বিতর্কের বিষয় ছিল: ‘স্বাধীনতার আগে আমাদের অবস্থা ভালো ছিল’। ১৯৬০ সালে বিতর্ক, সুতরাং ১৯৪৭ এর আগের কথাই বলা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে সবাই এর বিপক্ষে বলতে চায়। আমি এর পক্ষে বললাম -কষ্টকর কাজ।
Published : 14 Sep 2022, 01:06 PM
বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬০ সালে, চতু্র্থ শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে। ভর্তির দিন আমার অধ্যাপক পিতা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ঘরে নিয়ে গেলেন।
প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হক, আমার পিতার নামেই নাম। পিতার নামের এক ভাগীদার আছেন জেনে খুব একটা পুলকিত হইনি, একটি নবম বর্ষীয় বালকের ক্ষেত্রে সেটাই হয়তো স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।
ছোটো-খাটো মানুষটি প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হক, শ্মশ্রু-শোভিত, আচকান আর আর জিন্নাহ টুপি পরিহিত। পাশের চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক খান মুহাম্মদ সালেক। সালেক স্যার আমাকে তার হাঁটুর ওপর বসিয়ে দোল দিতে লাগলেন। টুকরো টুকরো কথা বলতে লাগলেন। আবার যোগ দিতে লাগলেন দুই সিরাজুল হকের কথার মধ্যেও। শিশু হলেও বুঝতে পারলাম যে, জিলা স্কুলের কর্ণধার এ দুই ব্যক্তির খুব সম্মানের পাত্র আমার পিতৃদেব।
চতুর্থ শ্রেণির শেষদিকে স্কুলের বার্ষিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার মাত্র একদিন আগে নিজেই নাম দিয়েছিলাম তাতে অংশগ্রহণের জন্য। সবকিছু ভালো করে বুঝিনি, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের কোন অভাব ছিলো না।
কিন্তু ‘একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর’। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিপীলিকার মতো প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করতে লাগলেন আমার পিতার ভূতপূর্ব ছাত্রকূল, বর্তমানে বরিশাল জিলা স্কুলে শিক্ষাদানরত। তারপর ঢিপঢিপ পদধূলি গ্রহণ। দেখা গেল, শিক্ষকদের প্রায় ৬০-৭০ ভাগই তার ছাত্র। আমার পিতা খুবই প্রীত হলেন এটা জেনে। বোধ করি তিনি ভাবলেন যে স্কুলে আমার দেখভালের জন্য একদল অভিভাবক পাওয়া গেল। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এসব দেখভালের জন্য দুষ্টুমীর সব স্বাধীনতা আমাকে হারাতে হয়েছিল।
প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হক প্রসঙ্গে আমার তিনটে কথা মনে আছে। এক, ছোটখাটো ফর্সা এ মানুষটি বেশ গম্ভীর প্রকৃতির রাশভারী স্বল্প কথার মানুষ ছিলেন। দুই, বেশ মনে আছে প্রতিদিন ক্লাশ শুরুর আগে স্কুলের সামনের মাঠে ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলনীতে বক্তৃতা করতে তাকে একটা টুলের ওপরে দাঁড়াতে হতো, নইলে তাকে পেছন থেকে দেখা যেত না। বেশ খর্বকায় ছিলেন তিনি। তিন, ভর্তির কিছুদিন পরেই ত্রৈমাসিক পরীক্ষায় দুটো শাখা মিলিয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে আমি প্রথম হলে পরে তিনি আমার ফলাফল কার্ডে লাল কালিতে লিখেছিলেন, ‘Congratulations!’ পরবর্তী জীবনে বহু ব্যবহৃত শব্দটি সেই আমি প্রথম শুনেছিলাম এবং বাবাকে জিজ্ঞেস করে অর্থ জেনেছিলাম।
