তারবার্তা: রক্তাক্ত পঁচাত্তর ও ইউনাইটেড স্টেটস অব পাকিস্তান

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ছিল ইয়াহিয়া খানের জন্য একটি বিশেষ দিন। এদিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দুই বছর পুরো হয় তার। সেদিনের রাতটা তিনি উদযাপন করেছিলেন বাঙালিদের উপর তার খুনে বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে। 

অমি রহমান পিয়ালবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2020, 06:28 PM
Updated : 14 August 2020, 10:58 PM

১৯৭৫ সালের ১৪ই অগাস্ট ছিল ভুট্টোর জন্য তেমনি এক বিশেষ দিন, পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করার পর সেদিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দুবছর পূর্তি। সে রাতটা কিভাবে উদযাপন করেছেন তার বর্ণনা আমরা পাবো পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোডের তারবার্তায়।

তার আগে চলুন আরেকটু এগিয়ে যাওয়া যাক। সময়কাল ১৯৭৬ সালের ৯ অগাস্ট। লাহোরের গভর্নর হাউজ। পাকিস্তানে এক সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছেন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার। দ্বিপাক্ষিক এ আলোচনায় আরো অনেকেই উপস্থিত। উপমহাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বয়ান দিচ্ছেন ভুট্টো। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দুজনের কথোপকথনের ভাবানুবাদটা তুলে দিচ্ছি :

ভুট্টো: … বাংলাদেশের কথা যদি বলি, আমরা আবার আগের মতো হয়ে গেছি। আমাদের সম্পর্ক এখন চমৎকার। তারা আমাদের এখানে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে আর প্রায় সব খাতেই আমাদের সহায়তা চাইছে। আমাদের কাছে সামরিক সহায়তাও চেয়েছে। আমরা বলেছি, আমাদের নিজেদের সামর্থ্যই তো যথেষ্ট নয়, দ্বিতীয়ত তাদের চিন্তামুক্ত করার মতো যথেষ্ট সাহায্য আমরা কিভাবে পাঠাবো? ওরা খুবই স্পর্শকাতর ধরনের মানুষ, ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। যদি ওখানে সত্যিই একটা স্থিতিশীল অবস্থা ওদের কাম্য হয় আর ওরা যদি সত্যিই পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চায় তাহলে আমাদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আমি বলছি না যে আমাদের অতীতের মতো হয়ে যেতে হবে।

কিসিঞ্জার: তেমন কিছু যদি করতে চান, তাহলে ১৯৮১ সালের পর করবেন, আবারও ওই চাপ সওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।

ভুট্টো: আমরা তো ফেডারেশন বা কনফেডারেশনের কথা ভাবছি না। কিন্তু ওরা যদি আমাদের সঙ্গে কোনো বিশেষ সম্পর্ক চায় তাহলে তারজন্য একটা রূপরেখা তো লাগবে। অনেকটা ফ্রান্স-জার্মানির মতো, ছয় মাস পরপর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে। এতে ওদের জন্য আমাদের কিছু করতে চাওয়াটা একটা নায্যতা পাবে।

বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে চরম ঘৃণা করে। এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ভারত তাদের লাঞ্ছিত করেই যাচ্ছে। রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থা- অপপ্রচারের শেষ নেই কোনও।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অভ্যুথান-পাল্টা অভ্যুথান লেগেই আছে। যখনই ভারতপন্থী কোনো সরকার আসে একটা অভ্যুথান হয়। আবার জনগণের মনমতো কেউ সরকার গঠন করলে, তখন ভারত আগবাড়িয়ে ঝামেলা পাকানো শুরু করে দেয়। ভারতের উচিত হবে এই দাদাগিরিসুলভ আচরণ বন্ধ করা। এমনকি নেপালের সঙ্গেও তারা বড় ভাই সাজার চেষ্টা করছে যাতে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা যায়। সিকিমকে তো পকেটেই পুরে ফেলেছে।

তো বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। অপ্রত্যাশিত কোনো পরিবর্তন আসতেই পারে। তারপরও যতদিন সেখানকার জনগণ পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে, আমাদের সম্পর্ক খুব বেশী খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই।

কিসিঞ্জার: আপনি কী চাচ্ছেন?

