ঘটনাবহুল শিক্ষাজীবনে দীক্ষা রাজনীতির

মধুমতি পাড়ের গ্রামটিতে ‘দস্যিপনার’ শৈশব পেরিয়ে এসে সহপাঠী-বন্ধুমহলে নেতা হয়ে উঠেছিলেন যিনি; বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কৈশোর থেকেই যিনি সচেতন, সেই শেখ মুজিবই হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের কাণ্ডারি। 

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2020, 04:56 PM
Updated : 16 Dec 2021, 07:14 PM

শোষণের নাগপাশ ছিঁড়ে বাঙালিকে তার ভাষা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির পথে নিয়ে চলা শেখ মুজিবের ছেলেবেলা আর শিক্ষা জীবন ছিল ঘটনাবহুল।

অসুখ এসে বার বার হানা দিয়েছে, রাজনৈতিক আন্দোলনে মন দিয়ে পড়াশোনাতে হয়েছে ঘাটতি। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেমে শেষে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই শেষ করা হয়নি তার।

শেখ মুজিবের লেখাপড়ার শুরু গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামের এম ই স্কুলে। শেখ মুজিবের ছোট দাদা শেখ আবদুর রশিদ এই স্কুল প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় সেটিই ছিল প্রথম ইংরেজি স্কুল, পরে সেটা হাই স্কুল হয়। মুজিব সে স্কুলে পড়েন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।

মুজিবের বাবা আইনজীবী শেখ লুৎফুর রহমান এরপর তাকে নিয়ে ভর্তি করান গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। তিনি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন সেসব দিনের কথা।

“আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তার গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসত না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।”

ছোট্ট মুজিব ছিলেন ভীষণ দুষ্ট প্রকৃতির। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, গান আর ব্রতচারী করতে পারতেন।

১৯৩৪ সাল, শেখ মুজিব তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। এ সময় তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলেন। হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। কলকাতায় নিয়ে গেলেন বাবা। দুই বছর ধরে চলল চিকিৎসা। দুবছরের জন্য পড়াশোনা বন্ধ হল। 

এরপরেও অসুখ তার পিছু ছাড়েনি।  

১৯৩৬ সালে মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হয়ে বদলি হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর বাবা লুৎফুর রহমান। টুঙ্গীপাড়ার বাড়ি ছেড়ে মা সায়েরা খাতুনও চলে আসেন মুজিবের অসুস্থতার জন্য। সে বছর মাদারীপুর হাই স্কুলে যখন সপ্তম শ্রেণিতে আবার পড়তে শুরু করেছেন, তখন চোখে ধরা পড়ল গ্লুকোমা।

চিকিৎসকদের পরামর্শে আবার কলকাতা গেলেন মুজিব। কলকাতা মেডিকেল কলেজে অপারেশন হল। এতে তার চোখ ভালো হল।

এরপর শেখ মুজিব মাদারীপুরে ফিরে দেখেন স্বদেশি আন্দোলনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পনের থেকে ষোলো বছরের তরুণরা নাম লেখাচ্ছেন স্বদেশি আন্দোলনে। মুজিব তাদের দলে ভিড়লেন।

অসমাপ্ত আত্মজীবনে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।”

মুজিবকে স্বদেশিদের দলে ভিড়তে দেখে গোপালগঞ্জ মহকুমার এসডিও তার দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদকে সতর্ক করে দেন।

১৯৩৭ সাল, গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করেন শেখ মুজিব। ওই স্কুলের শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেছিলেন। তিনি মারা গেলে ওই সমিতির দায়িত্ব নেন শেখ মুজিব, হন সাধারণ সম্পাদক।

গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় মুজিব স্কুলের ফুটবল, ভলিবল ও হকি দলে নাম লেখান। তখনও রাজনীতির দিকে ততটা খেয়াল ছিল না তার।

পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি মুজিব নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। বাসায় আসা আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ ও মাসকি মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকা তিনি নিয়মিত পড়তেন।

স্কুলবেলায় মুজিব ছিলেন ভীষণ বন্ধুপ্রবণ।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘একগুয়ে’ মুজিবের ছিল একটি দস্যি দল। সেই দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে তারা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

১৯৩৮ সাল ছিল শেখ মুজিবের জীবনের বাঁকবদলের বছর। গোপালগঞ্জে আসেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, সঙ্গে আসেন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাদের আগমন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব পড়ে শেখ মুজিবের কাঁধে।

সেবার শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চোখে পড়েন শেখ মুজিব, পরে যার হাত ধরেই মুজিব আসেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে। 

ওই বছরই গোপালগঞ্জে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগে।শেখ মুজিব সে দাঙ্গায় আসামি হয়ে সাত দিনের জন্য জেল খাটেন। মুজিবের জেল জীবনের সেই শুরু।

