অক্ষর যেন পরিধানের অলঙ্কার

অ, আ, ক, খ কিংবা পুরো একটি কবিতা- পোশাকের নকশায় ঠাঁই পায় বাঙালিয়ানায়।

ওমর শরীফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2021, 09:37 PM
Updated : 20 Feb 2021, 09:37 PM

টি-শার্ট কিংবা পশ্চিমা পোশাকে লেখা বা অক্ষর দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলার ধারা বহুকাল ধরেই চলছে। তবে দেশি পোশাকে বর্ণমালা বা কবিতার অংশ যখন নকশার মাধ্যম হয় তখন সেটা হয়ে যায় একান্তই বাঙালির অনুভূতি।

সেসব পোশাক ভাষার মাসেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশি ফ্যাশন হাউজগুলোতে। তবে অক্ষর দিয়ে নকশা করার বুদ্ধিটা ঠিক করে কবে থেকে ‍শুরু হয়েছিল তা নিয়ে রয়েছে নানান মতবাদ।

স্মৃতিচারণ মূলক বই ‘বাদামের খোসা’য় এক জায়গায় লেখা আছে দেশের একটি দৈনিক পত্রিকার ফ্যাশন-বিষয়ক সাময়িকী’র ফটোশুটের জন্য তারা নিজেরাই শাল ও শাড়িতে বাংলা বর্ণমালা লিখে নকশা করেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির বিশেষ সংখ্যার জন্য করা সেই আয়োজন থেকেই হয়ত দেশি পোশাকে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে নকশা করা শুরু।

আর সেই বুদ্ধিটাও এসেছিল, সরিষাবাড়িতে ১৯৯৬ সালে ‘নকশ কাঁথার মাঠ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খাঁদি পাঞ্জাবিতে ভরাট সুতায় বর্ণমালার কাজ করেছিল- সেখান থেকে। তবে তার আগে বর্ণমালা পোশাকের নকশায় স্থান পায়নি, তা কিন্তু নয়।

পোশাক নকশকর ও গবেষক চন্দ্রশেখর সাহা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা ১৯৮২ বা ৮৩ সালের দিকে আড়ংয়ের হয়ে পোশাকে বর্ণমালা ব্যবহার করেছিলেন। শাড়ি, শার্ট ও পাঞ্জাবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল বাংলা অক্ষর।

শুধু তাই নয়, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, নিউমার্কেটের একটি দোকানের জন্য শাড়িতে নকশা ফোটাতে ব্যবহার করেছিলেন বাংলা বর্ণমালা। তথ্যটি জানান, দেশি ফ্যাশন ঘর রঙ বাংলাদেশ’য়ের কর্ণধার সৌমিক দাস।

রঙ বাংলাদেশ’য়ের কর্ণধার সৌমিক দাস।

সৌমিক বলেন, “আসলে কত আগে থেকে অক্ষর দিয়ে দেশি পোশাকে নকশার কাজ শুরু হয়েছিল তা ঠিক মনে নেই। তবে বহু আগে কামরুল হাসানের এরকম কাজ আমি দেখেছি।”

রঙ বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাকেও ব্যবহার করা হয় অক্ষর কিংবা পংক্তি। তবে সরাসরি নয়, অক্ষর দিয়ে লোকজ-মোটিফের সংমিশ্রণে করা হয় নানান নকশা।

রঙ বাংলাদেশ’য়ের পোশাকে ফুটেছে বাংলা অক্ষর।

৮০’র দশকেই কিছু কিছু পোশাকে দেখা গিয়েছিল অক্ষর দিয়ে নকশা করা। তবে সেগুলোর সংখ্যা ছিল খুবই কম।

কে ক্র্যাফট’য়ের কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, “আশির দশকের দিকে আমি চারুকলার কিছু ছাত্রদের এরকম কাজ করতে দেখেছি। সৌখিন কাজ ছিল সেগুলো। আমার মনে হয় নব্বইয়ের পর থেকেই বিস্তৃতি আকারে নকশার জন্য বর্ণমালার ব্যবহার শুরু হয়।”

কে ক্র্যাফট’য়ের কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান।

“শুধু অক্ষর নয়, বিভিন্ন শ্লোগান, কবিতার লাইনও চলে এসেছে পোশাকে। আর সেসব ফোটাতে প্রথম দিকে হাতেই আঁকা হত। তারপর তো স্ক্রিন প্রিন্ট আসার পর হাতে আঁকার পরিমাণ কমলো। আমরাও এরকম কাজ করেছি। দেশাত্মবোধক গানও নিয়ে আসা হয়েছে পোশাকের নকশায়।” বললেন খালিদ।

শুধু বাংলা অক্ষর নয়, অন্য ভাষার অক্ষরও বাঙালি পোশাকের জমিনে উঠে এসেছে।

কে ক্র্যাফট’য়ের শার্টে ফুটেছে বর্ণমালার নকশা।

খালিদ আরও বলেন, “২০০৪ সালের দিকে চাইনিজ বর্ণমালা দিয়েও পোশাকে নকশা ফুটিয়েছি আমরা। এছাড়া নিত্য উপহারও বর্ণমালা দিয়ে কাজ করেছে। আর বাংলা আদী বর্ণমালা ব্যবহার করেও আমরা কাজ করেছি। বর্ণমালার বিবর্তন ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল বিভিন্ন মোটিফে। এছাড়া শালে বুননে অর্থাৎ হাতে আঁকা বা স্ক্রিন প্রিন্টে নয়, সুতার বুননে অক্ষর দিয়ে নকশা করেছিলাম আমরা।”

