রঙ-বেরঙের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

লক্ষ কোটি বছর ধরে কীভাবে মাটি, বৃক্ষ বুকে নিয়ে ফসিল হয়ে রঙবেরঙের পাহাড় হয়েছে তা পড়েছিলাম স্কুলের পাঠ্যবইয়ে।

ফাতিমা জাহানফাতিমা জাহান
Published : 13 March 2024, 08:54 AM
Updated : 13 March 2024, 08:54 AM

আমি আর ফিয়ানা পাশাপাশি বসে আছি। হঠাৎ ফিয়ানা আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জুয়া খেলো? আমি বললাম, না। আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি অ্যালকোহল খাও? এবারও জবাব না শুনে ফিয়ানা বলল যে আমি ঠিকই করেছি। লাস ভেগাস থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে এসেছি একদিনের ট্যুরে, বাসে করে ঘুরছি। ফিয়ানা আমার ট্যুর গাইড। বাসে আরও জনা ত্রিশেক বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ আছে।

কিন্তু ফিয়ানার সঙ্গে আমার ভাব বেশিই হয়ে গিয়েছে। এটা সেটা টিপস দিচ্ছে। কারণ এই চরাচরে তার বহু বছরের অভিজ্ঞতায় সে সলো ট্রাভেলার মেয়ে দেখেনি। ছেলেরা একা একা বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু মেয়ে খুব কম। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে বাস আবার লাস ভেগাসের রঙিন জগতে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখার শখ আমার ছোটবেলা থেকেই। আমেরিকার অন্য কোন জায়গা দেখার আগ্রহ তেমন ছিলো না। লক্ষ কোটি বছর ধরে কীভাবে মাটি, বৃক্ষ বুকে নিয়ে ফসিল হয়ে রঙবেরঙের পাহাড় হয়েছে তা পড়েছিলাম স্কুলের পাঠ্যবইয়ে। আমি এখনো সে পাঠ্যবইয়েই আটকে আছি। আমার ধারণা কিশোরবেলার পর আমি আর কিছুই শিখিনি, কিছুই মনে ধরেনি আমার। যেখানেই যাই না কেন কিশোরবেলায় জেনে আসা জায়গা আগে চোখে ভাসে।

আমেরিকায় ঘুরে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে গাড়ি ব্যবহার করে। কিন্তু আমার তো এদেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, তাই বেড়াতে যাবার জন্য গাইডেড ট্যুর ভরসা। লাস ভেগাসে মানুষ আসে ঘুরতে, জুয়া খেলতে, বিভিন্ন ধরনের সঙ্গের আশায়। কিন্তু এরা কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমি লাস ভেগাসে এসেছি শুধু গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে। লাস ভেগাসের মায়া, কায়া পার হয়ে মরুভূমির মাঝ দিয়ে অ্যারিজোনা রাজ্যের বিশালতা কম কিছু নয়।লাস ভেগাস পার হবার পর হুভার ড্যাম, কলোরাডো নদী নিয়ে কিসব যেন বলছিল ফিয়ানা।

আমি তো ততক্ষণে হারিয়ে গিয়েছি বাদামি ধূসর মরুর ছোট ছোট শুকনো ঝোপের মাঝে, পেছনের উঁচু উঁচু সারিবদ্ধ পাহাড় এখনও নীরব, এখনও শুকনো। নদীতে বাঁধ দেওয়ার কী কী উপকারিতা তা জানার চেয়ে আমার মন আটকে থাকে ঘাসের হলুদ হয়ে যাওয়ায়। যদি কোন একলা গাছ পথে পড়ে তার ডালপালা গোনায়। আধুনিক জীবনের উপকারিতা থাকুক না হয় আধুনিক মানুষের জন্য। আমি এই মরুভূমির মাঝে একলা গাছ বা কচিৎ এক আধখানা ঝোপঝাড়ের সঙ্গেই না হয় সন্ধি করি!

