গবেষণা: বয়স বাড়ার সঙ্গে নারীদের শারীরিক মিলনে আগ্রহ হারানোর ধারণাটা ঠিক না

নারীদের যৌনাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক বিষয় ছাড়াও নানান প্রভাব কাজ করে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 03:01 PM
Updated : 21 May 2023, 03:01 PM

১৫ বছর ধরে ৩ হাজার ২শ’ নারীর ওপর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মধ্য বয়সের পর থেকে নারীরা যে যৌনাকাঙ্ক্ষা হারায়, সেটা সম্পূর্ণ ঠিক না।

২০২০ সালে সেপ্টেম্বরে অনলাইনে অনুষ্ঠিত ‘নর্থ আমেরিকান মেনোপজ সোসাইটি’র বার্ষিক সম্মেলনে এই তথ্য উপস্থাপন করেন গবেষণার প্রধান ডা. হলি থমাস।

তিনি বলেন, “পর্যবেক্ষণে অংশ নেওয়া প্রায় এক-চতুর্থাংশ নারী তাদের বয়স নির্বিশেষে যৌনতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মূল্যায়ন করেন।”

এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ’য়ের মেডিসিনের সহকারী এই অধ্যাপক বলেন, “পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বয়স হলেও প্রচুর সংখ্যক নারী এখনও শারীরিক সম্পর্ককে উচ্চ মূল্য দেয়।”

তিনি মন্তব্য করেন, “যদি নারীরা তার সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হতে পারে যে, শারীরিক সম্পর্ক তাদের জন্য আনন্দদায়ক ও পরিপূর্ণ করবে, তাহলে বয়স হলেও তারা যৌনতাকে উচ্চ মূল্য দিয়ে থাকেন।”

এই গবেষণার সাথে যুক্ত না থেকেও ‘নর্থ আমেরিকান মেনোপজ সোসাইটি’র মেডিকেল পরিচালক ডা. স্টেফেনি ফাবিয়ন মন্তব্য করেন, “এটা আসলে সত্যিই মুগ্ধ করার মতো যে, পর্যবেক্ষণে অংশ নেওয়া এক চতুর্থাংশ নারীর কাছে যৌনতা শুধু মাত্র একটা বিষয় নয়, বরং উচ্চ মূল্য রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের গবেষণা স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও অন্তর্দৃষ্টি দেবে, না হলে দেখা যাবে নারীদের বয়সের সঙ্গে যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়ার বিষয়টা তারা সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে ধরবে।”

প্রচলিত ধারণা উড়িয়ে দেওয়া

তবে এটা সত্যি যে, আগের বহু গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বয়সের সঙ্গে নারীদের যৌনবিষয়ে আগ্রহ কমে যায়। তবে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় সেসব ফলাফলকে বিদ্রুপ সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ডা. থমাস বলেন, “আগের বহু গবেষণায় বয়সের সঙ্গে নারীদের শারীরিক মিলনের আগ্রহ কমে যাওয়ার বিষয়ে জানালেও, বাস্তবতা হল আমার সব রোগীদের ক্ষেত্রে তথ্যটা সঠিক নয়।”

“২০২০ সালে উপস্থাপিত আমাদের গবেষণায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যা কিনা আগের গবেষণায় করা হয়নি। এক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে চেষ্টা করেছি।”

সময়ের সাথে যেভাবে যৌনতার অনুভূতি পরিবর্তিত হয়

এই গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকার তথ্য নিয়ে জাতীয়ভাবে করা গবেষণা ‘দি স্টাডি অফ উইমেন’স হেল্থ অ্যাক্রোস দ্য নেইশন, (সোয়ান)’য়ের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়।

দেখা গেছে যৌনতার গুরুত্বের বিষয়ে নারীরা তিনটি স্বতন্ত্র ধারণা পোষণ করেন।

পর্যালোচনা করা তথ্যে, প্রায় এক চতুর্থাংশ নারী (২৮%) সাধারণভবেই মনে করেন যে, মধ্য বয়সের পর থেকে তারা শারীরিক মিলনের বিষয়ে কম গুরুত্ব দিয়েছে।

তারপরও আরেক এক চতুর্থাংশ নারীদের ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রায় ২৭ শতাংশ জানিয়েছেন- তাদের বয়স ৪০, ৫০ এবং ৬০ এর মধ্যেও যৌনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যা কি-না হতবাক করার মতো হলেও, বয়সের সঙ্গে নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষা কমার ধারণার বিপরীতে অবস্থান করছে।

মায়ো ক্লিনিক’য়ের নারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডা. ফাবিয়ন সিএনএন’কে বলেন, “যৌনতাকে ভিন্নভাবে দেখতে হচ্ছে।”

“২০ বছর বয়সে যেমন চল্লিশে সেরকম না, ষাটে যেমন চল্লিশে তেমন না, আবার আশিতে যেরকম ষাটে তেমন না।”

তিনি মন্তব্য করেন, “হয়ত সামান্য কিছু সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে, তবে সাধারণ মানুষ যারা স্বাস্থ্যবান ও সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, তারা শারীরিক সম্পর্কে থাকেন।”

নারীদের মধ্যে যারা যৌনতাকে চরম গুরুত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে কিছু বিষয় লক্ষ করা গেছে। যেমন- তারা উচ্চ শিক্ষিত, কম বিষণ্ন এবং মাঝ বয়সের আগে তাদের শারীরিক মিলনের অভিজ্ঞতা খুব ভালো।

ডা. থমাস বলেন, “নারীদের মধ্যে যারা চল্লিশেও পরিতৃপ্ত শারীরিক সম্পর্কে ছিলেন তারা বয়স বাড়ার সঙ্গেও যৌনতাকে উচ্চ মূল্য দিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, “এছাড়া কিছু আর্থ-সামাজিক বিষয়ও এখানে কাজ করে। যেমন- উচ্চ শিক্ষিত নারীরা বেশি উপার্জন করেন, ফলে তারা জীবনে অনেক স্থীতিশীল আর কম মানসিক চাপে ভোগেন। ফলে অন্যান্য মৌলিক চাহিদার ব্যাপারে কম চিন্তা করতে হয় বলে যৌনতাকে প্রাধান্য দিতে পারেন।”

এছাড়া জাতি ও জাতিগত বৈশিষ্টের ওপরেও কিছু বিষয় নির্ভর করে।

যেমন- কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নারীরা সাধারণত মন্তব্য করেছেন, মধ্য বয়সে যৌনতার গুরুত্ব রয়েছে। অন্যদিকে চীনা ও জাপানি নারীরা মধ্য বয়সে যৌনতাকে কম গুরুত্ব দিয়েছেন।

ডা. থমাসের ভাষায়, “আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, বিষয়টা আসলে যতটা না জৈবিক তার চেয়েও বেশি প্রভাব রাখে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণগুলো। সংস্কৃতির ভিন্নতায় নারীদের চারিত্রিক ভিন্নতা থাকে, বয়সের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো ভিন্ন। আর সেটা বয়সের সঙ্গে যৌনতাকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রভাব রাখে।”

নারীদের যৌনাকাঙ্ক্ষার প্রভাবগুলো

গবেষণার জন্য অংশ নেওয়া বেশিরভাগ নারী (৪৮%) মন্তব্য করেন, মেনোপজে যাওয়ার বছরগুলোতে তারা স্বাস্থ্যকর যৌন সম্পর্কে মূল্য দিয়েছিলেন। তবে সেই আগ্রহ ৫০ ও ৬০ বছর বয়সের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।

যৌনতার ক্ষেত্রে অনুভূতি, শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন বিষয় নারীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সেগুলোকে সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা যায়।

স্বাস্থ্যগত বিষয়: ৪০ থেকে ৫০’য়ের মধ্যে নারীরা যখন মেনোপজের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবেশ করতে থাকেন, তখন হরমোনের পরিবর্তনের কারণে তাদের কাছে শারীরিক মিলনটা হয় কম পরিতৃপ্তির, অনেকের ক্ষেত্রে কষ্টদায়ক।

এক বিন্দু ইস্ট্রোজেনের ঘাটতির কারণে নারীর যৌননাঙ্গের কোষকলা পুরু হওয়া ও শুষ্কতার সমস্যা দেখা দেয়। যে কারণে চরম অস্বস্তি হয়। ‘হট ফ্লাশেজ’ ও মেনোপজের অন্যান্য লক্ষণগুলো মেজাজের ওঠানা, ঘুমের পরিমাণে প্রভাব ফেলে। ফলে দেখা দেয় অবষণ্ন, মানসিক চাপ, বিরক্তি, মাথা ঝিমঝিম করা ও বিষণ্নতা।

এছাড়াও বয়স বাড়ার সঙ্গে কোমড়ে ব্যথা, হাতের আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো বিষয়গুলোও গননায় ধরতে হয়।

ডা. ফাবিয়ন বলেন, “তবে এসবের জন্য চিকিৎসাও রয়েছে। যা কি-না মানুষদের শারীরিক মিলনে সক্ষম রাখতে সাহায্য করে।”

মানসিক বিষয়: নারীদের ক্ষেত্রে মানসিক বিভিন্ন বিষয় যৌনাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে সাংঘাতিক প্রভাব রাখে। শারীরিক বা যৌন হয়রানির মতো বাজে অভিজ্ঞতা, মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা সামলানোর মতো বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।

ডা. ফাবিয়ন বলেন, “দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ শারীরিক মিলনের ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব ফেলে তা ঠিক বলতে পারবো না। তবে ‘লড়াই কর নইলে মর’- এই ধারণার মধ্যে দিয়ে যখন মানুষ যায়, তখন নিজেকে গুহামানব ভাবতে শুরু করে, যেন একটা সিংহ তাকে তাড়া করছে।”