চতুর্থ শ্রেণির শেষদিকেই স্কুলের বার্ষিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার মাত্র একদিন আগে নিজেই নাম দিয়েছিলাম তাতে অংশগ্রহণের জন্য। সবকিছু ভালো করে বুঝিনি, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের কোন অভাব ছিলো না। নবম-দশম শ্রেণির ছাত্ররা তাচ্ছিল্য করে ভাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাংলার শিক্ষক নাজিমুদ্দিন স্যার (কবি জসীম উদদিনের চাচাতো ভাই) ছোট বাচ্চা দেখে অনেকটা দয়া-পরবশ হয়েই আমাকে প্রতিযোগী তালিকায় নিয়ে নিলেন।
আমার সঙ্গের প্রতিযোগীরা সবই নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র। মনে আছে, মাইকের নাগাল পাওয়ার জন্য আমাকে একটা টুলের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো।
বিতর্কের বিষয় ছিল: ‘স্বাধীনতার আগে আমাদের অবস্থা ভালো ছিল’। ১৯৬০ সালে বিতর্ক, সুতরাং ১৯৪৭ এর আগের কথাই বলা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে সবাই এর বিপক্ষে বলতে চায়। আমি এর পক্ষে বললাম -কষ্টকর কাজ। তবু ১৯৪৭ এর পরের দুর্নীতি, শোষণ এসব কথা বলেছিলাম খুব রসিয়ে রসিয়ে বলে স্মরণে আছে। কোন পড়াশোনা নেই, কিছু জানা নেই, সবই ওইটুকু মানুষের মনে মনে ভেবে নেওয়া যুক্তি।
আমার সঙ্গের প্রতিযোগীরা সবই নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র। মনে আছে, মাইকের নাগাল পাওয়ার জন্য আমাকে একটা টুলের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। আমার বক্তব্য শেষে তুমুল করতালি, সেটা বক্তব্যের বিষয়বস্তুর ওপর যত না, তার চেয়ে অনেক বেশি একটি ছোট ছেলের নির্ভয়তার জন্য। বক্তব্য শেষে আমাকে ধরে টুল থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের জিলা স্কুলের অসাধারণ শিক্ষক গিয়াসুদ্দীন স্যার।
ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা গেলো বিচারকেরা আমাকেই শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে রায় দিয়েছেন। সারা মিলনায়তনে শোরগোল পড়ে গেল। সবাই অবাক - চতুর্থ শ্রেণির একটি ছোট ছেলে জিলা স্কুলের উচ্চতর শ্রেণির বাঘা বাঘা বিতার্কিককে পরাজিত করে শিরোপা জিতে নিয়েছে! সবাই বিস্মিত,আমি বিহ্বল! উচ্চতর শ্রেণির প্রতিষ্ঠিত বিতার্কিকরা বলতে লাগলেন যে, ছোট বলেই আমার প্রতি এক ধরনের পক্ষপাত করা হয়েছে। এদের একজন ছিলেন পরবর্তী সময়ের নন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক কবীর আনোয়ার (‘সুপ্রভাত’ খ্যাত)।
বহু পুরস্কার পেয়েছি, বহু শিরোপা অর্জন করেছি। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির ওই বিতর্ক এবং সিরাজুল হক স্যারের ওই উৎসাহ আমার সারা জীবনের পাথেয় হয়ে ছিল।
সারা জীবন কবীর ভাই এ ঘটনার উল্লেখ করে ঠাট্টা করেছেন। পরবর্তী কালে কতভাবে কবীর ভাইয়ের সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে। শওকত ভাই (কবীর ভাইয়ের অগ্রজ শওকত আনোয়ার) ও কবীর ভাই বেনুদের ও আমাদের পরিবারের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। কবীর ভাই চিরকাল আমার পরম গুণমুগ্ধ - আমার কথা বলে বেড়ান নানান জনে।
পুরস্কার বিতরণের কালে সিরাজুল হক স্যার আমাকে খুব আদর করেছিলেন। নিচু হয়ে আমার চিবুক নেড়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে, বলেছিলেন, ‘চমৎকার বলেছো। কনগ্রাচুলেশন্স! ডিবেট করা ছেড়ো না’।
না, ছাড়িনি। শিক্ষা জীবনের সবসময়েই ওটা আমার একটা নেশা ছিল। বহু পুরস্কার পেয়েছি, বহু শিরোপা অর্জন করেছি। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির ওই বিতর্ক এবং সিরাজুল হক স্যারের ওই উৎসাহ আমার সারা জীবনের পাথেয় হয়ে ছিল।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!