‘সুপারহিরো চরিত্র আমরাও সৃষ্টি করবো’

‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিশু-কিশোরসাহিত্যের নানা বিষয়ে ভাবনা জানাচ্ছেন শিশুসাহিত্যিক মাহফুজ রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।

কিডজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2023, 07:37 PM
Updated : 6 Feb 2023, 07:37 PM

মাহফুজ রহমান শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। এবছর শিশু-কিশোরসাহিত্যে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ পেয়েছেন তিনি, এর আগে ২০২০ সালে পেয়েছিলেন ‘পাঞ্জেরী ছোটকাকু আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার’।

অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিশু-কিশোরসাহিত্যের নানা বিষয়ে মাহফুজ তার ভাবনা জানাচ্ছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।

এবারের বইমেলায় আপনার নতুন কী কী বই প্রকাশিত হয়েছে বা পাওয়া যাচ্ছে?

মেলায় আমার নতুন কোনো বই আসেনি। গত বছর প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছিল কিশোর উপন্যাস ‘কং পাহাড়ে শয়তান’, সেটা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ময়ূরপঙ্খীতে আছে ছড়ার বই ‘গুল্টু’, সমগ্র প্রকাশনে পাওয়া যাবে ছবির বই ‘পরি আর ভাইরাস’। বাকি দুটি বই বাজারে নেই।

শিশু-কিশোরদের মানসিক উৎকর্ষ বিকাশে বইমেলা আরও কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন? আপনার কোনো পরামর্শ?

বইমেলা মূলত বাণিজ্যিক আয়োজন। আর দশটা বাণিজ্যিক আয়োজনে ঘটিবাটি, চুড়িফিতা থেকে ঢেউটিন বিক্রি হয়, আর এই আয়োজন কেবলই বই-কেন্দ্রিক। মূল পার্থক্যটা এখানেই। যেকোনো বাণিজ্যিক আয়োজনের লক্ষ্যই হলো প্রচার, প্রসার এবং অবশ্যই বিক্রি। বই বেচাকেনার সঙ্গে মানসিক উৎকর্ষের সম্পর্ক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা মানসিক উৎকর্ষের সম্ভাবনা তৈরি করে মাত্র। বই কেনা হলো, কিন্তু পড়া হলো না, তাহলে মানসিক উৎকর্ষ হবে কোত্থেকে! বইমেলা শিশু-কিশোরদের মানসিক উৎকর্ষ বিকাশে তখনই ভূমিকা রাখে, যখন পরিবার বা প্রতিষ্ঠান তাদেরকে বই পড়তে উৎসাহিত করে। আমাদের বইমেলা এখনো পুরোপুরি শিশুবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। নানাভাবেই পারেনি। মেলার পরিবেশ এবং বইয়ের মান—এই দুটিই বড় খামতির জায়গা।

আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে? শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করতে কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করে কি, আর কীভাবে?

লেখালেখি আমার কাছে ‘রুমাল থেকে বিড়াল’ বানানোর চেয়েও বড় এবং মহৎ ম্যাজিক। ছেলেবেলায় বই পড়ে শেষ করার পর ঘোরের মধ্যে থাকতাম। ভাবতাম, এটা কী পড়লাম! এটা কী দেখলাম! এটা কী শুনলাম! তখন তো অতশত বোঝার কথা নয়; এখন উপলব্ধি করি, বই আমাকে সীমাহীন কল্পনা করার সূত্র দিয়েছিল। কল্পনায় কিছু সৃষ্টি করার যে আনন্দ, সেটার নেশা বড় নেশা। ফলে লেখালেখির শুরু ওই আনন্দের নেশা থেকে।

এই আনন্দের নেশাই শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করার মূল অনুপ্রেরণা। তবে বয়স যত বাড়ছে, ততই একটা বিষয় উপলব্ধি করছি। চমৎকার একটা ছেলেবেলা কাটিয়েছি আমি। এখন ওই ছেলেবেলার মতো নির্ভার ও আনন্দে ভরপুর কিছু সময় কাটে লিখতে বসলে। যতক্ষণ লেখি বা লেখার চিন্তা করি, ততক্ষণ আমি আমার চরিত্রগুলোর সঙ্গে জীবনযাপন করি। এটা আমার কাছে হ্যারি পটারের ‘হগওয়ার্টস সিক্রেট প্যাসেজ’–এর মতো।

কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি চির শিশু, চির কিশোর’। শিশুদের জন্য লিখতে হলে নিজেকেও কি ‘শিশুমনের’ হতে হয়? ব্যাখ্যা করবেন।

হাজার চাইলেও এই বয়সে আমার মন শিশুর মতো হবে না। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি। হ্যাঁ, শিশুর মতো কৌতুহলী আমি হতে পারি, কিশোরের মতো ভাবার চেষ্টা করতে পারি। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আমার কাছে জরুরি শিশু–কিশোরদের মন বোঝার চেষ্টা করা। এখন এটাকে যদি ‘শিশুমন’ বলেন, তাহলে আমি একমত।   

শিশুসাহিত্যে ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটির রূপটি আসলে কেমন? শিশু-কিশোরদের মনে এটি কীভাবে ধরা দেয়?

একটা সংস্কৃতি লেখককে কতটা প্রভাবিত করল কিংবা একজন লেখক সংস্কৃতিতে কতটা প্রভাব ফেললেন, সেটাই মূলত ‘ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটি’ দেখিয়ে দেয়। কেবল বইপুস্তক নয়, লেখকের লেখায় জগতের সব সৃষ্টির প্রভাব অনিবার্য। এভাবে দেখলে দুনিয়ার সব লেখাই আদতে ‘ইন্টারটেক্সটচুয়াল’। তবে আপনি যদি উদাহরণ দিতে বলেন, তাহলে আমি অবশ্যই অবন ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’র কথা বলব। বিখ্যাত সুইডিশ লেখক সেলমা লেগরলফের ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চারস অব নিলস’ বেরিয়েছিল ১৯০৬ সালে। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত ‘বুড়ো আংলা’য় সেলমা লেগরলফের ওই বইয়ের প্রভাবের কথা ভাবুন একবার! এটাকে আমি মোটেও ‘অ্যাডাপ্টটেশন’ বলব না। এটা বরং আমার কাছে ‘ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটি’র মোক্ষম নজির।

একইভাবে শার্লক হোমস ও ফেলুদার কথাও বলা চলে। সত্যজিৎ রায়ের ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’র সঙ্গে স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ইটি’র সম্পর্কটাকেও হয়তো এই কাতারে ফেলা যায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার’ আমার খুব প্রিয় একটা বই। এবং এই সফদর আলীও খুব প্রিয় চরিত্র। তার সঙ্গে মার্কিন কার্টুনিস্ট রুব গোল্ডবার্গের ‘প্রফেসর বাটস’–এর সম্পর্কটা কি খেয়াল করেছেন! এটাও তো ‘ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটি’র আরেক উদাহরণ।

সম্প্রতি রোমানিয় সাহিত্যিক ইয়ন ক্রিয়াঙ্গার একটা গল্প পড়লাম, যেটার সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘টুনটুনি আর রাজার কথা’ গল্পের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি। আর এটা তো সবাই জানেন, দুনিয়ার সব রূপকথা আদতে একেকটা রসুনের কোয়া, এই কোয়াগুলো একটা গোড়া থেকেই উঠে এসেছে। অর্থাৎ রূপকথামাত্রই ‘ইন্টারটেক্সটচুয়াল’।

শিশু–কিশোরেরা এত জটিলতার মধ্যে যাবে না। ‘ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটি’ কী, কেন, কীভাবে—এসব নিয়ে ভাবার প্রশ্নই আসে না। তবে ‘ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটি’ গোপনে তাদেরকে বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার পথ দেখায়। সুইডেনের ওই নিলস হোলগারসন আর আমাদের বুড়ো আংলা যে একই পৃথিবীর অভিন্ন সত্তা, এটা মনের ভেতর গেঁথে গেলে শিশু–কিশোরের নিজের আকাশটা আরও বড় হয়ে যায়।

শৈশব-কৈশোরে আমরা যা পড়ি তার অনেকটাই বাকি পুরো জীবনে মনের কোণে ঠাঁই নেয়। আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক, ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মিনি, ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল, বিভূতিভূষণের ‘আম আঁটির ভেঁপুর’ অপু কিংবা নজরুলের ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটকের কমলি ইত্যাদির কথা বলতে পারি। আজকাল এ ধরণের চরিত্রগুলোর জায়গা নিয়ে নিচ্ছে বিদেশি জনপ্রিয় কল্পকাহিনির সুপারহিরো। ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন?

