ব্ল্যাক হক, হামভি: অত্যাধুনিক যেসব যুদ্ধাস্ত্র এখন তালেবানের হাতে

কান্দাহার বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের বানানো আইকনিক একটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ওড়ানোর চেষ্টা চলছে, তালেবান যোদ্ধারা সেদিকে তাকিয়ে আছেন- সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে এমন দৃশ্যই।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2021, 12:24 PM
Updated : 29 August 2021, 12:25 PM

বহুবিধ কাজে ব্যবহারযোগ্য চার পাখার এই এয়ারক্রাফটটিকে কেবল টারমাকের চারপাশে পাক খেতে দেখা গেলেও এটি একই সঙ্গে বিশ্বকে একটি বার্তাও দিয়ে দিয়েছে। তা হল- তালেবান এখন আর ভাঙাচোরা পিকআপ ট্রাকে চড়া কালাশনিকভ বন্দুক হাতে থাকা আগের সেই যেন তেন যোদ্ধাদের গোষ্ঠী নয়; তাদের হাতে এখন এমন অনেক সামরিক সরঞ্জাম আছে, যা অনেক দেশের নিয়মিত সেনাবাহিনীরও নেই।

চলতি মাসের মাঝামাঝি কাবুল দখলের পর একাধিক ছবিতে তালেবান যোদ্ধাদেরকে তাদের হাতে আসা যুক্তরাষ্ট্রের বানানো অস্ত্র ও যানবাহন দেখাতেও দেখা গেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা বিভিন্ন পোস্টে অনেক তালেবান যোদ্ধাকে দেখা গেছে পূর্ণাঙ্গ সামরিক সাজে, যাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ বাহিনীর যোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। সেসব ছবিতে ছিল না তালেবান যোদ্ধাদের লম্বা দাড়ি কিংবা তাদের ঐতিহ্যবাহী সালোয়ার-কামিজ পোশাক, ছিল না জং ধরা পুরনো সব অস্ত্রও।

আফগান জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনী যখন দেশটির একের পর এক শহরে আত্মসমর্পণ করছিল, তখন তালেবানরা তাদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র জব্দের সুযোগ পায়। পায় হামভি ট্রাক ও ব্ল্যাক হকের মতো হেলিকপ্টার।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বলছেন, এখন তালেবানরাই পৃথিবীর একমাত্র উগ্রপন্থি গোষ্ঠী,যাদের একটি বিমান বাহিনীও থাকছে।

তালেবানের হাতে কতগুলো এয়ারক্রাফট এখন?

চলতি বছরের জুনের শেষদিকেও আফগান বিমানবাহিনীর কাছে হামলায় ব্যবহারযোগ্য হেলিকপ্টার ও বিমানসহ মোট ১৬৭টি এয়ারক্রাফট ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশনের (সিগার) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল।

তবে এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত কতগুলো তালেবানের হাতে পৌঁছেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। 

১৬ জুলাই তোলা উপগ্রহের এক ছবিতে কান্দাহার বিমানবন্দরে ৯টি ব্ল্যাক হক, দুটি এমআই--১৭ ও ৫টি ফিক্সড উইং বিমানসহ মোট ১৬টি এয়ারক্রাফট দেখা গিয়েছিল।

শহরটি তালেবান নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার ৬ দিন পর তোলা উপগ্রহের আরেকটি ছবিতে বিমানবন্দরে দেখা গেছে দুটি ব্ল্যাক হক, দুটি এমআইসহ ৫টি হেলিকপ্টার। এর মধ্যে তৃতীয়টি ইউএইচ-৬০ হেলিকপ্টার হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন দিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সামরিক বিমান বিশেষজ্ঞ আঙ্গাদ সিং।

তালেবানের দখলে এখন হেরাত, খোস্ত, কুন্দুজ ও মাজার-ই-শরীফসহ আফগানিস্তানের বাকি ৯টি বিমানঘাঁটিও।

এসব ঘাঁটি থেকে মনুষ্যবিহীন ড্রোন এবং এয়ারক্রাফট জব্দের ছবি দিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম ও তালেবান যোদ্ধার।

স্বতন্ত্র কিছু ওয়েবসাইটেও কিছু কিছু এয়ারক্রাফটের অবস্থান জানানো হয়েছে। 

তবে আফগান বাহিনীর অনেক এয়ারক্রাফট যে তালেবানের হাতে পড়ার আগেই অন্যত্র উড়িয়ে নেওয়া হয়েছে তারও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ১৬ অগাস্ট তোলা উপগ্রহের এক ছবিতে উজবেকিস্তানের তিরমিজ বিমানবন্দরে এমআ ই-১৭, এমআই--২৫, ব্ল্যাক হকসহ দুই ডজনের বেশি হেলিকপ্টার এবং একাধিক এ-২৯ লাইট-অ্যাটাক ও সি-২০৮ এয়ারক্রাফট দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে রাজি না হওয়া দিল্লিভিত্তিক এক সামরিক বিমান বিশেষজ্ঞ।