২০০০ সালের দিকে শতাব্দী নামের একটি প্রতিষ্ঠানও শাড়ির আঁচলে বুননে অক্ষর দিয়ে নকশা করেছিল বলে জানান খালিদ।

শুধু অক্ষর নয় সুতার কাজে নকশা করে শহীদ মিনার ফুটিয়ে তোলার কাজও হয়েছে। গত বছর বিশ্বরঙ এরকম শাড়ি ও পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়েছিল।

বিশ্বরঙ’য়ের কর্ণধার বিপ্লব সাহা।

বিশ্বরঙ’য়ের কর্ণধার বিপ্লব সাহার কথায়, ২০০৫-৬’য়ের দিকে শাড়িতে ব্লকপ্রিন্টের মাধ্যমে অক্ষর দিয়ে নকশা করেছিলাম আমরা। এখন-তো আর সরাসরি অক্ষর ব্যবহার করা হয় না। ‘অ’, ‘ই’ বা ‘ঈ’র সঙ্গে নানান মোটিফে বিমূর্ত শিল্পের ছটা দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা।”

বিপ্লব আরও বলেন, “সাত-আট বছর আগে ‘মা’ শব্দটা বিভিন্ন ভাষায় লিখেও নকশা করা হয়েছিল আমাদের পোশাকে। এছাড়া পূজার বিশেষ পোশাকে সংস্কৃত বর্ণমালাও ব্যবহার করা হয় নকশা হিসেবে।”

বিশ্বরঙ’য়ের পোশাকে বর্ণমালা।

অক্ষর, শ্লোগান কিংবা কবিতার অংশ যাই ব্যবহার করা হোক পোশাকের নকশায় সেগুলো যে ক্রেতাদের সবসময়ই আকৃষ্ট করে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিবিয়ানা’র কর্ণধার লিপি খন্দকার।

বিশেষ দিনগুলোতে বিশেষ পোশাক পরার এই বিষয়-সম্পর্কে বিবিয়ানার কর্ণধার ও নকশাকর লিপি খন্দকার বলেন, “আশির দশকে আমাদের মা-খালাদের কাছে কালো পাড়ের সাদা শাড়ি সংগ্রহে থাকতোই। সেই সময় প্রভাত ফেরিতে সেসব পরেই আমরা গিয়েছি। এই ভাষার মাস এখন তো আর শুধু শোকের মাস নয়, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে এটা আমাদের গর্বের আর আনন্দের। ফলে দেখা যায় শুধু শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নয়, এই ভাষার মাসে নানান সেমিনার হয়, বইমেলা চলে কিংবা কোথাও কোনো অনুষ্ঠান হয়। সেখানে ঐতিহ্যবাহী কালোপাড়ের সাদা শাড়ির সঙ্গে যদি অন্যান্য নকশা ফুটিয়ে তুলতে অক্ষর কিংবা কবিতা ব্যবহার করা হয় তখন পোশাকে সেটা আলাদা মাত্রা তৈরি করে। আর সব মানুষই চায় নিজেকে একটু অন্যভাবে সাজাতে। সেদিক থেকে পোশাকের নকশায় বর্ণমালার ব্যবহার যেমন দেয় নতুনত্ব তেমনি ক্রেতারাও আকৃষ্ট হয়।”

লিপি খন্দকার আড়ংয়ের ডিজাইনার ছিলেন। সেই সময় অক্ষর নিয়ে তিনিও নকশা ফোটাতে কাজ করেছেন। এরপর নিজের প্রতিষ্ঠান বিবিয়ানা গড়ে তোলার পর পঞ্চকবির কবিতা নিয়েও কাজ করেছেন।

বিবিয়ানা’র পর্দা, কুশন, চাদরে ‘তুই কি আমার দুঃখ হবি’।

শুধু পোশাকে নয় পর্দা, কুশন ও বিছানার চাদরের নকশাতেও ব্যবহার করা হয়েছে আনিসুল হকের ‘তুই কি আমার দুঃখ হবি’ কবিতার পংক্তি। দেশি কবির পাশাপাশি লিপি খন্দকারের পোশাকে জায়গা করে নিয়েছে শেক্সপিয়ার ও রুমি’র কবিতা।

এবার লিপি খন্দকারের কথার খেই ধরে অতীতে ফিরে যাওয়া যাক কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের হাত ধরে।

এই কবি ২০১২ সালে ফ্যাশন হাউজ অঞ্জন’স’য়ের একটি প্রদর্শনীতে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন এভাবে,

“বইমেলায় বসে আছি আমি ও কবি শামসুর রহমান। হঠাৎ শামসুর রহমান বলে উঠলেন, ‘দেখুন, একটি শাড়ি হেঁটে যাচ্ছে।’ আমি দেখলাম দারুণ একটা সাদা শাড়ি। তিনি বলছেন, ‘আমি তাকিয়ে দেখি সাদা সেই শাড়ি বাংলা বর্ণমালায় ভরা। আর সেটা পরে হেঁটে চলেছেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম, পোশাকেও এমন দেশপ্রেম হতে পারে!”

কবির এই কথায় রেশ ধরে বলি, বিশেষ দিনের পোশাকে দেশপ্রেম ফুটিয়ে তুলতে পোশাকে অক্ষর, বর্ণমালা, শ্লোগান আর কবিতার ব্যবহার বহু আগে থেকেই চলে আসছে। আর সেই দেশপ্রেমের সঙ্গে বাঙালির অনুভূতির অদ্ভূত আনন্দের প্রকাশ পায় যখন দেশি পোশাকে জ্বল জ্বল করে মাতৃভাষার অক্ষরগুলো।