‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কবি পিয়াস মজিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।
Published : 15 Feb 2023, 10:49 AM
পিয়াস মজিদ একজন কবি। ‘নাচপ্রতিমার লাশ’, ‘মারবেল ফলের মওসুম’, ‘গোধূলিগুচ্ছ’, ‘কুয়াশা ক্যাফে’-সহ তার কবিতার বই মোট ১৫টি।
অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন পিয়াস। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।
এবারের মেলায় আপনার নতুন কী বই প্রকাশিত হয়েছে?
দুটো বই এর মধ্যে বেরিয়ে গেছে। ঐতিহ্য থেকে কবিতার নতুন বই ‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ আর পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে গানের অনুষঙ্গে লেখা কবিতার সংকলন ‘এ সকাল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়’। আর একটি যুগ্ম-কবিতা বই প্রকাশিত হবে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘মেহজাবিনের ছাতার লোভে’। এছাড়া বৈতরণী থেকে আমার প্রথম কবিতাবই ‘নাচপ্রতিমার লাশ’, ঐতিহ্য থেকে দ্বিতীয় কবিতাবই ‘মারবেল ফলের মওসুম’-এর নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে।
বইমেলার কোন দিকটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে আপনাকে?
মেলায় আজই একটি দৃশ্য দেখলাম। একজন বয়স্ক মানুষ হুইলচেয়ারে বসে আছেন আর এক তরুণ তাকে স্বেচ্ছা-সহায়তা করছেন মেলায় ঢুকবার জন্য। আমার কাছে এটা একটা স্বর্গীয় দৃশ্য।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনে করতেন কবি হওয়ার বীজ শৈশবেই রোপিত হয়। আপনার কবিতা লেখার শুরুটা কীভাবে? লেখালেখিতে কোনো ব্যক্তি বা শৈশব-কৈশোরের ঘটনা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে কি, আর কীভাবে?
আমার লেখা শুরু মূলত পড়তে পড়তে। ছোটবেলা থেকে নির্জনতাকে জনারণ্য ভেবে আনন্দ পেতাম। চারপাশের মানুষের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে খুব একটা কানেক্টিভিটি খুঁজে পেতাম না। ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতা আমাকে আত্মহননের চিন্তাতেও উদ্বুদ্ধ করেছে, কিন্তু কবিতার অক্ষর আমাকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছে। অনুপ্রেরণা বলতে, স্কুলবেলায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে পড়তে আনা দু-তিনটা বই, যেমন বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, শরদিন্দুর ‘ঝিন্দের বন্দী’ কিংবা রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ আমাকে অজানা-অচেনা একটা মায়াপৃথিবীর খোঁজ দিয়েছে। এসব লেখাপত্রের ছায়া ও রোদে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে কখন যে কবিতায় ভরে ওঠেছে আমার ডায়েরির পাতা, তা খেয়ালই করিনি।
আপনার ‘নির্জন নোটবুক’ বইয়ে ‘একটি নিবিড় রেলগাড়ি’র কথা বলেছেন। কারও নদী, কারও শহর, কারও গ্রাম বা কারও একটা বৃক্ষ থাকতে পারে, শিশু যখন বড় হতে থাকে তার চারপাশের পরিবেশ কীভাবে ভূমিকা রাখে সৃজনশীল বা শিল্পী হওয়ার পেছনে?
চারপাশের পরিবেশেরই তো নির্মাণ আমরা। স্কুল একটা শিশুর চিন্তার জগৎ নির্মাণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, যদি সেই স্কুল শুধু ভারি ব্যাগ বহন না করায়। পরিবার শিশুর ভালো বিকাশে ভূমিকা রাখে যদি সে পরিবারে ভালো একটা লাইব্রেরি থাকে। একটি এলাকাও সে ভূমিকা রাখতে পারে যদি সেখানে সুন্দর খেলার মাঠ থাকে।
আপনি কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন, দেশের অন্যতম প্রাচীন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৮৭ বছরে পা দিয়েছে। স্কুলের কোন স্মৃতি এখনও কি কল্পনায় আসে?
আমি কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র, আবার সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেববর্মণও এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার শিবনারায়ন দাশ, গীতিকার-সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ এ স্কুলে পড়েছেন- এটা ভাবতেই ভালো লাগায় ভরে যেত মন। স্কুলের স্মৃতি বলতে টিফিনের বিরতিতে খেলাধুলায় অদক্ষ আমার ধর্মসাগরের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকার কথাই মনে আসে। আর কিছু নয়, সেই তাকিয়ে থাকাগুলো ভীষণ মনে পড়ে, কারণ আমি জীবনে যত কিছুই হই, স্কুলবেলার দূরপানে তাকিয়ে থাকার অমল-ধবল চোখ আর কি পাবো!
আপনার পড়া প্রথম বই কোনটি? শৈশব-কৈশোরে পড়া কোনো বই কি এখনও আপনার মনে পড়ে?
প্রথম বই মনে হয় ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’। সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ সিরিজের বইটা স্কুলবন্ধু মানিকের সূত্রে হাতে পেয়েছিলাম। মনে আছে, আনার পাতালবাসের গল্প পড়তে পড়তে আমি নিজেও সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম অতল পাতালে।
স্কুলে কেউ কেউ পাঠ্যবইয়ের ভেতর সৃজনশীল বই রেখে লুকিয়ে পড়তো, আপনি কীভাবে পড়তেন? একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ফিকশন পড়ার সেরা উপায় কোনগুলো?