তিরমিজ বিমানবন্দরে এসব হেলিকপ্টার ও এয়ারক্রাফট আফগান বিমান বাহিনীরই ছিল বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিষয়ক থিঙ্কট্যঙ্ক সিএসআইএস এর বিশেষজ্ঞরা।

এসব এয়ারক্রাফট পেলেও তালেবানরা শেষপর্যন্ত সেগুলো ব্যবহার করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেকেই সন্দিহান।

ধারণা করা হচ্ছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা হয়তো আফগান বিমানবাহিনীর অনেককে তাদের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এয়ারক্রাফটগুলোর যন্ত্রাংশ, আধুনিকায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তারা বিপাকে পড়বে।

তবে ব্ল্যাক হক না হলেও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তাদের বানানো এমআই -১৭ ব্যবহারে তালেবানের অতটা বেগ পেতে হবে না বলেই অনেকে ধারণা করছেন।

এয়ারক্রাফট বাদ দিলে কট্টরপন্থি এ ইসলামী গোষ্ঠীটি অবশ্য আগে থেকেই অত্যাধুনিক বিভিন্ন বন্দুক, আগ্নেয়াস্ত্র ও সাঁজোয়া যানের সঙ্গে পরিচিত।

আফগানিস্তানের দুই দশক মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর উপস্থিতির কারণে দেশটিতে এসব সরঞ্জাম প্রচুর এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আফগানিস্তান ছাড়ার ঘোষণা আসার আগেই বিভিন্ন টহল পোস্ট বা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে তালেবান অনেক অস্ত্র জব্দ করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকেও তারা এ ধরনের অনেক অস্ত্র পেয়েছে। পেয়েছে নাইট ভিশন গগলসের মতো সরঞ্জামও।

২০০৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সেনাসদস্যদের পাশাপাশি বিপুল সমরাস্ত্রও নিয়ে যায়, এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির বানানো ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩০টি রাইফেল, ৬৪ হাজারের বেশি মেশিনগান, ২৫ হাজার ৩২৭টি গ্রেনেড লঞ্চার এবং ২২ হাজার ১৭৪টি হামভি ট্রাক ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।

২০১৪ সালে নেটোবাহিনী আফগানিস্তানে যুদ্ধের দায়িত্ব ছেড়ে দেয় আফগান সেনাবাহিনীর হাতে। আফগানদের নিয়ে গড়া এই বাহিনী তালেবানের সঙ্গে লড়াইয়ে সুবিধা করতে না পারায় যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র দেয়ার পাশাপাশি পুরনো অস্ত্রগুলোও বদলে দেয়।

ওয়াশিংটন কেবল ২০১৭ সালেই আফগান বাহিনীকে ২০ হাজার এম১৬ রাইফেল দিয়েছে; পরবর্তী বছরগুলোতে অন্য সরঞ্জামের পাশাপাশি অন্তত ৩ হাজার ৫৯৮টি এম৪ রাইফেল ও ৩ হাজার ১২টি হামভি যান দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সিগার।

আফগান বাহিনীর কাছে দ্রুতগতিতে হামলায় ব্যবহারযোগ্য যানও ছিল।

এসব সরঞ্জামের বড় অংশই এখন তালেবানের হাতে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে আফগানিস্তানের নতুন এ শাসকগোষ্ঠী এসব অস্ত্র, সরঞ্জামের কিছুটা অংশ ব্যবহার করতে পারলেও, এর একটা অংশ শেষ পর্যন্ত কালোবাজারে বিক্রি হতে পারে বলে অনেকে সন্দেহ করছেন।

তালেবানরা নিজেদেরকে আগের চেয়ে উদার এবং তুলনামূলক বেশি দায়িত্বশীল হিসেবে হাজির করলেও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তাদের আদর্শিক মিত্রদের কাছে এসব অস্ত্র চলে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়।

তালেবান জোটের মধ্যে থাকা অনেক ছোট-বড় উপদল মতের অমিল হলে জোট ছেড়ে চলে যেতে পারে, সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে তাদের কাছে থাকা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রগুলোও।

তালেবান নেতৃত্ব এখন এসব শঙ্কা মোকাবেলায় এবং তাদের হাতে থাকা অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে কী করে, তাই দেখার বিষয়, বলেছেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল পলিটিকস অ্যান্ড সিকিউরিটির অধ্যাপক জোডি ভিটোরি।