বিধবা ও তোতাপাখি, প্রথম কিস্তি

ব্রিটিশ সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২ - ১৯৪১) শিশু-কিশোরদের জন্য ‘দ্য উইডো অ্যান্ড দ্য প্যারট’ শিরোনামে এ গল্পটি লেখেন ১৯২২-২৩ সালে। প্রায় ৬৬ বছর অজ্ঞাত অবস্থায় থাকার পর এ পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কার করেন উলফের ভাইয়ের ছেলে লেখক কোয়েটিন বেল। ১৯৮৮ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।

ফাহিমা কানিজ লাভাফাহিমা কানিজ লাভা
Published : 26 Oct 2022, 02:37 PM
Updated : 26 Oct 2022, 02:37 PM

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। ইয়র্কশায়ারে স্পিলবি নামে একটা গ্রাম ছিল। সেখানে থাকতেন এক বিধবা বৃদ্ধা, নাম মিসেস গেজ।

একদিন মিসেস গেজ তার কুটিরে বসে ছিলেন। যদিও তার এক পা খোঁড়া এবং চোখেও একটু কম দেখতেন, তবুও তিনি একজোড়া কাঠের জুতা মেরামত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন। কারণ এ সপ্তাহে চলার জন্য তার হাতে খুব বেশি টাকা-পয়সা ছিল না।

যখন তিনি কাঠের জুতায় প্রথম আঘাতটি করলেন, ঠিক তখনই দরজায় ডাকপিয়ন এলো। ডাকপিয়ন দরজা খুলে তার কোলে একটা চিঠি ছুড়ে দিল। চিঠিটার গায়ে ঠিকানা লেখা ছিল ‘মেসার্স স্ট্যাগ অ্যান্ড বিটল, ৬৭ নম্বর সড়ক, লুইস, সাসেক্স’। মিসেস গেজ চিঠিটা খুলে পড়লেন- ‘ম্যাডাম গেজ, আপনার ভাই মিস্টার জোসেফ ব্র্যান্ডের মৃত্যুর খবর আপনাকে জানাতে পেরে আমরা সম্মানিত।’

মিসেস গেজ বললেন, 'হায় খোদা! বড় ভাই জোসেফও শেষ পর্যন্ত চলে গেল!'

চিঠিতে আরো লেখা ছিল, ‘তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি আপনার জন্য রেখে গেছেন। এর মধ্যে আছে আপনার জন্য একটা থাকার ঘর, আস্তাবল, শসার মাচান, কাপড় ইস্ত্রি করার যন্ত্র, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি। এগুলো আছে লুইসের কাছে রডমেল গ্রামে। তিনি আপনার জন্য তার সমস্ত সঞ্চয় তিন হাজার পাউন্ড স্টার্লিং-ও রেখে গেছেন।’

মিসেস গেজ তার ভাইয়ের কৃপণ স্বভাবের সাথে ছোটবেলা থেকেই ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। পাল্টা শুভেচ্ছা কার্ড বা প্রতিউত্তর দেওয়ার জন্য এক পয়সা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনতে হবে, এটা হয়তো তাকে বিরক্ত করার জন্য যথেষ্ট!

মিসেস গেজ আনন্দের চোটে প্রায় আগুনেই পড়তে যাচ্ছিলেন। তিনি তার ভাইকে অনেক বছর ধরে দেখেননি, তবে তিনি প্রতি বছরই তাকে বড়দিনের শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাতেন। যদিও সেগুলোর জন্য তার ভাই কোনো প্রাপ্তিস্বীকার করেনি বা পাল্টা তাকে কোনো শুভেচ্ছাও জানায়নি। মিসেস গেজ তার ভাইয়ের কৃপণ স্বভাবের সাথে ছোটবেলা থেকেই ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। পাল্টা শুভেচ্ছা কার্ড বা প্রতিউত্তর দেওয়ার জন্য এক পয়সা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনতে হবে, এটা হয়তো তাকে বিরক্ত করার জন্য যথেষ্ট!