আরে দারুণ প্রশ্ন। সবসময়ই মনে হয় পৃথিবীর সেরা বইগুলোকে ‘আউট বই’ বলা হয়। অথচ এই আউট বইগুলোই কিন্তু আমাদের মনের পৃথিবী তৈরি করে। আমি স্কুলে থাকতেই ‘রহস্য পত্রিকায়’ কার যেন অনুবাদে ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘ইন দ্য পেনাল কলোনি’ অনুবাদ পড়েছি। তখন তো আর কাফকা কে চিনি না, অত গভীর লেখার মর্মও ধরতে পারিনি। তবে পাঠ্যবইয়ের বাইরে কিছু বলে ধরেই নিয়েছিলাম তা মজার কিছু। আমার বোনের মিশনারি স্কুল লাইব্রেরিতে ভালো ভালো বই ছিল। সে মাঝে মাঝে বই আনতো যেগুলো আমিও পড়তাম। একটা বইয়ের কথা মনে আছে, ব্যারোনিস সি ওর্কজির ‘দ্য স্কারলেট পিম্পারনেল’। এই তো সেদিন কোনো আলোচনায় দেখলাম এটা একটা বিশ্বখ্যাত বই। বাবা-মায়েরা যদি নিয়ম করে ফিকশন পড়ার সুযোগ করে দেন তাহলে আমি মনে করি একাডেমিক পড়াশোনার ক্লান্তি বা একঘেঁয়েমিটা কেটে যেতে পারে।
আপনার জীবনে কোন শিক্ষক আছেন কি এখনও বেঞ্চে বসে যার ক্লাস করতে ইচ্ছে করে?
জিলা স্কুলের আজিজুন্নেছা আপার কথা মনে পড়ে। কথাসাহিত্যিক মিন্নাত আলীর লেখা ‘পাট’ গল্পটা তিনি এমনভাবে পড়াতেন যে পাট-ফলানো চাষীর ক্ষুধার জ্বালায় পাটের ফাঁস গলায় দেওয়ার বিষয়টা মনে হয় চোখের সামনে দেখতে পেতাম।
শৈশব-কৈশোরের প্রিয় কোনো খেলা বা স্কুল পালানোর স্মৃতি?
আমার খেলা বলতে ক্যারম বোর্ড পর্যন্ত, আর শবেবরাতে বন্ধুরা মিলে বাজি ফোটানো। স্কুল পালানোর মধুর স্মৃতি আছে তো অবশ্যই। স্কুলে ‘ভালো ছেলে’ হিসেবে পরিচিত দুই বন্ধু মিনার আর পিয়াস একদিন স্কুল পালাল এবং স্কুল পালিয়ে কুমিল্লা শহরে একটা আশ্চর্য সুন্দর লাইব্রেরির সন্ধান পেলো।
কী সেই ‘আশ্চর্য সুন্দর লাইব্রেরি’?
আমার স্কুল-পালানোর সঙ্গী মিনারের বাবা ছিলেন তখনকার জেলা শিক্ষা অফিসার। আঙ্কেলের সূত্রে মিনার কুমিল্লার বেশকিছু লাইব্রেরির সন্ধান জানতো। তারই একটা ছিল জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরি। তো, স্কুল পালানোর পর ছুটি হওয়ার আগের যে সময়টা ফাঁকা ছিল, সেটা ভরাট করার জন্য আমরা সেই লাইব্রেরিতে গেলাম। আরে অবাক কাণ্ড! আমি ভেবেছিলাম শুধু ধর্মীয় বই থাকবে, কিন্তু গিয়ে দেখি আবদুল্লাহ আল মুতীর বই, রোকেয়া রচনাবলি, নজরুল রচনাবলিসহ আরও কত কী! কিছুক্ষণ বইপত্র উল্টে জেনে নিলাম লাইব্রেরির সময়সূচি। এর কিছুদিন পর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে রেজাল্টের আগের এক মাস ফাঁকা সময়টায় আমি প্রায়ই লাইব্রেরিটা চষে বেড়াতাম। বুঝে-না বুঝে কত বই যে পড়েছি সেখানে, আবার লাইব্রেরি গুছিয়ে দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে ভারি ভারি কিছু বই বাসায় নিয়ে পড়ার অনুমতিও পেয়েছি। এখন তো মনে হয়, সে-ই আশ্চর্য সুন্দর লাইব্রেরিটা আমাকে অজ্ঞাতেই সাহিত্যের দিকে টেনে এনেছে।
শিশু-কিশোরদের জন্য একটা রহস্য গল্পের বই লিখেছেন আপনি, ‘অধরার অভিযান’। ভবিষ্যতে আর কী লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে?
শিশুদের জন্য সামান্যই লিখেছি, তবে আনন্দ পেয়েছি অনেক। আমাদের দেশের কবিরা শিশুদের নিয়ে খুব একটা লিখতে চান না। পাশের দেশের বাংলাভাষী কবি-লেখকদের সবারই দেখবেন শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভলিউম ভলিউম কাজ আছে। আমার ইচ্ছে আছে, হারানো ছেলেবেলা নিয়ে কিশোর উপন্যাস লেখা যা আসলে আমার আত্মজীবনীই হবে।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!