মা হওয়ার পরে

‘মা’ শব্দটার মাঝে আছে পৃথিবীর সকল ভালোবাসা। সন্তান জন্ম দেওয়া মানেই মা নয়, মা হওয়া একটা সাধনার মতো।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2018, 03:19 AM
Updated : 17 May 2018, 08:30 AM

দশ মাস সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার পর একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক অনেক পরিবর্তন আসে। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর কারও ওজন বাড়ে, অনেকের আবার স্বাস্থ্য ভাঙে। সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে অনেক মা নিজের প্রতি আর খেয়াল রাখতে পারেন না। অনেকে তখন মায়ের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলে, যা অনেক কষ্টদায়ক।

শিমু লতা মৃধা, বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও এন্টারপ্রেনরশিপ’ বিভাগের প্রধান। তার কাছে মাতৃত্ব মানে ‘তিলে তিলে মা হয়ে ওঠা’। সন্তান জন্ম দিয়েই কেবল মা হতে হয় আর সন্তান জন্ম না দিলে যে মা হওয়া যায় না- এটা তিনি মানেন না।

তার মতে, “মা হতে হয় সাধনা করে। অনেক মা আছে যারা সন্তান দত্তক নেন, তারপর একটু একটু করে তার দেখাশুনা করা, তার জন্য ভালোবাসা, তার ভালো মন্দের খোঁজ রাখা, তার জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী তৈরি করার চেষ্টা করেন। এটাই তো তার মাতৃত্বের প্রকাশ।”

শিমু লতা নিজে একজন মা। সন্তান হওয়ার পরে তার জীবনে কেমন পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার আগে থেকেই রাত জেগে বই পড়ার অভ্যাস। তবে সন্তান হওয়ার পরে যখন একটা নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছিল তখন বেশ কষ্টের ছিল। সারা রাত সন্তানের খেয়াল রাখা, পরের দিন আবার কাজে বাইরে যাওয়া আবার একই ঘটনা- এমন করে চলতেই থাকতো।”

“মাঝে মাঝে ঘুমে চোখ লেগে আসছে এমন সময় সন্তান কেঁদে ওঠে, তখন সব কিছু বাদ দিয়ে ওর কী সমস্যা হচ্ছে তা দেখতাম। একটা সময় মনে হত সে কবে বড় হবে। তারপরও সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এই কষ্ট একটা ভালোলাগায় পরিণত হয়। চোখের সামনে সন্তানকে একটু একটু করে বড় হতে দেখার মতো তৃপ্তি আর কিছুতে নেই।”

তার মতে, “মা পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গেই সন্তানের জন্য আপোস করতে পারে না। আর এই কারণেই সে ‘মা’ হয়ে ওঠে।”

নতুন মা হয়েছেন আশা আহমেদ। সন্তান হওয়ার পরে নিজের মাঝে কী ধরনের চারিত্রিক পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগে ধৈর্য শক্তি একদমই ছিল না। যে কোনো কিছুতেই খুব রেগে যেতাম, জোরে চিৎকার করতাম। মন ভালো না থাকলে যখন তখন বাসার বাইরে বের হতাম। কিন্তু মা হওয়ার পরে নিজের মাঝে হঠাৎ করেই পরিবর্তন এসেছে।”

“এখন বাবু ভয় পাবে এর জন্য নিজে থেকে খুব সতর্ক থাকি, চিৎকার করি না। বাড়িতে কোনো সমস্যা হলে যতটা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রাখি, মন চাইলো আর যখন তখন বাইরে চলে যাই না। কোথাও যাওয়ার আগেই বাবুর কথা মনে হয়, ও একা থাকবে, কোথাও গেলেও বার বার ফোন করে খোঁজ নেই বাবু ঠিক আছে কিনা। ঠিক মতো খেয়েছে কিনা। সত্যি বলতে ওকে একা রেখে কোথাও যেতে ইচ্ছাও করে না।”

“মাঝে মাঝে রাত জেগে শিশুকে পাহারা দিতে হয় পরের দিন সকাল থেকে আবার তার পিছনেই সময় দিতে হয়। প্রতিনিয়ত এভাবে থাকার পরেও সন্তানের মুখ দেখে একটা ভালোলাগা কাজ করে।” বলেন আশা।

রূম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী। ভালোবাসেন ঘুরে বেড়াতে। কাজের প্রয়োজন বা বেড়ানো যে কারণেই হোক না কেনো মাঝে মধ্যে শিশুকে বাড়িতে রেখেই কয়েকদিনের জন্য বাইরে যেতে হয়। তাছাড়া নিয়মিত অফিস তো আছেই।

মা হওয়ার আগে ও পরে জীবনের এই কর্মচঞ্চলতা কীভাবে সামলাচ্ছেন আর তার জীবনে কেমন পরিবর্তন এসেছে।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মা হওয়ার পরে দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। মানসিক পরিবর্তনও আসে। আমি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নেই যে তার বাবা বাসায় থাকবে। তাছাড়া কাজের চাপে অনেক সময় সন্তানকে সময় দেওয়া হয় না সেক্ষেত্রে পরে চেষ্টা করি তার জন্য আলাদা সময় বের করতে। আমরা বড়রা অনেকসময় মনে করি শিশু কিছু বুঝতে পারছে না। সত্যি বলতে ওরা সব বুঝে। বাবা-মা তাকে সময় দিচ্ছে কিনা বা কে তাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে এসবই শিশুরা বুঝতে পারে।”

কাজের চাপে অনেক সময় খাওয়া দাওয়া করা হয় না। নিজেরা ঠিক মতো খাই না খাই, সন্তান খেয়েছে কিনা সেদিকে সব সময় মনোযোগ থাকে।

তিনি আরও বলেন, “এখন মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে বাইরে কাজ করছে, নিজেদের অবস্থান মজবুত করছে। তারপরও আমাদের সমাজে এখন পর্যন্ত মেয়েদেরকে ঠিক মতো এগিয়ে যাওয়ার সুবিধা দিচ্ছে না। একজন মেয়ে যখন চাকুরি করতে যায় সে যদি বিবাহিতা হয় তাহলে আগেই তাকে জিজ্ঞেস করা হয় সন্তান কবে নেবেন। কারণ এটা তার কাজে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে অনেক বড় বড় কাজের নেতৃত্বে নারীরা নেই যার মূল কারণ তার সন্তান আছে। সে চাইলেই ঠিক মতো কাজ করবে না।”

অফিসগুলোতে ‘ডে কেয়ারের’ ব্যবস্থা না থাকায় মায়েরা ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। আবার বাড়িতেও কর্মজীবী মাকে শুনতে হয় তুমি তো বাইরে কাজ কর সন্তান তো অযত্নেই থাকবে। অফিসেও তাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হয় না এই বলে যে আপনার ছোট বাচ্চা আছে আপনি ঠিক মতো কাজটা শেষ করতে পারবেন না। নানান প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে মেয়েরা যখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন তখন আবার এই ধরনের প্রতিবন্ধকতা তাদের অনেকটাই পিছিয়ে দেয় বলে মনে করেন, রূম্পা।

আজকাল অনেকে মেয়ে নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য মা হতে চায় না। যার পেছনে সামাজিক ও পারিবারিক অসহযোগিতা অনেক বড় কারণ। আজ পরিবার, অফিস ও সামাজিক অবস্থা যদি নারীর জন্য সুন্দর পরিবেশ ও সন্তান পালনের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে মা ও সন্তান দুজনেই ভালো থাকবে আর সমাজও উপকৃত হবে।