যুক্তরাষ্ট্রে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু বাড়ছে কেন? 

স্পেন, ইতালি, জাপান এবং আরও অনেক দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি তিন গুণ বেশি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2023, 05:24 AM
Updated : 27 March 2023, 05:24 AM

সন্তান প্রসবের বেলায় ধনী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের মায়েরা।

ইউএস সেন্টার ফর ডিজিস কনট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের প্রকাশিত নতুন তথ্য বলছে, কোভিড মহামারীর মারাত্মক প্রকোপের সময়টায় দেশটিতে মাতৃমৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।

২০২১ সালে সেখানে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি লাখে ৩৩ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে, যেখানে আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৩ দশমিক ৮ জন।

কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মধ্যে মৃত্যুর এই হার দ্বিগুণেরও বেশি। সিডিসি বলছে, শ্বেতাঙ্গ নারীদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মৃত্যুর ঝুঁকি তিন গুণ বেশি।

বিশ্ব ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ফ্রান্সের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রসবকালে মাতৃমৃত্যুর হার দ্বিগুণ। আর স্পেন, ইতালি, জাপান এবং আরও অনেক দেশের চেয়ে তিন গুণ বেশি।  

২০০০ সাল থেকে এই ঝুঁকি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অথচ আরও ৩৭টি দেশে মাতৃমৃত্যুর গড় হার কমতির দিকে রয়েছে।

”এ তো স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র হিসেবের বাইরে একেবারে”, বললেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিকসের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক জোয়ান কস্তা-ই-ফন্ট।

তিনি বলেন, “কোভিড (মাতৃমৃত্যু) পরিস্থিতি আরও নাজুক করে দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এরও আগে থেকেই পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠেছিল।

”২০২১ সালে মহামারীর মধ্যে মাতৃমৃত্যু বেড়ে যাওয়া ছিল ভয়ানক ঝড়ের মত। বর্ণ বৈষ্যম্য, স্বাস্থ্যবীমায় আওতা কম হওয়া এবং বীমার খরচ বেশি হওয়ার কারণে এমন ফলাফল।”

নারীরা গর্ভকালে যত ধরনের বাধার মুখে পড়েন তার পেছনে বীমার পরিকল্পনাকে দায়ী করেন এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, ”বীমা এমন একটি সেবা হয়ে উঠেছে যা কারো প্রয়োজনে কাজে দিচ্ছে না। বিত্তবানদের জন্য দারুণ সেবা দিলেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সেবার মান খুবই খারাপ।”

যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে কোনো খরচ ছাড়াই সন্তান প্রসব করা যায়; সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার ডলার খরচ করতে হয়।

বীমা রয়েছে এমন কারো বেলাতেও গর্ভকালের পরীক্ষা ও প্রসবের পরের পরিচর্যা সেবা একেবারেই নিম্নমানের।

জোয়ান কস্তা-ই-ফন্ট বলেন, “কোভিডের সময় পরিস্থিতি আরও একটু খারাপ হয়েছিল, কিন্তু মাতৃমৃত্যু তো আমেরিকার কাঠামোগত সমস্যা।”

স্বাস্থ্যসেবার চড়া খরচ, জাতিগত ও আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে স্পষ্ট বৈষ্যম্য অনেক বছর ধরেই এই মৃত্যুহারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী রেখেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কোভিড সংক্রমিত হলে গর্ভবতী নারীদের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এই ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে যদি স্থূলতা ও ডায়াবেটিস থাকে। কারণ এসব কারণে গর্ভকালে নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে; এমনকি মৃত্যু ঝুঁকিও রয়েছে।

”যুক্তরাষ্ট্রে কম আয়ের মানুষের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি, তাদের অসুখ-বিসুখও বেশি হয়, অথচ তাদের সেবা সুবিধা কম থাকে,” বলেন কস্তা-ই-ফন্ট।

তার বলা কারণগুলো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের বেলায় আরো বেশি প্রযোজ্য বলে জানাচ্ছে বিবিসি।

কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে স্থুলতা বা অতিরিক্ত ওজনের সমস্যা বেশি দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপে ভোগার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের ২০ শতাংশ। এরপরও বীমা করা নেই এমন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের সংখ্যা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ বেশি।

সিডিসির সংজ্ঞায় মাতৃমৃত্যু মানে গর্ভকালে মৃত্যু ঘটা অথবা প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে মৃত্যু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ মাতৃমৃত্যু প্রসবের পরে হয়ে থাকে; বিশেষ করে যখন সদ্য মা হওয়া কাউকে চাপ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে আনা হয়। এতে করে নারীর প্রসব-পরবর্তী যত্নে অবহেলা হয়।    

কালো আমেরিকানদের মধ্যে অনেকেই স্বল্প আয়ের চাকরি করেন। এসব কর্মক্ষেত্র থেকে স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা দেওয়া হয় খুব কমই। মাতৃত্বকালীন ছুটিও খুব বেশিদিনের দেওয়া হয় না নারী কর্মীদের।

মহামারীর দিনে খাবার সরবরাহসহ অন্যান্য জরুরি পরিষেবাগুলো চালু রাখা জরুরি হয়ে উঠেছিল। আর কর্মীদের পক্ষে এসব বাসায় বসে করা সম্ভব ছিল না। ফলে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ গড়ে গিয়েছিল। 

এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ না মেলায় মৃত্যুহার বাড়তে থাকে। 

হোয়ার্ড ইউনিভার্সিটি এবং উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা গর্ভকাল ও ম্যাটারনাল-কোয়েটাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রোচান্ডা মিচেল বলেন, ”নারীরা বলছেন, ‘আমি আসতে পারছি না, রক্তপাত হচ্ছে, মাথাব্যথা হচ্ছে; আমার স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা নেই।”

তিনি বলেন, ”গর্ভকালে সবাই কর্মক্ষেত্রে আসছে, উৎসব করছে মাতৃত্ববেলার। কিন্তু প্রসবের পর যদি বেশিরভাগ মায়ের মৃত্যু হয়, তাহলে তো আমাদের ওই সময় যত্ন দরকার।”

স্বল্প আয়ের কর্মীদের জন্য একটি বীমা কার্যক্রম দাঁড় করানো না গেলে অনেক গর্ভবতী তার প্রথম দিকের স্বাস্থ্য ঝুঁকির উপসর্গগুলো আমলে না নিতে বাধ্য হবেন।

”এমনকি যাদের স্বাস্থ্যবীমা রয়েছে, তাদেরকেও চড়া খরচের জন্য প্রসবের পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে নিরুৎসাহিত করা হয়। অপেক্ষা করতে হয় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য; কিন্তু ততক্ষণে হয়ত বড্ড দেরি হয়ে গেছে,” বললেন রোচান্ডা মিচেল।

পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বড় রকমের সংস্কার না হলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে না। 

“এক কথায় পরিস্থিতি বোঝানো খুব কঠিন। আমার মনে হয় যেসব উদাহরণ ও বৈষ্যম্য আমরা দেখছি, তা মূলত স্বাস্থ্যখাতের বড় দুরবস্থার খণ্ড চিত্র।”