ঘূর্ণিঝড় মোখা আসছে, মিয়ানমারেও সরানো হচ্ছে উপকূলবাসীকে

রাখাইনসহ মিয়ানমারের তিন রাজ্যের ২০ লাখ মানুষ ঝড়ের কবলে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে জিডিএসিএস।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2023, 09:34 AM
Updated : 13 May 2023, 09:34 AM

বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাত হানার আগে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি একই জোর প্রস্তুতি চলছে মিয়ানমারেও।

সাগরে গভীর নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পরই মিয়ানমারের জন্য রেড এলার্ট জারি করে ‘দ্য গ্লোবাল ডিজাস্টার অ্যালার্ট অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশন সিস্টেম’ (জিডিএসিএস)। দেশটির রাখাইন, সাগাইং ও ম্যাগওয়ে রাজ্যের প্রায় ২০ লাখ মানুষ এই ঝড়ের কবলে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সামরিক অভিযানে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়া রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ায় মঙ্গলবার থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে সেখানে।

মিয়ানমারের ডিপার্টমেন্ট অব মেটিওরোলোজি অ্যান্ড হাইড্রোলজি তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি রোববার কিউকফিউ শহরতলীর উপকূলীয় এলাকায় পৌঁছাতে পারে। তখন বাতাসের গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ মাইল।

ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা আগে থেকেই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে মোখার আঘাতে সেখানে ‘চরম মানবিক প্রভাব’ পড়তে বলে সতর্ক করেছে আবহাওয়া বিভাগ।

ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের হিসাব দিয়ে ইরাবতী জানিয়েছে, মিয়ানমার জান্তার সামরিক দমন-পীড়নে ইতোমধ্যে সাগাইং অঞ্চলের ৬ লাখ ২৪ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ম্যাগওয়েতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ জন।

জান্তা সৈন্যরা স্থানীয় গ্রুপ ও মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর প্রতিরোধ দুর্গগুলো ধ্বংসে ‘ফোর-কাট’ কৌশলের আওতায় ওই দুই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে আক্রমণ ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তাতমাদও’ নামেও পরিচিত। ১৯৬০ এর দশকে কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা এবং অস্ত্রধারী পুরনো জাতিগোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের সঙ্গে লড়াইয়ে এই ‘ফোর-কাট’ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল দেশটির তখনকার সেনাবাহিনী। এই কৌশলের মাধ্যমে মূলত বিদ্রোহী স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর খাবার, অর্থ সংস্থান বা ফান্ড, তথ্য এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়, যার ফলাফল হয় ধ্বংসাত্মক।

পুরনো কৌশলে সামরিক জান্তার এই দমন-পীড়নের মধ্যে রাখাইনে ঘূর্ণিঝড় মোখা আরও বিপর্যয় নিয়ে আসছে। গ্রাম প্রশাসক উ থান ইরাবতীকে জানান, রাখাইনের পাউকতাও শহরতলী এবং এনগাপি দ্বীপের চার শতাধিক বাসিন্দা কিয়েন কে মাও গ্রামের মঠে আশ্রয় নিচ্ছেন।

“গ্রামের মঠে বুধবার ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ এসেছে। পরদিন আরও অনেকে আসেন। যতদূর পারি গ্রামে আমরাও অনেক প্রস্তুতি নিয়েছি।”

রাখাইনের রাজধানী সিত্তের বিপরীতে অবস্থিত থাইখোন দ্বীপের বাসিন্দারাও পাকতাও ও সিত্তও শহরের উদ্দেশে তাদের বাড়িঘর ছেড়েছেন। ঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে জেলেরা তাদের ট্রলার সিত্তেতে নিরাপদে রেখেছেন।

সিত্তের দোকানগুলো তাদের মজুদ মালামাল নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছে। এই মুহূর্তে কিছু পণ্যের দামও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সুশীল সমাজ সংগঠনের সদস্য ইউ সোয়ে নাইং।

রাখাইনের প্রাক্তন আইনপ্রণেতা ইউ পো সান বলেন, কিয়াউকতাওয়ে আসন্ন ঘূর্ণিঝডড়ের বিষয়ে সতর্কতা জারি করছে কর্তৃপক্ষ। ওয়ার্ডগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো চলাচল করছে এবং ঝড়ের বিষয়ে সতর্ক করছে৷ শহরের বাসিন্দারা সতর্ক রয়েছে।

উত্তর রাখাইনের সীমান্তবর্তী চিন রাজ্যের পালেতোয়াতেও কর্তৃপক্ষ ঝড়ের সতর্কতা জারি করেছে। সেখানকার বাসিন্দা কো হতান পেইং ইরাবতীকে বলেন, “রেডিওতে প্রচারিত আবহাওয়ার খবর থেকে বাসিন্দারা ঝড়ের খবর জানছে। ফায়ার সার্ভিস বিভাগ জনগণকে তাদের বাড়ি ও গীর্জাকে সুরক্ষিত করার আহ্বান জানিয়েছে। লোকজন খুব বেশি প্রস্তুতি নেয়নি।”

জিডিএসিএস পূর্বাভাস, ঘূর্ণিঝড়টি রোববারের মধ্যে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং কিয়াউকফিউয়ের উপকূল অতিক্রম করবে। তখন বাতাসের গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ১০০ মাইল বা ১৬০ কিলোমিটার। এই ঝড়ের কবলে পড়বে রাখাইনের ৯ লাখ ৩০ হাজার মানুষ।

মিয়ানমারের আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা রাখাইনের রাজধানী থেকে ৪০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত সিত্তে এবং রাথেডংয়ের মধ্যে একটি পথ নিয়ে অতিক্রম করবে। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিতে শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে- সিত্তে, রাথেডাং, বুথিডাং, মংডু, মাইবোন, পোন্নাগিউন ও ম্রাউক-উ।

মিয়ানমারের সংবাদপত্র দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার জানিয়েছে, রাখাইনের মংটাও শহরতলীর কর্মকর্তারা শহরের কেন্দ্রে ও গ্রামাঞ্চলে বাসিন্দাদের দুর্যোগের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

জেলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্বাবধানে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মকর্তারা ঝড়ের কারণে বন্যা ও ভূমিধস হলে আগে থেকেই বাসিন্দাদের প্রস্তুতি নিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে বলেছেন। দুর্যোগের খবরগুলোও শোনার জন্য তাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় রাখাইনে নেওয়া পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা পরিদর্শন করেছেন মূখ্যমন্ত্রী ইউ হেতেন লিন। বৃহস্পতিবার রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রী ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সিত্তও শহরের যেসব এলাকায় ঝড় আঘাত হানতে পারে, সেখানে তদারকি করেছেন। যাত্রীবাহী নৌযান, ট্রলার ও ফেরিগুলোও পরিদর্শন করেন তিনি।