কিন্তু এখন এসব কথা ভেবে আর কাজ কী! বরং তিন হাজার পাউন্ড স্টার্লিং, একটা বাড়ি- এসব নিয়ে মিসেস গেজ এখন বাকি জীবন বিলাসিতায় কাটিয়ে দিতে পারবেন।

মিসেস গেজ ঠিক করলেন যে তাকে একবার রডমেল গ্রামে যেতে হবে। গ্রামের পাদ্রী রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয় তার যাতায়াতের ভাড়া পরিশোধের জন্য দুই পাউন্ড ধার দিলেন। পরদিন তার যাত্রার সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেল। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার অনুপস্থিতিতে তার কুকুর শ্যাগের যত্ন নেওয়া। মিসেস গেজ গরিব হলেও তিনি প্রাণীদের প্রতি খুবই দায়িত্বশীল ছিলেন এবং প্রায়ই কুকুরটিকে হাড় খাওয়াতে গিয়ে তার নিজের পাতেই খাবার কম পড়ে যেত।

মঙ্গলবার গভীর রাতে তিনি লুইসে পৌঁছান। আপনাদের জানিয়ে রাখি যে সেই দিনগুলোতে, সাউথইজ গ্রামে নদীর উপর কোনো সেতু ছিল না, কিংবা নিউহ্যাভেনের রাস্তা তখনো তৈরি হয়নি। রডমেলে যাওয়ার জন্য একটা সরু খাত দিয়ে হেঁটে ওউস নদী পার হতে হতো। এই পথের চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়, তবে সেখানে শুধু ভাটার সময়, যখন নদীর তলের পাথরগুলো পানির ওপর থেকে দেখা যায়, তখনই পার হওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।

পাখিটার মেজাজ বেশ চড়া। সে এককালে এক নাবিকের কাছে ছিল এবং তার কাছেই আজেবাজে ভাষা শিখে ফেলে।

মিস্টার স্টেসি একজন কৃষক। তিনি তার কার্টে (চার চাকার এক ধরনের ঘোড়ায় টানা মালগাড়ি) করে রডমেল যাচ্ছিলেন। পরোপকারী মিস্টার স্টেসি মিসেস গেজকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। নভেম্বরের সেই রাতে ৯টার দিকে তারা রডমেলে পৌঁছান এবং মিস্টার স্টেসি গ্রামের শেষ মাথায় মিসেস গেজকে সেই বাড়িটি দেখিয়ে দিলেন যেটি তার ভাই তার জন্য রেখে গিয়েছিল।

মিসেস গেজ ওই বাড়ির দরজায় টোকা দিলেন। কোনো সাড়া মিলল না। তিনি আবার টোকা দিলেন। এবার খুব অদ্ভুত এবং উচ্চস্বরে কেউ চিৎকার করে উঠল, ‘বাড়িতে কেউ নেই।’

এমন তীব্র আওয়াজে মিসেস গেজ এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে কারও পায়ের আওয়াজ না শুনলে তিনি হয়তো পালিয়েই যেতেন। যাইহোক দরজা খুললেন গ্রামের এক বুড়ি, নাম মিসেস ফোর্ড।

মিসেস গেজ বললেন, কে যেন চিৎকার করছিল ‘বাড়িতে কেউ নেই?’

একটি বড় ধূসর তোতাপাখির দিকে ইশারা করে মিসেস ফোর্ড খুব বিরক্তির ভাব নিয়ে বললেন, ‘ওই হাড়-জ্বালানো পাখিটা। সে প্রায়ই চিৎকার করে আমার দম বন্ধ করে ফেলে। ওইখানে তার বসার লাঠিটার ওপর সে সারাদিন মূর্তির মতো ঠায় বসে থাকে আর চিৎকার করে বলে ‘বাড়িতে কেউ নেই’। যদি কখনো তার বসার লাঠিটার কাছে যান, তবেই তাকে দেখতে পাবেন।’

মিসেস গেজ যেন মনের চোখে দেখতে পেলেন, পাখিটা এককালে খুব সুদর্শন ছিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো অবহেলায় পাখিটার পালকগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘সম্ভবত পাখিটার মনে সুখ নেই অথবা সে হয়তো ক্ষুধার্ত।’

কিন্তু মিসেস ফোর্ড জানালেন, পাখিটার মেজাজ বেশ চড়া। সে এককালে এক নাবিকের কাছে ছিল এবং তার কাছেই আজেবাজে ভাষা শিখে ফেলে। যাইহোক, মিস্টার জোসেফ পাখিটাকে খুবই পছন্দ করতেন এবং তাকে জেমস বলে ডাকতেন। তিনি নাকি পাখিটার সাথে এমনভাবে কথা বলতেন যেন সেটা কোনো একটা যুক্তিশীল মানুষ।

