তপন রায়চৌধুরীর গল্প: ফিরে তাকাই

পুজোতে একদল শিশু-কিশোর নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিলো। নাটকও ঠিক হল- সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’।

তপন রায়চৌধুরীতপন রায়চৌধুরী
Published : 9 May 2023, 09:26 AM
Updated : 9 May 2023, 09:26 AM

তখন আমি স্কুলে পড়ি। বিজয়া দশমীর পরের দিন অর্থাৎ একাদশীর দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম দশমীর প্রণামের পালা সারতে। প্রথমে বাবনদের বাড়ি। বাবনের বাবা-মা অর্থাৎ কাকা-কাকিমাকে প্রণাম করতাম। তারপর শুরু হত খাওয়া- নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, নিমকি, সেইসঙ্গে সিঙ্গারা রসগোল্লাও।

গত কয়েক বছর ধরে এমনই চলে আসছিল। কিছুটা সময় বাবনদের বাড়িতে কাটিয়ে আমি বেরিয়ে পড়তাম বাবনকে সঙ্গে নিয়ে, অর্থাৎ তখন দুজন হলাম, আমি আর বাবন। এরপর একই নিয়মে সুপ্রিয়’র বাড়ি। সুপ্রিয়কে নিয়ে তারপর বাচ্চুদের বাড়িতে। আমি, বাবন, সুপ্রিয়, বাচ্চু এইভাবে আমাদের বিজয়ার দলটা একটু একটু করে ভারি হয়ে উঠত প্রত্যেক বছরের মত। কত মজার দিন সব কাটিয়েছি! সেসব আজ স্বপ্ন মনে হয়।

এরকমই একটা পুজোর সময়, তখন বোধহয় আমার ক্লাস টেন, বিজয়ের প্রণামের পালা সাঙ্গ করে হঠাৎই একটা সকালে আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম, আজই সন্ধেবেলা একটা নাটক মঞ্চস্থ করলে কেমন হয়! আমি ছিলাম সবার মধ্যে বড়। বাবন ক্লাস ফোর, বাচ্চু ক্লাস ফাইভ, রুনু সিক্স, এইরকম আর কি। সবাই বলল, দারুণ হবে। যেমন ভাবা অমনি কাজ শুরু হয়ে গেল। আমি, বাবন, সুপ্রিয়, মিঠু, মিতালী, বাচ্চু, মৌসুমী, রুনু, শৈবাল এইরকম প্রায় দশজন একসঙ্গে হাজির হলাম আমাদের বাড়ির সামনের খেলার মাঠে।

একটা ছোটখাটো মিটিং হয়ে গেল আমাদের মধ্যে। ঠিক হল, সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নাটকটা করা হবে আজই সন্ধেবেলা। দু’একজন অবশ্য বলল, আজকেই... কী করে হবে, একদিনে? আমি বোঝালাম, কেন হবে না, মোটে তো পাঁচ-ছ’পাতার স্ক্রিপ্ট, এখন তিনবার মতন রিহার্সাল দিয়ে নেব, দুপুরে মাঠে স্টেজ বাঁধবো, সন্ধেবেলা শুরু হবে আমাদের বিচিত্রানুষ্ঠান। থাকবে মিতালির গান, শৈবাল আর মৌসুমী কবিতা আবৃত্তি করবে, বাচ্চু হাস্যকৌতুক, একদম শেষে আমাদের নাটক।

ব্যস, অ্যাকশন শুরু হয়ে গেল। আমরা সবাই মিলে বাবনদের বাড়িতে হাজির হলাম। কাকিমা সব শুনে প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেলেন, ভাবলেন নিশ্চয়ই, কীভাবে এত কম সময়ে একটা অনুষ্ঠান সম্ভব! তবে আমার পাগলামিতে কাকিমার ভরসা ছিল ষোলোআনা। পথিকের ভূমিকায় বাবন, প্রথম বৃদ্ধ বাচ্চু, দ্বিতীয় বৃদ্ধ মিঠু, তৃতীয় বৃদ্ধ রুনু, এইভাবে কাস্টিং হয়ে গেল বাকিগুলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই। তারপর রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল পুরোদমে।  

সেইসময় গোটা পাড়াটাই ছিল একটা পরিবারের মত। আমাদের আমান্ত্রণে সবাই খুশি হয়ে গেল দারুণ। আর, তারপর থেকেই আমার ভেতরে নার্ভাসনেস শুরু হয়ে গেল- সব ঠিক ঠিক মতন নামবে তো!

