চীন সীমান্তে সংঘর্ষে ২০ সেনা নিহত, বলল ভারত

লাদাখে ভারত-চীন সীমান্তে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ২০ সেনা নিহত হয়েছে বলে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে।

>>রয়টার্স
Published : 16 June 2020, 09:21 AM
Updated : 17 June 2020, 09:40 AM

মঙ্গলবার ভারতের পক্ষ থেকে প্রথমে তিন সেনা নিহত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। পরে এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী বলেছে, “সংঘর্ষে নিহত এক সেনা কর্মকর্তা ও দুই সৈনিকের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর আহত আরও ১৭ সেনা মারা গেছে।”

সংঘর্ষে গোলাগুলি হয়নি। পাথর এবং রড নিয়ে মারামারিতেই প্রাণহানি ঘটেছে বলে এর আগের খবরে জানিয়েছিল সেনাবাহিনী।

কয়েক পাঁচ দশকের মধ্যে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এটাই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় ঘটনা।

বার্তা সংস্থা এএনআই এক সূত্রের বরাত দিয়ে ৪৩ জন চীনা সৈন্যের হতাহতের খবর দিলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

সংঘাতে প্রাণক্ষয় নিয়ে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চীনা সংবাদমাধ্যমগুলো অনেকটাই নীরব। সিনহুয়ার খবরে বলা হয়েছে, চীনা সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ‘আলোচনার সঠিক পথে’ ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।  

হিমালয় পর্বতের পশ্চিমাংশের লাদাখে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত ও চীনের সামরিক বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আছে। এর আগে দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হলেও রক্তপাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এবারের সংঘর্ষের ঘটনাটি লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সোমবার রাতে ঘটেছে বলে বিবৃতিতে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। দুই পক্ষের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করেছেন বলেও জানায় তারা।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতকে একতরফা কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে ঝামেলা আর না বাড়াতে বলেছে। চীনের দাবি, ভারতীয় সেনারাই প্রথম হামলা চালিয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “১৫ জুন ভারতীয় পক্ষ দুবার সীমান্ত লঙ্ঘন করে উস্কানি দিয়েছে এবং চীনা সেনাদের আক্রমণ করেছে। এ থেকেই দুই সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়।”

ওদিকে, চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ বলছে, চীনা বাহিনীতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

যদিও চীনা সেনা নিহত না আহত হয়েছে সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেনি তারা।

হিমালয় পবরতের পশ্চিমাংশের লাদাখে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত ও চীনের সামরিক বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স

কী বলছে দুই পক্ষ?

লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত এবং চীনের সংঘর্ষে মঙ্গলবার প্রাথমিকভাবে এক সেনা কর্মকর্তা ও দুই সেনা নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছিল ভারতের সেনাবাহিনী। 

পরের বিবৃতিতে তারা আরও ১৭ সেনা মারা গেছে জানিয়ে মোট নিহতের সংখ্যা ২০ উল্লেখ করেছে।

ভারতের কয়েকটি সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, ভারতীয় সেনাদেরকে ‘পিটিয়ে মারা’ হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী কিছু জানায়নি।

ওদিকে চীন হতাহতের কোনো ঘটনা নিশ্চিত করেনি। তবে তারা ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে।

চীনের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ঝ্যাং সুইলি ভারতীয় পক্ষকে তাদের সীমান্তের সেনাদেরকে কড়াভাবে সংযত রাখতে বলেছেন এবং সমস্যা সমাধানে আলোচনার সঠিক পথে ফিরে আসার বার্তা দিয়েছেন।

সুইলিও সংঘর্ষের ঘটনার জন্য ভারতীয় পক্ষকে সীমান্তের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের জন্য দোষারোপ করেছেন এবং ভারত ইচ্ছা করে উস্কানি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।

ভারতকে নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘন এবং কোনোরকম উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে বলে তিনি দাবি জানান।

উত্তেজনা

লাদাখের ‘লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কনট্রোল’ (এলএসি) এর সীমানা ভালভাবে নির্দেশ করা নেই। তার ওপর সেখানে নদী, হ্রদ এবং বরফে ঢাকা পর্বতের কারণে এই নিয়ন্ত্রণরেখার হেরফেরও ঘটতে পারে।

নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অনেক জায়গাতেই ভারত এবং চীনের সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে।

দুই পক্ষ জোর দিয়েই একথা বলে আসছে যে চার দশক ধরে সীমান্তে কোনো গুলি চলেনি। ভারতের সেনাবাহিনীও মঙ্গলবারের সংঘর্ষে কোনো গুলি চলেনি বলে জানিয়েছে।

তবে সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

ভারত গালওয়ান উপত্যকায় হাজার হাজার সেনা পাঠানোর অভিযোগ করেছে চীনের বিরুদ্ধে। তাছাড়া, ভারতের অংশে ৩৮,০০০ স্কয়ার কিলোমিটার চীন দখল করে আছে বলেও অভিযোগ তাদের।

গত তিন দশকে ভারত ও চীনের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনাতেও সীমান্ত সমস্যার কোনো সমাধান বেরিয়ে আসেনি।

দু’দেশের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৯৬২ সালে একটি যুদ্ধ হয়েছে। তাতে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল।

২০১৭ সালে দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়ায়। ওই বছর ডোকলাম বিরোধের পর সীমান্তে দু'দেশের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বড় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

গত মে মাসে লাদাখে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায় উত্তেজনা বাড়ে। গালওয়ান উপত্যকায় চীন এবং ভারত উভয়ই বিপুল সেনা সমাবেশ করে মুখোমুখি অবস্থান নেয়।

গালওয়ান অঞ্চলে ভারতের সড়ক ও সেতু বানানো নিয়ে চীনের ধারাবাহিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে দুইপক্ষের মধ্যে নতুন করে এ উত্তেজনার শুরু। 

নিজেদের সীমানার ভেতর ওই সড়ক স্থানীয় জনগণের জন্য বানানো হয়েছে বলে দাবি নয়া দিল্লির। অন্যদিকে, চীনের গণমাধ্যমগুলো সীমান্তে উসকানির জন্য ভারতকে দায়ী করে আসছে। 

৫ মে দু’দেশের সেনার মধ্যে সংঘর্ষের পর থেকে পূর্ব লাদাখ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ওইদিন ভারত ও চীনের সেনারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল লোহার রড, লাঠি নিয়ে। পাথর ছোড়াছুড়িও হয়েছিল।

পরে বৈঠকে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও ৯ মে উত্তর সিকিমে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুপক্ষের সেনারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর অগাস্টে ভারত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরেই ‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চীনকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করলে চীন অনেক বেশি চিন্তিত হয়ে ওঠে। তখন থেকেই ছক কষতে শুরু করে চীন।

সর্বশেষ মঙ্গলবারের সংঘর্ষের পর দুপক্ষ উত্তেজনা নিরসনে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ফল যাই হোক সংঘর্ষর এ ঘটনা ভারতে চীন-বিদ্বেষ আরও বাড়াবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।