ভুট্টো: কাল রাতেই তো আপনাকে বললাম। কিছু সাবেক কর্নেলকে যেভাবেই হোক দেশে ফিরতে দেওয়ার অনুরোধ এসেছে। আমরা প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু তারপরও অভ্যুথানের খবর শোনা যাচ্ছে।

কিসিঞ্জার: আমরা শুনেছি।

ভুট্টো: জেএসডি (জাসদ), একটা জাতীয় সমাজন্ত্রিক মার্কবাদী দল সেনাবাহিনীর বেশ কিছু পদে ঢুকে পড়েছে। তারা অনেক সমস্যা তৈরি করছে। জাসদের একজন নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে (কর্ণেল তাহের)। এটা এখন একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে প্রচুর রাজনীতি। এদের মধ্যে কিছূ মার্ক্সবাদীও আছে। আবার এদিকে পুরানো রাজনীতিবিদরাও মাঠে নামতে চাইছে। প্রেসিডেন্ট (সায়েম) ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিতে চাইছেন, কিন্তু তারপরও বর্তমান সরকার শঙ্কিত যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোটা থমকে যেতে পারে। আর সেটা এখন মোটামুটি প্রকট হয়েই ফুটে উঠেছে।

কিসিঞ্জার: আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে আগ্রহী। আপনার মতোই আমাদেরও ধারণা যে এটা শুধু অস্ত্র সরবরাহ করে নিশ্চিত করা যাবে না। কারণ অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আমাদের ওই পরিমাণ অস্ত্র পাঠাতে হবে। তার চেয়ে অন্য জায়গায় রেখে সময়মতো সেখানে পৌছে দেওয়াটাই ভালো।

ভুট্টো: আমরা মনে করি এই বিশেষ সম্পর্কটা একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে যাতে আমরা আরো বেশি করে সাহায্য দেওয়ার একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাই। এটা তো সমর্থন দেওয়া যায়। (পড়ুন, এটাকে তো আপনারা সমর্থন দিতে পারেন)

কিসিঞ্জার: পরিকল্পনাটার মূলনীতি ঠিক আছে, কিন্তু এটা প্রকাশ হয়ে গেলে প্রশ্ন উঠবে। আপনারা যদি নিয়মিত বৈঠক করে ব্যাপারটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সেটা তো ভালোই। এটা আমরা দুজনেই সেই ১৯৭১ সালেই টের পেয়েছি। ব্যাপারটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি হিসেবে ঘোষণা দিতে চাইলে একজন বন্ধু হিসেবে আমি কিছু প্রশ্ন তুলতে পারি।

ভুট্টো: আমরা তাদের প্রস্তাবটা দিয়েছি যাতে আমাদের সর্বাত্মক সহায়তার ব্যাপারটাকে একটা ভিত্তি দেওয়া যায়, যাতে এটাকে কেউ সন্দেহের চোখে না দেখে।তারা যদি আপত্তি করে, তাতে আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যাবে না।

কিসিঞ্জার: আমরাও তাদের সাহায্য করতে পারি। তাদের নৌবাহিনী প্রধান ওয়াশিংটন এসেছিল। এমনিতে কোনো নৌ-প্রধানের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু এই লোকের সঙ্গে আমি গুরুত্ব দিয়েই দেখা করেছি। তাদের সার্বভৌমত্বে আমরা আগ্রহী যা ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভুট্টো: চীনারাও সাধ্যমতো সাহায্য করছে। আমরা মে মাসে পিকিং গিয়েছিলাম, আমরা প্রস্তাবটা দিয়েছি, তারাও বলেছে যে তাদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে সাহায্য করবে। রুশ রাষ্ট্রদূতকে আমি বলেছি যে বাংলাদেশে ভারতের সঙ্গে মিলেঝুলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো উপকার হয়নি, কারণ বাংলাদেশের মানুষের ঘৃণা খুব বেশি। বলেছি- ভারত যাই করে তাতেই তোমরা তাল দাও কেন? ওরা তো বাংলাদেশকে একটা পুতুল রাষ্ট্র বানাতে চায় যারা ওদের কথা মতো নাচবে।

