বাঁশতলার স্মৃতিসৌধ দেখতে

টিলার ওপর মাঠ, এমন দৃশ্য হয়। তবে টিলার ওপর চোখ জুড়ানো স্মৃতিসৌধ! এমনটি না দেখে থাকলে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা গ্রামে।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2018, 07:38 AM
Updated : 16 Dec 2018, 07:38 AM

শুধু স্মৃতি সৌধ নয়, এখানে আছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধী বা কবর। সব মিলিয়ে তিন দিকে মেঘালয় পর্বতমালা ঘিরে থাকা বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ এক কথায় অসাধারণ।

এখানে সৌন্দর্যের আরও সঙ্গী পাবেন- চেলাই খালের ওপর স্লুইজগেট বা পানির ব্যারেজ ও টিলার ওপর জুমগাঁও।

বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ ইতিবৃত্ত

ডাউক সড়ক থেকে সুনামগঞ্জ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ নং সেক্টর। পাঁচ নং সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। সাব সেক্টর ছিল সুনামগঞ্জ জেলার বাঁশতলা। এখানকার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন।

পাহাড় ঘেরা বাঁশতলা এলাকায় এবং তার আশপাশে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হন তাদের সমাহিত করা হয় বাঁশতলার এই নির্জনে। সেই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য নির্মাণ হয় বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ। এলাকাবাসির কাছ থেকে জানা যায় প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয় করে বাঁশতলায় এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন।

আমাদের বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ দেখা

২০০৬ সালের ঘটনা। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আমীন আহমেদ চৌধুরীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র ইতিহাস জানতে গেলে তিনি আমাদের সিলেট ক্যান্টনমেন্টের স্মৃতিভাস্কর্য নির্মাণের গল্প শোনাতে গিয়ে বাঁশতলা স্মৃতিসৌধের গল্প বলেছিলেন। সে গল্প ভুলতে বসেছিলাম। তরতাজা করলেন সিলেটের বন্ধুরা।

তাদের নিয়ে বেশ কয়েকবার পরিকল্পনা হল, তবে সময় হলনা। এভাবেই দিন যাচ্ছিল, একদিন আচমকা বাঁশতলা যাওয়ার প্রস্তাব পেলাম।

রাত সাড়ে বারটার ইউনিক বাসে আমরা সিলেট যাত্রা করে কনকনে শীতের ভোরে সিলেট পৌঁছে কোনো রকম বিশ্রাম ছাড়াই আম্বরখানা চলে আসি। তার আগে বন্ধু সামিউল্লাহ লাহিড়ীকে মোবাইল করে আমাদের আসার খবর দিয়ে যাবতীয় ব্যবস্থার কথা বলি।

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ। শীতের আমেজ ভালোই। ভোরের আলো ভালো করে না ফুটলেও বাসস্ট্যান্ড ও মাজার এলাকায় জমজমাট না হলেও মোটামুটি লোকজন আছে।

তারপর আম্বরখানা নেমে সম্রাটের খোঁজ করে র’-চায়ে চুমুক দেই। সম্রাট আম্বরখানায় আগে থেকেই সিএনজি চালিত অটোরিকশা ঠিক করে রেখেছিল। সেই অটোরিকসায় রওনা হলাম ৪০ কিলোমিটার দূরের ছাতকের দিকে।

যানজট-হীন সে রাস্তায় যাত্রাসঙ্গী শরীফ চোখ বুজে ঘুমের ভান করলেও সামিউল্লাহ লাহিড়ী ইচ্ছে মতো বলে চলে বাঁশতলার গল্প। তার গল্প বলার কারণ সে এর আগেও বাঁশতলা ঘুরে এসেছে। সামিউল্লাহর সে গল্প শুনে শুনে আমরা এগিয়ে চলি ছাতকের উদ্দেশ্যে।

দিনের শুরু হচ্ছে সঙ্গে শুরু হচ্ছে মানব কোলাহল। সেসব কোলাহল পেরিয়ে অচেনা নিস্তব্ধ নিঝুম পথে চলতে সময় লাগেনা। এখানে পথের দুপাশের সৌন্দর্য অসাধারণ সঙ্গে মিষ্টি পাখির ডাক। এভাবেই কখন চোখ বন্ধ হয়েছে জানি না। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর শরীফের ডাকে ঘুম ভাঙে। আমরা ছাতক বাজার চলে এসেছি।

এখানে পাবলিক খেঁয়াঘাট থেকে নৌকায় ১০ মিনিটে সুরমা নদী পার হয়ে চলে আসি নোয়ারাই বাজার। সেখান থেকে আবার সিএনজি চালিত অটো রিকশায় প্রায় দেড় ঘন্টায় বাংলাবাজার হয়ে বাঁশতলা। অবশ্য বাঁশতলা স্মৃতিসৌধে পৌঁছাবার আগেই মুগ্ধ হতে হয়।

সে মুগ্ধতা এনে দেয় এখানকার স্লুইজগেট। চেলাই খালের ওপর নির্মিত এই গেট দেখার পর পা আর আগে বাড়তে চাচ্ছিলনা। তবু শরীফ আর সম্রাটের তাড়া খেয়ে আগে বাড়তে হয়।

