এন্ডোমেট্রিওসিস: টিভি চিত্রায়নে নারীর অসহ্য যন্ত্রণা

ক্রিস্টি মিলার তখন ১১ বছরে পা রেখেছে যখন তার পিরিয়ড শুরু হল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2022, 12:55 PM
Updated : 13 June 2022, 01:19 PM

”প্রত্যেক মাসে আমার রক্তরক্ষণ হত, বমি হত। আমি না খেতে পারতাম, না ঘুমাতে। কোনো কাজই করতে পারতাম না,” বলেন তিনি।

”আমার মনে হত আমি মরে যাচ্ছি, অথচ কেউ কোনো তোয়াক্কা করছে না।”

এর দশ বছর পর এন্ডোমেট্রিওসিস ধরা পড়ে ক্রিস্টি মিলারের। এন্ডোমেট্রিওসিস একটি ক্রনিক অসুখ, যাতে শরীরের প্রজনন অঙ্গের কোষস্তরে বেড়ে উঠতে থাকে।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, এ অসুখে মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, যৌন সংসর্গে ব্যথা হয়, তলপেটে ক্রমাগত ব্যথা হতে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে সন্তান ধারণ সম্ভব হয় না আর।

ক্রিস্টির উপসর্গগুলোই ফ্রান্সিসের অভিজ্ঞতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্যালি রুনির উপন্যাসের ভিত্তিতে নির্মিত টিভি সিরিজ ’করভারসেশন উইথ ফ্রেন্ডন্স’ এ।

সেখানে দেখা যায়, এন্ডোমেট্রিওসিসের যন্ত্রণায় ফ্রান্সিস কখনও বাথরুমে পড়ে কাতরাতেন, কখনো ভিড়ের মাঝেই জ্ঞান হারাতেন।

টিভি সিরিজটি দেখার পর ক্রিস্টি বলেন, “আমি এই প্রথম এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে পর্দায় চিত্রায়িত হতে দেখলাম। আমার মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি কাজ করছিল। সেখানে একটা চরিত্র আমার কষ্টগুলোকেই তুলে ধরছিল।”

চিকিৎসক ফিওনা রেইডি একজন গাইনোকলজিস্ট এবং এন্ডোমেট্রিওসিস বিশেষজ্ঞ। ক্রনিক অসুস্থতা নিয়ে এ টিভি সিরিজ নির্মাণে তিনি নানা পরামর্শ দিয়েছেন নির্মাতা টিমকে।

ফিওনা রেইডি বিবিসিকে বলেন, “যন্ত্রণাময় এই এন্ডোমেট্রিওসিস কিন্তু বিরল কোনো রোগ নয়। একশ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জন নারীর এ সমস্যায় ভুগতে হয়। এই অসুখ একবার হলে নারীর জীবনযাপনে গুরুতর প্রভাব ফেলে।

“যদিও এ রোগ কেন হয় তা নিয়ে খুব ভালো ধারণা আমাদের এখনও নেই। এখনও গবেষণা চলছে এবং যথেষ্ট তহবিলও নেই। নারীরা আসলে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিতই রয়েছে।”

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রেইডি বলেন, এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত অনেক নারীর বেলায় শুরুর দিকে তাদের উপসর্গগুলোকে গুরুত্ব দেন না চিকিৎসকরা; একথা নারীরাই জানিয়েছেন।

অসুখ ধরতে ধরতেই গড়ে আট থেকে নয় বছর লেগে যায়; যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে তেমনটাই হচ্ছে।

“এখন এন্ডোমেট্রিওসিস শনাক্ত করার উপায় মানেই হচ্ছে অস্ত্রোপচার। অথচ এই অসুখ অস্ত্রোপচার ও ওষুধ দুটো দিয়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব। যদিও সেরে ওঠার মত চিকিৎসা এখনও নেই,” বলেন রেইডি।

’দায় অনুভব করছিলাম’

করভারসেশন উইথ ফ্রেন্ডন্স এ ফ্রান্সিস চরিত্রে অভিয়ন করেছেন এলিসন অলিভার। সেজন্য তিনি চিকিৎসকের কাছ থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে জানার চেষ্টা করেছেন এন্ডোমেট্রিওসিস বিষয়ে; যেন তিনি পর্দায় সেই যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমাদের কাজের সবচেয়ে বড় জায়গাটা ছিল আমরা এই যন্ত্রণা নিয়ে বলতে কোনো সংকোচ বোধ করিনি। এমনকি যখন মাসিক বন্ধ, তখনও এ অসুখ আপনার জীবন ও মনের স্থিতিতে প্রভাব ফেলে।”   

এলিসন অলিভারের ভাষায়, ”এটা এমন একটা বিষয়, যা পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে আমি ভীষণভাবে দায় বোধ করছিলাম। এ বিষয়ে নিয়ে তো কথাই হয় না তেমনভাবে।”

এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে একটি ফেলোশিপে এখন ডাবলিনে থাকা ডা. রেইডি বলেন, মেয়েদের স্বাস্থ্য ও মাসিক বিষয়ে কথা তেমন হয়ই না।

” টেলিভিশনের মত মূলধারার গণমাধ্যমে এমন একটি সমস্যা তুলে ধরেছে কনভারসেশনস উইথ ফ্রেন্ডস; এটা সত্যিই অভাবনীয়। এমন একটা গল্প থাকা আসলেই জরুরি, যা নিয়ে মানুষ কথা বলবে, জানতে চাইবে।”