কিসিঞ্জার: ওটা একাত্তর সালে ওদের লক্ষ্য ছিল।

ভুট্টো: ওরা (বাঙালিরা)  একাত্তর সালে ভাবতো যে পশ্চিম পাকিস্তান ওদের শোষণ করছে। এখন পাকিস্তান আমলকে তাদের স্বর্নযুগ বলে মনে হয়। শেখ মুজিব যখন মারা গেল তখন চোখের পানিও ফেলেনি কেউ।

কিসিঞ্জার: আমরা প্রচুর খাদ্য সাহায্য দিয়েছি, ওরা ওই খাতে আমাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহকদের মধ্যে পড়ে।

ভুট্টো: বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মনোভাব আগের চেয়ে অনেক ইতিবাচক হয়েছে। তবে এভাবে যদি সরকার বদলাতে থাকে তাহলে তো ওদের ভবিষ্যত অন্ধকার। এই একটা ভারতপন্থি আসে তো তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়, আবার জনগণের পছন্দের সরকার আসে তো তাদের উৎখাত করা হয়। আমাদের উচিত হবে বাংলাদেশের মানুষের মনোবল চাঙা রাখার জন্য খাদ্য এবং নানা ধরনের সাহায্য অব্যাহত রাখা। অস্ত্রশস্ত্র আসলে ঠিক উপায় না।

কিসিঞ্জার: এটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।

ভুট্টো: চীনারা অবশ্য তাদের এভাবেই সাহায্য করছে।

কিসিঞ্জার: অস্ত্র দিয়ে?

ভুট্টো: হালকা অস্ত্র…

আলোচনাটুকু পড়ার পর পাঠকের মনে নানা ধরণের প্রশ্ন জাগতেই পারে। যেমন ভুট্টো কী চাইছেন সেটা আলোচনাতেই পরিষ্কার। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে, সেখানে জাসদের অনুপ্রবেশ নিয়ে এমন দায়িত্ব নিয়ে কথা বলার মানে কী? তিনি তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তাহলে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান কি তার কাছে অভিযোগ অনুযোগ জানাচ্ছেন? সাবেক কর্নেল কারা? ফারুক-রশীদ তো! তাদের দেশে ফেরা না ফেরায় ভেটো দেওয়ার ভুট্টো কে? বাংলাদেশের নৌবাহিনী প্রধানইবা কি আবদার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন? ভুট্টো যেখানে বারবার বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশ বানানোর প্রস্তাব দিচ্ছে সেখানে কিসিঞ্জার কেনো ভেটো দিচ্ছেন বারবার? বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে তার এত দরদের হেতু কী!

প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে এটা বোঝা জরুরী, ভুট্টো মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রে কতখানি জড়িত। তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন কি ছিল এতে, নাকি স্রেফ পরিস্থিতির ফায়দা ওঠাতে চাইছিলেন তিনি। বাংলাদেশে তার মিত্র ছিল কারা, কারা তার মতো ভারতবিদ্বেষী মতবাদটা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে একটি যুদ্ধাঞ্চল বানাতে চাইছিল?

মার্কিন ন্যাশনাল আর্কাইভে চিলি, কিউবা, লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকায় সিআই-এর জঘন্য কীর্তিকলাপের অনেক দলিলই মেলে। সেগুলো নিয়ে অনেক গবেষকই কাজ করেন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের যোগ্য গবেষকরা তেমন কোনও প্রয়াসই নেননি। বরং বাংলাদেশ এবং ১৫ই অগাস্ট প্রসঙ্গে অনেক ডকুমেন্টই এখনও রেস্ট্রিকটেড, ক্লাসিফাইড এবং ডিলিটেড যেগুলো প্রকাশ পেলে অনেক রহস্য হয়তো পরিষ্কার হয়ে যেত। আমাদের অনুমানের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হতো না।