তবে কথা হয় ফেরার পথে স্লুইজ গেটে আমরা অনেক সময় থাকব, আর যাব জুমগাঁও। টিলার ওপর পাহাড়ি গ্রাম। এখানে প্রায় ৩৬ ক্ষুদ্রজনগোষ্ঠী পরিবারের বসবাস। শুনে তো আমার পা আবার থমকে যায়।

তারপর আবার এগিয়ে চলি স্মৃতিসৌধে। তারপর তো অল্প সময়, চলে আসি বাঁশতলা স্মৃতিসৌধে।

ছাতক পাবলিক খেয়াঘাট থেকে বাঁশতলা যাওয়ার পথটির প্রাকৃতিক শোভা বেশ সুন্দর। সে ভালো লাগার মাত্রা বেড়ে যায় বাঁশতলা পৌঁছে। এমন সুন্দর অভাবনীয়, মন আনন্দে ভরে উঠল।

ভারত সীমান্ত ঘেরা বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ এখন আমাদের একেবারে চোখের সামনে। শীতের দিন হলেও আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন নয়, সূর্য উঠেছে। ঝকঝকে নীলাকাশ যাকে বলে। আর হাত বাড়ানো দূরত্বে পাহাড়। আকাশ তলে পাহাড় আর স্মৃতিসৌধ ভাবতে ভাবতে মুখ থেকে বের হয়ে আসে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় আর পাহাড়ে হেলান দিয়ে স্মৃতিসৌধ।’ জাতীয় কবির গানে একটা লাইন জুড়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু সুর জুঁড়ে দিতে পারলাম না। তবু গুনগুনিয়ে চেষ্টা করি।

গুনগুন সে চেষ্টায় সম্রাট আর শরীফ চমকে তাকায়। তাদের সে চমক চোখে নিয়ে স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখি। এখানে পর্যটক বলতে আমরা তিনজন। স্মৃতিসৌধ তো বটেই পুরো এলাকাটাই অসাধারণ সৌন্দযের্ ঘেরা। সেই মনোরম মুগ্ধতা ছড়ানো সুন্দরকে ছুঁয়ে চলে আসি সমাধিস্থলে।

এখানে দেয়ালের একপাশে লাইন করা স্মৃতিসৌধ আর তাদের ছায়া হয়ে আছে অজস্র বৃক্ষরাজি। সমাধি এলাকায় পা রাখতেই দুচোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। এখানে মোট ১৪টি সমাধিতে শুয়ে আছে আমাদের ১৪ ভাই। মিরপুর, কাটাসুর আর বুড়িগঙ্গা হয়ে এমন অজস্র ভাই আমাদের শুয়ে আছে সমগ্র বাংলাদেশে। এখানে শীত-গ্রষ্ম যাবে আসবে, দিন-রাত হবে তবে আমাদের সেসব ভাইয়েরা আর ফিরে আসবেনা।

ভাবতে ভাবতে বাঁশতলাকে বিদায় বলে জুমগাঁওয়ের পথ ধরি।

প্রয়োজনীয় তথ্য

সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে বাঁশতলা যাওয়া যায়। আবার ছাতক উপজেলা থেকেও বাঁশতলা যাওয়া যাবে। দিনরাত ঢাকা-সিলেট-সুনামঞ্জ বাস চলাচল। সুবিধা মতো সময়ে হানিফ, ইউনিক কিংবা শ্যামলির বাসে চেপে বসলেই হবে। আমরা সিলেট-ছাতক-দোয়ারা বাজার হয়ে বাঁশতলা গিয়েছিলাম।

সন্ধ্যার বাসে যাত্রা করলে রাত বারোটার মধ্যে সিলেট পৌঁছে রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে পরদিন বাঁশতলা। সাত-সকালে আম্বরখানা থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় ছাতক আসতে হবে। ভাড়া মাথা পিছু ৮০ থেকে ১০০ টাকা।

এবার ছাতক বাজার থেকে সুরমানদী পার হয়ে সিএনজিতে চেপে সরাসরি বাঁশতলা।

দুরাত একদিনের ভ্রমণ। তাই বাঁশতলা বেড়াতে স্পেশাল কোনো ছুটির অপেক্ষা করতে হবে না। যে কোনো বৃহস্পতিবার বের হয়ে শনিবার ভোরেই ঢাকা থাকতে এবং কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত হতে পারবেন!

সচেতনতা

বেড়াতে বের হয়ে কখনও গাছাড়া ভাব দেখাবেন না। সব সময় সাবধান ও সর্তকতার সঙ্গে চলাচল করবেন। খাবার স্যালাইন পানি ও শুকনা খাবার এবং প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখবেন। যেখানেই যান, একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন আপনার বা আপনার ভ্রমণ সঙ্গীদের মাধ্যমে পরিবেশ যেন হুমকিতে না পড়ে। পলিথিন বা প্লাস্টিকের বোতলসহ পরিবেশ বিপন্ন হয় তেমন কিছুই কোথাও কোনো ভাবেই ফেলবেন না।

ছবি: লেখক।