শিশু–কিশোররা নিজেকে কেবল একটা পাড়ার মানুষ না ভেবে গোটা দুনিয়ার মানুষ ভাবলে সব দিক দিয়ে মঙ্গল। তবে বিশ্বনাগরিক হওয়ার আগে নিজের মাটিটা চেনা জরুরি। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে আমাকে অবশ্যই ফটিক, মিনি, অপু, দুর্গাকে চিনতে হবে। এই চেনানোর দায়িত্ব পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং অবশ্যই লেখকের। প্রযুক্তির হাইপার জাম্পের কারণে অপু–দুর্গারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সন্দেহাতীতভাবে। এটা মাথায় রেখে সুপারহিরোদের মতো আকর্ষণীয় চরিত্র আমরাও সৃষ্টি করব বলে বিশ্বাস করি। এটার লক্ষ্মণ আপনি দেখবেন কিছু দেশি ওয়েবসিরিজের জনপ্রিয়তার মধ্যে। নেটফ্লিক্সে এত দুর্দান্ত কনটেন্ট থাকার পরও আমরা কেন দেশি কন্টেন্টে হুমড়ি খাই? একই যুক্তি শিশু–কিশোরসাহিত্যেও খাটে। কিছুটা সময় আমাদের লাগবেই। প্রযুক্তির হাইপার জাম্পে আমরা এখনো ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারিনি।

অন্যের অসঙ্গতি নিয়ে হাস্যরস, দুর্বলতা অনুকরণ করে রসিকতা, হালকা বাৎসল্য আজকাল শিশু-কিশোরসাহিত্যে দেখা যায়। এখানে একটা হায়ারার্কিকে চ্যালেঞ্জ করে অন্যটিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে কি?

যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বললেন, সেসব আদতে কৌতুকের বৈশিষ্ট্য। এসব ছাড়া কৌতুক হয় না। সমস্যা হলো, আমরা হাস্যরস (হিউমার) সৃষ্টি করতে গিয়ে ওই কৌতুক (জোক) উগড়ে দিই। আমরা বুঝি না, কোনটা হাস্যরস আর কোনটা কৌতুক। এই সমস্যা যুগে যুগে ছিল। এ কারণে বলা হয়, যার সেন্স অব হিউমার যত ভালো, তিনি ততটাই বুদ্ধিমান।

সমসাময়িক শিশুসাহিত্য অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী, নৈতিকতা নির্ভর হয়ে পড়েছে কি? এ শিশুরাই যখন পরবর্তীতে বাস্তব জগতে প্রবেশ করে তখন মিল খুঁজে পায় না, পৃথিবী যদি অসরলই হয়ে থাকে তাহলে আমরা কেন সাহিত্যে শিশুদের জন্য সরলতা সাজিয়ে দেখাচ্ছি?

জাতীয়তাবাদ কেবল শিশু-কিশোরসাহিত্য নয়, প্রতিটা ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। আর বই পড়িয়ে কখনো নৈতিকতা শেখানো যায় না, নৈতিকতা পুরোপুরি পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বিষয়। শিশু-কিশোর সাহিত্যে এসব ঢুকে পড়ে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে। এসবের চর্চা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। আর শিশুসাহিত্য সরল নয়, সহজ হওয়া জরুরি। শিশুসাহিত্যে সরলতা দেখানো মানে শিশুকে বিভ্রান্ত করা।

কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী নানাভাবে শিশুকিশোরদের মনস্তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। পাঠ্যবই ব্যবহারের চেষ্টা করে কিংবা দলীয় প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে। এ সর্বগ্রাসী শাসন থেকে শিশুদের মুক্ত করার উপায় কী? সৃজনশীল লেখকদের ভূমিকা কতোটুকু এখানে? 

কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সব সময় তাদের ঢোল পেটাতে চাইবে। এসবের ঊর্দ্ধে না উঠলে নিজেকে কেউ সৃজনশীল লেখক দাবি করতে পারেন না। কাজেই সৃজনশীল লেখকমাত্রই এর বিরুদ্ধে ক্রমাগত কাজ চালিয়ে যাবেন। এর চর্চা যত বাড়বে, শিশু-কিশোরদের ওপর প্রভাব পড়বে ততটা গভীরে।

শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভবিষ্যতে আর কী লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে আপনার?

আমি মূলত গল্প বলতে চাই। সেটা ছোটগল্প, উপন্যাস, কমিকস কিংবা ছড়ার ফর্মে হতে পারে। কখনো কেউ বলেনি, এমন গল্পই বলতে চাই।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!