রেইডি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক হুলু চ্যানেলে প্রচারিত ওই সিরিজ দেখার পর অনেক নারীই হয়ত ডাক্তার দেখানোর কথা ভাববেন, কারণ একই ধরনের উপসর্গ হয়ত তারও আছে।

‘আমার ২০ বছর বয়সটা যেন ধ্বংস করে দিয়েছিল এই অসুখ’

প্রথম প্রথম যখন মাসিকের দিনে অতিরিক্ত রক্তপাত হতে শুরু হল, ক্রিস্টির স্কুলের শিক্ষক আর চিকিৎসরা তার কথা উড়িয়ে দিতেন ’মিথ্যা কথা’ মনে করে। তারা মনে করছিলেন, ’সবার নজরে আসার জন্য’ বানিয়ে বানিয়ে ওইরকম কষ্টের কথা বলছেন ক্রিস্টি।

”কেউ মানতেই চাইছিল না যে আমি যতটা অসুস্থ হওয়া যায় ততটাই অসুস্থ হয়েছিলাম। আমার মাসিকের দিনগুলো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, আর এটা সব সময়ের জন্য আমার জীবনটাকেই পাল্টে দিল।”

ক্রিস্টি বলেন, ”১৮ বছর ধরে এন্ডোমেট্রিওসিস বয়ে বেড়াচ্ছিলাম আমি। এর অর্থ, আমার জীবনের অর্ধেক সময় জুড়ে পিরিয়ড আমাকে অসুস্থ করেছে।”

ক্রিস্টির এন্ডোমেট্রিওসিস বেশ জটিল পর্যায়ে ছিল। চারবার অস্ত্রোপচরা করতে হয়েছে তার; এর মধ্যে তিনবারের অস্ত্রোপচারে অসুস্থতা কমেনি।

”শেষবার অপারেশন কাজে দিয়েছে অনেকটা। তবে আমি এখনও নিয়মিত ব্যথা অনুভব করি। মাসিকের দিনে আমি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারি না। এ সময় কাজ চালিয়ে যাওয়াটা আসলেও কষ্টকর।”

ক্রিস্টি বলেন, ”আমার বয়স এখন ২৯, এখন মনে হয় আমার সেই বিশ বছর বয়সটা ধ্বংস হয়ে গেছে এই অসুখে। ”

শেষ পর্যন্ত যখন এন্ডোমেট্রিওসিস ধরা পড়ে তার, ওই মুহূর্তে স্বস্তিবোধ করেছিলেন ক্রিস্টি।

”এক দশক ধরে ডাক্তারের পর ডাক্তার দেখিয়ে চলেছিলাম, তারা কেউ আমাকে গুরুত্ব দেননি। অস্ত্রোপচারের সময় চিকিৎসক বললেন, ’কিছু একটা জটিলতা আছে। আপনার একটি রোগ রয়েছে।’ তখন আমার মনে হল আমি যেন লটারি জিতেছি।”

‘জীবন বাঁচিয়েছে ওষুধ’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এন্ডোমেট্রিওসিসের উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্র যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে। আর এক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ওই উপসর্গ কমাতে সহায়ক হতে পারে।

২৭ বছরের ব্রন্টি শিল্টজ ম্যানচেস্টারের বাসিন্দা। তাকেও প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করতে হত। এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে পিল খাওয়া শুরু করায় এখন অনেকটা ভালো বোধ করেন তিনি।

ব্রন্টি শিল্টজ বলেন, ”ফ্রান্সিসের মতই ছিল আমার সমস্যা। আমি ব্যথায় চিৎকার করতাম, বমি করতাম, জ্ঞান হারাতাম। মাসের দুই দিন আমি একেবারেই অকেজো হয়ে পড়তাম।    

“পানি খাওয়ার জন্য মাথা পর্যন্ত তুলতে পারতাম না আমি। আমার মা মুখে পানি ঢেলে দিতেন। আমি রাস্তায় বেরিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম।”

তিনি বলেন, “টিভিতে এ নিয়ে একটা সিরিজ দেখা সত্যি অভাবনীয়। আমি আগে এমন কিছু দেখিনি।”

১৫ থেকে ২২ বছর বয়সে ব্রন্টিকে তার চিকিৎসকরা বলেছিল, পিরিয়ডে ব্যথা হওয়াটাই ‘স্বাভাবিক’।

”বছরের পর বছর ধরে আমি হাতজোড় করে বলেছি, ভালোভাবে পরীক্ষা করে আমার সমস্যাটা বার করা হোক।”

ব্রন্টি বলেন, এন্ডোমেট্রিওসিস জটিলতা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে তার আত্মহত্যা করতেও ইচ্ছে হত।

“আমি বিষন্নতায় ভুগতে শুরু করলাম। আমি আতঙ্ক বোধ করতাম এই ভেবে যে এভাবে তো সারাজীবন আমি চলতে পারব না।”

এন্ডোমেট্রিওসিস কীভাবে জীবনকে অচল করে দেয়, তা জানাতে এবং এ অসুখ নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কনভারসেশন উইথ ফ্রেন্ডস কাজে দেবে বলে আশা করছেন ব্রন্টি।

যারা এই অসুখে ভুগছেন এই সিরিজ দেখে তারা সহজলভ্য চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে পারবেন বলেও তিনি আশা করছেন।

ব্রন্টি বলেন, ”ওষুধ আমার জীবনটাকে পাল্টে দিতে পারেনি, তবে আমার জীবনটা বাঁচিয়েছে।”