হলুদ, বাদামি পাহাড়ের জঙ্গল পেরিয়ে ধীরে ধীরে দু’একটা সবুজ গাছের দেখা মেলে পথে। মনে হয় বহু অপেক্ষায় থেকে তারপর বহু খরার দিনের পর বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। কাঁটা ঝোপঝাড় ঝুঁকে পড়তে চাইছে কিছু কিছু সবুজের কাছে। পেছনের পাহাড় এখন আর উদাসীন নেই। পেছনে ঝলমলে নীল আকাশ থেকে যেন রঙ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আরও সামনে বাস যখন এগোচ্ছে তখন গাঢ় নীলের মাঝে অদ্ভুত সব সাদা মেঘেরা দম নিচ্ছে, ফুলে ফুলে উঠছে, নিচে তাকিয়ে দেখছে পাহাড় আর মাটির কতখানি সবুজ হওয়া বাকি।

এরই মাঝে পথে পড়ল ছোট্ট একটি ছিমছাম গ্রাম। অবশ্য আমেরিকার সব গ্রামই আমার কাছে ছিমছাম লাগে। এই গ্রামটি সবুজে ঢেকে আছে। সবুজ ঘাস আর গাছগাছালি যেন নীল আকাশের নিচে কয়েকটি ইট-কাঠের ঘরের বাসিন্দাদের অবকাশ যাপনকে পাকাপাকি করে দিয়েছে। দেখে এত শান্ত, নিরিবিলি লাগছে যেন এখানেই থেকে যাওয়া যায়।

গ্রামের পরিধি শেষ হয়ে গেলে আবার সেই পুঞ্জীভূত মেঘ, সঙ্গে কারোর চোখের মণির মতো নীল আকাশ। নিচে হলদে মাঠে ছোপ ছোপ সবুজ ঝোপালো গাছ। এরও খানিকটা এগিয়ে গেলে সবুজ ঝোপ ঘন হতে থাকে, যেন এবার ষড়যন্ত্র করে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে। দূরের পাহাড়কে তো আর চেনাই যাচ্ছে না। সবুজ থেকে আরও সবুজ হচ্ছে। মাথার উপরের মেঘগুলোকে বানিয়ে ফেলেছে আগ্নেয়গিরির শুভ্র ধোঁয়া, তারা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখে সৌন্দর্য বাড়িয়ে চলছে আকাশের।

পথে যেতে যেতে পড়ল আরেকটি ছোট গ্রাম। গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে রেললাইন। নিশ্চুপ সেই সবুজ সতেজ গ্রামে আমার যা দেখে ভালো লাগল তা হলো গ্রামে প্রবেশের মুখে সারি সারি ছোট ছোট লেটারবক্স রাখা, যেন ডাকপিয়ন এসে চিঠির বাক্সে চিঠি ফেলবেই আর যার চিঠি সে ঠিক পেয়ে যাবে ডাকবাক্স খুললে। কী সুন্দর এক আয়োজন এই জঙ্গলের মাঝে ঘটা করে চিঠি পড়ার! সাদা, কালো, নীল কত না রঙের ছোট ছোট বাক্স বহন করে আনন্দ-বেদনার বারতা।

 হুট করে আমাদের বাস এসে পৌঁছালো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সাউথ রিম-এর গেইটে। মেক্সিকান, আমেরিকান, চায়নিজ, ইন্ডিয়ান আর আমি দেশি খুব বেশি বাংলাদেশি সবাই নেমে গেইট পার হয়ে ফিয়ানাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। ফিয়ানা এখানকার এগারোটি ভিন্ন ভিন্ন আদিবাসীদের ইতিহাস বলছিল আর মাঝখান দিকে আমি উধাও। আমার চোখ আটকে আছে রঙিন উপত্যকায়।

