টি-শার্ট কিংবা পশ্চিমা পোশাকে লেখা বা অক্ষর দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলার ধারা বহুকাল ধরেই চলছে। তবে দেশি পোশাকে বর্ণমালা বা কবিতার অংশ যখন নকশার মাধ্যম হয় তখন সেটা হয়ে যায় একান্তই বাঙালির অনুভূতি।
সেসব পোশাক ভাষার মাসেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশি ফ্যাশন হাউজগুলোতে। তবে অক্ষর দিয়ে নকশা করার বুদ্ধিটা ঠিক করে কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে রয়েছে নানান মতবাদ।
স্মৃতিচারণ মূলক বই ‘বাদামের খোসা’য় এক জায়গায় লেখা আছে দেশের একটি দৈনিক পত্রিকার ফ্যাশন-বিষয়ক সাময়িকী’র ফটোশুটের জন্য তারা নিজেরাই শাল ও শাড়িতে বাংলা বর্ণমালা লিখে নকশা করেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির বিশেষ সংখ্যার জন্য করা সেই আয়োজন থেকেই হয়ত দেশি পোশাকে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে নকশা করা শুরু।
আর সেই বুদ্ধিটাও এসেছিল, সরিষাবাড়িতে ১৯৯৬ সালে ‘নকশ কাঁথার মাঠ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খাঁদি পাঞ্জাবিতে ভরাট সুতায় বর্ণমালার কাজ করেছিল- সেখান থেকে। তবে তার আগে বর্ণমালা পোশাকের নকশায় স্থান পায়নি, তা কিন্তু নয়।
পোশাক নকশকর ও গবেষক চন্দ্রশেখর সাহা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা ১৯৮২ বা ৮৩ সালের দিকে আড়ংয়ের হয়ে পোশাকে বর্ণমালা ব্যবহার করেছিলেন। শাড়ি, শার্ট ও পাঞ্জাবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল বাংলা অক্ষর।
শুধু তাই নয়, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, নিউমার্কেটের একটি দোকানের জন্য শাড়িতে নকশা ফোটাতে ব্যবহার করেছিলেন বাংলা বর্ণমালা। তথ্যটি জানান, দেশি ফ্যাশন ঘর রঙ বাংলাদেশ’য়ের কর্ণধার সৌমিক দাস।
রঙ বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাকেও ব্যবহার করা হয় অক্ষর কিংবা পংক্তি। তবে সরাসরি নয়, অক্ষর দিয়ে লোকজ-মোটিফের সংমিশ্রণে করা হয় নানান নকশা।
কে ক্র্যাফট’য়ের কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, “আশির দশকের দিকে আমি চারুকলার কিছু ছাত্রদের এরকম কাজ করতে দেখেছি। সৌখিন কাজ ছিল সেগুলো। আমার মনে হয় নব্বইয়ের পর থেকেই বিস্তৃতি আকারে নকশার জন্য বর্ণমালার ব্যবহার শুরু হয়।”
শুধু বাংলা অক্ষর নয়, অন্য ভাষার অক্ষরও বাঙালি পোশাকের জমিনে উঠে এসেছে।
২০০০ সালের দিকে শতাব্দী নামের একটি প্রতিষ্ঠানও শাড়ির আঁচলে বুননে অক্ষর দিয়ে নকশা করেছিল বলে জানান খালিদ।
শুধু অক্ষর নয় সুতার কাজে নকশা করে শহীদ মিনার ফুটিয়ে তোলার কাজও হয়েছে। গত বছর বিশ্বরঙ এরকম শাড়ি ও পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়েছিল।
বিপ্লব আরও বলেন, “সাত-আট বছর আগে ‘মা’ শব্দটা বিভিন্ন ভাষায় লিখেও নকশা করা হয়েছিল আমাদের পোশাকে। এছাড়া পূজার বিশেষ পোশাকে সংস্কৃত বর্ণমালাও ব্যবহার করা হয় নকশা হিসেবে।”
লিপি খন্দকার আড়ংয়ের ডিজাইনার ছিলেন। সেই সময় অক্ষর নিয়ে তিনিও নকশা ফোটাতে কাজ করেছেন। এরপর নিজের প্রতিষ্ঠান বিবিয়ানা গড়ে তোলার পর পঞ্চকবির কবিতা নিয়েও কাজ করেছেন।
এবার লিপি খন্দকারের কথার খেই ধরে অতীতে ফিরে যাওয়া যাক কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের হাত ধরে।
এই কবি ২০১২ সালে ফ্যাশন হাউজ অঞ্জন’স’য়ের একটি প্রদর্শনীতে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন এভাবে,
“বইমেলায় বসে আছি আমি ও কবি শামসুর রহমান। হঠাৎ শামসুর রহমান বলে উঠলেন, ‘দেখুন, একটি শাড়ি হেঁটে যাচ্ছে।’ আমি দেখলাম দারুণ একটা সাদা শাড়ি। তিনি বলছেন, ‘আমি তাকিয়ে দেখি সাদা সেই শাড়ি বাংলা বর্ণমালায় ভরা। আর সেটা পরে হেঁটে চলেছেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম, পোশাকেও এমন দেশপ্রেম হতে পারে!”
কবির এই কথায় রেশ ধরে বলি, বিশেষ দিনের পোশাকে দেশপ্রেম ফুটিয়ে তুলতে পোশাকে অক্ষর, বর্ণমালা, শ্লোগান আর কবিতার ব্যবহার বহু আগে থেকেই চলে আসছে। আর সেই দেশপ্রেমের সঙ্গে বাঙালির অনুভূতির অদ্ভূত আনন্দের প্রকাশ পায় যখন দেশি পোশাকে জ্বল জ্বল করে মাতৃভাষার অক্ষরগুলো।