তেমন দুটো নমুনার স্ক্রিনশট আমি তুলে দিচ্ছি। ১৯৭৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড একটি তারবার্তা পাঠান তার পররাষ্ট্র দপ্তরে। তারবার্তাটি মুছে ফেলা হয়েছে, কিন্তু তার শিরোনাম ও ট্যাগ রয়ে গেছে। শিরোনাম বলছে- বিডি অফিসারস ক্লেইম দ্যাট দে ওয়ার্কড টু রিইউনাইট পাকিস্তান (বাংলাদেশি সেনাকর্তাদের দাবি তারা পাকিস্তানের একত্রিকরণের জন্য কাজ করেছে)।

অফিসারের অনুবাদে আমি সেনা কর্তা লেখলাম কেন? ট্যাগ দেখুন, ফারুক রহমান এবং খন্দকার আবদুর রশীদ। দুইজনের পরিচয় এবং কীর্তি নিয়ে নিশ্চয়ই নতুন কিছু বলবার নেই।

এখন পর্যন্ত অনেককেই দেখেছি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের বিশ্লেষণ করেন। তাদের বেশিরভাগের চোখেই ফারুক-রশীদদের কাজটা ‘হুইমজিকাল’, হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলা। তাদের পেছনে কোনও পৃষ্ঠপিোষকতা ছিল না, কোনো তৃতীয় রাষ্ট্রের সমর্থন ছিল না। এটা অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। 

মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ কর্নেল তাহের এবং জাসদের বিপ্লব নিয়ে বই লিখেছেন (দ্য আনফিনিশড রেভ্যুলেশন)। মুজিব হত্যা নিয়েও তার একটা অসম্পূর্ণ কাজ আছে, এনাটমি অব আ ক্যু। এটি বাংলাদেশের একটি ইংরেজি পত্রিকায় কয়েক পর্বে ছাপা হয়েছে। লিফশুলজ সেখানে রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারকে ক্লিনচিট দিয়েছেন, তাকে সাক্ষী মেনেছেন। দোষ দিয়েছেন, ঢাকায় তখনকার সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরিকে। ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে ফারুক-রশীদ অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাসকে দেওয়া সাক্ষাতকারে জিয়াকে জানিয়ে সব কিছু করার কথা বলেছেন। তার প্রবন্ধে এটি হাইলাইট করেছেন লিফশুলজ, লিখেছেন :

Among the many things that he talked about my source described how both Mustaque and General Ziaur Rahman had been in contact and discussions with the Majors for more than six months prior to the actual coup. This individual had personally attended numerous meetings that Major Rashid had held separately with Zia and Mustaque. In his television interview with Anthony Mascarenhas, Rashid described a meeting with General Zia on March 20, 1975, in which a coup was discussed in detail. This meeting took place five months before the coup. My source attended this meeting with General Zia but claimed it was not the first in which plans for a coup were discussed.

 

১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জিয়া সব জেনেছেন (আরটিভির একটা ফুটেজ পাওয়া যায় যেটাতে মাসকারেনহাসের নেওয়া সাক্ষাৎকারটার অনুবাদ সাবটাইটেল করা হয়েছে, সেখানে ফারুকের বলা টুয়েন্টিয়েথ অব মার্চকে টুয়েন্টিএইট অব মার্চ ভেবে সাবটাইটেলে ২৮ মার্চ লেখা হয়েছে)। এবং তিনি সেটা শেখ মুজিবকে জানাননি। কাউকেই কি জানাননি? হয়তো না। 

তবে আমরা উপরের মতো একটা ডিলিটেড মেসেজ পাই ২০ মার্চ ১৯৭৫ সালের। সেটা পাঠানো হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর (স্টেট) থেকে, ঢাকা, নয়াদিল্লী দূতাবাস এবং মিশরের আসওয়ানে সফররত হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্দেশ্যে। তারবার্তার শিরোনাম ক্যু রিউমার্স বা অভ্যুথানের গুজব। 

