এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ।
বাতাসে সাধারণত অক্সিজেন থাকে ২১ ভাগ। যদি কোনো কারণে এর ঘাটতি হয়ে অন্য সব গ্যাসের ঘনত্ব বা বালুকণার ভাগ বেড়ে যায়, তবে তাকে দূষিত বায়ু বলা হয়।
আগুন অক্সিজেন নষ্ট করে ব্যাপক মাত্রায়। বিশেষ করে যানবাহন ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়া বাতাসকে ব্যাপকভাবে দূষিত করে। সেই সঙ্গে হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া প্রভৃতি কেমিকল থেকে সৃষ্ট বিষক্রিয়ায়ও বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়।
বায়ুদূষণ থেকে হাঁপানি: হাঁপানি একটি প্রদাহজনিত অবস্থা। এতে কিছু উদ্দীপক শ্বাসনালিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে সাময়িকভাবে তা সরু করে দেয়। ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত যে ধুলা উড়ছে, তা হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট তৈরি করে। ধুলাবালি মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। শহরে দূষিত বায়ুর কারণে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা গ্রামের তুলনায় বেশি।
দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢোকার পর ফ্রি রেডিক্যালের সৃষ্টি হতে পারে, যা শ্বাসতন্ত্রের অসুখ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটির বেশি এবং প্রতিবছর বিশ্বে ২৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এ রোগের কারণে। এর মধ্যে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা চার লাখের মতো।
অন্যদিকে একই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে আরও ৫০ হাজার লোক এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বায়ুদূষণে সিওপিডি হওয়ার কারণ: ইংরেজিতে রোগটির নাম ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি। বাংলায় একে বলে ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টের অসুখ। এতে শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয় এবং রোগী শ্বাসকষ্টে ভোগে। তবে এটি অ্যাজমা বা হাঁপানি নয়।
ফুসফুসের শ্বাসরোধক প্রক্রিয়াটি দূষিত শ্বাস গ্রহণের কারণে ক্রমেই বাড়তে থাকে। এতে ফুসফুস দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রথমত, ফুসফুসের ছোট ছোট শ্বাসনালির ভেতরের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্বাসনালি স্থায়ীভাবে সংকুচিত হয় এবং সেখানে অতিরিক্ত শ্লেষ্মা তৈরি হয়ে বায়ুরোধক প্রক্রিয়াটি বাড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, ফুসফুসের বায়ুকুঠুরি অস্বাভাবিক প্রদাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এর সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা নষ্ট হয় এবং রক্তে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যায়।
বিশ্বে পাঁচ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার বেশি। এর কারণ বায়ূদূষণের হার বেশি।
দেশে বক্ষব্যাধির জন্য একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে আসা রোগীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টের অসুখ বা সিওপিডিতে আক্রান্ত।
শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে ঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষ করে শ্রমিক জনগোষ্ঠী, যারা যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়ে শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিচ্ছে কল-কারখানার সৃষ্ট ধূলিকণা এবং রাসায়নিক দ্রব্য পুড়ে সৃষ্ট বাষ্প।
বায়ুদূষণে ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ: যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স ২০১৪-এর সূচকে সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম স্থানে রয়েছে।
আর বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে শীর্ষে। এটি শুধু দুঃসংবাদ নয়, উদ্বেগেরও বিষয়। বাতাসে কার্বন মনো-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের কারণে ফুসফুসের প্রদাহ বাড়ছে।
দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢোকার পর সেখানে ফ্রি রেডিক্যাল সৃষ্টি হতে পারে। এই যে ফুসফুসের বহু ধরনের অসুখ, এগুলোই দীর্ঘদিন শরীরে থাকতে থাকতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়।
সঙ্গী করুন ভিটামিন 'সি': ভিটামিন 'সি'সমৃদ্ধ ফলমূল বা শাকসবজি খেলে বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া কমানো যায়। যারা ফুসফুসের জটিল রোগে ভুগছে তাদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
সম্প্রতি লন্ডন হাসপাতালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁপানি এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি নামের রোগে যারা ভুগছে তাদের রক্তে ভিটামিন 'সি'র মাত্রা কমে গেলে শ্বাসকষ্টে ভোগার ঝুঁকি বাড়ে।
আবার যেসব উপাদান দেহের জারণ প্রক্রিয়া ঠেকাতে পারে সেগুলো বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কমাতে পারে।
ভিটামিন 'সি'র মতো জারণ-নাশক উপাদান ফ্রি রেডিক্যালের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করতে পারে। দেহ কোষকলার ক্ষতি করার আগেই জারণ-নাশক উপাদান এসব ফ্রি রেডিক্যালকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে।
তবে দেহে এই ভিটামিনের কার্যকারিতা ২৪ ঘণ্টার বেশি থাকে না। এ জন্য প্রতিদিনই খানিকটা হলেও 'সি' ভিটামিন গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেবু, আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, আনারস, আমড়া, আম, আঙুর, কাঁচামরিচ, জলপাই, বরই, কামরাঙা, টমেটো, বাঁধাকপি, কমলালেবু ইত্যাদি ভিটামিন 'সি'র ভালো উৎস। এ সবই সহজলভ্য এবং তুলনামূলক সস্তা।
এছাড়া ভিটামিন 'সি' আমাদের দেহে লৌহ বা আয়রন শোষণে সাহায্য করে। মাছ বা মাংস অর্থাৎ আমিষজাতীয় খাবার খাওয়ার সময় সঙ্গে লেবু খেলে দেহের লৌহ শোষণ ক্ষমতা বাড়ে।
ছবি: রয়টার্স।