আমি একাধারে প্রম্পটার এবং পরিচালক। তিনবার রিহার্সাল হয়ে গেল। তারপর সবাই যে যার পার্ট লিখে নিল। বলে দিলাম, সবাই পার্ট মুখস্থ করবি বাড়িতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নানারকম ভুলভ্রান্তি, পার্ট ভুলে যাওয়া, ঠিকমত ক্যাচ করতে না পারা, এসবের মধ্যেই আমাদের রিহার্সাল পর্ব যখন শেষ হল তখন বোধহয় বেলা বারোটা হবে। বাবনদের বাড়ি থেকে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম সঙ্গে সঙ্গে। ঠিক হল, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে দুপুর দুটো নাগাদ আবার আমরা আমাদের খেলার মাঠটাতে হাজির হব। কারণ স্টেজ বানাতে হবে। আমি আর বাবন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এলাম, সন্ধে সাতটা নাগাদ আমাদের ফাংশন শুরু হবে, সবাই যেন অবশ্যই আসেন।

সেইসময় গোটা পাড়াটাই ছিল একটা পরিবারের মত। আমাদের আমান্ত্রণে সবাই খুশি হয়ে গেল দারুণ। আর, তারপর থেকেই আমার ভেতরে নার্ভাসনেস শুরু হয়ে গেল- সব ঠিক ঠিক মতন নামবে তো! কারণ আমার দায়িত্ব যে সবথেকে বেশি ছিল। দুপুর দুটো নাগাদ আমরা হাজির হলাম আমাদের খেলার মাঠে। স্টেজ বাঁধার জন্য একটা জায়গা ঠিক হল। তারপর আমরা সবার বাড়িতে বাড়িতে হানা দিলাম সদলবলে, স্টেজ তৈরির সরঞ্জাম যোগাড় করতে। বাবন, মিঠু, বাচ্চু এই তিনজনদের বাড়ি থেকে তিনটে পুরোনো খাট জোগাড় করলাম। সেই সঙ্গে গোটা পাঁচ ছয় সতরঞ্চি, খান ১০-১২ চেয়ার, দু’তিনটে বড় বড় ত্রিপলও জুটে গেল আমাদের অনুষ্ঠানের জন্য। বড় বড় কয়েকটা বাঁশও পেয়ে গেলাম। বিকেল পাঁচটার মধ্যে আমাদের স্টেজ রেডি হয়ে গেল। ইলেকট্রিকের কানেকশন নেওয়া হল দেবেনদার বাড়ি থেকে।

তখন অক্টোবর মাস। হালকা শীত নামতে শুরু করেছে। একটু যেন অন্ধকার ভাব চারদিকে। যে যার বাড়িতে চলে গেলাম তারপর। মাঠে যখন হাজির হলাম, তখন সন্ধে সাড়ে ছ’টা হবে। আমাদের স্টেজের এবং দর্শকের দিকের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সন্ধে সাতটার মধ্যে সবাইকে মেকআপ নিয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল। কথা হয়েছিল, যে যার বাড়ি থেকে মেকআপ করে আসবে। আমি মাইকে মাঝেমধ্যেই ঘোষণা করতে লাগলাম, আমাদের অনুষ্ঠান এখনই শুরু হতে চলেছে, আপনারা সবাই এসে আসন গ্রহণ করুন। দেখলাম, পাড়ার দাদা-দিদিরা, কাকা-কাকিমারা সব একে একে আসতে শুরু করেছেন। ফাঁকা চেয়ারগুলো সব ভরাট হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। মিতালিকে বলাই ছিল বেশ কয়েকটা গান রেডি রাখতে। ও বেশ ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারতো।  

এবার স্টেজের একটু বর্ণনা দিই। কয়েকটা খাট একসঙ্গে জড়ো করে স্টেজ করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটা শতরঞ্চি বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল খাটগুলোর ওপর। আর সেই স্টেজের তিনদিক ঘিরে ছিল ত্রিপল। ত্রিপলের ওপার থেকে আমি প্রম্পটিং-এর কাজ করব ঠিক হল। স্টেজের পেছনদিকে এক ফালি জায়গা রাখা হয়েছিল যার মাধ্যমে আমাদের নাটকের কুশীলবরা আসা-যাওয়া করতে পারে।

সন্ধে সাতটা পনেরো মিনিট নাগাদ মিতালির গান দিয়ে শুরু হল আমাদের ফাংশন। ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে দেখে নিলাম, বেশ লোকসমাগম হয়েছে। বাবন, বাচ্চু, রুনুসহ আমরা সবাই স্টেজের পেছনে অর্থাৎ ত্রিপলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা তখন রীতিমতন উত্তেজিত এবং আনন্দে আত্মহারা। মিতালির গান শেষে জোর হাততালি হল। এরপর শৈবাল কবিতা বলতে উঠলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’। মাঝে একটু গুলিয়ে গিয়েছিল শৈবালের, ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল স্টেজে, দর্শকের মধ্যে তখন হাসির রোল, সেইসঙ্গে আওয়াজ ‘কী হল’ ‘কী হল’। আমি ত্রিপলের পেছন থেকে ধরিয়ে দিলাম শৈবালকে। ও তখন দ্বিগুণ উৎসাহে কবিতাটা শেষ করল। জোর হাততালি তখন।  