সেটার ট্যাগে বিজি ইনিশিয়ালে বাংলাদেশের নাম ছিল। ব্যক্তির নাম ছিল না, ছিল জবাবে। ২১ মার্চ নয়াদিল্লী থেকে ঢাকায় এবং ২২ মার্চ ঢাকা থেকে পাঠানো তারবার্তার জবাবে ‘মুজিবুর রহমান’ নামটা আছে। এটার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দূতাবাসের অগোচরে ঢাকা থেকে খবর পাঠানো হয় যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একটা অভ্যুথানের চক্রান্ত হয়েছে, সেটা নিশ্চিত হতেই পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে তারবার্তা আসে। কাকতালীয় এই ব্যাপারটা থেকে এটা অনুমান করা উচিত হবে না যে, জিয়া ফিলিপ চেরিকে বলেছেন ফারুক-রশীদের পরিকল্পনা। সেটা সে দেশে জানিয়েছে, তারা খোজ নিয়েছে। তবে মার্কিনিরা খবরটা মুজিবকে ঠিকই দিয়েছিলো।
তিনি পাত্তা দেননি।

তবে জিয়া মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ রেখেছেন এটা লিফশুলজ উল্লেখ করেছেন তার লেখায় :

My unusual source made a rather interesting comment when he noted that he had been present during two different meetings- one with Zia and a separate one on a different day with Mustaque-in which Major Rashid independently raised a question concerning what the attitude of the United States would be to the planned coup. “Both Zia and Mustaque independently told us that they had checked with the Americans,” said this military officer. “Their answers were the Americans. I then realized that Zia and Mustaque had their separate channels to the Americans. After that the subject didn’t come up again.”

এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় লিফশুলজের সেই সোর্স ছিলেন মহিউদ্দিন। বেঙ্গল ল্যান্সারের এই মেজর ছিলেন ফারুকের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এই মহিউদ্দিন শেখ রাসেলকে নিজের হাতে গুলি করে মারেন। হেগে তাকে রাষ্ট্রদূত বানান জিয়া, পরে তিনি নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণাঞ্চলে ব্রেডায় একটি রেস্তোরাঁ খোলেন, যেখানে প্রায় নিয়মিতই বৈঠকে বসতো মুজিব হত্যায় জড়িত সামরিক কর্মকর্তারা। মহিউদ্দিন্ আরেকজন ছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে বদলির আদেশ স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে এই মহিউদ্দিনকেই আগস্টের শুরুতে মুজিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন জিয়া। ২০ অগাস্ট মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর তৎপরতার খবরে ভীত হয়ে সস্ত্রীক মার্কিন দুতাবাসে আশ্রয় নেন । খালেদের অভ্যুথানের পর অন্যদের সঙ্গে দেশ ছেড়ে পালাননি। এবং ৭ নভেম্বর জিয়াকে মুক্ত করার সময় তিনি ছিলেন সেখানে উপস্থিত।

যাহোক লিফশুলজকে দেওয়া সাক্ষাতকারে চেরি অস্বীকার করেছেন অভ্যুথানে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার। আর ধোয়া তুলসীপাতা সাজা বোস্টারকে দেখা যায় ৯ অগাস্ট (‘৭৫) যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এমআর সিদ্দিকীর বাসায় ডিনার খেতে , যেখানে হাতে গোনা অতিথিদের একজন ছিলেন খন্দকার মোশতাক। তার বাসায় জিয়ার মতো সামরিক আইন প্রশাসকদের সঙ্গী হয়ে সেনা কর্মকর্তারা দল বেঁধে সিনেমা দেখতে আসেন (প্যাটন), আর ফাঁকে ফাঁকে রাষ্ট্রনীতি এবং ভারতের আগ্রাসন ঠেকাতে অস্ত্রসস্ত্র কিভাবে পাওয়া যায় তা নিয়ে আলাপ করেন। যে খালেদকে ভারতপন্থি বানাতে জাসদ লিফলেট ছেড়েছে বলে অভিযোগ, তাহের গ্রেপ্তারের পর যাকে ছাড়াতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণ করতে গিয়ে তার ভাইসহ চারজন জাসদ সদস্যের মৃত্যু, সেই জাসদ যে আসলে ভারতের টাকায় চলে এমন কানপড়া মার্কিনিদের দিতে একটুও বাধেনি জিয়ার । এমনকি লিফলেটে বিসমিল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম, খোদা হাফেজ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ লাগিয়েও নিস্তার মেলে না তাদের, রেডিওতে তাদের মীরজাফর বলে ঘোষণা দেন জিয়া । ভারতজুজু, মার্কিন রাষ্ট্রনীতি, জাসদ এবং খালেদকে নিয়ে আগামী পর্বগুলোতে বিস্তারিত লেখা হবে, তাই এখানে আলোচনা আর বাড়াচ্ছি না।