চোখে মেখে দিয়েছে কেউ জাদু। প্রথমবার প্রিয় কাউকে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতির মতো যেন। মধ্যাহ্নের অবাধ্য বাতাস আমাকে এই ডোরাকাটা লাল নীল সবুজ বাদামি মালভূমিতে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। এত বিশাল উপত্যকা আমি কখনো দেখিনি। এত শূন্যতার মাঝেও যেন কোন খাদ নেই, হাহাকার আছে তবুও হতাশা নেই। এমন এক অমূল্য সৌন্দর্য চোখের আড়াল হয় না। চারদিকে ছড়িয়ে আছে সেই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক। এ এক অপার্থিব চির নতুন দেশ।

মাথার উপর পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ গুঞ্জন তুলছে, বাতাসে আগুন নেই, আছে গোলাপজলের মতো শীতলতা। রোদ খুব একটা বিরক্ত করছে না, উদ্যাম বাতাসের জোর করে উড়িয়ে দেওয়া নেই। ফিয়ানা বলছিলো, আজ নাকি আবহাওয়া চমৎকার। অন্যদিন হয় রোদ থাকে, নয় ঠান্ডা থাকে, নয় দমকা বাতাস থাকে। আজ আবহাওয়া এত ভালো যে সবার মন ভালো হয়ে যায়।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কের পাহাড়ের ধার রেলিং দিয়ে বাঁধানো, খাদের ধার ধরে পথও আছে। যতক্ষণ ইচ্ছা হাঁটা যায়, হেঁটে হেঁটে এই বিশাল শূন্যোদ্যানের অপর পাশে চলে যাওয়া যায়। এমনকি এখানে তাঁবু করে রাতে থাকাও যায়। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট কাঠের তৈরি হোটেল আছে, হেরিটেজ হোটেল বা কটেজ। এক-দেড়শ বছরের পুরনো বাড়ি ছিল সেগুলো। সেখানেও অনেকে শখ করে থাকে।

আমি এখন পাহাড়ি লাল, খয়েরি, বাদামি খাদের ধার ধরে হারিয়ে যেতে থাকি। এই উপত্যকা একেবারেই শুষ্ক নয়। লাল, খয়েরির মাঝে কিছু সবুজ বৃক্ষ জায়গা করে নিয়েছে নিজের মনের কথা বলতে, বাতাসে দুলে দুলে শেষ অবধি কথা কয়েই যাচ্ছে। প্রকৃতি আসলে সব জায়গা শূন্য করে রাখে না। কিছু পূর্ণতা দিয়ে ধরণী শোভা বাড়াতে থাকে। পার্কের মাঝে জায়গায় জায়গায় বেঞ্চ করা আছে, খোলা হলেও রোদ না থাকায় বসে সারাদিন শূন্যোদ্যান দেখা যায়। আমি খাদের ধারের একটা পাথরে বসে ফিয়ানাকে বললাম ছবি তুলে দিতে।

ফিয়ানা আরও উল্লসিত। এত সাহস সে নাকি কাউকে দেখাতে দেখেনি। আড়াই হাজার ফুট উঁচু থেকে পা হড়কে পড়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য এখানে অনেকেই রক ক্লাইম্বিং, মাউন্টেইন ক্লাইম্বিং করতে আসে, তাদের কথা ভিন্ন। আমি নিজেও এসব করেছি বিস্তর। কিন্তু এবার শুধুই প্রকৃতিকে কাছে পাবার লোভ আমার। এখানে যতদূর চোখ যায়, স্তরে স্তরে মেঘ আর মেঘের নিচে সারি সারি পাহাড়ের লালিমা, একেক স্তরে একেক রঙ। এই রঙের বিন্যাসের জন্য এই উপত্যকার নাম দেয়া হয়েছে ‘কালারফুল টেস্টামনি’।

নাম যাই হোক না কেন, এই ধরিত্রীর বুকের খুব কাছে এই চুনি, পান্না, হীরে জহরতের রত্নভাণ্ডার গড়ে উঠেছে লক্ষ লক্ষ বছরের যত্ন করে আঁকড়ে ধরায়। সে ধরায় ধরাধামে নেমে আসতে থাকে উদাসীন একেক রঙের সুগন্ধ। মাটির, গাছের, ফোটা নতুন পাতার, আর খানিক বৃষ্টির ফোঁটার সুগন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ।