কোভিড-১৯: টিকা নেওয়া পরও যে কারণে মাস্ক পরতে হবে

টিকা নিলেও আপনার মাধ্যমে ছড়াতে পারে ভাইরাস।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2021, 04:55 PM
Updated : 7 June 2021, 04:55 PM

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিলাতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া’র ‘আরবান হেল্থ ল্যাব’য়ের ‘ফ্যাকাল্টি পরিচালক’ ডা. ইউজিনিয়া সাউথ দেশটির প্রথম করোনাভাইরাস গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন।

সম্প্রতি টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেন এই চিকিৎসক। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন’য়ের আগে তিনি টিকার দ্বিতীয় ডোজ সম্পূর্ণ করেন। তারপরও মুখ থেকে মাস্ক সরাননি ডা. সাউথ।

ডা. সাউথ বলেন, “কাজের সময় হয়ত আর কোনোদিনই হয়ত মাস্ক ছাড়া থাকা হবে না। মাস্ক ছাড়া নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না।”

এই ছিল একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের গল্প যিনি টিকা নিয়েছেন এবং একটি উন্নত রাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়ার পরও মাস্ক ছাড়া নিরাপত্তা পান না।

অপরদিকে সাধারণ মানুষ মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছেন দিব্যি।

ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান’য়ের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. প্রিতি মালানি বলেন, “মাস্ক পরা আর সামাজিক দূরত্বের দিন শিগগিরই শেষ হচ্ছে না। যতদিন না ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হচ্ছে, ততদিন স্বাস্থ্যবিধি না মানার কোনো বিকল্প নেই।”

জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক সংস্থা ‘গ্যাভি, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন্স অ্যান্ড ইমিউনাইজেইশন’য়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে আরও জানানো হল টিকা নেওয়ার পরও কেনো মাস্ক পরা জরুরি।

শতভাগ কার্যকর নয় কোনো টিকাই

যুক্তরাষ্টের ‘সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)’র সাবেক পরিচালক ডা. টম ফ্রিডেন বলেন, “বিশদ আকারের ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’য়ে দেখা গেছে ‘মডার্না’ ও ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’য়ের টিকার দুই ডোজ করোনাভাইরাস থেকে হওয়া অসুস্থতা দূর করতে ৯৫ শতাংশ কার্যকর। এই ফলাফল নিঃসন্দেহে ভালো, তবে প্রতি ২০ জনের মধ্যে এটা কিন্তু অনিরাপদ রেয়ে গেল।”

মালানি বলেন, “টিকার এই পরীক্ষাগুলো করা হয়েছে শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে, সেখান পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। তবে বাস্তবে টিকা কিছুটা কম কার্যকর।”

পরিংখ্যানের ক্ষেত্রে গবেষকরা দুটি শব্দ ব্যবহার করেন ‘এফিকেসি’ আর ‘এফিক্টিভনেস’।

‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’য়ের টিকার যে কার্যকারিতা দেখা যায় তা হল ‘এফিকেসি’ আর বাস্তবে টিকা গ্রহণ করা জনসাধারণের মাঝে যে কার্যকারিতা দেখা যায় তাকে বলা হয় ‘এফেক্টিভনেস’।

টিকা পরিবহন, সংরক্ষণ, বিতরণ ইত্যাদির মাধ্যমে টিকার ‘এফেক্টিভনেস’ কমে যাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ টিকা সংক্রান্ত ‘সিডিসি’য়ের দেওয়া যেকোনো নির্দেশনা না মানলেই টিকার কার্যকারিতা কমে যাওয়া সম্ভব।

টিকার সুরক্ষা তাৎক্ষণিক নয়

মালানি বলেন, “টিকা নেওয়ার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তা ব্যবহার করে ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি করতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় নেয়। আর এই ‘অ্যান্টিবডি’ই ভাইরাসকে সংক্রমণে বাধা দেয়।”

“টিকা যেহেতু দুই ডোজ’য়ে নিতে হয় তাই অন্যান্য টিকার তুলনায় কোভিড টিকা সুরক্ষা দিতে সময় নেয় বেশি। ‘ফাইজার’য়ের দুই ডোজ’য়ের মধ্যে সময়ের পার্থক্য তিন সপ্তাহ আর ‘মডার্না’য়ের ক্ষেত্রে চার সপ্তাহ।”

টিকা নেওয়া ব্যক্তি থেকেও হয়ত ভাইরাস ছড়ায়

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অফ হেল্থ অ্যান্ড ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’কে কোভিড বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া চিকিৎসক পল অফিট বলেন, “টিকা দুই ধরনের সুরক্ষা দেয়। ‘হাম’য়ের টিকা সংক্রমণ ঠেকায়, ফলে টিকা নেওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে ভাইরাস আর কারও মাঝে ছড়ানো সম্ভব হয় না। তবে অন্যান্য বেশিরভাগ টিকার ক্ষেত্রে, যিনি টিকা নিয়েছেন শুধু তিনি অসুস্থ হবেন না এই সুরক্ষা দেয়, তবে তার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে আগের মতোই।”

জর্জ মেইসন ইউনিভার্সিটি’র শার স্কুল অফ পলিসি অ্যান্ড গভার্নমেন্ট’য়ের সহকারী অধ্যাপক ও ‘এপিডেমিওলজিস্ট’ সাসকিয়া পোপেস্কু, বলেন, “কোভিড’য়ের টিকা রোগ প্রতিরোধ করে, তবে তা সুস্থদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া দমন করে কি-না তা জানতে এখনও সময় প্রয়োজন।”

‘সিডিসি’য়ের সাবেক পরিচালক ফ্রিডেন একই মন্তব্য করে বলেন, “টিকা নেওয়া একজন ব্যক্তি থেকেও হয়ত ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই এই ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মাস্ক পরা বাদ দেওয়া যাচ্ছে না।”

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম

‘ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার’য়ের অধ্যাপক ডা. গ্যারি লেম্যান বলেন, “ক্যান্সার রোগীর জন্য কোভিড অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণা বলেন তাদের আক্রান্ত হওয়া এবং মৃতুবরণ করা উভয়েরই সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি।”

“যার ফুসফুসে ক্যান্সার আছে সে ‘নিউমোনিয়া’কে প্রতিহত করতে পারবে না এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ‘কেমোথেরাপি’ কিংবা ‘রেডিওথেরাপি’ যারা নিচ্ছেন তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই চিকিৎসা পদ্ধতির কারণেই দুর্বল হয়ে যায়।”

“লিউকেমিয়া’ আর ‘লিমফোমা’ সরাসরি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টিকারী কোষকে আক্রমণ করে, ফলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি ওই ব্যক্তির থাকে না।”

তিনি আরও বলেন, “ক্যান্সার রোগীদের জন্য টিকা কতটুকু কার্যকর তা এখনও কারও জানা নেই। কারণ ক্যান্সার রোগীরা টিকার ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’য়ে বরাবরই বাদ পড়েছেন। তবে তাদের জন্য কার্যকারিতা যে ৯৫ শতাংশ নয় সেটা ধরে নেওয়া ভুল হবে না।”

করোনা ভাইরাসের সব ভ্যারিয়েন্ট মাস্কে বাধা পড়ে

করোনাভাইরাস তার রূপ পাল্টেছে বহুবার। বর্তমান ‘ভ্যারিয়েন্ট’ পূর্বের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন বলে মনে করে বিশেষজ্ঞরা।

ফ্রিডেন বলেন, “মানুষের ভীড় এড়িয়ে চলা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর মাস্ক ব্যবহার করা সব ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেই সমান কার্যকর।”

শুধু করোনাভাইরাস নয় সকল ভাইরাসকেই প্রতিহত করতে পারে এই স্বাস্থ্যবিধিগুলো। তবে পরিষ্কার মাস্ক ব্যবহার এবং তা সঠিকভাবে ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।

আরও পড়ুন