১৯৪১ সাল; মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা এল। গণিতে বড় ভয় মুজিবের। বাংলা পরীক্ষার আগে ‘মামস’ হয়ে গলা ফুলে গেল তার, এল ভীষণ জ্বর। বাংলা পরীক্ষা দেন বেডে শুয়ে। বাংলায় কম মার্কস পান। দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে পাস করেন, মন ভেঙে পড়ে তার।  

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে শেখ মুজিব যান মাদারীপুরে, সেখানে গড়ে তোলেন মাদারীপুর মুসলিম ছাত্রলীগ।

পরের বছর শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সেখানে থাকতেন বেকার হোস্টেলে। এ সময় শেখ মুজিব মুসলিম লীগের রাজনীতিতে খুবই সক্রিয় ছিলেন। ছাত্রদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় মুজিব কলেজ সংসদ (ছাত্র ইউনিয়ন) নির্বাচনে মুসলিম ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রার্থী দিয়ে জয়ী করে আনেন। দুই বছর এ রকম হওয়ার পরের তিন বছর শেখ মুজিবের মনোনীত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন।

বেকার হোস্টেলে শেখ মুজিব নানা প্রয়োজনে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতেন। তিন মাসের জন্য তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হন।

কলকাতায় গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার যোগাযোগ বাড়ে আরও। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে ছাত্র শেখ মুজিব নেমে পড়েন জনকল্যাণে। সোহরাওয়ার্দী লঙ্গরখানা খুললে তার হয়ে রিলিফের কাজ করতে থাকেন মুজিব।

বেকার হোস্টেলে থাকার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয় শেখ মুজিবকে। 

বিএ পরীক্ষার আগে বেকার হোস্টেল ছেড়ে তিনি উঠেন ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পার্ক সার্কাসের বাসায়। তখন শেখ মুজিবের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা চলে আসেন তার কাছে। মুজিব তার স্ত্রীকে ডাকতেন রেণু নামে।

এরপর রাজনৈতিক নানা পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয় ভারতবর্ষ। মুজিব চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন শেখ মুজিব। পাশাপাশি মুসলিম লীগের রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খরচ চালাতে শেখ মুজিব সাংবাদিক বন্ধু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মাধ্যমে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেহাদে। তিনি ছিলেন ওই পত্রিকার ‍পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি। এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করা ছিল তার কাজ।

১৯৪৮ সাল, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে ষড়যন্ত্র শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। রুখে দাঁড়ান বাংলার দামাল সন্তানরা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১১ মার্চ গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। 

অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের চোখে মুজিবের রাজনৈতিক উত্থান

বঙ্গবন্ধু গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের মতে, ১৯৪৩ সাল শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বেঙ্গল মুসলিম লীগের কাউন্সিলর হওয়ার পাশাপাশি তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র নেতা হয়ে উঠেছিলেন ইসলামিয়া কলেজে।

শামসুজ্জামান খান বলেন, “আবুল হাশিম সাহেব তখন মুসলিম লীগের সম্পাদক। তিনি রাজনীতিকে প্রগতিশীল করার জন্য কতগুলো কর্মসূচি নিলেন। মুজিবকে বললেন, ‘শুধু জিন্দাবাদ  মুর্দাবাদ বললে হবে না। রাজনীতি করতে গেলে পড়াশোনা করতে হবে। সেমিনার করতে হবে।’মুজিব বললেন, সারা দিন রাজনীতি শেষ করে রাতে হাশিম সাহেবের ক্লাসে যাবেন। এ ঘটনা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।”

অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান জানান, আবুল হাশিম সম্পাদিত মিল্লাত পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে কলেজছাত্র শেখ মুজিব অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতেন।

“শেখ মুজিব হকার হিসেবে কলকাতার পথে পথে এই পত্রিকা ফেরি করতেন। পত্রিকাটি হিন্দু-মুসলিম সবাই পড়তেন। ওই সময়ে শেখ মুজিবের প্রস্তুতি হয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে, পরিশ্রম করে। শেখ মুজিব এ সময়ে রাজনীতি বোঝার জন্য অর্থনীতি আর সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করতেন ।”

যে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান বুকে ধরে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ, সে স্লোগান শেখ মুজিব নিয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’  কবিতা থেকে।

শামসুজ্জামান খান বলেন, “বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন, নজরুলকে ভালোবাসতেন। মাদারীপুরে স্বদেশি আন্দোলনের নেতা পূর্ণচন্দ্র দাসকে ব্রিটিশরা গ্রেপ্তার করেছিল। তিনি মুক্ত হওয়ার পরে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতাটি। সে কবিতায় রয়েছে জয় বাংলা শব্দ দুটি। মুজিব জয় বাংলা শ্লোগানটি নিয়েছেন সে কবিতা থেকে।”

স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতিকে যুক্ত করছেন বলে ইতিহাসবোধ আর তার রাজনীতিবোধ সম্পর্কে ধারণা পরিপক্ব হয়েছিল। এজন্য তার পক্ষে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়েছে।”