এখানে একটা চমকপ্রদ ব্যাপার পাঠকদের জানানো যায়। মুজিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাশাপাশি স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছে তার হত্যাকারীরা, যে কারণে লাশ হতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি এবং ভগ্নিপতি সেরনিয়াবাতকেও। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যেও আত্মীয়তার ছড়াছড়ি। খুনি রশীদও খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে। রাষ্ট্রদূত এমআর সিদ্দিকির দুইবোন ফারুক এবং রশীদের ঘরণী। আবার মোশতাককে উৎখাতে ব্রতী খালেদ মোশাররফ হচ্ছেন ফারুকের দূরসম্পর্কের মামা !

মোশতাক যে এক পাকিস্তানে ফিরতে আগ্রহী এবং জিয়া যে ভুট্টোর বিশেষ পছন্দ ছিল। 

ফেরা যাক একদম শুরুতে বলা ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ভুট্টো কি করছিলেন সেই কাহিনীতে। ১৮ অগাস্ট পাঠানো বাইরোডের তারবার্তা বলছে- “ভুট্টো আগের রাতে তাকে ফোন করে বলেছেন, আমি জানি আপনারা খারাপ লোক না, বাংলাদেশে অভ্যুথানে আপনাদের হাত নেই। তবে রাশানরা তো ঠিক উল্টোটা ভাবছে।”

এরপর আমরা জানতে পারি যে ১৪ অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে সন্ধ্যায় ভুট্টোর ওখানে সস্ত্রীক দাওয়াত ছিলো বাইরোডের। মূলত আলোচনাটা কাবুলকেন্দ্রিক হলেও সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। ভুট্টো এটাকে বলেছেন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ঝামেলা, কিন্তু সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আজিমভ তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন- যে তাদের কাছে প্রমাণ আছে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনায় ভালোমতোই জড়িত। 

বাইরোড রসিকতা করে ভুট্টোকে বলেছেন, যে আপনি যেরকম সবার আগে তাদের স্বীকৃতি দিলেন তাতে সন্দেহ তো আপনাকেও করতে পারে। ভুট্টোর জবাব তার নাকি বাংলাদেশে এমন কেউ নেই যাতে এই সন্দেহ কারো মধ্যে জাগবে। অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর (সৌদি আরব ও লিবিয়া) আগেই পাকিস্তান কাজটা করতে চেয়েছে কারণ দুদেশের মধ্যে একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। ভুট্টো বলেছেন, তিনি নতুন রাষ্ট্রপতিকে (মোশতাক) বেশ ভালোমতোই চেনেন, এবং আশা করছেন সম্পর্কটা এবার ভালো হবে।

১৯৭৬ সালের অগাস্টে এসে ভুট্টো কর্নেলদের (ফারুক-রশীদ) ফিরতে বাধা দিচ্ছেন বাংলাদেশে, অস্ত্র চাইছেন ভারত থেকে দেশকে বাঁচাতে, চীনারা এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে এমন তথ্য দিচ্ছেন কিসিঞ্জারকে। কিন্তু জিয়ার প্রতি তার মনোভাবটা কি তখনও শুরুর মতোই, নাকি ভাঙ্গন ধরেছে? কিসিঞ্জার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ-পাকিস্তান এক জোটে তার আপত্তির কথা। ওদিকে ফারুক-রশীদও জিয়ার ওপর দারুণ খ্যাপা। এক মাস আগে (৮ জুলাই ’৭৬) ফারুক ফিনানশিয়াল টাইমসে ছয় পাতার চিঠি পাঠিয়েছেন । সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আহবান জানানো হয়েছে জিয়াকে যে কোনোভাবে উৎখাতের, কারণ তিনি নাকি ইসলাম এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন!