দের নিজস্ব বৃত্তটিকেই সত্য বলে বিশ্বাস করতে চান, তার দেখনদারিই তাদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, তাদের আনন্দ মনের উপরিতলেই ভাসতে থাকে। গভীরে প্রবেশ করে না। কিন্তু নিজ অনুভূতির শিকড়ে না পৌঁছালে সেই অনুভূতি পূর্ণতা পায় না। শিকড় মানে দুর্গাপূজাকে হিন্দু-ঐতিহ্যের পরাকাষ্ঠা হিসেবে দেখা এবং দেখানো নয়, আপনার গভীর অনুভূতির কাছে সৎ থাকা। তার জন্য প্রয়োজন অন্যের মনের সঙ্গে নিজের মানসিক সংযোগ রচনা করা। নিজ ধর্মমতকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণার মধ্যে সমস্যার সমাধান নেই। অন্য ধর্মকেও সুন্দর বলে স্বীকার করে নেওয়া। যে যার ধর্ম পালন করবে, কোনো বিদ্বেষ নয়, হিংসা নয়, ভালোবাসা ও প্রীতির বন্ধনে একে অপরের সম্মানের ভিত্তিতে। তাই প্রকৃত সর্বজনীনতা। এই সর্বজনীনের অঙ্গ হবার সুযোগ আজ আর সুলভ নয়, এখন ব্যক্তিনাগরিকের দৈনন্দিন জীবন বহুলাংশে আপন আপন বিচ্ছিন্ন বলয়েই অতিবাহিত হয়। দুর্গাপূজার কয়েকটি দিন সেই বলয়গুলো পরস্পরকে স্পর্শ করবার সুযোগ পায়। সেই সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার আমরা কখনোই করতে পারব না?