এরপর বাচ্চুর ক্যারিকেচার। ও আবার এসবে সিদ্ধহস্ত। দর্শকরা দারুণ এনজয় করলো। তারপর মৌসুমীর কবিতা, সৈকতের গান এইরকম আরও দু-একটা আইটেমের পর শুরু হল আমাদের নাটক ‘অবাক জলপান’। নাটক শুরু হওয়ার আগে আমরা পাঁচ মিনিট স্টেজ অন্ধকার করে সময় নিলাম। কুশীলবদের সবাই একসঙ্গে জড়ো হল স্টেজের পেছনে। আমাদের স্টেজ ছিল খুবই ছোট, দশ ফুট বাই দশ ফুট। তার উপর একটা খাটের কোনো একটা জায়গায় একটা গর্ত ছিল, সেটা শতরঞ্চি দিয়ে ঢাকা ছিল। সবাইকে বলে দেওয়া হলো, অভিনয় করতে করতে তারা যেন একটু সতর্ক থাকে ওই ব্যাপারে, কারণ, ওখানে একবার পা পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না। তাড়াহুড়োর মধ্যে আমাদের ওইরকম একটা খাট দিয়েই স্টেজ বানাতে হয়েছিল।

হঠাৎ ঘটলো এক মহাবিপত্তি।  রুনু ওর পার্ট বলতে বলতে অসাবধানতায় পা দিয়ে ফেলল খাটের গর্তে, আর, ভারসাম্য হারিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল স্টেজের উপরে।

যাই হোক, শুরু হল আমাদের নাটক। আমি পেছন থেকে প্রম্পট শুরু করলাম। ত্রিপলের পেছনদিকে স্বভাবতই কোন আলো ছিল না, এক হাতে টর্চ জেলে, আর, অন্য হাতে বই ধরে প্রম্পটিং শুরু হল। টর্চটা এমনই ছিল যে তার ব্যাটারি বোধহয় অনেক দিনের পুরোনো, মাঝেমাঝে একনাগাড়ে জ্বালানোর ফলে টর্চের আলো নিভে আসছিল। সেটাকে থাবড়ে টাবড়ে আলো বাড়ানো হচ্ছিল একটু। ফলে আমার প্রম্পটিংও খুব একটা সহজ ছিল না। আমাদের কুশিলবরা থেকে থেকেই তাদের পার্ট বলতে গিয়ে বেশ ভালোরকম হোঁচট খাচ্ছিল। কেউ কেউ কিছু বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছিল স্ট্যাচুর মতন, আর, তখনই দর্শকদের মধ্যে খুব হাসির রোল উঠছিল। আমিও ভাঙাচোরা টর্চ নিয়ে কোনোরকমে প্রম্পটিং চালিয়ে যাচ্ছি।

হঠাৎ ঘটলো এক মহাবিপত্তি।  রুনু ওর পার্ট বলতে বলতে অসাবধানতায় পা দিয়ে ফেলল খাটের গর্তে, আর, ভারসাম্য হারিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল স্টেজের উপরে। হো হো করে সবাই হেসে উঠলো, আর, সেই মুহূর্তে রুনু একটা ইঁদুরের মতো সুরুত করে পালিয়ে এলো স্টেজের পেছনে। বেচারা বাবন, যে পথিক সেজেছিল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারিদিকে তাকাতে লাগলো। বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল ওকে। আমি তখন চেঁচাতে শুরু করলাম, ওরে লাইট নিভিয়ে দে, লাইট নিভিয়ে দে।

লাইট নিভতে সময় নিল কিছুটা।  সব অন্ধকার! চারিদিকে তখন শুধু হইচই, দমফাটা হাসি, আর, মাঝে মাঝে ‘কী হল’ ‘কী হল’ আওয়াজ। এদিকে রুনু জেদ ধরে বসলো, সে আর স্টেজে উঠবে না। সর্বনাশ! তাহলে কি এখানেই আমাদের নাটকের ইতি টানা হবে! আমি রুনুকে বোঝাতে লাগলাম, যাতে ও আবার স্টেজে ফিরে যায়। সবাই তখন আমরা জড়ো হয়েছি স্টেজের পেছনে। রাস্তার আলোতে দেখতে পেলাম, বাবন, বাচ্চু, সৈকত মুখ টিপে হাসছে। আমার তখন সব হাসি ফুরিয়ে গেছে, কোনমতে ফাংশন শেষ করতে হবে, এছাড়া আমার আর কোনো চিন্তা ছিল না। দর্শকদের মধ্যে তখনো হৈ চৈ চলছে। আমি মিতালিকে বললাম, তাড়াতাড়ি স্টেজে গিয়ে গান শুরু করতে এবং থামতে বারণ করলাম, যতক্ষণ না আমি বলি, কারণ, রুনুকে স্টেজে যেতে রাজি করাতে কত সময় লাগবে, সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

লাইট জ্বালানো হল। মিতালি গান ধরল। পরপর দুটো গান করল। তুমুল হাততালি দর্শকাসন থেকে। আমি ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, বেশ ভিড় হয়ে আছে, কেউ চলে যায়নি। আমাদের নাটক ‘অবাক জলপান’ আবার শুরু হল একেবারে প্রথম থেকে। দর্শক মহ্ল থেকে একচোট হাসির রোল উঠল আবার। রুমুকে রাজি করালাম কোনোমতে। এরপর আর কোন সমস্যা হল না। যথাসময়ে শেষ হল আমাদের নাটক এবং ফাংশন। প্রচুর হাততালি হল।