বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনিকে ফেরানোর অগ্রগতি নেই

দুই দফায় ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকি পাঁচ খুনি এখনও রয়েছে অধরা।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2021, 05:56 PM
Updated : 14 August 2021, 05:56 PM

তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী।

এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের বারবার দাবির পরও তাদের ফেরত পাঠানো হয়নি।

বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পায়নি সরকার কিংবা গোয়েন্দারা। মোসলেম উদ্দিন ভারতে আছেন বলে গত বছর পত্রিকায় খবর এলেও তার ’সত্যতা নিশ্চিত’ হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুটোর খবর জানি, তিনটার কোনো খবর জানি না। যে দুজনেরটা জানি, তাদের ফেরানোর কোনো আপডেট নাই।

”আমেরিকা আমাদের নতুন কোনো তথ্য দেয় নাই, আর কানাডাতো কোনো তথ্যই দেয় না।”

আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, “যারা সর্বোচ্চ আদালত থেকে সাজাপ্রাপ্ত, তাদের (মধ্যে) যাদের ব্যাপারে এই রায় এখনো কার্যকর করা যায়নি তারা পলাতক থাকার কারণে, এবং দুজন দুটি দেশে থাকার কারণে, তাদেরকে ফিরিয়ে এনে এই রায় কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।”

গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে এক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে কোনো ধরনের ’শিথিলতা নেই’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

একদল সেনা কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে।

এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত, তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর আসে।

বাকি ১১ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন বন্দি অবস্থায় আদালতে রিভিউ আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায়।

এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। বাকি ছয়জন পলাতক থেকে যান।

তার প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক ৬ জনের একজন ৭২ বছর বয়সি মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় সরকার।

তখন গোয়েন্দারা বলেছিলে, মাজেদ এতদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়েছিলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর সময় দেশে ফেরেন।

পলাতক মাজেদের আপিলের সুযোগ ছিল না। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষার চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তা নাকচ হওয়ার পর কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

তখনই কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারে খবর এসেছিল যে পলাতক বাকি পাঁচজনের একজন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছেন।

এই খবর পেয়ে নড়েচড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকার, ভারতের এনসিবির কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রকাশিত খবরটি ’সত্য নয়’।

আব্দুর রশীদ, শরীফুল  হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন কোথায় আছেন, তা এখনও অজানা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে

মোসলেম উদ্দীনের বিষয়ে খোঁজ পাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, “যার কথা বলছেন, সেটা হচ্ছে মোসলেম উদ্দিন। তার ব্যাপারে একটা খবর এসেছিল। আমরা এটা যাচাই বাছাই করে দেখেছি, এখন পর্যন্ত এর সত্যতা আমরা পাইনি।”

যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে দেশের সরকার পর্যালোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে গত বছর খবর এসেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ওই বছরের ১৭ জুন দেশটির ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডের কাছে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় মামলার নথি পর্যালোচনার জন্য তলব করেছিলেন।

মার্কিন সাময়িকী পলিটিকো তখন লিখেছিল, বারের এই পদক্ষেপের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে তার রাজনৈতিক আশ্রয় হারাতে পারেন এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোও হতে পারে।

রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গত বছর চিঠিও দিয়েছিলেন।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সেই উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে ওই পর্যন্তই আছে, তারা কাগজপত্র দেখতেছেন। ওদের আমরা বললে বলে, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস স্বাধীন। তারা দেখবে বিষয়টা‘।

”আমরা আমাদের প্রবাসীদের বলেছিলাম, তোমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে খোঁজখবর করতে পারো। অনেককে বলেছি, কিন্তু খুব একটা ভালো কেউ করতে পারেনি।”

এবিএমএইচ নূর চৌধুরী (বাঁয়ে) কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন

অন্যদিকে আইনি জটিলতার কারণে কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকেও ফিরিয়ে আনতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ কানাডা শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী।

বুধবার দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী ক্যারিনা গোল্ডের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকেও নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গ তোলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ’আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য’ এই খুনিকে কানাডা থেকে ফেরত পাঠানো হবে বলে বাংলাদেশের ‘দৃঢ় প্রত্যাশার’ কথা বৈঠকে পুনর্ব্যক্ত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

রশীদ ও ডালিম যে কোথায় আছেন, তার তালাশ এখনও পায়নি দেশের গোয়েন্দারা।

পুলিশ সদরদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, তাদের ’অবস্থান সনাক্তকৃত নয়’। ডালিমের ‘সম্ভাব্য অবস্থান’ পাকিস্তান কিংবা লিবিয়া আর রশীদের ‘সম্ভাব্য অবস্থান’ লিবিয়া কিংবা জিম্বাবুয়ে।

ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বরাবরের মতোই বলছে, পলাতক খুনিদের আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আর তাদের সবার নামেই ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি আছে।

জানতে চাইলে এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুইজন ছাড়া বাকি তিনজন কোন দেশে অবস্থান করছে, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই।”

রাশেদ চৌধুরী এবং নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।

এই দুই খুনিকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, “আমরা সরকারকে বলছি, খুনিদের ফেরত দাও। যেহেতু তোমরা সুশাসনের কথা বল, আইনের শাসনের কথা বল, আমরা আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সুশাসন নিশ্চিত করতে চাই, এ কারণে তোমরা খুনিদের ফেরত দাও।

” তোমাদের দেশকে আমরা ‘হাব ফর কিলারস’ (খুনিদের আশ্রয়স্থল) হিসাবে দেখতে চাই না। এটা তোমাদের জন্য লজ্জার।”

দুই খুনিকে ফেরাতে এবং অন্যদের অবস্থান চিহ্নিত করতে প্রবাসীদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমাদের কাছে কোনো তথ্য নাই। এত লোক বাইরে থাকে, কিন্তু দুষ্টলোকের খোঁজ দেয় না। আমরা তাদের অ্যাওয়ার্ড দিব বলেছি, তবুও তারা দেয় না।”

তিনি বলেন, “প্রবাসী ভাইবোনদের বলছি, আপনারা অন্তত একটা কাজ করেন, প্রতি মাসে অন্তত একবার এই খুনিদের বাড়ির সামনে গিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি করেন আর জনসাধারণকে বলেন যে, এখানে খুনি থাকে। যাতে তারা পীড়িত হয়।”

আরও খবর-