মিসেস ফোর্ড শীঘ্রই চলে গেলেন। মিসেস গেজ তার বাক্সে থাকা কিছু চিনি এনে তোতাপাখিটাকে দিলেন। তিনি খুব সদয় সুরে বললেন যে তিনি পাখিটার কোনো ক্ষতি করতে চাইছেন না; এ-ও বললেন যে তিনি পাখিটার পুরোনো মালিকের বোন এবং এই বাড়িটার দখল নিতে এসেছেন। তিনি বাড়িটা ঘুরে দেখবেন। যাইহোক, পাখিটা ততটাই খুশি থাকল যতটা একটা পাখির পক্ষে খুশি থাকা সম্ভব।

ওই পাখিটার ভাষা খুবই নোংরা। ওটা কোনো কাজেরই না। আমার মনে হচ্ছে আপনি অকারণেই এখানে আসলেন। বাড়িটাও জরাজীর্ণ এবং অবশ্যই আমাদের খরচও যথেষ্ট।

মিসেস গেজ একটা বাতি নিয়ে বাড়িটার চারপাশে ঘুরে দেখেছিলেন। তিনি বুঝতে চাইছিলেন যে তার ভাই তার জন্য কী ধরনের সম্পত্তি রেখে গেছে। কিন্তু এটা তার জন্য খুবই হতাশাজনক মনে হতে লাগল। বাড়িটার সমস্ত কার্পেটে গর্ত আর চেয়ারগুলোর তলা খসে পড়েছিল। চুলার ওপরের তাক দিয়ে একটা ইঁদুর দৌড়ে গেল। রান্নাঘরের মেঝেতে বড় বড় ব্যাঙের ছাতা (ছত্রাক জাতীয় উদ্ভদ) বেড়ে উঠেছিল। দুই পয়সা দাম পাওয়ার মতো কোনো আসবাবপত্রের কাঠও ছিল না সেখানে। শুধু এই ভেবে মিসেস গেজ নিজেকে উৎফুল্ল রাখছিলেন যে লুইস ব্যাঙ্কে অন্তত তিন হাজার পাউন্ড স্টার্লিং জমা আছে তার জন্য।

পরদিন মিসেস গেজ আইনজীবী স্ট্যাগ এবং বিটলের কাছ থেকে তার জন্য ভাইয়ের রেখে যাওয়া অর্থ দাবি করতে লুইসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তারপর তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে চান। মিস্টার স্টেসি ওইদিন কয়েকটা শূকর নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। আবারও তিনি মিসেস গেজকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। পথে স্টেসি তাকে কয়েকজন যুবকের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ানক সব ঘটনার গল্প শোনালেন। ওই যুবকেরা ভরা জোয়ারের সময় নদী পার হতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিল।

বেচারি মিসেস গেজ, তিনি সরাসরি মিস্টার স্ট্যাগের অফিসে দেখা করতে গেলেন। আর এখানেও তাকে হতাশই হতে হলো। মিস্টার স্ট্যাগ খুব গম্ভীর ও মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘দয়া করে বসুন ম্যাডাম। বাস্তবতা হলো আপনাকে কিছু অপ্রীতিকর সংবাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু আমিই আপনাকে চিঠিটা লিখেছি, পরে আমি নিজেই খুব যত্নের সাথে মিস্টার জোসেফ ব্র্যান্ডের কাগজপত্র দেখেছি। কিন্তু আফসোসের কথা যে তিন হাজার পাউন্ডের কোনো চিহ্নই আমি খুঁজে পাইনি। আমার সঙ্গী মিস্টার বিটল নিজে রডমেলে গিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনিও কিছুই খুঁজে পাননি- সোনা, রুপা বা কোনো মূল্যবান জিনিসপত্রই সেখানে নেই। শুধু একটা ধূসর রঙের তোতাপাখি আছে, ওটাকেই বরং আপনি বিক্রি করে দিন।'

বেঞ্জামিন বিটল বলেছেন, ‘ওই পাখিটার ভাষা খুবই নোংরা। ওটা কোনো কাজেরই না। আমার মনে হচ্ছে আপনি অকারণেই এখানে আসলেন। বাড়িটাও জরাজীর্ণ এবং অবশ্যই আমাদের খরচও যথেষ্ট।’ এটুকু বলেই মিস্টার স্ট্যাগ থামলেন। মিসেস গেজও ভালো করেই বুঝলেন যে তাকে এবার চলে যেতে হবে- এটাই মিস্টার স্ট্যাগের ইচ্ছা।

চলবে...

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!