“আচ্ছা বলুন তো, সিংহ তাড়া করছে এরকম অবস্থায় কি শারীরিক মিলনের কথা মাথায় আসবে? উত্তর হচ্ছে- না। দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপে থাকলে নারীদের মধ্যে এরকমই মনোভাব খেলা করে। দুশ্চিন্তা প্রবলভাবে নারীদের যৌনাকাঙ্ক্ষায় প্রভাব রাখে।”

যদিও এই গবেষণায় দুশ্চিন্তা, উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে দেখা হয়নি। তবে যেসব নারীর মাঝে বিষণ্নতার লক্ষণ পাওয়া গেছে, তাদের ক্ষেত্রে শারীরিক মিলনে অনাকাঙ্ক্ষা প্রারম্ভিক জীবনের চাইতে এখন বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে।

সঙ্গীর সঙ্গ: মধ্য বয়সে এসে নারীরা রোমান্টিকতায় নাটকীয় মোড় দেখতে পায়ে। যা কিনা তাদের যৌনজীবনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে।

ডা. থমাস এক্ষেত্রে প্রশ্ন রাখেন, “বিচ্ছেদ বা মৃত্যুর মতো কোনো কারণে কি সঙ্গী হারিয়েছে? সঙ্গীর কি কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে যে কারণে শারীরিক মিলন সম্ভব হচ্ছে না? সঙ্গী কি অন্যান্য বিষয়ে বেশি ব্যস্ত- হতে পারে সেটা চাকরি জীবন, যত্নের অবহেলা কিংবা বেশি বয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় কাটানো?- এসব বিষয় যৌনতাকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়।”

এমনকি সঙ্গী থাকার পরও সম্পর্কের মাত্রায় অতি ওঠা-নামার কারণেও নারী ঘনিষ্ট হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।

তাই ডা. ফাবিয়ন নিজেকেই প্রশ্ন করার পরামর্শ দেন, “সঙ্গীকে পছন্দ করেন? নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ কি ভালো? আপনারা কি একই সময়ে একই জায়গায় আছেন?

সামাজিক রীতিনীতি: যৌনবিষয়ক বিষয়ে সমাজও নারীর মাঝে প্রভাব বিস্তার করে। ধর্ম, সংস্কৃতি ও পারিবারিক রীতি এই বিষয়ে বিশাল ভূমিকা রাখে।

ডা. ফাবিয়ন বলন, “আর এরমধ্যে সমাজ শেখায় বয়সের দোষ। এই কারণে কিছু নারী মনে করতে থাকেন যৌনজীবনে থাকা আসলে বাজে বিষয়, নারীদের যৌনতা পছন্দ করা উচিত না।”

“আমার অভিজ্ঞতায় ৬০ থেকে ৬৫ বছর বয়সি বহু নারী দেখেছি যারা কখনও যৌনশিক্ষা পায়নি। এমনকি তাদের সঙ্গীরাও না। আর তারা এই বিষয়ে সত্যিকার অর্থে জানতেও চায় না।”

তাহলে যা করা উচিত

ফাবিয়ান এবং থমাস- দুজনেই জোড় দিয়ে বলেন, “কোনো নারী যদি যৌনাকাঙ্ক্ষার অভাব নিয়ে বিব্রত বোধ না করেন তবে অবশ্যই তার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার নেই।”

তবে তারা গবেষণার সূত্র ধরে জানান, অন্তত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নারী পাওয়া গেছে যারা যৌনাকাঙ্ক্ষা কমের কারণে বিব্রত এবং সমাধান চান।

এক্ষেত্রে ডাক্তাররা ওষুধ, থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে সাহায্য করতে পারবেন। তবে আগে সেই নারীকে চিকিৎসকের কাছে মুখ খুলতে হবে।

ডা. থমাস বলেন, “আগের গবেষণায় দেখা গেছে নারীরা এই বিষয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। হতে পরে সেটা তাদের কাছে বিব্রত লাগে অথবা মনে করেন এটা বয়সের বাড়ার সঙ্গে হয়ই। তাই সেই বিষয়ে আর আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেন না।”

ডা. ফাবিয়ন আরও বলেন, “যদি যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়, তবে সেই নারীর উচিত হবে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। এটা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর যেসব নারী এটা নিয়ে যুদ্ধ করছেন তাদের জন্য সমাধানও রয়েছে।”

আরও পড়ুন

Also Read: যৌন জীবন নষ্টের পেছনে স্মার্টফোন

Also Read: যৌনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী যেসব খাবার

Also Read: যেসব গোপন বিষয় সঙ্গীকে জানানো ঠিক না

Also Read: যে কারণে সঙ্গিনী বুঝে ফেলে মনের কথা